আমরা মনে করি, পুঁজিবাদ থেকে বেরিয়ে এলেই মুক্তি, কিন্তু বিকল্প নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে এসে আমরা নিজেদের ইতিহাসের বাইরে চলে এসেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েও আমরা কথা বলতে পারি না কেন? কথা বললেও তা জনগণের কাছে পৌঁছায় না কেন? কারণ, সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রে ব্যবস্থা বা সিস্টেম বলে যা গ্রহণ করেছি, তা শোভন নয়। ‘ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে সেই শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ প্রকাশিত হয়েছে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের বই ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’।
তার ‘শোভন বা ডিসেন্ট’ প্রিফিক্স আদৌ কোনো ধারণাগত আসঞ্জণ বা কোহেরেন্স অর্জন করেছে কি না, সেই সংশয় কেটে যাবে তার ব্যাখ্যা ও গাণিতিক বিশ্লেষণে। এই বই আমি মনে করি পুঁজিবাদের ক্রিটিক নয়, কাউন্টার-ন্যারেটিভ নয়, তিনি এটাকে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। তার ‘শোভন’ শব্দটি সেই অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি যেন ফোর্ডিজম থেকে নমনীয় সঞ্চয়ের রূপান্তর কেলাসিত হয়। তার ‘শোভন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ রাষ্ট্রের মৌলিক তাত্ত্বিক পুনর্গঠন। তিনি পাঠককে কখনো তত্ত্বের সমর্থক করে তোলার চেষ্টা করেন না, বরং ভাবনা জাগিয়ে দেন নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
কৃতজ্ঞতাপত্র, মুখবন্ধ ও মোট ১২টি অধ্যায় ছাড়াও বইটিতে আছে ২৭টি সারণি, ৩৯টি লেখচিত্র, তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট। ১২টি অধ্যায়ের কয়েকটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক অর্থনীতি: শোভন জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ: শোভন সমাজ বিনির্মাণে প্রধান দুর্ভাবনার বিষয়, কভিড-১৯ এর প্রত্যক্ষ ক্ষতির বিশ্লেষণ এবং মোকাবেলা ভাবনা: শোভন সমাজ অভীষ্ট প্রাথমিক কর্মকাণ্ড, কভিড-১৯ পুনরুদ্ধার ও শোভন সমাজ অর্থনীতি বিনির্মাণের মডেল, সমাজ সমগ্রকের রাজনৈতিক অর্থনীতি: শোভন সমাজ অর্থনীতির সন্ধানে, ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশ বিকল্প বাজেট ২০২০-২০২১, কভিড-১৯ মহামারীর বিশ্বে পরিবর্তন অনিবার্য, আমরা কী চাই?
তবে এই বইয়ে যে বিষয়টি নেই, তা হলো ‘রোহিঙ্গা সমস্যা ও তার রাজনৈতিক অর্থনীতি’। দেশের একটা অংশের বিরোধিতার মুখে সুন্দরবনের পাশেই স্থাপন করা বহুল আলোচিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও কোনো তর্ক নেই। দেশের এমন বাস্তব ও আলোচিত ঘটনা হতে পারে লেখক সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন কিংবা তিনি এই বিষয়ে অন্য কোনো লেখায় কথা বলতে চান।
বইটির শিরোনামে ‘বড় পর্দা’ আসলে কী, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অধ্যাপক আবুল বারকাতের এই কথায়, ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে এতকাল আমরা দেখেছি ছোট পর্দায়, খণ্ডিত, আংশিক ও কামরাভুক্তভাবে। ফলে বিকাশের মর্মবস্তু বুঝতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এসবের বিপরীতে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে দেখতে হবে বড় পর্দায়। মানুষকে দেখতে হবে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে।…শোভন সমাজ-শোভন অর্থনীতি-শোভন রাষ্ট্র হলো শেষ বিচারে বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও উচ্চ নীতি নৈতিকতাসম্পন্ন আলোকিত মানুষের জীবনব্যবস্থা।’
বৈশ্বিক পুঁজিবাদ ও স্থানীয় ফ্যাসিবাদের নিগ্রহ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে এ ‘শোভন সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে’ একটি সদর্থক বিকাশ বলে মনে করি। এ ‘শোভন’ প্যারাডাইম নানাজনের কাছে নানাভাবে ধরা দিতে পারে। তা কোন পিরিয়ডাইজিং কনসেপ্ট নয়, বরং ইতোমধ্যে এটি একটি গণ-আকাঙ্ক্ষা ও সংহত ধারণা হিসেবে গড়ে উঠতে চাইছে। সমাজ-বিজ্ঞানী বারকাতের দর্শন-বীক্ষায় তা সঠিক সময়ে ধরা পড়েছে।
মহামন্দা-মহামারীর মহাসংকটে মানুষের মাঝে ‘শোভন ব্যবস্থার’ প্রত্যাশা প্রবল। অধ্যাপক বারকাত লিখেন, ‘‘একুশ শতকের এই সময়ে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র ত্রিমাত্রিক বিপর্যয়ের শিকার। আর্থিকীকরণকৃত রেন্টসিকিং-পরজীবী-লুটেরা পুঁজির নিরঙ্কুশ আধিপত্যে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার নিরন্তন উৎপাদন-পুনরুৎপাদন, যা অর্থনীতিতে অবশ্যম্ভাবী করেছে গভীর মহামন্দা (প্রথম ও প্রধান বিপর্যয়), রাজনীতি-সরকার থেকে ক্ষমতা অভিবাসিত হয়েছে (দ্বিতীয় বিপর্যয়), আর একই সময়ে ভাইরাসের (আপাতত কভিড-১৯) কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষ হয়েছে গৃহবন্দি (তৃতীয় বিপর্যয়)। এসবের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এমন অবস্থা যখন বড় পর্দার প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য-আস্থা-সম্মানভিত্তিক নতুন এক জীবনব্যবস্থা, ‘শোভন সমাজব্যবস্থা’ আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার চাহিদা অনিবার্য। এ পথে হাঁটা ছাড়া অশোভন পৃথিবী থেকে শোভন পৃথিবীতে উত্তরণ সম্ভব নয়। পথটা দেখাবে শোভন রাজনীতি।”
পুঁজিবাদী কর্তৃত্বের সব থেকে বিরোধী দর্শন মার্ক্সসীয় প্রজ্ঞাকেও আমরা যেন ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে রুশ বিকৃতিকেই মডেল করেছি। ফলে আমাদের ‘ব্যবস্থা বা সিস্টেম’ এতকাল ঠিকমতো তৈরি হয়নি। ‘শোভন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে অধ্যাপক বারকাতের বীক্ষা ওই কলোনিয়াল ডিসকোর্সের বাইরে গিয়ে সময় সম্পর্কে যে ধারণায় স্থিত হয়, তা পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি চায়। বর্বর মার্কিনি অসভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড় করায় প্রতিবাদকে। ঐতিহাসিক রূপান্তরের যে স্বপ্নে আমরা দাঁড়াবো, তাকে আঙুল দিয়ে দেখায়। পুঁজিবাদের ভিত্তি পশ্চিমা চিন্তা-প্রকৌশল প্রত্যাখান করে তার বয়ান। যুক্তি বা বুদ্ধির যে প্রগতি, পুঁজিবাদের তল্পীবাহক যে ইতিহাসের জয়গান এযাবৎ করা হয়েছে, বারকাতের এ বই তার মূলেই ধাক্কা দিয়েছে।
