বাড়িটা ম-ম করছে খুব। নাক উঁচিয়ে ঘ্রাণটা টেনে নেয় ফেদি। মৃদু, চিকন সুরে ঘেউউউউ গান গায় আকাশের দিকে মুখ তুলে। কণ্ঠ উপচেপড়া আনন্দটুকু দারুণ ছন্দে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অদূরে হুটোপুটিরত সদ্য বিয়োনো গোটা পাঁচেক ছানাপোনা কান ফেলে শোনে, মা ফেদির এই আনন্দগীত। হুটোপুটি ছেড়ে দৌড়ে আসে সদলবলে। ফেদি শুয়ে পড়ে টান টান। তার ঝুলে পড়া, দুগ্ধভারে ফুলে ওঠা বানগুলোয় মুখ লাগিয়ে ছানাগুলো চুকচুক খায়, কুঁইকুঁই শব্দ তোলে সমস্বরে। মার আনন্দগীতে সঙ্গত ধরে তারাও। তৃপ্তিতে বন্ধ চোখে পড়ে থাকে ফেদি। মাঝে মাঝে জিব বের করে ছানাপোনাগুলোর গা-গতর চেটে সাফ-সুতরো করে, মাতৃস্নেহের উছল ধারায় ভিজিয়ে দেয় তাদের নধরকান্তি শরীর। এত যে খাদ্যের আকাল, ফেদির বানগুলো তবু দুধে টইটুম্বুর। ছানাপোনাগুলোর শরীরও চকচকে, দারুণ হৃষ্টপুষ্ট। গেলো বছর ও পাড়ায় এক সাহেব এসেছিল, সঙ্গে তার পোষা বিলেতি কুকুর টমও। দেখেই প্রেমে পড়েছিল ফেদি। ভুতোর সে কী রাগ তাতে! পারলে ফেদিকে কামড়ে, ছিঁড়ে খায়। বলে, হারামজাদি ফেদি, তোর ‘ক্যারেক্টার ঢিলা’! তুই একটা নচ্ছার মাগি!
ফেদি ওসব কানে তোলেনিন। তার মতো হা-ভাতে, হাড্ডিচর্মসার ফেদিকে যে বিলেতি সাহেব কুত্তা টম আদর করার ছলে কাছে ডেকেছে, সেই বলে তার কত জন্মের ভাগ্যি! সেখানে পাড়ার চা-দোকানে উঁচুস্বরে বাজানো ‘ক্যারেক্টার ঢিলা’ গান শুনে শেখা ভুতোর ওই মুখস্ত গালি পাত্তা দেওয়ার সময় তার কই তখন! আলস্যে, তৃপ্তিতে, বোঁজা চোখ আধেক খুলে ছানাপোনাগুলোকে আড়চোখে দেখে আনন্দে আবার খানিক ঘেউউউ গান গায় ফেদি। বাপের মতো দেখতে হয়েছে সবক’টা। পুরো বিলেতি একেকটা। ফেদি বা ভুতোর মতো হা-ভাতে, নেড়ি কুত্তার চেহারা নয় কারও। গর্বে বুক ফুলে ওঠে ফেদির। ভাগ্যিস, তাদের বাপ টম এসেছিল এই তল্লাটে, সাড়া দিয়েছিল ফেদির অমন উথাল পাথাল প্রেমে, নইলে কি আর এমন একপাল সাহেব কুকুরছানার মা হওয়া ভাগ্যে জুটতো তার!
