বাঙালি নারীবাদ ও সিমন দ্য বোভোয়ার
সন্ধ্যার ক্যাফে বসে অথবা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত
সম্মেলন কক্ষে গোলটেবিলে
কথার খৈ ফোটে মেদবহুল রমণীর ঠোঁটে।
সুরার পেয়ালা নেচে ওঠে সাকির সুরে
আদিবাসী মনবন জেগে ওঠে সাংগ্রেইংয়ে
জোসনা রাতে আহত ম্যান্ডোলিনে সুর তুলে নীলকণ্ঠের কবি
পূর্বরাতে মেঘের সুরভি মেখে বৃষ্টিরেণু মুঠোপুরে
বজ্রপাতের উৎস খুঁজি
কবিতার খেরোখাতায় বিগত প্রেমিকারা নারী না মানুষ?
বৃষ্টি ভেজা বুকে ভোদকার উষ্ণতায় মস্তিষ্কের অনুরণনে
সিমন দ্য বোভোয়ার সুখছবি আঁকি।
নারিকেল জিঞ্জিরা থেকে সেন্টমার্টিন
প্রায় নদীর কাছে যেতাম রকে বসে গল্প হতো দু’জনে,
নদীর ঢেউয়ে জলের অতলে দেখি মীনের সংসার।
স্বপ্ন বুনি আগাম, অমনি বৃষ্টিহীন আচমকা বন্যার জোয়ার
স্রোতের টানে আমরা ভেসে গেলাম
রোদেলা শাড়িতে সে ডুবতে থাকলো,
স্রোতের বিপরীত সাঁতারে শাড়ি-ব্লাউজ-শার্ট-জিন্স-কেডস
সব খুলে আসীম আবেগে আদিম দু’জন।
কেয়া বনে নাফের চরে যখন ঘুম ভাঙলো
জোসনা ছিল আকাশে, আমরা আকাশ দেখলাম
জোসনায় কেয়ার সুরভি মেখে পাথুরে চরটি আমাদের হলো।
উলুখাগড়ার বেড়া,কেয়ার খুঁটি,
কাশফুলের ছাউনি ছোট্ট একটা কুটির আমাদের
প্রাগৈতিহাসিক সংসার।
এখানে নীল পদ্মপুকুর, মিষ্টি জল,
পুকুরপাড়ে জোড়া নারকেল গাছ
সাগরের লোনা হাওয়া,
ঢেউয়ের গর্জন পুকুরে সাগরে ডুব সাতারে
খিদে পেলে নারকেল তলায় বসে শালুক খেতাম।
বাইন গাছের ছায়ায় কেওড়া ফুলে
প্রজাতির উড়াউড়ি দেখতে দেখতে শুয়ে থাকি
সাগর মেখলা সঙ্গমে।
এমনি সময়ে ডিক্রি নিয়ে শ্বেতাঙ্গ এক নাবিক এলো,
আমরা হা করে তাকিয়ে রইলাম
হাত ও মুখের ইশারায় বললো ছেড়ে দিতে হবে স্বপ্নচর,
পাখিরা বিদ্রোহ করলো
নাবিক বাজ আঁকা পতাকা ওড়ালো
খুঁটি পুতলো আমাদের উদোম বুকে।
পিস্তল উঁচিয়ে শ্যেন দৃষ্টি ফেলে ডিক্রি জারি করে, ৎ
এখানে বিলাসী প্রাসাদ হবে।
দলবেঁধে আসবে মানুষ জমবে মেলা শীতে,
শৈবাল-নুড়ি-পাথর-কাছিম-শ্যাওলা
প্রেয়সীর প্রিয় উপহার
সেই থেকে স্বপ্নচর নারিকেল জিঞ্জিরা ভোগের আঁধার।
প্রেম
ইটখোলার চুল্লিতে পুড়ে খাক হ
আমি দিব্যি করিব সংসার
তোর বালতি ভরা অশ্রুজলে
আমি করিব স্নান
তোর সুন্দর চোখ তুলে মার্বেল করে
বানাব কানফুল, দেখবে লোকে ব্যতিক্রম
তোর প্রেমে পোড়া কলিজা ভুনা অনামিকা টুকরো
নানরুটি সাথে আমার উপাদেয় প্রাতরাশ
মাংস ছিল্লা হাড়ে গহনা-চুড়ি
বাইন্যা শিল্পে নতুন সংযোজন
তোর অকাল দেবদাস-প্রয়াণে লিখিব এলিজি
তোর সমাধিতে রোপিব দেবদারু
বিরহ ‘লালন’ রুশ্নি ছড়াবে মালবিকা।
মহিনের কন্যারা
ঢেউ জড়ানো পাতাদের সুরভী ছড়ানো
ঝাউয়ের গান শুনি
তীরে বসে উচ্ছল ঢেউয়ে বৃষ্টির খেলায় মুগ্ধ থাকি
মরুর ক্যাকটাস ফলের সাথে কাঁঠাল রসের
যৌগ রসায়নে উত্তপ্ত বুদ্বুদ বাজনা শুনি
জল জোসনায় ধীরলয়ে আসে জলপরি
আমি অপার হয়ে ছলচ্ছল হাসি শুনি।
তুমি কি দেখতে পাও সখি অদৃশ্যের দৃশ্য?
