মোহাম্মদ নূরুল হক। একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক। কাব্য ভাষায় তিনি ধীর, নম্র ও কল্লোলযুগের প্রতিনিধি। তার কবিতা ছন্দবদ্ধ। চিত্রগল্পের আধার। যে আধার নিজ ভূগোল ও পরিপার্শ্বের। তার কবিতা একদিকে হাজার বছরের ইতিহাস, মিথ, কিংবদন্তি ও ঐতিহ্যলগ্ন—আরেকদিকে রয়েছে সামসাময়িক অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও অসংলগ্নতাসহ নানা বিষয়ের উপস্থিতি। কবিতায় তিনি, নিজেকে নিজের ভেতর থেকে হয়ে ওঠার প্রাবল্যে সমর্পিত। রয়েছে আধ্যাত্ম আর বস্তুবাদী চেতনার সম্মিলন; কবির চতুর্থ কবিতার বই ‘লাল রাত্রির গান’-এ উল্লিখিত বোধন ও প্রতীতি সহজেই ধরা পড়ে।
‘লাল রাত্রির গান’। লাল শব্দটি দিয়ে আমাদের চেতনায় রক্তিম লালিমার উপস্থিতি ধরা পড়ে। রাত্রির মধ্যে ধরাপড়ে মাটিজাত নিজস্ব অন্ধকার। গান শব্দটির মধ্যে আছে একটি সুর বা তান, যার আরেক নাম ছন্দ। সুতরাং ‘লাল রাত্রির গান’ কাব্যগ্রন্থ’র নামকরণে শুরুতেই কবি একটি ছন্দবদ্ধ ঝাঁকুনি দিয়ে রেখেছেন। একটি দেশ ও ভূগোলের অবস্থিতি-প্রেক্ষাপটে এই নামবন্ধ একজন যৌক্তিক শিল্পীর রক্তিম আবেগ প্রকাশের সচেতন প্রয়াস।
‘লাল রাত্রির গান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতার স্তবক উদ্ধৃত করা যাক।
মানুষের কত রকমের গল্প থাকে
কারও বন্ধুর গল্প—
কারও কারও থাকে পূর্ব পুরুষের
বীরত্বের গাথা সমুদ্রজয়ের কথা!…
আমার কোনো বন্ধু নেই
…
আমার থাকে পেছনে মেঘের কার্নিশ বেয়ে নেমে আসা
মাইল মাইল রাত্রি গাঢ় অন্ধকার
আর থাকে রূঢ় বর্তমান সূর্যকে কপালে রেখে
উদ্ভাসিত হেঁটে চলা গন্তব্যের দিকে
আর থাকে নির্বান্ধব পিচ্ছিল রাত্রির দীর্ঘশ্বাস!
[মানুষের কত গল্প থাকে]
অনেকের অনেক গল্প থাকলেও কবির কোনো গল্প নেই। কবির থাকে ‘নির্বান্ধব পিচ্ছিল দীর্ঘশ্বাস’।
একজন প্রখর সংবেদনশীল শিল্পসত্তার অমীয় সত্যটুকুই যেন কবি প্রকাশ করেন।
এই সন্ধ্যার আঁধারে আজও কাঁপে স্মৃতির কাচারি!
