তাহমিনা আসলে জানে না—ঠিক কী ঘটতে চলেছে তার সঙ্গে। তবে, ভাসা ভাসা জানে। অবশ্য ইচ্ছে করেই জানার চেষ্টা করেনি। অথবা বলা যায়, জেনেও না-জানার ভান করে আছে। কাউন্সেলিং রুমে তাদের অনেকক্ষণ ধরে অনেক কিছু বলেছে, বুঝিয়েছে। মাথায় ঢোকেনি কিছুই। ঢোকাতেও চায়নি।
শুধু রুস্তমের একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বউ, আমার বীর্য দিয়ে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। তোমার যখন এত শখ, আমরা যদি অন্যখান থেকে বীজ নেই, তোমার কি আপত্তি আছে? তোমার সন্তান মানেই আমার সন্তান, আমাদের সন্তান। তুমি মত না দিলে কোনোকিছুই হবে না। দেশে ফেরত যাবো। একমাত্র তোমার মতই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কথাগুলো যেন একনিশ্বাসে বললো রুস্তম। লম্বা করে দম নিলো একটা।
অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে তাহমিনা। বিদ্যা বলতে সেই অষ্টম শ্রেণি। তাও পাস করেনি। বিয়ে হয়ে গেলো বলে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। সুযোগ্য পাত্র পেয়ে হাতছাড়া করেনি তাহমিনার পরিবার। অনেক সহায়-সম্পত্তির মালিক রুস্তম। এক বাপের এক ছেলে। সন্তান হয়নি বলে রুস্তমের বা্বা বিয়ে করেছেন চারটা। সুন্নত পুরা করার পর, আল্লাহ মালিক মুখ তুলে চেয়েছেন। চার নাম্বার বিবির ঘরে রুস্তমের জন্ম। বীরযোদ্ধার নামে নাম রেখেছেন রুস্তম। কিন্তু ওই একটাই! রাহমানুর রাহিমের সুদৃষ্টি আর পায়নি রুস্তমের বাবা। দুই-দুই বারের মেম্বার, চেয়ারম্যান, টাকা-পয়সার কমতি ছিল না কোনো। শুধু একটাই আফসোস, সন্তান তার একজনই। প্রচলিত আছে চেয়ারম্যানের ভিটায় দাঁড়িয়ে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, যতদূর চোখ যায়, সব জমিন রুস্তমের বাবার। এছাড়া, আছে মাছচাষের পুকুর, বাজেমালের দোকান, কাপড়ের আড়ত। আরও কত কী! রুস্তম ঠিকঠাক মনে রাখতে পারে না। নায়েব ফজল উদ্দিন দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত লোক। সে-ই দেখাশোনা করে সবকিছু। চেয়ারম্যানের আর আগের মতো শারীরিক সক্ষমতা নেই। রোগেশোকে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। বামপাশটা অবশের মতো হয়ে শয্যা নিয়েছেন বহুদিন। তার অবশ্য এসব নিয়ে আফসোস নেই। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন অনেক দিয়েছেন। আয়ুও পেয়েছেন যথেষ্ট। কিন্তু এই বয়সেও নাতি-নাতনির মুখ দেখতে না পারার শোক তিনি কিছুতেই বইতে পারেন না। তার ছেলেটাও হয়েছে একটু ব্যতিক্রম। ঘাড়ত্যাড়া। আরে বাবা! এক বউয়ে সন্তান না হলে দশ বউ দ্যাখ। পুরুষ মানুষের বিয়ে করতে বাধা কী! তার কথায় দেশগ্রামের মানুষ যেখানে উঠে-বসে, অথচ নিজের রক্তের ছেলেকে তিনি একটা কথাও শোনাতে পারেন না। ‘নিজের রক্তের ছেলে’ এই কথাটা মনে পড়লে কোথায় যেন একটা ব্যথা চিনচিন করে অনুভূত হয়। কেমন যেন অস্বস্তিও হয়। চেহারাসুরত, স্বভাব-চরিত্র, চালচলন কিছুই তার মতো হয়নি। ছেলেটা একেবারে অন্যরকম। হয়। আসলে, নিজের চেয়ে নিজেকে ভালো আর কে চেনে? নারীজাতি হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রতারক জাতি। একবিন্দু বিশ্বাস করেন না তিনি নারীদের। নারীদের সবকিছুতে পাপ। এজন্য দোজখেও নারীর সংখ্যা বেশি হবে। তওবা, তওবা।
বুঝলা বউমা, এখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম যতদূর চোখ যায় সমস্ত জায়গাজমির ওয়ারিশান তোমার এই ছেলে, আমার পেয়ারের নাতি।
ছেলের বউ নিজেই পছন্দ করে এনেছেন চেয়ারম্যান। গরিবঘরের অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। চলাফেরা, স্বভাব-চরিত্র অত্যন্ত মিষ্ট। সংসারে গরিবঘরের মেয়েরা বেশি উপযুক্ত। মাথা নত থাকবে সবসময়। গলার স্বর থাকবে নিচু। গৃহস্থালি কাজেকর্মেও হবে সুশীলা। চেয়ারম্যানের তিন নম্বর বউ ধনীর মেয়ে। তার জ্বালাযন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে প্রতীজ্ঞা করেছেন, ধনীর মেয়ে আর নয়। মেয়েমানুষ হবে কাদামাটির মতো। যেমনে ইচ্ছা তেমনে সাইজ করা যাবে। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু এতগুলো বছর পরেও সন্তানাদি না হওয়া চিন্তার কারণ তো বটেই! তাবিজতুমার, কবিরাজি পথ্য কোনোকিছুরই অভাব রাখেননি তারা। সব নষ্টের মূল ওই ছেলে। সে কিছুতেই এগুলো নেবে না। বউকেও নিতে দেবে না। এইচএসসি পাস দিয়ে সে মহা শিক্ষিত হয়েছে! তাবিজতুমারে বিশ্বাস নাই। আসতাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! আরে, তাবিজ তো আল্লারই কালাম। পরিবারের সবার চাপে শেষ পর্যন্ত শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে রাজি হলো রুস্তম।
বাড়ি ফিরেই ঘোষণা দিলো, বউকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাবে। বাচ্চা হওয়ার চিকিৎসা করাতে। বেকুব আর কাকে বলে! চেয়ারম্যানের মতো বুদ্ধিমান লোকের এমন বেকুব ছেলে হবে ভাবাই যায় না। গ্রামেও শুরু হলো নানান ফিসফাস, কানাঘুষা। পুরুষমানুষ, এক বিবিতে বাচ্চা না হলে দশ বিবি নিবে। ইন্ডিয়া যাবার দরকারটা কী! তাছাড়া গ্রামের পীর-হুজুর, কবিরাজরা তো মরে যায়নি এখনো! এই তো সেদিনও মেম্বারের মেয়ের আটবছর পর বাচ্চা হলো কামেল পীরের পানিপড়া খেয়ে। এমন ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে কেউ বুঝিয়ে উঠতে পারলো না। রুস্তমের মা তো কেঁদেকেটে অস্থির। ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা শুনে তাহমিনা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। এই সবকিছু তো তারই দোষ। এত গুণীমানি আর ধনীর ঘরে বিয়ে হয়েছে তার মতো গরিবঘরের মেয়ের। রুস্তমও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তাকে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। অথচ সে একটা সন্তান দিতে পারেনি আজতক। স্বামী যদি আবার বিয়ে করে তাতেও কিছু মনে করবে না সে। মাঝেমাঝে ভালোমানুষ স্বামিটাকে পাগল বলে মনে হয় তার। কী যে সব বলে, বুঝে উঠতে পারে না তাহমিনা। বাচ্চা না হওয়ার সব দায়ভার নাকি রুস্তমের। তাহমিনার নাকি কোনো সমস্যা নাই। শহরের ডাক্তাররা কীসব বলে বুঝ দিলো, স্বামীর মাথা গেলো নষ্ট হয়ে। পুরুষমানুষের আবার দোষ থাকে নাকি!
এই শহরে এর চিকিৎসা নাই। ঢাকায় যেতে বললো সবাই। দু’চারদিন দৌড়াদৌড়ি করে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো, ঢাকায় না, একেবারে ইন্ডিয়া চলে যাবে। সেই থেকে তাহমিনার ছোট্টবুকের খাঁচার ভেতর পরানপাখিটা ধড়ফড় করছে। প্রতি ওয়াক্তের নামাজের মুনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়ে তাহমিনা। রাব্বুল আ’লামিন যেন তাদের জন্য সবকিছু সহজ করে দেন। বহন যোগ্যের অধিক ভার তিনি তো কাউকে দেন না! কাওসারের জন্য আর নিজের জন্য বারবার আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলো।
শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এমনভাবে তাহমিনার দিকে তাকাতো, যেন তাহমিনাই সবকিছুর জন্য দায়ী। এ কেমন বউ, যে স্বামীকে ভুলিয়েভালিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না!
চেয়ারম্যানের রঙচঙা পাকাবাড়ির সিমেন্টের উঠানে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে নতুন হাঁটতে শেখা তাহমিনা আর রুস্তমের ছেলে সোহরাব! হুইলচেয়ারে বসে নাতির কম্পিত পায়ে দৌড়ে যাবার দিকে তাকিয়ে গর্বে ভরে ওঠে তাঁর বুক। চোখে চিকচিক করে আনন্দের অশ্রু। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। তাহমিনাকে ডেকে কোলে তুলে দিতে বলেন আদরের একমাত্র নাতিকে। চুমোয় চুমোয় ভরে দেন সোহরাবের নিষ্পাপ ছোট্টমুখটি।
বুঝলা বউমা, এখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম যতদূর চোখ যায় সমস্ত জায়গাজমির ওয়ারিশান তোমার এই ছেলে, আমার পেয়ারের নাতি।
প্রশান্তির হাসি হাসে তাহমিনা।