মানুষ হবার অপরাধে
এই যে আমাকে দেখছ—
এখনো মধ্যরাতে চমকে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলি—
শুধু মানুষ হবার অপরাধে!
এখনো দুঃখ পেলে ডুকরে কেঁদে উঠি প্রিয়!
বাতাসের গায়ে কান পেতে শুনি অনেক অজানা শব্দ।
রাতের আঁধারে ঘাতকের চাবুকের নিঠুর প্রহার—
এখনো ঘুম কেড়ে নেয় আমার—
শুধুই মানুষ হওয়ার অপরাধে!
বুকের বামপাশে যে বেদনার শব্দ শুনি
তারই পাশে সমান্তরালে জল্লাদের উল্লাস শুনে
এখনো ক্রোধে ফেঁটে পড়ি
মানুষ হবার অপরাধে।
আমাদের ঘামে ও রক্তে ঘোরে যে চাকা
তার সাফল্যে আমাদের ভাগ নেই
আমাদের কথা নেই
আমাদের জীবন নেই
আমাদের আনন্দ নেই
আমাদের ব্যথা নেই
আমাদের অসুখ নেই
আমাদের সুখ নেই
আমাদের বাঁচা নেই
আমাদের স্বস্তির মরণ নেই
শুধু মানুষ হবার অপরাধে প্রিয়তমা
আমাদের আছে শুধু—
দীর্ঘকাল বেদনা বয়ে বেড়ানোর মতো প্রাণ
শৃঙ্খলে বন্দি হবার মতো এক জীবন
বিনা কারণে মরে যাবার মতো অফুরান সময়
অত্যাচারিত হবার ক্লান্ত নিয়তি
বঞ্চিত হবার বেদনার সাধ
শুধু মানুষ হবার অপরাধে প্রিয়তমা—
আমাদের ক্রোধ খেই হারিয়ে ফেলে
আমাদের পথে ধূলা জমে
আমাদের মগজে মরীচিকা পড়ে
তবুও জেনে রেখো প্রিয়তমা
যতবার জ্বলেছে মানুষের চিতা বিনা কারণে
ততবার পুড়েছি আমি
যতবার কবরে শুয়েছে মানুষ বিনা কারণে
ততবার জ্বলে উঠেছি আমি
শুধুই মানুষ হবার অপরাধে!
ডিস্টোপিয়া
পথের ধুলা উড়ে যায়, কার ছায়া পড়ে থাকে? কেউ জানে না কে কোথায় যায়! একটা ইঁদুরের চোখে সন্ধ্যা নামে। একটা সারস উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে, গত শীত রাতের কথা মনে করে একটানা একই সুরে ডেকে ডেকে একটা প্যাঁচা আরও খানিকটা আঁধার নামায়। রাত গাঢ় হয়। দূরে কার ঘর থেকে মরা কান্না ভেসে আসে বাঁশির করুণ সুরের মতোন। কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে থাকা পুকুরে পানি দেখা যায় না, মনে হয় ধোঁয়া ওড়ে শুধু। ধোঁয়ার নানামাত্রিক কুণ্ডুলী ও গতিপথের নানান মুভমেন্টকে নাচের মূদ্রা বলে ভ্রম হয়। একটা মাছ ঘাই মারলে বোঝা যায় এটা পুকুর! এস্রাজের মৃদু মৃদু সুর ভেসে আসে বাতাসে, সেই সুরে কান পেতে কার আওয়াজ ধরার চেষ্টা করে কে! এই রাস্তার শুরু কোথায়? পথের শেষে জেগে থাকে কে? চারিদিকের ধানক্ষেত থেকে পাকা ধানের ম ম গন্ধে কার নাভি খসে পড়ে জন্মের মতো! দূরে মহাকালের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটা বাবলা গাছ। সমান্তরালে বয়ে যাওয়া রেললাইনের আজন্ম সঙ্গী কাঠের স্লিপারের বুকে ঝরে পড়ে কোন গাছের আর্তনাদ! সঙ্গী পাথরের বুকে কার কান্না জমা হয় একটু একটু করে! এই পথ কোথায় গিয়ে শেষ হয়? কামারপাড়া? কামারপাড়ার বুকে কার কান্না শুকিয়ে মরে নিশুতি রাতের কাম নিয়ে!এই অন্তহীন রাতের আকাশে আজ কত তারা? কার বুকের হাহাকার নিয়ে লাশের মিছিল বাড়ে? কেন বাড়ে? কে কারে মারে?