যেন বহুকাল পর ফিরে এলো হারানো সাকিন…
এইখানে কথা বলে চাঁদ সওদাগর-
যুবা লখিন্দর কালো অক্ষরে অক্ষরে
কথা বলে সূর্যসেন-
তিতুমীর-নবাব সিরাজ
কথা বলে চারু মজুমদার বজ্র কণ্ঠের শেখ মুজিব
[কাচারি ঘরের পালা]
কবি ফিরতে চান নিজের কিংবদন্তির কাছে। হারিয়ে ফেলা কাচারি ঘরের কাছে। যে কাচারি ঘর সৃজনের আরেক পাঠাগার। আরেক শিল্পঘর। যে স্মৃতিঘরে আছে চিরায়ত সুগন্ধি। কবির শিল্পধ্যানে বসবাস করে নিজের ইতিহাস-মানব, ঐতিহ্য ও কিংবদন্তির আধার; অনিবার্য ধারাবাহিক পরম্পরা।
লাল রাত্রির কসম-এই নীল রাত্রির কসম
আমার আকাশ জুড়ে একটিই চাঁদ…
আহারে বেকুব কবি
আজও তুই নতজানু, তেমনি বেকুব!…
দেখ ঐ রক্তের স্রোতে ভেসে যায় সবুজ প্রান্তর
কৃষকের ধানীমাঠ ফসলের গোলা
পোয়াতি লাউয়ের ডগা কেঁপে কেঁপে ওঠছে ভীষণ।
[লাল রাত্রির কসম]
মাঝেমধ্যে সংবেদনশীল মন দ্বিধা আর সংকোচে জড় আর পলায়নপর হয়ে ওঠে। কবি যেন-নিজেই নিজেকে দেন ধিক্কার! আর ভুল-ভূগোলের জন্মদায় নিয়ে হয়ে ওঠেন দ্বিধা ও শঙ্কাচিত্ত; প্রবল অভিমানে-তখন হৃদয়ের বজ্রাহত ধ্বনি সহকারে তিনিও কয়ে ওঠেন—‘আহারে বেকুব কবি আজও তুই হৃদয়ের দাস!’
রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে যেমন বলেন, ‘এটি কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা।’ আবার আবু সায়ীদ আইয়ুব বলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত; অন্তত মুক্তির প্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ সে অর্থে মোহাম্মদ নূরুল হক ভূগোল ও দেশসচেতন একজন যুক্তিনিষ্ঠ আধুনিক কবি।
এভাবে সমস্ত দুঃখবোধ, আনন্দন কবি হৃদয়ের নীল ইতিহাসে জমা রাখেন।
আকাশে ফুটেছে ফুল আলেয়ার নামে
নেমেছে প্রেমের চাঁদ মেঘেদের খামে
মেঘে-মেঘে রটে গেল প্রণয় খবর
তারাদের গ্রামে ছোটো প্রেমিকপ্রবর
…
লখিন্দর ওঠে আসে বেহুলার টানে
চতুর বালিকা ছোটে বণিকের টানে
[আবহমান]
যে উপমহাদেশ স্পিরিচুয়ালিজম এর আধার, যেখানে অধ্যাত্ম-আধ্যাত্মসহ সুফিবাদী নানা তরিকার উদার সহাবস্থান, সেখানে কবি তার আবেগমথিত হৃদয়, বাংলার নানা কথাগল্প, মরম, কিংবদন্তির এর কাছে সমর্পিত; ‘আবহমান’ কবিতায় কবি সেই আবহমান ঘরানাকে সৃজন ও মননের একটি উৎকৃষ্টের চূড়ান্তে নিয়ে গেছেন। যেখান থেকে আমরা শুরু করতে পারি সৃষ্টির আরেক নব ধ্যান।
বাবা তো ক্রন্দনরত পাহাড়ের নাম
গোপন রক্তক্ষরণে
ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে জীবনের আয়ু
…
মানুষের ইতিহাসে বেঁচে থাকে লালমাছিগুলো
বাম চোখে তারা জ্বেলে স্বপ্ন আঁকে যারা
যারা দায় পৃথিবীর চিরায়ত গান
যারা শুনে রাত্রির নিশ্বাস
তারা জানে পৃথিবীর তিনভাগ জলে
মিশে আছে দশভাগ বাবার হৃদয়!
[কন্যাকে লেখা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম চিঠি]
বাৎসল্যের অধীর মায়া ও স্নেহ জেগে ওঠেছে একজন বাবার। শরীর থেকে শরীর আলাদা হলেও হৃদয়ের গোপন কুটুরিতে মজ্জাগত বন্ধন সহজাত। এই বন্ধন রক্তের সঙ্গে রক্তের। মা যদি সন্তানের অকৃত্রিম মায়া আর নির্ভরতার আধার; বাবা তবে সেই আঁধারের একজন নির্মোহ চালক। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাপনার এও যেন অদৃশ্য এক সুতো। নানা ইন্দ্রজাল ও স্বার্থের জাঁতাকলে, যেই সুতোর বাঁধন আলগা করতেও সে প্রস্তুত! তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন দায়িত্ববান বাবাও অনুভূতির সমস্ত দরোজা খুলে দিয়ে বলে ওঠেন—‘পৃথিবীর তিন ভাগ জলে/ মিশে আছে দশ ভাগ বাবার হৃদয়।’
আরেক কবিতায় কবি বলেন,
আমার সমস্ত রাস্তা যদি উড়ে যায় মেঘস্রোতে
আর ওই রাত নামে হামাগুড়ি দিয়ে অনন্তের
. আন্ধারের মতো;
সম্ভ্রান্ত সন্ধ্যারে কোন কবি বশ করে নিয়ে যাবে
ডালিম ডানার মতো লাল-লাল সূর্যাস্তের আগে!
