যমজআঁধার
তোমার কোমল হাত ছুঁয়ে গেছে ভোরের বাতাস, দুপুরের রোদ―সন্তর্পণে একা, তোমার
অলকদাম ছড়িয়েছে বৈধব্য বিষাদ গান, বেহালা বিজনসুর;
বিপন্নবৈষ্ণব এক গেরুয়া আঁচল তার খুঁজে ফিরে মৃত্তিকার মুখ―সায়াহ্নে নদীর তীর দূর অরণ্যের
বাঁয়ে দুই চোখ তার।
কী মধুর সুরে যাদুর ছোঁয়ায় এঁকে গেছো তুমি দিন ও রাতের মুখ, কেউ কি দেখেছে এই রুপোর
চাঁদোয়া―বনপোড়া হরিণীর আদিমঅভিসার!
আমিও মানুষ―ইচ্ছের ফানুসে উড়ে আর পুড়ে আঁধারের সবটুকু গিলে গিলে খাই; রেখে যাই
জোছনার শিস আর সুর―ভুলে যাই যতো পথ―পিদিমপ্রহর।
রাতের বেদনা ভুলে নীরবে দাঁড়িয়ে ভাবো রোদপোড়া কাকতাড়ুয়া একা; ঈষাণে মেঘের নদী,
তোমার ডানায় জমে ঘোর আষাঢ়ের যমজআঁধার।
আমি কেন রাত ভালোবাসি
রাত তুমি দীর্ঘ হও―যতো পারো, দীর্ঘ হও
তোমার মায়ার মাঝে এই আমি বাঁচি
পাতারা বোঝে না প্রেম―অঙ্গারে আগুন নাচে,
আলো কাছাকাছি।
তোমার আঁধার আমি চুমুকে চুমুকে গিলি,
বেদনারা প্রিয়তর মিঠেল পানের খিলি;
বিরহ সফেদ চুন তোমার অধরে
কবির গজল তুমি এই পারাপারে।
রাত তুমি কাছে এসো,
কোল পেতে বসো―
তোমার শরীর জুড়ে মোয়ার মিছিল তারা নাভিমূল,
পূর্ণিমা আকাশচাঁদ চিরায়ত ফাঁদ; ফোটা যোনিফুল।
তুমি এক কুচকুচে জিপসি বালিকা―
প্রেমিক কবির দেবী, অলেখা কবিতা;
রাত তুমি দীর্ঘ হও, দীর্ঘ হও
আকাশ লিখুক আজ জোছনাসংহিতা।
রাত তুমি দীর্ঘ হও―যতো পারো, দীর্ঘ হও
তোমার কাজল নীল ছায়া হয়ে আছি,
মায়ার সুতোয় বেঁধে ঘন ঘন চুমো খাই―
স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি।
কবর ও কাসিদা
জুমার খুতবা পাঠে বার বার কবরের কথা বলেন খতিবি হুজুর―কবরখানা দোজখআগুন―আঁধারের সুদীর্ঘ বয়ান;
যখন বাবার কবরের কাছে যাই―মনে হয় তিনি শুয়ে আছেন; তাঁহার শাদা দাড়ি শাদা টুপি উড়ছে বাতাসে রোদপোড়া বৃক্ষের ছায়ায়;
যখন মায়ের কাছে যাই―আমার মায়ের মুখ আনত বিশ্বাসে; কি নিবিড় নির্ভরতা! সেজদায় সমর্পিত পরম মুগ্ধতা।
মা বলেন―বাবা সব শুনছেন―হয়তো স্বপ্নের ঘোরে আমাদের দেখভাল করেন প্রত্যহ; আমার মা―
আমাদের সকাল বিকেল রাতের আশ্রয়; তাঁর মোনাজাত দীর্ঘতর হয় কিশোরীর এলো চুলের মতন প্রতি রাত।
কাসিদা বাবার মতো দূরগামী, মায়ের মতো মৃদুভাষী―কবিতা তো আত্মার সরোদ;
থোকা থোকা সবুজহলুদ ঘাস ছাড়া কবরে আর কিছু নেই; কিছুই থাকে না; কবর কখনো কারো আকুতি শোনে না।
কাসিদা প্রত্যহ শোনে আত্মার সেতার―মেঘের বিলাপ;
