‘দুই শহরের জানালা’—গল্পগ্রন্থের জন্যে ২০১৯ সালে ‘এবং মানুষ পুরস্কার’ পেয়েছিলাম। বৈশাখের কবিতা উৎসবে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। স্থান কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, ঢাকা।
নির্ধারিত তারিখে পুরস্কার গ্রহণ করতে ঢাকা গেলাম। বিপুল আয়োজন দেখে অভিভূত হলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সভাপ্রধান ও বিশেষ অতিথির চেয়ার অলঙ্কৃত করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রতিষ্ঠিত কয়েকজন গুণী কবি-সাহিত্যিক।
ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত ও চনমনে হয়ে উঠলাম—এত বড় অনুষ্ঠান থেকে পুরস্কার নেবো! উফ, এখনো ঘোষণা করছে না কেন, কেন যে এখনো মঞ্চে ঢাকছে না? পুরস্কারটা সাধারণত অনুষ্ঠানেই ঘোষণা হয়, দুই-একদিন আগে শুধু লেখককে বিশেষভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়—সে কারণেই উত্তেজনটা একটু বেশি, মনের ভেতরে শঙ্কা।
সময় মতো পুরস্কার ঘোষণা হলো। সানন্দে গ্রহণ করলাম। আমার পরপরই পুরস্কার গ্রহণ করলেন কবি মতিন বৈরাগী। সঞ্চালনায় ছিলেন কবি আনোয়ার কামাল ও দুজন নারী। আমি পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি শেষ করার পর মঞ্চে উঠলেন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব কবি মতিন বৈরাগী। তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন—‘আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এটাই আমার জীবনে প্রথম পুরস্কার! এর আগে আমি একটি পুরস্কারও পাইনি।’
তার কথা আমাকে ভীষণভাবে আহত করলো। বুকে ধাক্কা দিলো। দেশের বড় বড় সব কাগজে যার লেখা প্রকাশিত হয় নিয়মিত, সেই ব্যক্তি জীবনে একবারও পুরস্কার পাননি, এবারই প্রথম! কথাটা শোনার পর ভেতরটা আর্দ্র হয়ে উঠলো। পৃথিবীর কত ঘটনাই যে আমাদের অজানা, অদেখা রয়ে গেলো। সেদিন মনে মনে শপথ নিলাম, জীবনে কখনো সুযোগ এলে লেখকদের জন্যে কিছু একটা করবো, সাধ্যে কুলালে পুরস্কার-সম্মাননার আয়োজন করবো। কেউ যেন অন্তত সত্তরোর্ধ্ব বয়সে এসে মঞ্চে দাঁড়িয়ে এভাবে আক্ষেপ করতে না হয়।
কিন্তু না। আমার আবেগ, আমার শপথ আমার কাছেই গচ্ছিত রইলো। কেউ এটাকে পাত্তা দিলো না। দুই-একটা সংগঠনের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপও করলাম। তারা বোধহয় মনে করেছে আমি নিজেই পুরস্কার পাওয়ার লোভে কৌশলে পুরস্কার প্রবর্তনের বুদ্ধি দেই। কেউ কানেও মাখেনি কথাটা। নানাবিধ ছুঁতো দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে সুকৌশলে। এছাড়া এর অল্পদিন আগে চাঁদপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার নিয়েও নানাবিধ তর্ক-বির্তক সৃষ্টি হয়েছিল।
আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে, সে পুরস্কার আমি নিজেও গ্রহণ করিনি শেষপর্যন্ত। অনেক জল ঘোলা হয়েছে সেই পুরস্কার নিয়ে। ফলে, পুরস্কার বিষয়টিতে কারও আস্থা সৃষ্টি করা গেলো না, দিতেও আগ্রহী হয়ে ওঠেনি কেউ বির্তক সৃষ্টির ভয়ে কিংবা মনোবলের অভাবে, মানসিক দীনতার কারণেও হতে পারে। সুতরাং যার মাথা, তার ব্যথা। আমি নিজেই প্রত্যয় নিলাম কাজটা করে দেখাবো। যেভাবেই হোক সফল আমাকে হতেই হবে।
উইলিয়াম ফকনারের কথাটা বারবার আওড়ালাম—‘মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই।’ এই ফাঁকে একটু অন্য কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি, ইত্যেমধ্যে চাঁদপুরের শিল্প-সাহিত্যের গৌরব তীব্রভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এখানকার কবি-সাহিত্যিকদের সুনাম দেশময় ছড়িয়ে গেছে। বিশেষত তরুণদের অগ্রযাত্রা প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে অন্যান্য জেলাগুলোতে, ঢাকার পত্রিকায় আসতে শুরু করেছে আমাদের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ছড়া। বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকারেও প্রকাশ হচ্ছে আমাদের লেখা। দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলার কাগজগুলিও চাইতে শুরু করেছে আমাদের কাছ থেকে লেখা। ফেসবুকের কল্যাণে পরিচিত হয়ে উঠলাম দেশবিদেশের অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকে সঙ্গে। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে, সফল অগ্রযাত্রার আদতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলাম আমরা গুটিকয় তরুণ: মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, তছলিম হোসেন হাওলাদার ও আমি রফিকুজ্জামান রণি। মূলত আমাদের এ কজনের রাতদিনের পরিশ্রমের ফসল, দুর্বার প্রচেষ্টা এবং গণ্ডি ছাপিয়ে উঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এ জেলার সাহিত্যের বেদীতে নতুন এক ঝাঁকুনি দিতে শুরু করেছে। দুই-একজন সিনিয়র লেখকও আমাদের সারথি ছিলেন। চাঁদপুরের কয়েক দশকের ঘুমন্ত সাহিত্যাঙ্গনকে অনেকটা ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তুলেছে আমাদের যৌথ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ—‘মৃত্তিকা’(মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, তছলিম হোসেন হাওলাদার রফিকুজ্জামান রণি সম্পাদিত)।
এ কাগজ সম্পর্কে পরবর্তীতে দৈনিক চাঁদপুরকণ্ঠের প্রধান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত সাহেবও পত্রিকায় লিখেছেন—চাঁদপুরের নবপর্যায়ের সাহিত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে মৃত্তিকাই হচ্ছে প্রথম লিটলম্যাগ। কাগজটি বের করতে গিয়ে কবি পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, গীতিকার পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী, নাট্যকার এসএম জয়নাল আবেদীন, সাংস্কৃতিক সংগঠক হারুন আল রশীদ, কবি সৌম্য সালেক, নাট্যকার জসীম মেহেদী, কবি দন্ত্যন ইসলাম ও লেখক মুখলেছুর রহমান ভূঁইয়ার দ্বারস্থ হয়েছি আমরা অনেকবার। মূলত তাদের আন্তরিকতার কারণেই কাগজটা আলোতে এসেছে সেদিন। এ ‘মৃত্তিকা’ আলোতে আসার পেছনে হাজার রকমের বিড়ম্বনা পোহানোর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অনেক আনন্দের স্মৃতিও আছে।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিকই এ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয়, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আমরা বই উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি। পাশিপাশি দেশেবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সুধিজন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানেও আমরা বই উপহার দেই।
চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গন যেহেতেু ইতোমধ্যে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে সুতরাং এখানকার কেউ-ই কম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লেখক নন। ফলে, নিজেদের মতামত এবং দর্শন সম্পর্কে নিজেরাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। যার ফলে লাভ এবং ক্ষতি দুটোই হয়েছে। নিজেদের মধ্যে অনৈক্য, বিদ্বেষ ও অশ্রদ্ধাভাব খুব সহজে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে অগ্রজরা উদাসীন এবং কেউ কেউ সুবিধা আদায়ে মত্ত থাকায় চাঁদপুরের সাহিত্যের স্বর্ণময় ইতিহাস অনেকটা ম্লান হওয়ার পথে। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো সবকিছু। সোনার সংসারে ঢুকে গেলো বিভেদের সাপ। পদপদবির তৃষ্ণা বেড়ে গেলো কারও কারও, ঈর্ষা-হিংসার বালাই যেখানে ছিলো না কখনো, সেখানে নতুন করে ঢুকতে শুরু করলো এ জাতীয় অভিশাপ। আরও কিছু বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও দাঁড়াতে হলো আমাদের। ফলে চর্চাটা হয়ে পড়লো জৌলসহীন কিন্তু একেবারেই থেমে যায়নি। প্রতিযোগিতা বেড়েছে তবে সেটা শিল্পসৃষ্টির প্রতিযোগিতা নয়, নিজেদের নিয়ে মাতামাতি করার প্রতিযোগিতা!