অনেক সময় কিছু বেদন-অনুভূতি মাঝেমধ্যে পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। আর সেই দু্ঃখবোধ যখন একজন অনুভূতিশীল মানুষের—তিনিও হয়ে ওঠেন আগ্রাসী। তখন তিনিও নিজের যাপন, মাটি আর ঋতুজ আচরণের কাছে অনুভূতির সমস্ত সৃজন ঢেলে দিয়ে বলেন—
০১.
চলো পুড়ে যাই, চলো উড়ে যাই তৃষ্ণার দহনে
এই চলন্ত নগরী হা করে থাকুক
পোড়াক মন-হৃদয়!
দুরন্ত দুপুর ঝুলে থাক কামারের হাপরের লালে।
[তৃষ্ণা]০২.
তোমার মেয়ের নাম অনামিকা শুনেছি সেদিন
নেই কেন আমাদের প্রেমের ফসল
কেন আজ শূন্য এই সোনার কলস?
কেন তুমি নেই পাশে, এই সব প্রশ্ন আজ জেগে ওঠে মনে…
আমাদের দুজনের স্বপ্ন রচনার হৃদয় নদীর তীরে
বুঝি তখন তোমার দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে
তোমার স্বামীর পাশে অন্ধকার রাত্রির কফিন!
[অনামিকা বিষয়ক একটি চিঠির খসড়া]
অনামিকা। হতে পারে একটি দেশ। হতে পারে কোনো বিশেষ অনুভূতির নাম। অথবা কবির ফেলে আসা কোনো স্মৃতিচারিতা। যিনি আজ স্মৃতিচারিতার মুখোমুখি। আবার বলা যায়, এটি কবির যৌক্তিক বোধের সচেতন আত্মপ্রকাশ। এই প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি মানবসমাজের এই যে দ্বিচারিতা, এই যে কুহেলিকা, প্রবঞ্চনা; তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমস্ত আক্ষেপ উজাড় ভরে ঝেড়ে দিচ্ছেন।
মানুষ! কতভাবেই না দূরে সরে যায়
এভাবেও যায়, ওভাবেও যায়।মানুষ! এভাবেও কাছে আসে, ওভাবেও আসে!
যেমন-‘কার’ও ‘প্রত্যয়ে’র বিভেদ ভুলে
‘ও’ বসে কার হয়ে বর্ণের পাশে!
এভাবেও মানুষ মানুষের পাশে থাকে।
…
আহা! মানুষের মানচিত্রে মানুষই রহস্য কেবল!
[মানুষ]
প্রাণীর রয়েছে দুটি সত্তা। রেশনালিটি ও এনমিলিটি (প্রাণিত্ব ও বৌদ্ধিকতা)। রেশনালিটি আছে বলেই মানুষ নামক প্রাণী আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধিক প্রাণী হিসেবে নিজেকে দাবি করে। কিন্তু মানুষের এই জ্ঞান, বুদ্ধি ও অনুভূতির কাছে মানুষ আজ নিজেই পরাভূত। একজন অনুভূতিশীল মানবিক মানুষও মানুষ হয়ে মানুষের আচরণের কাছে নানাভাবে দ্বিধা ও শঙ্কাচিত্ত। এইসব আচরণের বৈচিত্র্য আর স্ববিরোধিতায় কবিও হয়ে ওঠেন প্রবল অসহায়—‘আহা! মানুষের মানচিত্রে মানুষই রহস্য কেবল!’এই চরণের মধ্য দিয়ে যেন তার নিরেট সত্যটুকু ধরা পড়ে।
এখন বিষণ্ন রাত-নেমে আসে ঈগলের মতো
নখের আঁচড়ে মেঘ ছিঁড়ে খায় প্রেমিক হৃদয়
…
প্রান্তরে এসেছ ফেলে রুপার মাদুলি
জিনের আছর ভেবে শুনেছিলে মাতালের গান?