অধ্যাপক বারকাত লিখেন, ‘যেকোনো দেশেই হিসাব করলে দেখা যাবে যে পুঁজির মালিক বা নিয়োগকর্তাদের (মালিক, শেয়ারহোল্ডার, বোর্ড অব ডিরেক্টরস, সিইও, মহাব্যবস্থাপক এবং অনুরূপ) সংখ্যা হবে দেশের মোট জনসংখ্যার বড়জোর এক শতাংশ, যাদের সবাইকে একত্রিত করলে ওই দেশের একটা ছোট্ট জেলা শহরের স্টেডিয়ামও পরিপূর্ণ হবে না। আর বাদবাকি জনসংখ্যার প্রায় সবাই অর্থ্যাৎ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হলেন তারা যারা পুঁজির মালিকের হয়ে কারখানায়, ব্যবসায়, কৃষি ফার্মে শ্রম দেন, পুঁজির মালিক কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তি বা মেহনতি শ্রমশক্তি প্রদানকারী কর্মী বাহিনী, উৎপাদক শ্রেণি।… তুমি যা উৎপাদন করবে তাঁর মালিক হবো আমি। ওসব আমি কোথায় কখন কার কাছে কত টাকায় বেচাকেনা করবো এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ স্বাধীনতা আমার। কারণ, আমি মালিক।’
এই বুদ্ধিবিভাস একদিকে যেমন গণতন্ত্র-প্রগতি-বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। পুঁজির আক্রমণে আমরা যেন সত্তাহীন শেকড়হীন ও নিজ অভিজ্ঞানচ্যুত, এ পরিস্থিতিতে কৃষকের লাঙলের মতো ভূমি খুঁড়ে নতুন মৃত্তিকার সন্ধান দিয়েছে অধ্যাপক বারকাতের কলম। সেই কলমের কালি যেন ১৮৭৩ সালে পাবনা-সিরাজগঞ্জে ঘটে যাওয়া উপমহাদেশের প্রথম প্রজা বিদ্রোহে কৃষকেরই রক্ত। তাঁর এই বিশাল বইখানা যেন নতুন সম্ভাবনার সবুজ দ্বীপ, আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমাদের চিরতরে দাস বানিয়ে রাখার যে সমীকরণ এ বই যেন ওই প্রক্রিয়ারই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি সাম্যবাদকে অনিবার্য স্বীকৃতি দেন, তার পরিবেশিত তথ্য প্রতিবাদী শক্তি সরবরাহ করে, সংস্কৃতির প্রায় সামগ্রিক পণ্যায়নে সেই সমাচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে, যেন ধনতন্ত্রকে মোকাবিলা করা যায়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে আমাদের বেদনাকে মুছে দেয়। উগ্র ডানপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে শাসনক্লান্ত শোভন চিন্তাপ্রক্রিয়ায় স্রোত আনে। মূল্যবোধ তৈরি করে সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে।
অধ্যাপক বারকাত মানবিকীকরণের পথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বলেন, ‘‘যার সমাধান পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া আদৌ সম্ভব না: ভাইরাল-ব্যাকটেরিয়া উদ্ভূত মহামারি, পারমাণবিক বোমা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি, গণতন্ত্রের ক্ষয়-লয়। সম্পূর্ণ বিষয়টি এখন আর একক কোনো দেশের বিষয় নয়, একক কোন দেশে শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যেও তা আবদ্ধ নয়, বিষয়টি প্রকৃতই আন্তর্জাতিক সংগ্রামের। এসবই সেই প্রেক্ষাপট ভিত্তি যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা ‘শোভন সমাজ ব্যবস্থা’ (ডিসেন্ট সোশ্যাল সিস্টেম), ‘শোভন অর্থনীতিব্যবস্থা’ (ডিসেন্ট ইকোনমিক সিস্টেম), ‘শোভন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ (ডিসেন্ট স্টেট সিস্টেম) তত্ত্বকাঠামো বিনির্মাণ এবং তা বাস্তবায়নের যুক্তি দিয়েছি। এসবই এ গ্রন্থের মূল বিচার্য বিষয়।”
এই বইয়ে অধ্যাপক বারকাত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরেছেন কিভাবে ডমিনেশন-হেজেমনি তৈরি হয়েছে, কিভাবে প্রকৃতির পণ্যায়ন ঘটেছে, উন্নয়নের গতিবেগের চেয়ে প্রকৃতি ধ্বংসের গতিবেগ কেন বেশি, গ্রামের মানুষকে ভূমিহীন করে শহরে তাড়িয়ে এনে কিভাবে কলকারখানায় আনা হয়েছে, কার বাজার বিস্তৃতির জন্য আনা হয়েছে, সরকারের কাছ থেকে কিভাবে ক্ষমতা গুটিকয়েক করপোরেশন ও ব্যাংকের কাছে চলে গেছে, নয়া-উদারবাদের চক্রান্ত, পুঁজির মালিক ও উৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে শাসন-শোষণের সম্পর্ক।