নিশাত
(সঞ্জয় ভট্টাচার্য স্মরণে)
সকালে জেগে ওঠে যে মহাশূন্য,
আলোকের শূন্যতা—
তুমি তাতে খানিকটা পুড়ে এসো, নিশাত!
আরও খানিকটা বাদামী হও
তোমার চোখ হোক আরো কিছুটা বাদামি
চুল হোক ব্ল্যাকহোলের অন্ধকার।
আর মহাবিশ্বকে কলরবে জাগিয়ে রাখে যে আলো—
তোমার শরীরে লেগে থাক
সেই কলরবের সুর, স্বর ও স্বাদ
তোমার বুকে পাই যেন—
সেই বিহ্বল সঙ্গীতের অমৃত সাগর!
কতটা বিষণ্ন হলে গোধূলীর মতো—
স্নিগ্ধ হয় মানুষ!
কতটা অন্ধকার হলে ভাসা যায়
আলোর সাগরে-স্মরণে অমৃতে!
আলো কি ডাকে কাউকে, নিশাত!
নাকি ডুবে যেতে হয় তাতে?
অবগাহনে বুঝে নিতে হয় তার ভাষা?
যে ভাষার তীব্রতার সৌরভে চোখ বুজে আসে—
ঘুমে নয়, সৌরভে-স্নিগ্ধতায়-স্বপ্নে!
হিসাব
এখনো এখানে রাত নামে
হাওয়ায় দখিনা বাতাসে
চাঁদের কিরণে ছেয়ে যায়-মেঘ!
রাতের সুনসান নিস্তব্ধতা ছেয়ে জেগে থাকে লোকালয়
শূন্যতায়! ক্ষুধায়! মৌন ভালোবাসায়!
ঘরের খিড়কি খুলে জেগে থাকে কাম!
পাশে পড়ে থাকে ছায়া
আলোর পাশে প্রতিফলনের সাক্ষী হয়ে
আঁধারের প্রতিচ্ছবি রূপে।
কী বিরূপ বিরহে চলে যায় নাগর
রাতজুড়ে পথের হাহাকার বাজে
ডাগর ডাগর চোখের কোণে
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে!
কোন আলোয় লেগেছে নেশা
অন্ধ নেশা! বড্ড নেশা!
মানুষ জেগেছে কোন খানে
কোন নেশায়! মরণ দিশায়!
তোমারে রিক্ত করে পেট আর বুক ভরেছে যার—
তার নামে আর কত ঘোর নেশা!
আর কত আত্মলীন হওয়া!
দরদকে খুঁজে পাষানের পাশে
আর কত অমলিন হাসি!
এবার চোখ খোলো রাই!
বিরহ কাতরতা ভুলে
রাতের আঁধারে বন্ধ চোখে
আলোর রোশনাই ফেলে
জেগে ওঠো নতুন নেশায়!
ভালোবাসায় হিসাব বুঝে নাও
বেঁচে থাকবার!
এখানে সন্ধ্যা নামে
এখানে সন্ধ্যা নামে
তীরে ডোবে নদী।
রাত গভীর হয়—পাখির ডানায়।
হাওয়ায় মেঘে ভেসে যায়- জীবন।
জলের ঝাপটায় বেঁচে থাকে
বাঁচবার আকুল আর্তনাদ!
মৃত্যুর মড়ক লেগেছে য্যানো—বাতাসে।
করুণ সুরে ভেসে আসে
মানুষের বিলাপের স্বর।
শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিয়ে শিউরে ওঠে—ভয়।
আতঙ্কে ভুল হয়ে যায় চেনা পথ।
মরণের নেশায় কোথায় হারিয়ে যায়?
জন্মান্তরের ভালোবাসা!
তীব্র ঘৃণায় রক্তের নোনা স্বাদ ভুলে গিয়ে
মরণকে আলিঙ্গন করে—প্রিয়তম মানুষ।