পায়ে পায়ে মেপে পথ লাল-নীল মিথের ভূগোল
পেছনে এসেছ রেখে।
[চাঁদ]
কবির অন্তরাত্মা যেন বা ছিঁড়ে খাচ্ছে কোনো এক অশুভ শক্তি। মগজ কুটুরির অস্তিমজ্জায় বাসাবাঁধা নেতিরা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠেছে। কবির প্রতিবেশী চাঁদ সাক্ষী হয়ে ঝুলে আছে। ঝুলে আছে নিয়তি। নিজের চিরায়ত গন্ধের মাটি, মিথ আর সুরের কিংবদন্তি দিয়ে কবি সাজিয়েছেন, নিজের অনবদ্য বোধনবাঁশি। ভারী কোনো ভাব অথবা স্তবকে না গিয়ে শুধু কিছু পঙ্ক্তি বা লাইনবন্ধে কবির কবিতার কিছু চরণ-চুম্বক—
০১.
এইভাবে চুপচাপ চলে যায়, দিনরাত, সপ্তাহ ও মাস
গর্দানের তেজ নিয়ে যেমন গর্জন করে গাঢ় লাল ষাড়
[নিশাচর রাশির জাতক]০২.
তবু নাস্তার টেবিলে নিরীহ শীতল সূর্য কাঁপে!
ওই লাল-গোল সূর্য প্রচণ্ড ক্ষুধায় গিলে খাবে
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেম-ভালোবাসা
[নাস্তার টেবিল]০৩.
ঘরেতে ঢুকেছে রাধা, ভেজাচুলে। কাঁপে তার বুক
এমন কামুক রাতে মেরুদণ্ড বেয়ে ওঠে কোন সাপ
[চলন্ত রাত্রির কাসিদা]০৪
একটি ফড়িং কেন ডুবে ডুবে কাটলো সাঁতার
লতায়-পাতায় প্রেম বাড়ে যদি নীল আসমানে!
[অনর্থ কথা]০৫.
আমার চিন্তার পথে মাঝে মাঝে ফড়িঙের ডানা
অথবা একটি মৃত হরিণের হাড় হানা দেয়
স্বপ্নের পথেও থাকে কিছু মৃত পাখি
[যখন একাকী]০৬.
বাবা বলতেন, জুনের জাতক নাকি জেদি হয়!
ভীষণ গোঁয়ার আর একরোখা হতে হতে তারা
[জুনের জাতক]০৭.
মগজে জেগেছে চাঁদ-হেমন্তের সোনামুখী কামুক সন্ধ্যায়!
[হেমন্তের শালিক]০৮.
রাষ্ট্রযন্ত্রে আস্থাহীন মানুষেরা পিঁপড়ের মতো দলে-দলে
মিছিলে শামিল! দ্যাখো-
মঞ্চে দাঁড়িয়ে গণ্ডার-শোকার্ত বাবাকে দেয় গালি!
[বাংলাদেশ]০৯.
তুমি যদি প্রেমে-কামে কাঁপো থরথর
আমিও তৃষ্ণার্ত আজ কামনা কাতর!
[প্রেম]১০.
রাধা খোঁজে বৃন্দাবনে শ্যাম
কৃষ্ণ দিলো নিষিদ্ধ করতালি!