এছাড়া তুলে ধরেছেন, বিশ্বের মোট যুদ্ধাস্ত্রের অর্ধেকটাই উৎপাদন করে যে যুক্তরাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্র কেন তার দেশের ২ লাখ নাগরিকের মৃত্যু ঠেকাতে পারলো না, গণতন্ত্রের নামে দ্বি-দলীয় সিস্টেম, ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ ও আবাসন সমস্যা, বাংলাদেশে আবাসন সমস্যা মেটাতে ‘জাতীয় মাল্টিপারপাস পাবলিক হাউজিং কমপ্লেক্স’ ধারণা, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্বব্যাংকেরই ১৬১ কোটি টাকা ঋণে ‘হেকাপ’ প্রকল্প দিয়ে কিভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে, নিউ নরমাল-নিউ রিয়েলিটি-গ্রেট রিসেট ইত্যাদি প্রপঞ্চ দিয়ে মহামারীতে কিভাবে পুঁজিবাদের উত্তরণের অভিনব পথ আবিষ্কার করা হয়েছে, তাও। পাশাপাশি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, গুটিকয়েক মানুষ যাদের ‘অলিগার্খি’ বলা হয় তাদের শাসনপদ্ধতি, সাম্রাজ্যবাদ তোষণকারী প্রচারমাধ্যম, কালো টাকা ও অর্থপাচার: উৎসে দুর্নীতি আর দুর্নীতির উৎসে পণ্য-অর্থ সম্পর্ক, রেমিটেন্স প্রবাহের উৎপাদনশীল ব্যবহার, নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশুর বিকাশ, মহামারীতে জীবিকার পথ খুলতে কী করা জরুরি, সে বিষয়েও।
সরকার ও রাজনীতি থেকে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ক্ষমতার আধুনিক রূপ ও জ্ঞান যে নতুন ধরনের আধিপত্য সৃষ্টি করেছে, সে ব্যাপারে তিনি আমাদের সতর্ক করেছেন। তার মতে,, আধিপত্যের তত্ত্ব কাঠামো নির্মাণ করছে পুঁজিবাদ। সমগ্রকে অস্বীকার করে কতিপয়ের জন্য যে উপযোগবাদী উৎপাদন ও প্রয়োজন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান তিনি। সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি বিষয়ে গবেষণাগ্রন্থ, প্রবন্ধ, মনোগ্রাফ, অভিসন্দর্ভ ও লোকবক্তৃতা সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে লিখেছেন পাঁচশর বেশি লেখা। তাকে বলা হয় ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ’। মূলে আঘাত করে সত্য উদঘাটনের পথটি প্রশস্ত করেছেন তিনি বইয়ে। প্রাচ্যবিদ্যাও যে এশিয়াকে ইউরোপের ছাঁচে ও স্বার্থে ঢেলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, একথা উচ্চারিত হয়েছে এখানে। তিনি সাম্যবাদকে অনিবার্য স্বীকৃতি দেন, তার পরিবেশিত তথ্য প্রতিবাদী শক্তি সরবরাহ করে, সংস্কৃতির প্রায় সামগ্রিক পণ্যায়নে সেই সমাচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে, যেন ধনতন্ত্রকে মোকাবিলা করা যায়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে আমাদের বেদনাকে মুছে দেয়। উগ্র ডানপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে শাসনক্লান্ত শোভন চিন্তাপ্রক্রিয়ায় স্রোত আনে। মূল্যবোধ তৈরি করে সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে।