সাহিত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও লেখকদের মনে দেখা দিলো চরম অসন্তোষ। কারও কারও অতিমাত্রায় বাড়াবাড়িতে ফুঁসে উঠলো লেখকরা। কেউ কারও পথ ছেড়ে দিতে চায় না। অথচ মাস কয়েক আগেও ছিল ভিন্ন প্রতিচ্ছবি; পরস্পরকে তুলে ধরবার প্রতি আন্তরিক ছিলো একসময়। কিন্তু আচানক কোনো ঝড়ের কবলে পড়ে সবকিছু কেমন এক লহমায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো, চিড় ধরে উঠলো সম্প্রীতির বেদীমূলে। তবে এখানে কারো দোষ দেওয়ার মতো কিছু নেই, প্রকৃতিরই খেলা এসব, পৃথিবীর কোনো সাম্রাজ্যই একটানা দুইশত বছরের অধিক টিকে থাকতে পারেনি, সে তুলনায় এসব বিষয় তো একেবারেই ছেলেখেলা।
আমি বিশ্বাস করি, যে নদীর স্রোত যত বেশি, সে নদীর শাখা-প্রশাখাও তত বেশি হয়। হয়তো-বা চাঁদপুরের সাহিত্যের স্রোতধারাও প্রবল হওয়ায় শাখা-প্রশাখা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে একদিন, তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশে উদিত হয়েছিল। সুতরাং আমার ভেতরে লালিত স্বপ্ন, মানুষের হাতে পুরস্কার তুলে দেবার মনোবাসনা সম্পন্ন করবার মতো সঙ্গী খুঁজে পেলাম না। তাই নিজেই খুঁজতে শুরু করলাম নিজের পথ।
একদিন কবি আসাদুল্লা কাহাফকে ফোন করে আনলাম কালিবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনে। মনের কষ্টের কথা জানালাম। তিনি আমাকে শতভাগ সাপোর্ট দিলেন এবং বললেন—‘তুমি তোমার মতো অগ্রসর হও, কেউ না থাকলেও আমি আছি তোমার সঙ্গে।’ ফোন দিলাম কবি নূরুন্নাহার মুন্নীকে। তিনিও আমাকে এগিয়ে যাবার উৎসাহ দিলেন এবং অচিরেই দেখাও করলেন। তারপর, অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, বৈঠকের পর বৈঠক, কাছে-দূরের অনেকের সঙ্গে শুরু হলো যোগাযোগ। অযাচক আশ্রম এবং প্রেসক্লাব ঘাট হয়ে উঠলো আমাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু (এই দুই জায়গার মাটিতে বসেই একদিন মৃত্তিকা বের করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলাম আমরা একঝাঁক সাহিত্যপাগল মানুষ। এই জাগায়গুলোতে বসেই মূলত আমাদের সাহিত্যের আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছিল। অযাচক আশ্রমের সামনের স্থানটির নামও দিয়েছিলাম আমি—কাব্যতলা। তখন সেখানে একটা গাছ ছিলো—ছায়াময়। বেলাশেষে ওখানেই আমরা বসতাম। একসময় গাছটির কথা আশ্রমের মহারাজ মহোদয়ও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে একদিন কথা বলার সময় তিনি গাছটির কথা স্মরণে আনতে পারেনি। আশ্রমের মহারাজ মহোদয় এখন প্রয়াত, তার শান্তি কামনা করি।) প্রায় সবাই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহস দিলেন এবং এ জন্যে নিজেদের একটা প্রতিষ্ঠান দরকার হবে সেটাও উপলব্ধি করলাম। ভেবে দেখলাম, সাধারণ সামাজিক সংগঠনের নাম ব্যবহার করে পুরস্কার-পদক প্রদান করার চেয়ে ওজনধারী প্রতিষ্ঠানসদৃশ কোনো নাম ব্যবহার করলে লেখকরা বেশি সম্মানিত বোধ করবেন।
পুরস্কারের গুরুত্বও বাড়বে। শুরু হলো নাম নির্ধারণের পালা। সবাই আমাকেই দায়িত্ব দিলেন এবং বললেন, তোমার মতো করে সাজাও সবকিছু; দুএকটা প্রস্তাবনাও এসেছে ইতোমধ্যে। তিনচারটা নাম পকেটে নিয়ে ঘোরাঘুরি করার পরও তৃপ্তি পেলাম না, কাউকে দেখালামও না। যা হচ্ছে সব কিছু অত্যন্ত গোপনে, টেরও পায়নি বাইরের মানুষ। অবশেষে প্রায় পনের দিন খাটাখাটনি করে ভাবলাম—‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি’ রাখলে কেমন হয়? কথাটা ভাবতেই মনের ভেতরে দারুণ একটা আনন্দভাব জেগে উঠলো। বাংলাসাহিত্যের প্রথম নিদর্শন তো চর্যাপদ, সেটার ওপর ভিত্তি করেই রাখা হোক আসন্ন সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের নাম। মন থেকে দারুণ এক সায় পেয়ে গেলাম, এটাই হোক তবে নাম। চূড়ান্ত করে ফেললাম নামটি। কবি আসাদুল্লা কাহাফ সহ অন্যান্যদেরও