বর্ধিত শূন্যের কঙ্কাল
এই যে তোমরা এখন যেখানে খেলছ শব্দভোর খেলা,
সেখানে একদিন আমিও দাঁড়িয়েছিলাম।অপেক্ষায় ছিলাম—
একটি আলোময় সূর্যের, অমাবস্যা পার হওয়া রাতের
কিনার ভেদ করে জেগে ওঠা নদীচরের, আর মুক্ত বাতায়নের।
যে জানালায় আছড়ে পড়বে রোদ,
যে কার্ণিশে ছটা ছড়াবে বর্ণের বিভা
আমি সেই আকাশকে তুলে রাখতে চেয়েছিলাম হাতের তালুতে।
অভিবাসী সান্ধ্যচাদর গায়ে জড়িয়ে নিবারণ করেছিলাম শীত,
আর বলেছিলাম বসন্ত আসবে, ফুটবে ফুল।
প্রজন্ম হে! শতফুল হয়ে তোমরা আজ যারা এখানে
পড়ছ বাংলা কবিতা,
যেখানে গাইছ রবীন্দ্রনাথের গান—
কিংবা নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ভাঙতে চাইছ
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’—
আমি সেই দিনটির অপেক্ষা করেছি যুগের পর যুগ।
নিউইয়র্কের জাতিসংঘ চত্বরে
কাঠ-রশি দিয়ে নির্মিত শহীদ মিনারের বেদিতে
তাজাফুল ছড়িয়ে দিতে দিতে শুধুই তাকিয়েছি
ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতের দিকে। বরফ পড়ছে,
উড়ছে তুষার। আর সেই তুষারেই জমা রাখতে চেয়েছি
আমার পদছাপ। আমার হস্তরেখার বিভাজিত বিন্যাস।
বর্ণবিদ্যার পূর্ববিদ্যা
হাত নেড়ে অস্তিত্ব জানানোর পরই পৃথিবী জেনে যায়
নতুন কেউ এসেছে। এসেছে আগামীর পথিক। এসেছে—
আগামীর শিক্ষক। যে এই ধরাধামকে শেখাবে বর্ণবিদ্যা,
শেখাবে অক্ষরের কলা। জানাবে মাটি দিয়ে ছবি আঁকার
কৌশল, কিভাবে চাঁদ জড়ায় নদী—সেই ইতিবৃত্ত।
যে কারিগর এখানে সাজিয়ে রেখেছিলেন বিদ্যার সম্ভার
তার সাথেই কবি সেরেছিলেন ইতিহাসের প্রথম পর্যটন
জেনেছিলেন ভূগোলের ব্যাখ্যা,কিংবা মেঘমহিমার ঝড়খণ্ড
পেরিয়ে এসে জানিয়েছিলেন,বিজলী কথা বলে কোন ভাষায়!
আমি সেই ভাষার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি দেশ-মহাদেশ
কোনো সূচিপত্র না সাজিয়েই উল্টিয়েছি পুস্তকের পর পুস্তক
কিছু কি লিখতে চেয়েছিলাম!না কি বলতে চেয়েছিলাম কিছু!
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রকাশ করেছিলাম যে
কান্না, তা-ই কি ছিল না আমার একান্ত বার্ণিক বিনয়!
শতকের শব্দগ্রাম
ভোরটুকুর দখল ছেড়ে দিচ্ছে আমাদের রক্তে লেখা
ভাষার সংগীত! যে পৌষ আমাদের শিয়রে বসে
শোনাতো পোষাপাখির বিরহগাঁথা;
. সে ও আজ সুদূর নির্বাসনে—
আমরা একা হয়ে যেতে যেতে সম্বলহীন পথের কাছে
. কেবলই খুঁজছি গন্তব্যের দিশা।
আমাদের ডিজিটাল চোখ এখন আর পড়তে পারে না
পত্রের প্রেম! আমাদের কর্ণযুগল এখন আর শুনতে
চায় না পাতার বাঁশির আওয়াজ!
একটি নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে, যে প্রাণে জাগতো
মাঘের ঢেউ; সেই নদীও এখন দেখায় কেবল কঙ্কাল!