কবি, পৃথিবীর সমানপ্রবীণ―কখনো তো কবরের পরোয়া করে না।
মেঘবোন
মধ্যাহ্নের মেঘবোন আকাশকে ছুঁয়ে দিলে সবুজ গ্রামের সারি
নীলাভ নদীর ঢেউ সামিয়ানা কাঁপে;
সমুদ্রসারস উড়ে নিজেকে হারায়―গাঙকবুতর ভুলে ভাসমান বয়া;
জল নয়, ছায়া নয়―বিবাগী বাউল তুমি শুধু ভেসে চলা;
যদিও মুহুরি নদী তোমার মতন ছোটে মোহনা মায়ায় বিদিত সাকিন তার;
মৈনাক আকুল হয়ে বাড়ায় দুহাত তোমার প্রণয় যাচে ঘন বরষার ভোরে।
এই সব জেনে শুনে নীলিমা ছেড়েছে ঘর―নিতম্বে পলাশ ফোটে;
আঁধার মাড়িয়ে এই রয়েছি দাঁড়িয়ে―ইটভাটার চিমনি;
ধোঁয়ার শরীর আর আগুনকুণ্ডুলি ভুলে মঙ্গলমায়ায়, নীল মেঘফুলে।
জল ও কাজল
ইলিশ চন্দন বাবুই দূর অভিবাসী―মরুর মায়ায় ছোটে মেঘনাওনদী
শাদাকালো পাখি দলিত দোয়েল তাকায় পেছনে ফিরে,
আমার গানের পাখি ভোলে ডাকাডাকি―
গোধূলির ঘরে বাজে মহুয়ার পালা;
শিস তার আজ বিষ-ফিসফিস বুকের বিবরে বাজে অচিন আয়াত,
বিরান বারান্দা জুড়ে ক্ষরণের ঘুণ―
গুলতির চোট এক গলায় গেঁথেছে দুপুরের গানে ভাঙে রোদের রেহেল ।
ঘরোয়া গানের পাখি―পেয়ারার পেট বেয়ে নেমে এলে হলুদ বিকেল
স্মৃতির ছিলিম ভরে ধূসর পানসি এক সমুখে দাঁড়ায়; আঁধারের যোনি
ছিঁড়ে নদী তিরতির―জল ও কাজল পোড়ে ভাটির ডাঙায়।
অবনি
দুপায়ে রাঙিয়ে ধুলো বাজাই আঁধার—
দুহাতে মেখেছি মেঘ ভেঙেচুরে রোদের আরশ;
মৃত্তিকা মুখের মায়া যতো না এগিয়ে যাই―সুর ছবি গন্ধ নাচে হাজার কিসিম,
আমাকে না হয় তুমি বলো এই বার―গোলোক বিদীর্ণ করে কোন দিকে যাবো?
নদীরা নয়নে ভাসে জলের আঁচলে ডোবে মোহনার মুখ,
রাতের নূপুরে জমে কাফনকুয়াশা বেহালার ভোরে ভাঙে অরনির বুক;|
মাছ ও মাছির মতো জল ও জালের ঘরে আদিম অশনিরাত
কাম ও ঘামের ভেলা বিজন প্রদোষে জ¦লে পোড়ে মোনাজাত।
অবনি নাচিয়া যায়—
চলিষ্ণু মাটির ঢেলা,
ভালোবাসা বুকে
সমুজ্জ্বল ভুলে;
দুচোখ যমজ খেয়া―বিপন্ন ছায়ায় দোলে মহুয়া মুহুরি মেঘ নীল উপকূলে।
বার্ন ইউনিট
সড়কশালিক গোঙায় শীতার্ত দেহে―কাক ও শকুন ছোড়ে তাজা ককটেল; দীর্ঘশ্বাস বাড়ে―মধ্যাহ্নেই রাত। অচিন আজাব― পোড়ারুটিকালো দগদগে মুখ, বিদঘুটে ক্ষত পোড়া বুক হাত কালশিটে পিঠে তুমি শুয়ে আছ; তুমি আজ হনুফা বেওয়া―অসমাপ্ত যুদ্ধদগ্ধ জননী আমার। তোমাকে তাকালে ঢাকার চেহারা ফুটে ওঠে তোমার দুচোখে; বিলাপ ও বেদনার রাতজাগা চোখে বিমর্ষ ডাক্তার―সফেদ সেবিকা ঘড়ির দোলক অবিরাম ঘোরে।আমাদের ঘুম নেই―তুমি তো মিমির জন্যে কাঁদো, ওর পরীক্ষার কথা ভাবো, অথচ সে জয় আর জাগরণের নেশায় আলপনা আঁকে; তোমার শরীরে নেচেনেচে বাড়ে বিষ আর ব্যথা; ভেজা চোখে বীভৎস মুখে আর্তস্বরে কাঁপে বার্ন ইউনিট, হাসপাতাল, সমগ্র শহর।