এ তল্লাটে আছে শুধু হাড় জিরজিরে ভুতো আর ঠ্যাং ভাঙা টিকু। তাদের দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় ফেদির, প্রেম তো দূর অস্ত। নেহাত একা একা জীবন চলে না, তাই তাদের সঙ্গে মিল-মিশ করতে হয়, নইলে কে আর পাত্তা দিতো ওই বদখতদের! তাছাড়া টমটা ছিল দারুণ স্মার্ট, কত যে আদব-কেতা জানতো! ফেদির মতো নেড়ি কুত্তির সঙ্গেও সে কথা বলতো অতিশয় আদব-লেহাজ নিয়ে, সাহেবের ফটর ফটর ইংরেজি বোলে সাড়া দিতো কী যে দ্রুততালে! চলাফেরাও করত ভারি তমিজের সঙ্গে। অথচ এরা! অসভ্য সব। বেত্তমিজ একেকটা। রাগে গা জ্বলে ফেদির। এই মরার দেখে কেন যে জন্মাতে গেছিল সে! জন্মাতো যদি টমের মতো বিলেতে! আহা! আফসোসে বড় একটা ঘেউ তোলে ফেদি।
টমের জন্য মনটা তার ঘেউ ঘেউ করে এখনো। টম চলে গেলো। যাক। ছানাপোনাগুলো তো তবু আছে। চেটেপুটে ছানাপোনাগুলোকে জবজব ভিজিয়ে দেয় ফেদি। টমের স্মৃতিচিহ্নগুলো। আহা।
আম্বিয়ার আজ সারাদিন ভারি ব্যস্ততা। দম ফেলানোর ফুরসত নেই একদম। সুয্যি ওঠার আগে, অন্ধকার থাকতে এ বাড়িতে সেঁধিয়েছে সে, আজ এ বাড়িতে বিস্তর খানাপিনার আয়োজন, একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে তাকেই। একে তো গিন্নিমা গেঁটে বাতে কাহিল, তায় আবার আজ তার ধুমসি মেয়েটাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, হেঁসেলে ঢুকে মাঝে মাঝে তদারকি ছাড়া তিনি কিচ্ছুটি করছেন না আজ। আইবুড়ো মেয়েকে পাত্রস্থ করতে সকাল থেকে হলুদ বাটো রে, মেন্দি লাগাও রে, এটা আনো রে, ওটা ঘষো রে করতে করতে তেনার জান পেরেশান, হেঁশেলের ভার তাই আম্বিয়ার ওপর ছেড়ে তিনি নিশ্চিন্তে মেয়ের মুখের অম্যাবস্যা কাটিয়ে খানিক জোছনা ফোটানোর কসরতে মেতেছেন। আর আম্বিয়ার ওপর ভরসা করলে ঠকতে হয় না তাকে, জানেন তিনি।
উঠোনের কোণার দিকের দু পাশের দুই নারকেল গাছের সাথে খানিক উঁচুতে কাপড় শুকানোর দড়ি লম্বালম্বি টাঙানো। নিত্যদিনের ব্যবহার্য কাপড়গুলো তাতে সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি দোল খায় পলকা হাওয়ায়। মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে সেগুলো তুলে রাখে আম্বিয়া। কিন্তু আজ দিনটা অন্যদিনের মতো নয়। বিশেষ দিন। আজ আয়েশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, তেমন হলে কাজি ডেকে আজই কলেমা পড়িয়ে তার আইবুড়ো নাম ঘুচানোর চেষ্টা করা হবে, হাবে-ভাবে বুঝেছে আম্বিয়া। দড়িতে তাই অন্যদিনের আটপৌরে কাপড়গুলো নেই আজ। কোনো অদৃশ্য যাদুমন্ত্রবলে সেগুলো লুকিয়েছে রংচটা, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, বিষণ্ন মুখগুলো নিয়ে। বদলে সেই সকাল থেকে সেখানে ঝুলছে ঝা চকচকে গামছায় বাঁধা বহুবিধ সেদ্ধ মসলার পোঁটলা। সেই পোঁটলা থেকে ভুরভুর গন্ধ ছুটছে। সুযোগ পেলেই হারামি কুত্তি ফেদিটা তার ছানাপোনা নিয়ে এসে সেই সুগন্ধি পোঁটলার নিচে ঘেউ ঘেউ শব্দে বাড়ি মাথায় তুলছে যখন তখন। সেদিকে কড়া নজর রাখছে আম্বিয়া। কুকুর তার দু চোখের বিষ। নতুন বিয়োনো কুকুর আরও। বাচ্চাদের দুধ দিতে হয় বলে তাদের পেটে থাকে রাজ্যের খিদে। সে কারণে ছোঁক ছোঁক করতে থাকে দিনভর। চোখের সামনে যা পায় খেতে চায় রাক্ষসের মতো। সকালে গিন্নিমার কথা মতো সে বড় ডেগচি ভর্তি পানিতে পরিমাণ মতো পেঁয়াজ, রসুন, খোসা ছাড়িয়ে ফেলে সেগুলোর সাথে ধনিয়া, আদা, জিরা আর এমনতরো হরেক মশলা নিয়ে জ্বাল করেছে আধাঘণ্টাটাক। বড় ছাঁকনিতে ছেঁকে মশলাগুলো গামছায় পোঁটলা বেঁধে কাপড় শুকানোর দড়িটাতে লটকে রেখেছে দিনভর। সারাদিনমান সেই পোঁটলা থেকে গন্ধ ছাড়ছে ভুরভুর। সারা বাড়ি মশলার গন্ধে একাকার। এই মশলা পরে বেঁটে মাংস রান্না হবে। খাসির মাংসে আলাদা মশলা মাখিয়ে রাখা হয়েছে। সেই মাংসে এই বাঁটা মশলা যোগ হবে। তারপর হাঁড়িতে চড়ানো হবে মাংস। তাতে মাংসের স্বাদ হবে জব্বর। অনেকদিন লেগে থাকবে মুখে। পাত্রপক্ষ বহুদিন জিভের ডগায় নিয়ে ঘুরবে সে স্বাদ। ইচ্ছে হলেও ভুলতে পারবে না। ডেগচির মশলাসেদ্ধ সুগন্ধি জলটুকু গিন্নিমার কথামতো আম্বিয়া তুলে রেখেছে যত্ন করে। পোলাও রান্না হবে সেই জলে। তাতে পোলাও হবে অমৃত। পোলাওয়ের ঘ্রাণেই অর্ধেক রসনাতৃপ্ত হবে পাত্রপক্ষের। আজ তাই মোটে ফুরসত নেই আম্বিয়ার। এসব কাজে অবশ্য অন্যরকম এক আনন্দ হয় তার। সাথে কেমন একটা অ-সুখও গলার কাছটায় সুড়সুড়ি দেয়, চোখে এসে হামাগুড়ি দেয়। কান-মুখ লেগে আসে তখন। ব্যথা করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে চায় হঠাৎ হঠাৎ। সাবধানে চোখ মুছে নেয় আম্বিয়া। গিন্নিমা দেখলে আর রক্ষে নেই। বকে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবেন আম্বিয়ার। বলবেন, আমার মেয়ের এমন দিনে তুই চোখের জল ফেলছিস রে হারামজাদি! আমার মেয়ের অমঙ্গল ডেকে আনছিস!
আঁচলে চোখ মুছে, ফোঁৎ করে বাঁ হাতে সর্দি ঝাড়ে আম্বিয়া। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ময়দা ময়ান করতে বসে সে। গাওয়া ঘিয়ে ময়দাগুলো পেলব হাতে মাখে। পাশে ডেগি মোরগের মাংসে মশলা মাখিয়ে বড় পাতিল ভর্তি করে রাখা।। পাত্রপক্ষ আসার সাথে সাথে তাদের নাস্তা দেয়া হবে। ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর ডেগি মোরগের ঝাল মাংস। জিভে জল আসতে চাইবে দেখেই। দ্রুত হাত চালায় আম্বিয়া। আর বেশি দেরি নেই। পাত্রপক্ষ এসে যাবে। তার অবশ্য সব রেডি। এখন শুধু চুলোয় বসাবে একে একে। সমস্যা শুধু হারামজাদি ফেদি। সে তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ পেলেই যে কোনো একটা কিছু মুখে নিয়ে পালায়। আর কুকুর বড় নাপাক। গু খেকো জানোয়ার। ওয়াক থু। কোনো কিছুতে মুখ লাগালে সেটা ফেলে দেয়া ছাড়া গতি নাই আর। সে কারণে আম্বিয়ার অসতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই একদম। হারামজাদিটা সেই সকাল থেকে জ্বালিয়ে মারছে। না পেরে আম্বিয়া তাকে মুরগি আর খাসির বাতিল হাড়-হাড্ডি ছুড়ে দিয়েছে কতগুলো, খানিক আগে। ফেদিটা সেগুলো নিয়ে সরে গেছে আপোষে। ঘরের পেছনে বাচ্চাগুলো নিয়ে সেসবই চেটেপুটে সাবাড় করছে সম্ভবত। বাচ্চাগুলোর কুঁইকুঁই ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। ফেদিটাও একটু পর ঘেউউউ সুর তুলছে মনের আনন্দে। শুনতে পাচ্ছে আম্বিয়া।
খুঁজে পেতে সকালের দেড়খানা শুকনো বাসি রুটি আর খানিকটা টকে যাওয়া তরকারি দেন ইতুর হাতে। কড়া গলায় বলেন, যা। বাড়িত যায়া খাগা বসে। তোর মার এহন মেলা কাম। বিরক্ত করিসনে হেনে।
ভরা বর্ষার পদ্মা মাতাল, উন্মাদ। কী তার রূপ আর ছন্দ! নৌকার বৈঠা বাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে কানে বাজে ঢেউয়ের মাতাল গর্জন।বাতাসের শোঁ শোঁ আর ঢেউয়ের ছলাৎ-ছল মিলে যে নতুন ছন্দ ওঠে পৃথিবীর যে কোনো সঙ্গীত তার কাছে নস্যি। গলা ছেড়ে গান ধরে বিভু:
সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই
বল আমারে তোর কি রে আর কূল-কিনারা নাই
ও নদীর কূল-কিনারা নাই…
বিভুর গান আর পদ্মার ঢেউয়ের ছন্দ একাকার হয়ে হাওয়ায় মিশে যায়, অপার্থিব সঙ্গমে ভরিয়ে তোলে ভরা বর্ষার উন্মত্ত পদ্মার বুক। দ্রুত হাতে বৈঠা বায় বিভু। অপর প্রান্তে নুরুও বৈঠা বায় সমান তালে। ছৈ তোলা নৌকার ভেতর থেকে চেয়ারম্যান কফিল মুন্সি আর তার সাগরেদদল বের হয়ে গলুইয়ের অদূরের ফাঁকা জায়গাটায় গোল হয়ে বসে কী সব সলাপরামর্শ করে নিচুস্বরে, মাঝে মাঝে তাস পেটে, তখন হল্লা করে গলা খুলে। আকাশে মেঘ। ভারী। যদিও একপাশে সূর্য তখনও ঝকমকে ভীষণ। ভারী, কালো মেঘের ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে কেমন অদ্ভুত রঙধনু রঙে ঝিকিয়ে ওঠে, পদ্মার বিশাল বুকজুড়ে পাতা বিশাল ঘোলা আয়নায় তীর্যক হয়ে আছড়ে পড়ে তার প্রতিবিম্ব, গান ভুলে হঠাৎ অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বিভু। এমন অপার্থিব দৃশ্যে চোখ ভিজে ওঠে তার, বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট বিলি কাটে হঠাৎ। কেন, নিজেও জানে না সে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে অজান্তেই। আর তখনই উল্টোদিক থেকে ধেয়ে আসা ট্রলারটার দিকে চোখ যায় তার। ছোট্ট কিন্তু দ্রুতগামি। তারা যাচ্ছে উজানে। কিন্তু ট্রলারটা আসছে ভাটির দিকে। একে তো যন্ত্রের গতি তায় আবার ঢেউও তাদের অনুকূলে। সে কারণে ট্রলারটার গতি তাদের দ্বিগুণেরও বেশি। পলকে কাছে চলে আসে তারা, প্রায় নিঃশব্দে। ঢেউ আর বাতাসের গর্জন ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ গিলে ফেলে। বিভু বৈঠা চালাতে চালাতেই দেখছিল ট্রলারটাকে। অলস কৌতূহলে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎই চোখ আটকে গেল বিভুর। ট্রলারটার ভেতর থেকে মুখে গামছা পরা লোকটা বেরিয়ে