আমাদের সবুজ মাঠের ঠিক মধ্যিখানে
যে গ্রামীণ টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে,
. তার দিকে তাকিয়েই আমরা
দেখতে চাইছি সেই শতকের শব্দগ্রাম—
যেখানে মা একদিন উঁকি দিয়ে অপেক্ষা করতেন
. তার খোকার।
মানুষের বিশ্বাসের ভাষা
মানুষের জীবনে অনেকগুলো পথই অসমাপ্ত
থেকে যায়।অদৃশ্য থেকে যায় অনেকগুলো সূর্য।
রাত কিংবা দিন পেরিয়ে যেতে যেতে সঞ্চয়ে
জমা হয় অনেক উষ্ণতা, শীত, অর্জন এবং বিসর্জন।
অনেক সাঁকো মানুষকে কাছে ডাকে। আবার অনেক
সেতুর কাছে যায় মানুষ।গিয়ে বলে নিজের জীবনের
গল্প।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষ, দক্ষিণে প্রবাহিত নদী—
বুঝে মানুষের ভাষা। সমব্যথী হয়। দরদে দরদে উড়তে
থাকে প্রতিবেশী ঝড়ের পতাকা। একটি পাখিও ওড়ে।
অক্ষরে অক্ষরে ছেয়ে যাওয়া আকাশ পেরোতে পেরোতে
পাখিটি বলে যায়, মানুষের বিশ্বাসের ভাষা
. এক ও অভিন্ন চিরকাল দ্বীপে-দ্বীপে, তাঁবুতে তাঁবুতে।
সংঘবদ্ধ শব্দের হরিণ
ডাক দিচ্ছ, নামে কী বেনামে! ডাকছো কাছে
আবার ঠেলে দিচ্ছ দূরেও। শেখাচ্ছ স্বরে-অ, স্বরে-আ;
বিদ্যাপতির হাতের আঙুলগুলো ধার করে লিখাচ্ছ
কবিতার কঠিন শব্দাবলি।
পৃথিবীতে প্রথম শব্দটি হচ্ছে, ভূমিষ্ট শিশুর পদাঘাত।
প্রথম ধ্বনিটি হচ্ছে তার কান্না। আর প্রথম আকাশ
হচ্ছে তার চাহনি।
আমি মানুষের চোখে চোখেই আজীবন খুঁজেছি
সংঘবদ্ধ শব্দের হরিণ;
বনজ প্রান্তর, ঠিক তোমার মতোই আমাকে ডেকেছে
বার বার। আর আমি হাত বাড়িয়ে—
শুধুই ছুঁতে চেয়েছি সর্বময় বর্ণের গহীন।
জীবনের ছায়াশব্দ
একটি জীবন ছায়ার কাছে জমা
অন্য জীবন হাতে নিয়েই ঘুরি
ভয়েই থাকি এই বুঝি হায়, এখন
আকাশ থেকে খসে পড়লো ছুরি!
যাচ্ছি কোথায়, গন্তব্য নেই জানা
তবু বলছি, আছি—ভালোই আছি
অনেক ভুলের খেলনাগুলো হাতে
রাত্রি-দিনে খেলছি কানামাছি!
এমন জীবন কে চায়! বলো কবে—
মানুষগুলো হারিয়ে গেলো কোথায়
রাজ্যে যারা দখলদারি করে—
শাসায় তারা; কালের প্রজা-প্রথায়!
যে নগরে ভাষার উচ্চারণে
দাঁড়িয়ে মানুষ রক্ত দিয়েছিল
কোথায় দ্রোহ, বজ্রকণ্ঠ আজ
এত আলো, কোথায় হারিয়ে গেলো!