তুমি কি শুনতে পাও জলদেবের মেঘরাগ?
কখনো কি পান করেছ? অমৃতের ফলজ শরাব
নৃত্য করি না একা, গাই না কোনো গান একা
আমরা যে সমবেত সুফিয়ানা, ইসকে দিওয়ানা
আমাদের দেহ থাকে, কলব লুটে ঊর্ধ্বলোক
আরাফ আরসে মহিনের ঘোড়া ছুটে আসে মর্ত্যলোকে
সেই ‘ভেজা মেঘের দুপুরে’ মাহিনের কন্যারা
আর্তনাদের আদর্শ খেয়ে বাঁচে।
চিয়ার্স: অধরা অধরে নহর শুকায়
কত দিন
শ্রাবণের ভেজা সৈকতে ভিজি না
কিটকট চৌকিতে বসে বসে ইলিশ ভাজা সাথে দুচোয়ানির চিয়ার্স
শুধু একটি চুমোর অভাবে
হলো না
আষাঢ় গেলো, শ্রাবণ যায় যায়
জলধিকে সাক্ষ্য রেখে মুক্ত সৈকতে
অধীর আকাঙ্ক্ষায়
অধর শুকিয়ে যায়
কেউ নাই কেউ নাই
কেউ কাউকে কি চায়?
কথা ছিল মানকচু ছাতায় লুকাবে আমায়?
খালি পা, ভাঁটফুল, ঝাউবিথী
মাসির গরম পিয়াজু,
মাধুরি রাখাইনের দুচোয়ানি
থুড়ি থুড়ি চিয়ার্সির পিয়ারিতে
ঘোলাটে হবো চোখে ও মুখে
অধর শুকিয়ে যায়
আশায় আশায়
হলোনা হলোনা
তাবত দুনিয়া তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবো বলে
ভালোবাসার চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেবো বলে
অধরা অধরে নহর শুকিয়ে যায়।
আষাঢ়ের মন ঝরে তুমুল প্রতাপে
কে কার মন ছুঁয়েছিল সেদিন?
না তুমি, না আমি
মনের জানালা ঠাস ঠাস খুলে যায়
‘এমনি ঘনঘোর বরষায়’
টিনের চাল বস্তির শিশু কাকের বাসা বোঝে
আষাঢ়ের একগুঁইয়ে প্রতাপের মর্মফল আর আমি
প্লাবনে ভেঙেছে বেড়িবাঁধ ঝিরিতে খরস্রোত
আদিবাসী তরুণী জানে জুমের অঙ্কুরে কী যাতনা
ঐ শৃঙ্গটি আর কতকাল বইবে তোমার অবসর স্মৃতি
এখনো একটি শেকড় ঠেস দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে ধস
‘তুমি চলে এসো এক বরষায়’
এখন কোথায় মন ঘোর বর্ষায়।
শুভ্র পরীর শাসন
সাদা সাদা অ্যাপ্রোন জড়িয়ে আসে পরীর দল
মনরাঙা শুভ্র হাসি দেয় সুঁই হাতে
পরীক্ষার নামে কঠিন কোমলে সিরিঞ্জ ভরে
শুষে নেয় খুন।
ধবধবে সাদা পরীরা পথ্য দেয় যথানিয়মে
চোখ রাঙানো শাসন–তামাকের গন্ধ কেন?
আংকেল জানেন এটা হাসপাতাল?
এখানে ওসব চলবে না, ডাক্তারদের বলে দেবো
সাতশত এক নম্বর কেবিনে যায় না ঢোকা তামাকের গন্ধে।
আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও শাসিয়েছ শুভ্র পরীরা
জয়াকে হাত করে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে তারা
আমি ভাবি, এমন কঠিন কোমলের শাসন
কৈশোরে পেতাম শব্দ নিয়ে খেলা হতো না আর
তখন আমি হতেম রাষ্ট্রযন্ত্রের দাস।
ছাইস্বর্ণ অম্লজলে
ঈশ্বর সবাই দেখি লুটে পড়ে চেটেপুটে চাটছে
লুটিয়ে লুটতে চাটতে পারি না খাসলত গুণে।
দিয়েছ নুরের আগুন, শিখা তো ঊর্ধগামী উদ্বায়ী।
ব্রজপাত বর্ষণে ভেঙেছি বারবার, মচকাতে পারি না,
লুটাতে শিখিনি পিচ্ছিল এ নরাধামে,
পিছলে যাই বারবার, সুপ্ততায় গুপ্ত হয়েছি,
রেহায় মেলেনি তবু ছাইস্বর্ণ ভেবে অম্লজলে
জ্বালিয়ে জারণ করে ছেঁকেছে কড়াইয়ে।
অতপর জেনেছি
তুমি ও মানুষের এমনি স্বভাব।
জ্বলে বুকের স্বদেশ
সম্মোহন বিদ্যায় তাদের পারদর্শিতায়,
তুমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পান করেছ খ্যাতির শরাব। ঝলকের ঝিলিকে
বাসনার জলে–জালে জ্বলে রূপের নহর।
ক্লান্তির অবসাদে টলে পা,
ঝাঁজালো টক টক লোবানে মুখোরিত বাতাস
শ্বাস নিই বিষাদের।
মাকড়সার ইন্দ্রজালে পোকা মাকড় আটকে গেলে
যেমন করে, তোমাদের মগজেও
কিলবিল করছে বিশ্বায়নের মোহান্ধ আকাঙ্ক্ষা। তাই
তুমিও ইউরোপ আমেরিকার ইন্দ্রতান্ত্রিক আসক্তিতে উন্মাদ।
বাংলাদেশের ধড়িবাজ ফটকাবাজ দুর্নীতিবাজেরা এখন কানাডায়,
সুশীল সোসাইটির পৌরহিত্যের আসনে বসার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা।
উড়ো খবর আসে ঠিকই,
তোমার নাকি চারণ ক্ষেত্র তাদের মদ মাদুলির মাদুরে।
মোহ মোহরের ইন্দ্রজালিক বাসনায়,
কোনো কোনো জল জলসায় রূপের রোশ্নাই জ্বেলে জ্বালাও বুকের স্বদেশ।
নিঃসঙ্গ জোছনার মায়া।
সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে ধবধবে সাদা অন্ধকারে
রাস্তা ঘাট জলমহাল লক্ষ্যারচরের বিলসহ বিরান ভূমি
কোথাও কেউ নেই সুনসান ভুতুড়ে নীরবতা চারদিক
ক’দিন থেকে শুনিনি প্রতিদিনের কাকের ডাক
কর্কশ স্বরে ডাকা কাকও অনির্দিষ্টকালের জন্য ডেকেছে ধর্মঘট
আমাদের বাড়ির উঠোনের গাছে যে পাখিরা আসতো তারাও নাই
ঠিকই চাঁদ ওঠে জোছনা বিলোয়, জোছনায় আসতো মনসার কন্যারা
এই ভরা পূর্ণিমা তিথিকে মনেহয় মরাকাটালের জোয়ার হল্লা দিয়ে আসে
পাড়াকে মনেহয় ভূতগ্রাম ঘরগুলোকে মনেহয় ভুতুড়ে বাড়ি শব্দ শুনি
কোথাও কোনো মানুষ দেখি না
আমি জানালায় বসে আকাশ দেখি।