এল দুম করে। ট্রলারের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে এল তাদের নৌকার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানফাটা গুলির শব্দে কানে প্রায় তালা লেগে গেল বিভুর। ট্রলারটা যেমন দ্রুত আসছিল তেমনই দ্রুত চলে গেল তাদের পাশ কাটিয়ে, প্রায় নাকের ডগা দিয়ে। সম্বিত ফিরল গলুইয়ের অদূরের ফাঁকা জায়গাটায় রক্তের গাঢ় দাগ আর কফিল মুন্সির সাগরেদদের চিৎকারে।
হতচকিত বিভু প্রথমটায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাকিয়ে থাকল সেদিকে। হাতের বৈঠা থেমে গেছে কখন, টের পায়নি নিজেই। কফিল মুন্সির শরীরটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বুক আর কপালের মাঝ বরাবর ছোট্ট দুটো ফুটো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। যেন তির বেরিয়ে যাচ্ছে ধনুক ছেড়ে। মুন্সির চোখদুটো বিস্ফারিত চোখে আকাশ দেখছে, পান খাওয়া ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে আছে, সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে লালচে সাদা দাঁত। সাগরেদগুলো চিৎকার করছে। একজনের হাত ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে গুলি। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে হাত বেয়ে। আরেকজনের পিঠে গর্ত। রক্ত। গুলি ভেতরে। কাটা মুরগির মতো মাটিতে পড়ে তড়পাচ্ছে লোকটা। ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে জনাতিনেক। প্রাণপণে উদ্দেশ্যহীন সাঁতরাচ্ছে লোকগুলো। বিভু চিৎকার করে ভয়ে, দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। নুরু উদভ্রান্তের মতো বৈঠা ফেলে ছুটে যায় মৃত কফিল মুন্সি আর তার আহত সাগরেদ লক্ষ্য করে। নৌকা ভাসতে থাকে দিকহীন। কালো, ভারী মেঘ ততক্ষণে সূর্যটাকে গিলে নিয়েছে পুরোপুরি। কফিল মুন্সির বুক আর কপালের সদ্যসৃষ্ট গাঢ় লাল ফুটো দুটোতে আকাশ জল ঢালছে মুষলধারে। শূন্যতা পূরণে প্রকৃতি উদগ্রীব ভীষণ।
মা!—শব্দটায় চমকে তাকায় আম্বিয়া। ইতু। শুকনো, বিষণ্ন, সারাদিনের না খাওয়া মুখ। সাতসকালে আম্বিয়া চলে এসেছে এ বাড়ি। বিভু গেছে এ বাড়ির কর্তার সাথে পদ্মার ওপারে, কোর্টে। হঠাৎ করেই মামলার শুনানির তারিখ পড়েছে আছে। চেয়ারম্যান কফিল মুন্সি তার চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে গেছেন হাজিরা দিতে। বিভুর নৌকা ভাড়া নিয়েছেন দিনকাবারি হিসেবে। রাতের পান্তায় মরিচ ডলে খেয়ে চলে গেছে বিভু, ইতুও পান্তাই খেয়েছে সেই সকালে। সারাদিন দানাপানি পেটে পড়েনি তার আর। ইতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আম্বিয়ার বুকের ভেতরটায় চৈত্র টাটায়। এত এত সুপাক, সুগন্ধি খাবার নিজ হাতে রান্না করছে সে দিনভর, অথচ ইতুর জন্য একমুঠো খাবার তুলে দেবার সাধ্যি তার নেই।
কী রে মা? তুই হেনে কী কামে আইচিস?
যবর খিদে লাগেচে মা। কী খাব?
তুই হেনে দাঁড়া ইটু। দেহিস ফেদি যিনি কিচুত মুক না দেয়। আমি গিন্নিমাক ডাহে আনি।
ভয়ে ভয়ে গিন্নিমার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আম্বিয়া। অপরাধীর মতো নিচু, কাচুমাচু মুখে ইতুর জন্য কিছু খাবার প্রার্থনা করে। মুখ ঝামটান তিনি বিরক্ত হয়ে। ইতুর এ বাড়িতে যখন তখন আসাটা একদম পছন্দ নয় তার। এইসব গরিবগুলোকে হাড়ে হাড়ে চেনেন তিনি। জাত হারামি এগুলো। চোরের চোর। সুযোগ পেলেই এটা ওটা নিয়ে সরে পড়ে। জিগ্যেস করলে স্বীকার পর্যন্ত করে না। আর এই আম্বিয়া তার অগোচরে কত কত খাবার তার মেয়ে আর স্বামীর জন্য পাচার করে প্রতিদিন তার ঠিক কী! রাগে গজগজ করতে করতে মেয়ের পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরে আসেন তিনি। খুঁজে পেতে সকালের দেড়খানা শুকনো বাসি রুটি আর খানিকটা টকে যাওয়া তরকারি দেন ইতুর হাতে। কড়া গলায় বলেন, যা। বাড়িত যায়া খাগা বসে। তোর মার এহন মেলা কাম। বিরক্ত করিসনে হেনে।
আম্বিয়ার মুখের দিকে একটু তাকায় ইতু। তার কচি, কোমল মুখটায় হতাশা চলকে ওঠে, গলার কাছটায় কান্না বলকে উঠতে চায়। সেদিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় আম্বিয়া। বলে, মা রে, বাইত যাও। আমি লাত্তিরি তুমার জন্যি গোস্ত-বাত নিয়াসপোনে, খেয়ানে সেহন। আমার সুনা, যাও।
ফেদি ছানাপোনা নিয়ে দৌড়ে যায় সেদিকে, গামলার খাবারগুলো ফেদি আর তার ছানাপোনাদের নাকে সুবাসিত হয়ে ওঠে আরও। ততক্ষণে বিভুর নৌকা এসে ঘাটে ভিড়েছে।
একবার মার দিকে আরেকবার গিন্নিমার কঠিন, রাগ-গনগনে মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ছোট করে চলে যায় ইতু। তার লোভাতুর, ক্ষুধার্ত চোখ রান্নাঘরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা তারই মায়ের হাতে তৈরিকৃত খাবারগুলো থেকে সরতে চায় না, ভিজে যেতে চায় জলে, ঝাপসা হয়ে আসতে চায় ক্রমশ। ছেড়া ফ্রক, খালি পা, উস্কখুস্ক চুলের ইতুর অপসৃয়মান ছায়ার দিক থেকে ঝাপসা চোখ সরিয়ে গিন্নিমার দিকে পেছন ফিরে বসে আম্বিয়া। গিন্নিমার মেয়ের আজ বিয়ে। আম্বিয়ার চোখের জল আজ বড় বেমানান, অযাচিত এ বাড়িতে।
সন্ধ্যানাগাদ পাত্রপক্ষ এসে যায়। তড়িঘড়ি তাদের জলখাবারের আয়োজন করে উপস্থিত আত্মীয়স্বজনেরা। ঘিয়ে ভাজা পরোটা, ঝাল মুরগির ঠ্যাং আর এমনি বহুবিধ সুবাসিত খাবারের গন্ধে আরেকবার জেগে ওঠে সারা বাড়ি। ফেদি আর তার ছানাপোনারা ফেলে দেয়া হারগুলো চেটেপুটে খায়, তাদের আনন্দ কোলাহল পাত্রপক্ষের হল্লা ছাপিয়ে যায়। বিভুর নৌকা তখনও চেয়ারম্যান আর তার সাগরেদদের নিয়ে ঘাটে এসে পৌঁছায় না। প্রাত্রপক্ষ অস্থির, অধীর হয়ে ওঠে। পাত্রী পছন্দ হয়েছে তাদের। রাতও