দেখালাম—সবাই একবাক্যে নামটি অনুমোদন করলেন এবং আমরা ঠিক করলাম প্রতিষ্ঠানটির সংক্ষিপ্ত নাম হিসেবে ‘চর্যাপদ একাডেমি’ শব্দটিও কখনও কখনও ব্যবহার করবো। যার ফলে বিচিত্র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আমাদের জন্যে সুবিধা হবে। তবে মূল নাম ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি’ শব্দটাই থাকবে। এরপর কমিটি গঠনের জন্য চূড়ান্তভাবে আলোচনাপর্ব শুরু হয়। দুই বছরের জন্যে গঠন করা হয় ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে একজন মাত্র নারী কবি ছিলেন, নাম কুক্করিপা। তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির প্রথম সভাপতি নিবার্চন করা হলো একজন নারী। অর্থাৎ কবি নূরুন্নাহার মুন্নীকে সভাপতি, আমাকে মহাপরিচালক, কবি আসাদুল্লা কাহাফকে নিয়ন্ত্রণ পরিষদ চেয়ারম্যান, কবি দুখাই মুহাম্মাদ ও নন্দিতা দাসকে পরিচালক করে জেলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত হলো এবং ঘোষিত হলো সেই কমিটি। কমিটিতে কোনো উপদেষ্টা পদ রাখা হয়নি। ওয়ান মিনিটে মিষ্টিমুখ করার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আমাদের কার্যক্রম।
কমিটি ঘোষণার পর থেকে জেলাশহরে শুরু হয় নানান-রকম গুঞ্জন। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। কেউ বলে আমরা অমুক প্রতিষ্ঠানের বিরোধী, তমুক ব্যক্তির বিরোধী, ছয়মাসও কাজ করার মুরদ নাই; পদপদবির লোভে কমিটি হয়েছে, দুদিন পর আতশ কাচ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না; কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করা হয়—আমার কাছে অভিযোগ আসতে শুরু করে। বললাম—কারও কথায় কান না দিয়ে, কারও বিরোধিতা না করে, কারও সঙ্গে অযথা ঝগড়ায় না জড়িয়ে নিজেদের মতো কাজ করার চেষ্টা করুন। কাজেই আমরা প্রমাণ দেবো আমরা কী। সবাই সেটাই করলো। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় হয়ে উঠলো। ঘাম, শ্রম, মেধা এবং অর্থও ব্যয় করতে লাগলো। আমাদের যা টার্গেট ছিল তা বাস্তবায়ন হতে শুরু হলো। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম কর্মসূচি ছিলো—‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ ঘোষণা। দেশের চারজন লেখকের হাতে তুলে দিয়েছি আমরা সে পুরস্কার। আমাদের প্রথম আয়োজনটা হয়তো খুব বেশি বড় আকারের ছিল না কিন্তু ইচ্ছেশক্তিটা অনেক বড় ছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়া জীবন। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় ফোকাস মোহনা কার্যালয়ে। মুহাম্মদ মাসুদ আলম ভাই এবং আরিফুল ইসলাম শান্ত ভাইয়ের কাছে সে অনুষ্ঠানের জন্যে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা ও মানসিক সাপোর্ট পেয়েছি। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি প্রবর্তিত প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন: কবিতায় স্বপন রক্ষিত (মরণোত্তর), কথাসাহিত্যে শামস সাঈদ, গবেষণা সাহিত্যে নূরুল ইসলাম ফরহাদ এবং লিটলম্যাগ সম্পাদনায় কবি ম. নূরে আলম পাটওয়ারী। পুরস্কার অনুষ্ঠানের নিউজ দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক খোলা কাগজ, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন জাতীয় এবং প্রায় প্রত্যেকটি স্থানীয় পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ সহ চট্টগ্রামের প্রথম সারির পত্রিকাগুলিতেও আসে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির নিউজ। আমরাও দারণভাবে উৎসাহিত হই। পথ হাঁটতে সাহসী হয়ে উঠি। আস্তে আস্তে অনেকের সুপরামর্শ পেতে থাকলাম। ত্রুটি-বিচ্যুতিও কেউ কেউ ধরিয়ে দিতে লাগলেন। অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, অনেকে নতুনভাবে যুক্ত হলেন। কেউ আড়াল থেকে ষড়যন্ত্র করে, কেউ আড়াল থেকে সহযোগিতা করে; কৌশলে পথ চলায় এক মুহূর্তের জন্যেও মুখ থুবড়ে পড়েনি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি।
হাজারও ঝড়-ঝাপটার মাঝে, অপবাদ-অপদস্থপর্ব কাটিয়ে, ঈর্ষাকাতরদের ইয়ার্কি তামাশার ভেতরেও কার্যক্রম থেমে থাকেনি আমাদের। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পরিবারের সকল সদস্য এবং শুভার্থীর সহযোগিতা না পেলে আমাদের এতটুকু হাঁটা সম্ভব হয়ে উঠতো না। বিশেষত চাঁদপুরের স্থানীয় পত্রিকাগুলোর কাছে আমাদের ঋণ অনেক বেশি, অনলাইন পোর্টালগুলোও আমাদের দারুণভাবে সাপোর্ট দিয়েছে। সম্পাদক মহোদয়গণের স্নেহ-ভালোবাসা থাকার কারণেই চর্যাপদ সাহিত্যে একাডেমি খুব দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছুতে পেরেছে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। দেশের ঐতিহাসিক পত্রিকা দৈনিক সংবাদ, যুগান্তর, প্রতিদিনের সংবাদ, বাংলা টিভি, ফোকাস মোহনার ভিডিও ভার্সন সহ অসংখ্য প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রিক মিডিয়া চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির নিউজ কভারেজ করে আমাদের কার্যক্রমকে এগিয়ে যেতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে। তাদের আন্তরিকতার ঋণ পরিশোধ্য নহে।
চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার-২০১৯ প্রদানকালে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম বছরে আমরা অন্তত দুই বার পুরস্কার দেওয়ার চেষ্টা করবো। ০১. চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, ০২. চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি প্রদত্ত দোনাগাজী পদক (মধ্যযুগের কিংবদন্তি পুঁথিসাহিত্যিক, চাঁদপুরের কৃতিসন্তান কবি দোনাগাজীর সম্মানে)। সেটাও আমরা ছয়মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। ডিসেম্বর মাসের শেষভাগে আমরা প্রদান করেছি ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি দোনাগাজী পদক-২০১৯’।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রসুইঘর চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। দেশের সাতজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক এ পদক পান। কথাসাহিত্যে মনি হায়দার, গবেষণা সাহিত্য এএসএম ইউনুছ, কবিতায় অনু ইসলাম, সার্বিক সাহিত্যে মোস্তফা হায়দার, লিটলম্যাগ সম্পাদনায় কবি সুমন কুমার দত্ত, সংগীতে গীতিকার মোহাম্মদ ইউসূফ এবং বাচিকশিল্পে জেরিন সিঁথি পদক গ্রহণ করেন। তাছাড়া শিক্ষাখাতে বিশেষ অবদান রাখায় পথশিশুদের শিক্ষালয় আলোর দিশারী স্কুলকে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা, সম্মাননা গ্রহণ করেন আলোর দিশারীর শিক্ষক পূজা ও ফারিয়া। অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় চাঁদপুরের মাটি ও মানুষের সংস্পর্শে বেড়ে উঠা দৃষ্টিপাতের লেখক, বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কথাকার বিনয় মুখোপাধ্যায় ওরুফে যাযাবরকে। অনুষ্ঠান সূচনা হয় প্রখ্যাত গিটারিস্ট দিলীপ ঘোষের অসাধারণ গিটার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ রবিঠাকুর ও ডিএল রায়ের চমৎকার দুটি দেশের গান গিটারে তুলে পুরো অনুষ্ঠানকে তিনি ভিন্ন রকম নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন। বিনা-পারিশ্রমিকে এমন অসাধারণ সুরেলা বিকেল উপহার দিয়ে তিনি চর্যাপদ একাডেমি পরিবারকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন দিলীপ ঘোষ।
শুধু তাই নয়, তারও মাস কয়েক আগে অস্কারে মনোনয়নপ্রাপ্ত ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ ভট্টাচার্য্যকে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি গুণিজন সম্মাননা প্রদান করে। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয় রিভার কুইজিন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। এর বাইরেও চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির পারিবারিক অনুষ্ঠান ‘ফ্যামিলি ডে’ আয়োজন করা হয় এলিট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের স্বরচিত কবিতায় (উন্মোক্ত বিভাগে) ৪জন এবং স্বরচিত কবিতায় (বঙ্গবন্ধু বিষয়ক) ৩জন, সর্বমোট সাতজন কবির হাতে পুরস্কার-ক্রেস্ট, বই ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।
ফ্যামিলি ডে-অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। খাবার হিসেবে দেওয়া হয় চিকেন বার্গার এবং তাদের মাঝে কুইজ ও ছড়াপাঠের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রদান করা হয় পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় শিক্ষাসামগ্রী। পথশিশুরাও যে বিজয়ী হতে পারে, তারাও যে দেশ ও জাতি সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারে সেটাই জানান দেবার চেষ্টা করেছে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি।
অনুমান করি, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো—‘বই উপহার কর্মসূচি’। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত বই উপহার প্রদান করা হয় কি না, আমার জানা নেই। থাকলে ভালো হতো। তবে আমাদের কাজ দেখে অনেকেই এমন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে বটে কিন্তু সফল হননি। (কেউ কেউ পরামর্শও নিয়েছে এমন আয়োজন করার জন্যে। জানি না শেষপর্যন্ত তারা করতে পেরেছে কি না। তবে কোথাও তাদের সফলতার নিউজ চোখে পড়েনি) জেলার প্রতিটি উপজেলার স্কুলগুলোতে ঢুকে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কাছে ছুটে গিয়ে আমরা উপহার হিসেবে দিয়ে আসি বই। মাসে কমপক্ষে ১০০ শিক্ষার্থীকে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-ছড়া ও ভ্রমণকাহিনির গ্রন্থ তুলে দেই আমরা। সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে অন্তত ৫/৬জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার প্রদান করি। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিকই এ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয়, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আমরা বই উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি। পাশিপাশি দেশেবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সুধিজন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানেও আমরা বই উপহার দেই। জেলার পত্রিকা অফিসগুলোতেও চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি বই উপহার কর্মসূচি পালন করেছে।
ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাফুজ আনাম, জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এসডি রুবেল, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি আসলাম সানী, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং দৈনিক খোলা কাগজ সম্পাদক কবি কাজল রশীদ শাহীনু, চাঁদপুরের প্রশাসন কর্মকর্তাসহ অনেক গুণীজনের হাতে আমরা উপহার হিসেবে বই তুলে দিতে সক্ষম হয়েছি। এ যাবৎকালে প্রায় ২৮০০-এর অধিক বই উপহার হিসেবে দিয়েছে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি। আশা করি, বই উপহার কর্মসূচি নিয়মিত চলবে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে বইমুখী করতে, ফেসবুক আসক্তি হ্রাস করতে এবং মাদক ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে জাতিকে বই পড়ায় উৎসাহিত করতে হবে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হলে খারাপ কাজ থেকে সরে আসবে নতুন প্রজন্ম। সে প্রচেষ্টা নিয়েই আমরা অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছি।
কাঁধে বই নিয়ে ‘ছড়িয়ে দিতে বই, পথের মানুষ হই’—স্লোগান দিতে দিতে আমরা ছুটে যাই জনবিরল কোনো জনপদের স্কুলে, যেখানে সৃজনশীল ও মননশীল তথা শিল্পসাহিত্যের বই এবং পত্রিকা-ম্যাগাজিন পৌঁছুতে পারে না সহজে। শিক্ষার্থীদের বই দিয়ে আসি অনুষ্ঠান করে, কখনো কখনো সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও থাকে, বই সম্পর্কে এবং বইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে দুচারটা কথা বলে তাদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা দেওয়ারও চেষ্টা করি আমরা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিকক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যেন থালা-বাসনের পরিবর্তে বই পুরস্কার দেওয়া হয়, সে বিষয়ে শিক্ষকমণ্ডলিকে অনুরোধ করি। এক্ষেত্রে বিষয়োপযোগী একটি স্লোগানও ব্যবহার করা হয়—‘ফেসবুক ও পাঠ্যসূচির গণ্ডিতে আর নই, চর্যাপদের সঙ্গে থেকে পড়বো সকল বই।’
সময়ের প্রেক্ষাপটে কারও না কারও হাত ধরে তৈরি হয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান—চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিও সে রকম সময়েরই একটি ফসল। আমাদের হাতে শুধু বীণাটুকু আছে কিন্তু সেটা বাজিয়ে যাচ্ছে সময় তথা কাল, হয়তো বা মহাকালও হতে পারে।
সারাদেশে বই উপহার কর্মসূচি পালন করার ইচ্ছে আমাদের এখনো আছে। সবার আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে আমরা সেটাও বাস্তবায়ন করতে পারবো আশা রাখি। বাংলাদেশের মানুষ চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির বই উপহার কর্মসূচি দেখে যেভাবে অভিভূত হয়েছে, আশা করি সারা পৃথিবীর মানুষও একদিন অভিভূত হবে। আমরা আমাদের নিজেদের প্রচার চাই না, চাই বই হোক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতর উপহার, বইকে যেন কেউ ছোট করে না দেখে। বইই সেরা উপহার—এমন ধ্যানধারণা তৈরি হোক সবার মাঝে এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। একদিন প্রতিটি মানুষ যেন সগৌরবে বলে ওঠে—‘বই কখনো হয় না পর, বইয়ের সঙ্গে বাঁধবো ঘর; বইয়ের দিকে বাড়াও হাত, ঘুচে যাবে অন্ধরাত।’
একটা কথা স্পষ্টভাবে বলে রাখতে চাই, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি কারও বিরোধী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ধ্যানধারণাও অনুসরণ করে চলে না। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি চলে তার নিজস্ব গতি, আদর্শ ও ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে। আমরা প্রতিটি ভালো কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, প্রত্যেকের অর্জনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’—বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই চমৎকার উক্তিটি আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই ‘আদি এবং অন্তে সত্য ও সুন্দরে আছি’, থাকার চেষ্টাও করবো। কেউ আমাদের বিরোধী প্রতিষ্ঠান মনে করলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত দায়, এখানে আমাদের কোনো দায়দায়িত্ব থাকার কথা নয়। আমি মনে করি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি জেলার অন্যান্য সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান রেখেই এগিয়ে যাচ্ছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সৃজনশীল কাজের বিরোধিতা আমরা করি না, করবোও না। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-বিমবিষা সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোনো প্রতিষ্ঠান কারও একার নয়, প্রতিটি সদস্যই প্রতিষ্ঠানের সমান অংশীদার। সুতরাং কোনো ব্যক্তি বিশেষের ভালো-মন্দের দায় প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। সব সাহিত্য প্রতিষ্ঠানেরই লক্ষ্য একটাই, শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা। সবার উদ্দেশ্য একটাই, সুন্দরের বীজ সবর্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া। তাহলে বিরোধ থাকার তো প্রশ্নই আসে না। সবাই তো একই পথের পথিক, হয়তোবা চলার ধরনটা একটু আলাদা, হাঁটার গতিটা একটু ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য যে অভিন্ন।