ব্যবস্থা বা সিস্টেম বলতে যা প্রচলিত তাকে কিভাবে ‘শোভন’ করে তুলতে হবে, পুঁজিবাদের প্রেসক্রিপশনকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, সেই সক্রিয় ধারণা কী, তার বিবরণ তিনি দিয়েছেন বইটির নানা পরিচ্ছদে। ইতিহাসের বিকাশে গত চারশ বছর ধরে প্রথমে ইউরোপ, তারপর আমেরিকা শক্তি ও অর্থনীতির জোরে কেন্দ্রীয় অবস্থানে, এর জোরেই তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য। বারকাত তার আধিপত্য সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেন না, তিনি দেখেন এতদিন ইতিহাসে থেকেও তার নিজ দেশ ও কালের নিদারুণ সংকট। যে আধুনিকতাকে ধনতন্ত্রের মতোই চূড়ান্ত ভেবেছিলাম, তা আসলে গভীর ভয়াবহ পরিণতি, শূন্যতা তৈরি করে আছে। কিন্তু ধনতন্ত্রের পরে কী হবে, তা অর্থনীতিবিদরা বলতে গড়িমসি করলেও বারকাত এই বইয়ে তার স্পষ্ট রূপরেখা দিয়েছেন এবং তা থেকে উত্তরণের ম্যানিফেস্টো দিয়েছেন।
বাজেট সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘‘প্রচলিত প্রথায় বাজেট প্রণয়নের শুরুটাই হয় ‘টাকা-পয়সাকে’ মূল অবজেক্ট অথবা উদ্দিষ্ট-লক্ষ্য-অভীষ্ট ধরে নিয়ে। বাজেট-প্রণেতারা প্রথমেই যা ঠিক করেন তা হলো ‘কত টাকা পয়সা আছে’ (যাকে বলে রিসোর্স এনভেলপ)। বই-পুস্তকে লেখা এবং বাস্তবে প্রয়োগকৃত বাজেট বিনির্মাণ ভাবনার এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এ ভ্রান্তি সঠিক ধরে নিয়েই প্রাক-বাজেট ও বাজেট প্রণয়নপরবর্তী তর্ক-বিতর্ক হয়, গণমাধ্যম অযথা সোচ্চার হয়, এসবই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাজেট বিষয়ক চিন্তনপদ্ধতিতে শক্তভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে। এসবের বিপরীতে ‘শোভন অর্থনীতি’ ব্যবস্থায় আমাদের বাজেট প্রণয়ন কর্মকাণ্ডের শুরুটাই হবে ‘কতো টাকাপয়সা আছে’ দিয়ে নয়, ‘কী কী প্রয়োজন’ তা দিয়ে।”
বারকাত লেট-ক্যাপিটালিজম বলতে কিছু স্বীকার করেন না, উত্তরপর্বে তিনি দেখেন ধনতন্ত্রের পরাজয় ও সাম্যের জয়। তার যুক্তিবাদিতা পাঠকের মনে স্বাধীনতার জন্ম দেয়। নিজের সমস্ত প্রস্তাবনা নিয়ে লড়াইয়ের পক্ষপাতী তিনি। একটি শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে বারকাত সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দেন।
আমি মনে করি পুঁজিবাদের সিলেবাসের বাইরে যারা বিচরণ করেন তারাই কীর্তির রচয়িতা। অধ্যাপক বারকাত পশ্চিম থেকে নিয়েছেন, কিন্তু নিজের ভাবকে ব্যাখ্যা করার জন্য ক্রমশ তার থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন নিজের দেশ ও ভাষাকেই। তিনি চাইলে তরুণ বয়সেই বিদেশ চলে যেতে পারতেন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষায় অধ্যাপনা আর বই লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সমগ্র ঔপনিবেশিক সত্তার প্রবল প্রতিবাদী, পুঁজিবাদকে সেজদা দেওয়া জ্ঞানকাণ্ডের হাত ছাড়িয়ে দ্বন্ধময় আকাশে বিস্তৃত তাঁর মনোজগত। তিনি সেই নির্মাণের প্রক্রিয়ার ভেতর ঢুকেছেন, তাঁর রোপন করা চারা আজ ৭৩৬ পৃষ্ঠার একটা মহীরুহ হয়েছে যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি, ধনতন্ত্রের পরের কথা কী? তিনি দেখিয়ে দেন যে- পশ্চিমের শূন্যতায়, ভাঙনে, পুঁজির যে নানা শব্দ বা শব্দগুচ্ছ আসছে তাঁর সঙ্গে আমাদের সাযুজ্য হতে পারে না। তাঁর ‘শোভন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ নতুন ইতিহাসের উজ্জীবন, সেই ব্যবস্থা অন্য গায়কীতে অন্য তালে বাঁধা।
সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রে ‘শোভন ব্যবস্থা’ বহুমাত্রিক এবং এর অভিঘাত বহুমুখী। আর এর পরিব্যপ্তি শিল্প, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য, আরো নানা দিকে। পুঁজিবাদের কয়েকটি মূলসূত্রকে অধ্যাপক বারকাতের ‘শোভন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বাতিল করতে চায়। কালচারাল-হেজেমনির সীমা ভেঙে নিজ ভাষা ও লোকজ সংশ্লেষণের সন্ধানে নামতে চায়। তাঁর উপস্থাপিত বিজ্ঞান ও যুক্তি সন্নিবেশনের কোন লেজিটিমেশন বা বৈধকরণের প্রয়োজন নেই বলে মনে করি।
তথাকথিত প্রথম বিশ্বের নব পদ্ধতিতে শোষণ-শাসনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বাঁচা একজন পাঠকের চোখে এসবই আমার কাছে ধরা দেয়। ইউরোপে আমেরিকায় পুঁজিবাদ সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন ও প্রত্যাখান দেখা দিয়েছে, পুঁজিবাদের প্রকরণ কৌশলে নতুন যেসব পরিবর্তন এসেছে তা পশ্চিমের পটে একরকম, আর এখানে আরেক রকম। অর্থনীতির সংকটে ও সংকটমুক্তির চেষ্টায় অর্থনীতির একাধিক ধারণাকে বাতিল ও সংশোধন করতে হচ্ছে। বিশ্বের শ্রমিকরা নয়, ধনিকরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে তার উদ্দেশ্যে। পুঁজিবাদের পশ্চিমী ভাবনায় মজে তার ভয়াবহ কামড়কে আমরা বুঝি না, বুঝেও আমল দেই না। ধনতন্ত্রকে পশ্চিমারা যেভাবে দেখছে, সেভাবে দেখতে চাইছি। আমি এই বইটি পড়ে নৈরাজ্যের মধ্যে ধনতন্ত্রের উপমা খুঁজছি, নানা তথ্য-উপাত্তের মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাচ্ছি বাস্তব জীবনের সঙ্গে। সময় সম্পর্কে এক আবিষ্টতা আছে এতে, ছাপা পৃষ্ঠার শব্দগুলো মৌখিক উক্তি হিসেবে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয় ‘শোভন বাংলাদেশের’ সমর্থনে। কারণ এ বই ক্ষমতাকে অত্যাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে প্রমাণ করে, সত্যের পার্থক্য তৈরি ও মানুষের সম্ভাবনা স্বীকার করে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী আব্দুল জব্বারের একটা গান আছে এমন, ‘শহরবাসী শোন/ তোমরা যাদের মানুষ বল না/ বিধিও যাদের কান্না শোনে না/ তারাও মানুষ কাঁদে তাদের প্রাণ/ আমি চোখের জলে শোনাই তাদের গান…’। এ কথাগুলোর অর্থ আমার কাছে এমন যে, মানুষ যা অ্যাড্রেস করতে পারে না তা মানুষের তৈরি ঈশ্বর বা কোনো সিস্টেম বা চূড়ান্ত শক্তিও ঠাহর করতে পারে না। তা-ই যদি না হয়, তাহলে মানুষ যেখানে ব্যর্থ ‘বিধিও’ কেন সেখানে ব্যর্থ হতে যাবেন? এই বিধি বা ব্যবস্থা বা সিস্টেম কেন শোভন নয়? বারকাত লেট-ক্যাপিটালিজম বলতে কিছু স্বীকার করেন না, উত্তরপর্বে তিনি দেখেন ধনতন্ত্রের পরাজয় ও সাম্যের জয়। তার যুক্তিবাদিতা পাঠকের মনে স্বাধীনতার জন্ম দেয়। নিজের সমস্ত প্রস্তাবনা নিয়ে লড়াইয়ের পক্ষপাতী তিনি। একটি শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে বারকাত সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দেন।
বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র
আবুল বারকাত
প্রকাশক: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা,
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০২০,
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা,
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭৩৬,
মূল্য: ১৫০০