[নিষিদ্ধ করতালি]
মেজাজে যথেষ্ট রোমান্টিক হয়েও নিছক ‘আর্টস ফর আর্টস সেক’-এর প্রতি কবির রয়েছে সচেতন অনীহা। একুশ শতকের এই দ্বারপ্রান্তে এসে একজন যৌক্তিক মানুষের আবেগ সামাজিক দায়কে যেমন প্রবলভাবে অস্বীকার করতে পারেন না—এজন্য তিনিও হয়ে ওঠেন একজন সচেতন, প্রজ্ঞাবান আঁধারের যাত্রী।
‘লাল রাত্রির গান’ পুরো কাব্যগ্রন্থে ৫৩টি কবিতা রয়েছে। উপর্যুক্ত কবিতার সারবস্তু ও কিছু লাইনবন্ধের (চরণ-চুম্বক) আলোচনা বাদে আরও কিছু কবিতা যেমন—‘লালমাছি জেগে থাকা গ্রামে’,‘পরানের ঘুম’, ‘মন্ত্রী মহোদয়গ ‘,‘রাত সিরিজ-১’, ‘রাত সিরিজ-২’, ‘কেন এই শূন্য-শূন্য লাগা’, ‘অবজ্ঞা’, ‘তারও বেশি নীল মে ‘, ‘নিয়তি’, ‘মিল অমিলের সঙ্গে’, ‘জন্মসূত্রে আমি তোর প্রেমিক ছিলাম’, ‘চৈত্রে কেন’, ‘উড়ন্ত কাশফু ‘, ‘সু ‘, ‘কে বেশি নিশাচ ‘,‘একচিলতে শ্রাবণ’, ‘একাকী জীবন’, ‘এই রাত’, ‘মাতাল জলের ঢেউ’, ‘বয়স্ক দুপুরের গাথা’, ‘ভুলি বলেই প্রিয়পাঠ্য’, ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগে’, ‘আকাশ পোড়ার গা ‘, ‘তৃষাতুর বাউ ‘, ‘না-কবিতা’, ‘আমার মৃত্যুর দিনে’, ‘বাউলনামা’, ‘জলের নূপুর’, ‘আর কারে তুই ভরসা করিস’, ‘অকারণে দোষী হলি’, ‘ওরে আমার হৃদয়রে তুই’, ‘তুই আমার আঁধার ঘর ‘ও ‘নাগরিক রাতের বয়স’।
বিষয়বস্তু আর ভাবে তিনি বৈশ্বিক ও মৃত্তিকালগ্ন; ভাষা কাঠামো আর কৌশলে কল্লোলপন্থী। পাশাপাশি সাহিত্যের স্বতন্ত্র দুই বড় শিল্পী রবীন্দ্র ও জীবনানন্দবোধে স্বচ্ছন্দ। এই দু’টি সাম্পানের মাঝামাঝি ধীর-অবস্থানে কবি মোহম্মদ নূরুল হকের শিল্পচেতনা। অতি আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সংহত ও যৌক্তিক প্রজ্ঞায় আঁটসাঁটো বুনট-ছন্দবদ্ধে নিজের শিল্পসত্যকে উপস্থাপন করেছেন। তার কবিতা সহজ চোখে সহজ মনে হলেও আত্মস্থের জায়গায় তার প্রজ্ঞা, শিল্পভাষা আর উপস্থাপনে শিল্পের জটিল কৌশলটি ধরা পড়ে। ফলে নৈর্ব্যক্তিক বোধ আর প্রজ্ঞায় নিজেকে সাধারণ্য থেকে আলাদা করতে পেরেছেন।
যুগ বিভাজনে মোহাম্মদ নূরুল হক আধুনিক; ‘লাল রাত্রির গান’ কাব্যগ্রন্থে এ-ও আমরা প্রত্যক্ষ করি। কথা হচ্ছে আধুনিকতা কী? এই নিয়ে যুক্তিবাদী আর ভাববাদী শিল্পীদের নানা ভাবনা মতান্তর আছে। ষোলো শতকের গোড়ার দিকে মডার্ন বা আধুনিক শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। পরে আঠারো শতকের দিকে ইউরোপে যুক্তিবাদিতা আর এনলাইটেনমেন্ট যাত্রার সময়েই আধুনিক শব্দটি নানাভাবে দৃশ্যমান হতে থাকে। এটি এখন পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদেরও সমার্থক। সুতরাং বলতে হয়, আধুনিকতা সংজ্ঞাটির সুনির্দিষ্ট কোনো রূপ পরিগ্রহ নেই। এটি আপেক্ষিক এবং বহুমাত্রিক। রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে যেমন বলেন, ‘এটি কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা।’ আবার আবু সায়ীদ আইয়ুব বলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত; অন্তত মুক্তির প্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ সে অর্থে মোহাম্মদ নূরুল হক ভূগোল ও দেশসচেতন একজন যুক্তিনিষ্ঠ আধুনিক কবি।
লাল রাত্রির গান
মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশক: দৃষ্টি
প্রচ্ছদ: কাব্য কারিম
মূল্য: ২০০ টাকা