পেট্রোল বোমায় জ¦লে আয়েশা আজাদ―গণতন্ত্র উল্কি আঁকে শাহবাগে, সংসদে, লাশকাটাঘরে।
সোনামুখ
কারো কারো মুখ হুলিয়ার মতো―পড়তে দেয় না,
লিখতে দেয় না―করতে দেয় না কিছু;
এ কেমন মুখ কোনো কথা নেই―
এ কেমন চোখ দেখেও দেখে না―অকারণে নেয় পিছু।
এই সোনামুখ কেন ভালোবাসি এ কোন মায়াবী চোখ,
ক্রূর নীরবতা পলে পলে আঁকে শত মরণের শোক।
ক্ষরণের চারাগুলো
এখনও বৃষ্টি এলে খুব একা হয়ে যাই―বেদনার হাত ধরে ধান ক্ষেতে হাঁটি; মেঘের মৈনাকে ছেয়ে যায় ধানপাতা, সবুজ পাহাড়, কোহালিয়া নদী ক্ষরণের চারাগুলো স্মৃতির বাদলে বাড়ে, অন্ধকারে সুনিবিড় ধানবন হয়ে হাসে; আলপথ ঘেঁষে তালগাছ হয়ে আকাশকে ছোঁয়। চোখের পেয়ালা ভরে বৃষ্টি জালে করতোয়া ব্যাকুল জানালা খুলে সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেকে হারায়; কামিনীকাননের ছাদে গিয়ে ভিজে যমজ কদম হাতে আকাশকে দেখে―চুল ভিজে, কপাল ভিজে, ঘাড় ভিজে, ভিজে ভিজে নিজে নিজে একা হয়ে যায়।
আচানক বৃষ্টি এলে স্মরণের পাতা খোলে কাকের পালক ঘুটঘুটে অন্ধকার; মেঘের দুহাত ধরে তুমুল ভিজতে চাই―খোলা আকাশের নিচে―বুকের ভেতর বাজে ঘন বরষার গান। দূরের গাঁয়ের দুরন্ত রাখালবালক নিজেরে হারায়।
সাঁকো
যখন জলের কাছে যাাই―জলের আঁতশি কাচে-বুদবুদে ঘোরে এক মুখ তবে কি আমিও জল? না কি এই টলটলে হাওরে জলজ সহোদর?
আমার ভেতরে তুমি মাঘের হিমের গায়ে আমরা লুকিয়ে থাকি, ভোরের কুয়াশা ঘিরে মদির উষ্ণতা! দুনিয়ার দীর্ঘতর ঘুম তোমার আমার।
আগুনের কাছে গেলে থাকো তুমি পাশে―লকলকে শিখা তুমি ডাকো আয় আয়―আলোয় আড়ালে নাচে অতল আঁধার;
ডেকে ডেকে এই তুমি কোন দিকে নেবে?
একাকী আমাকে রেখে কোন দিকে যাবে?
যখন ঘুমুতে যাই রাতের কোমল বুক মায়ের আদরে ডাকে―এই বুকে রূপ নাচে ছায়া কাঁপে আড়ালে-অন্তরালে;
প্রত্যহ তোমাকে আমি কতো নামে ডাকি! তোমার ডানায় হাসে এক অরূপ আলোর সাঁকো।
পোড়ামাটির সানাই: মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ, বইমেলা ২০১৬, তৃতীয় চোখ, প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর, মূল্য: ১০০ টাকা