বাড়ছে। তারা আর অপেক্ষা করতে চায় না। কিন্তু চেয়ারম্যান কফিল মুন্সি না আসা পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়, এ নিয়ে বচসা চলে তুমুল। ভেতর বাড়ি থেকে গিন্নিমা বলে পাঠান পাত্রপক্ষ আগে তাদের রাতের খাবারটা খেয়ে নিক, ততক্ষণে নিশ্চই মুন্সি এসে পড়বেন, তখন বিয়ের বন্দোবস্ত করা হবে, আর না হলে তখন বিকল্প চিন্তা করবেন তিনি। পাত্রপক্ষ শান্ত হয় অগত্যা। নাক ডুবিয়ে খায় তারা। গলা পর্যন্ত গেলে। বিভুর নৌকা আসে না তখনও। আম্বিয়ার বুকের ভেতর কালো মেঘ জমে যায়। শ্রাবণ। ইতুর মুখটা মনে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি, হতাশা, বিভুর তখনও না ফেরার দুশ্চিন্তা তাকে অস্থির করে তোলে। মরিয়া হয়ে সে গিন্নিমার সামনে গিয়ে ভীড় ঠেলে দাঁড়ায়। বলে, অ গিন্নিমা! আমাক কয়ডা খাবের দেন। আমি ইতুর জন্যি দিয়াসি। উয়োর বাপের তো এহনও আসার খবর নাইকো। ছেড়িডার খিদে লাগেচে যবর।
চেয়ারম্যান কফিল মুন্সির বউ, আম্বিয়ার গিন্নিমা, বেকুব আম্বিয়ার এই অবিবেচক আচরণে রেগে আগুন হয়ে ওঠেন। বাড়িভর্তি অতিথি, বরপক্ষের লোকজন, তার মধ্যে চেয়ারম্যান কফিল মুন্সির তখনও না ফেরার দুঃশ্চিন্তা, সবকিছু একা সামাল দেয়ার হ্যাপা, আর তার ভেতর আম্বিয়ার এই তুচ্ছ, সামান্য একটা ব্যাপারে তাকে বিরক্ত করার ছোটলোকি স্বভাবে বিরক্ত, ক্রুদ্ধস্বরে তিনি ধমকে ওঠেন, এই কি তোর আইক্কেল রে আম্বিয়া? দেকতিচিস আমার কতবড় বিপদ যাতেচে, তার মুদ্দি তুই আইচিস জ্বালাবের? তোর সুময় অসুময় জ্ঞিয়ান আল্লা কবে দিবি ক দিনি?
আম্বিয়া কুঁকড়ে ওঠে সংকোচে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, ছেড়িডার যবর খিদে লাগেচে মা। সেই কহন খায়চে…
বিরক্ত গিন্নিমা ওঠেন অগত্যা। গামলায় খানিকটা পোলাও, মাংস তুলে ধরিয়ে দেন আম্বিয়ার হাতে। কণ্ঠে ব্যস্ততা নিয়ে বলেন, দিয়েই চলে আসপি। বাড়িবরা লোকজন, মেলা কাম পড়ে আচে, দেরি করিসনে কিন্তুক।
আমি এই যাব আর আসপো মা। ইটুও দেরি হরবোনানে।—আম্বিয়ার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা উপচে পড়ে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। দ্রুত হাঁটে। ঘুটঘটে অন্ধকার। ইতুর না খাওয়া মুখ আর বিভুর তখনো না ফেরার দুঃশ্চিন্তায় অন্যমনস্ক আম্বিয়া, দেখতে পায় না কিছুই প্রায়। তবু প্রতিদিনের চেনা পথ। হাঁটে অভ্যস্থতায়। হঠাৎ ফেদিটা পেছনে ঘেউউউউ করে ওঠে। চমকে ওঠে আম্বিয়া। চমকে হাত থেকে ছিটকে যায় খাবারের গামলা। ফেদি ছানাপোনা নিয়ে দৌড়ে যায় সেদিকে, গামলার খাবারগুলো ফেদি আর তার ছানাপোনাদের নাকে সুবাসিত হয়ে ওঠে আরও। ততক্ষণে বিভুর নৌকা এসে ঘাটে ভিড়েছে।