গেলো ২০২০ সালটা ছিল অত্যন্ত কালো কাপড়ে মোড়ানো একটি বছর। অসংখ্য প্রিয়জন হারানোর বছর ছিল এটি। সারা পৃথিবী স্ববির হয়ে গিয়েছিল। এরপরও আমাদের কাজ থেমে থাকেনি। অন্তত চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ২০২০ প্রদান সফলভাবে প্রদান করতে পেরেছি আমরা। ২০২০ সালে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান সার্বিক সাহিত্যে কবি ও সম্পাদক জামসেদ ওয়াজেদ, কবিতায় কবি বীরেন মুখার্জী, কথাসাহিত্যে হামিদ কায়সার, গবেষণা সাহিত্যে জাহাঙ্গীর হোসেন, শিশুসাহিত্যে মকবুল হামিদ, সংগীতে আশিক কবির, বাচিকশিল্পে তানজিনা তাবাচ্ছুম, শিক্ষায় আজমল হোসেন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, প্রধান আলোচক ছিলেন কবি আসলাম সানি এবং উদ্বোধক ছিলেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান। এ অনুষ্ঠানটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমরা চেষ্টা করবো নতুন করে আরও একটি পদক চালু করতে। ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পদক’ চালু করার কথা ভাবছি আমরা। কারণ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কারণেই চর্যাপদের মতো মহামূল্যবান সম্পদের সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা। সুতরাং তাকে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্যে পরিণত হয়েছে এখন।
এই পর্যায়ে এসে কিছুটা আত্মপ্রসাদে ভুগি এই ভেবে যে, আমার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি’ এখন সবার কাছে অত্যন্ত আদরণীয় হয়ে উঠেছে। এ সফলতার ভাগ চর্যাপদ পরিবারের সবার প্রাপ্য, এখানে আমার চেয়ে তাদের ভূমিকা অনেক বেশি। তাদের রক্ত-ঘাম, মেধা-পরিশ্রম ও অর্থ-বির্সজন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। তাদের আন্তরিকতা এবং স্নেহ-ভালোবাসা না পেলে এতোদূর হয়তো আসতো না প্রতিষ্ঠানটি। শক্তিমান গিটারশিল্পী দিলীপ ঘোষ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন—‘চর্যাপদ একাডেমির প্রতিটা সদস্য এক একটা বুলেট। তাদের কর্মদক্ষতা দেখে আমি অবাক হই।’ জানি না, দিলীপ দার কথা কতটুকু সত্য কিন্তু আমি মনে করি তিনি মিথ্যে বলেননি।
রাষ্ট্র যেমন নিজের প্রয়োজনেই একদিন তৈরি হয়—সময়, ঘটনা এবং পারিপার্শ্বিতার ওপর ভিত্তি করেই এক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ঠিক তেমনিভাবে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনও তার নিজের প্রয়োজনে তৈরি হয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে কারও না কারও হাত ধরে তৈরি হয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান—চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিও সে রকম সময়েরই একটি ফসল। আমাদের হাতে শুধু বীণাটুকু আছে কিন্তু সেটা বাজিয়ে যাচ্ছে সময় তথা কাল, হয়তো বা মহাকালও হতে পারে।
২৩ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার, চাঁদপুর রোটারী ভবনে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি গিটারসন্ধ্যার আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিনোদন আমাদের মনকে প্রসারিত করে। সে কথা চিন্তা করেই আমরা এমন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা চাই চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি সব গণ্ডি ছাপিয়ে নিজস্ব একটি জগত নির্মাণ করে আপন মনে এগিয়ে যাক।
একদিন সবাই থাকবে চর্যাপদের সঙ্গে, এটাই বিশ্বাস করি।