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
কিছু আকাশ পকেটে না থাকলে,
শূন্য হয়ে পড়ে সঞ্চয়।
কিছু মেঘ উড়িয়ে দিতে না পারলে
সার্থক হয় না মানুষের পাখিজনম।
আমি মানুষের বন্দীত্বের বিপরীতে আজ
লিখে যাচ্ছি পাখিত্বময় পৃথিবীর গল্প।
যে গল্প পড়ে একদিন আগামীর মানুষেরা
জানবে, কত বেদনায় উড়ে গিয়েছিল প্রাণ,
ইয়ামেন সীমান্তে পড়ে থাকা শিশুর দেহ থেকে।
কিছু নদীকে রক্তকোষ ফিরিয়ে না দিলে,
অনুমান করা যায় না জলের গভীরতা।
কিছু পর্বতের চূড়ায় না উঠতে পারলে,
উদ্ধার করা যায় না গিরি’র চৌহদ্দি।
প্রতি চার বছর পর পর যে দিনটি আসে,
কিংবা প্রতি শতাব্দী পর পর জন্ম নেয়
যে মহামানুষ—
তাকে বরণউৎসবে আকাশও জমিয়ে রাখে
কিছু ভিন্ন আভা,
এই যে রোদটুকু দেখছ, আমি তার ঠিক
মধ্যিখানে দাঁড়িয়েই চিত্র আঁকতে চাইছি
সেই অনাগত ভোরসমগ্রের।
বুকসেলফে সাজানো সুরদক্ষিণা
স্তরে স্তরে সাজানো অক্ষরের মাঝে জ্যোতি
. ছড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও কিছু আলো এসে সাজাবে এই ঝাড়বাতি;
সেই প্রত্যয়ে গান গাইছে একটি সবুজ পাখি।দরজার
চৌকাঠ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাতামহী, হাতে তার
. দুটি জবাফুল।
বৃষ্টিতে ভেজা জবাফুলের রঙে আমি মিশিয়ে দিয়েছি
আমার সঞ্চিত পঞ্চাশটি বৈশাখ। আর—
বাকিগুলো খুব গৌরবে ভাসিয়ে দিয়েছি
. সুরমা’র এলোমেলো জলে।
আবার শুদ্ধ হবে মাটি, আবার শুদ্ধ হবে মানুষ—
যারা মোমবাতি হাতে পথে দাঁড়িয়ে আছে;
তাদের দিকে কেউ এগিয়ে দেবে
. একটি সতেজ দিয়াশলই
এমন গীতিকবিতায় আমি গেঁথে যাচ্ছি সুরের দক্ষিণা—
জানি এই বিশ্বকে একদিন শাসন করবে,
. একটি বৈশাখি পাখির আলোকিত ডানা।
উদ্ভিদের উত্তরাধিকার
খুব শক্ত হয়ে উঠবে একদিন নরম মাটি দিয়ে
বানানো খেলনা। সানকিতে পৃথিবীর সুন্দরতম
জলভাতে হাত রাখতে রাখতে আমি তাকাবো
সুরেলা চঞ্চুর দিকে। তোমাকে বলবো, চলো—
একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি। একসাথে জোসনার শরীরে
মিশে যেতে যেতে—
. উদযাপন করি বৈশাখি চাঁদের উদারতা।
খুব শক্ত হয়ে উঠবে একদিন আমার হাতের মুঠো।
তোমার আঙুলগুলো ছাড়াতে না পেরে,
তুমি আমার দিকেই সমর্পণ করবে তোমার ভার!
আমি তা বহন করতে করতে ক্রমশ
. এগিয়ে যাব নদীর দিকে। একটি নবীন ঢেউ
জমাট উদ্ভিদগুলোর শিকড়ে আঘাত হানতে হানতে
আমাদের শিখিয়ে যাবে উত্তরাধিকারের ভিন্নসূত্র;
বলবে, দীর্ঘ ভাঙনের বিপরীতেই গড়ে উঠে
. দ্বৈত প্রেমের বসতি।
বাদককে যেদিন ওরা হত্যা করে ফেললো
সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেলো একটি অ্যাম্বুলেন্স। নিয়ে গেলো
একটি দেহ, একটি ভাঙা গিটার—আর একটি পুরনো স্বরলিপির
খসড়া। নিয়ে গেলো কিছু ভাংতি পয়সা। ওজনহীন মধ্যরাত।
পাতালরেলের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে যে লোকটি বাজনা বাজাতো,
সে আজ আর সেখানে নেই। জায়গাটি ফাঁকা পড়ে আছে। একটি
চড়ুই, মাটিতে ঠোকর দিয়ে কুড়াতে চাইছে পুরনো খুদদানা।
একজন কাগজওয়ালা পাশে দাঁড়িয়ে বিলোচ্ছে ফ্রি দৈনিক।
বাদককে ওরা হত্যা করে ফেলেছে—সংবাদটি পড়তে পড়তে
ব্যক্তিগত প্রহরীদের দিকে তাকাচ্ছেন, নগরের মেয়র।
অস্ত্রনিষিদ্ধকরণ আইনের প্রাথমিক বিবেচনা, তার টেবিলে
পড়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। পারমানবিক অস্ত্রব্যবসায়ীদের সাথে
মিটিং-এর আবার তারিখ চাইছেন মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধান।