শব্দের প্রেমে যে পড়েছে একবার, সেই মরেছে! সেই শব্দ-প্রেমিকের উদ্ধার নেই যে আমৃত্যু। সে তো লিখবেই, কিভাবে লিখবে, কত বিরামে লিখবে, না কি মনে ভাব উদয় হওয়ামাত্রই প্রসবে কাতর হবে, সে প্রশ্ন একদিকে যেমন অবান্তর, অন্য দিকে খুবই জরুরি। একদা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে,
নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ
কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।
যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ॥
এই বক্তব্যের আলোকে যেকোনো সৃষ্টিশীল রচনার স্রষ্টা যদি প্রেরণাবাদে বিশ্বাসী হয়, তাহলে তো প্রাসঙ্গিকভাবে বলাই যায়, যখন যে কথা যেভাবে মনে আসে, সে কথা সেভাবে লিখে ফেলা উচিত। তবে, কোনো রকম সম্পাদনা ছাড়াই সে রচনাটি প্রকাশ করা উচিত কি না, সেটিই প্রশ্নের উদ্রেক করেছে এবং বিষয়টি আলোচনার যথেষ্ট অবকাশও আছে।
প্রেরণাবাদে অবিশ্বাসী স্তেফান মালার্মে অবশ্য অন্য কথা বলেছেন। প্রতীকীবাদী এই ফরাসি কবিকে গুরু মেনে তিরিশের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘মালার্মের কাব্যাদর্শ আমার অন্বিষ্ট’। সা-রে-গা-মা শিখেই কারও যেমন স্টেজে উঠে সঙ্গীত পরিবেশন করা উচিত নয়, তেমনি কবিতা লেখা মাত্রই প্রকাশের জন্যে আকুল হওয়ার কোনো কারণ নেই।
শব্দশিল্প সাধনার বিষয়, কাজেই নিরন্তর চর্চার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধিলাভ এলে তবে তা প্রকাশ করা উচিত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য নিজের কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটিকে আগে সম্পূর্ণ আয়ত্তে এনে তবে সরস্বতীর সাধনায় আত্ম নিবেদন করেছেন। সেই প্রমাণ তার কবিতার অন্তর্লীন ভাব-ঐশ্বর্যে এবং প্রকরণশৈলীর সম্মিলনে অনবদ্য এক রস-ব্যঞ্জনায় কালোত্তীর্ণ হয়ে ফলেছে।
আমার অগ্রজ কবি রফিক আজাদকে প্রথম পেয়েছিলাম সম্পাদক হিসেবে। একথা অনস্বীকার্য যে, তার সমকালে এবং পরবর্তীসময়ে তার মতো বিদগ্ধ সম্পাদক খুব কম পেয়েছি। যিনি বাংলা ভাষা, ভাষার শব্দের উৎপত্তিসহ প্রতিটি বানানে ছিলেন ঈর্ষণীয় রকম প্রাজ্ঞ। প্রথাবিরোধী তার নিজের কবিতা, সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনার জ্ঞান এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতালব্ধ মননশৈলীতে তিনি বাংলা কবিতায় শুরু থেকেই একটি বিশিষ্ট বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন।
প্রকাশনা শিল্পের যদি নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদ থাকে, সেক্ষেত্রেও যেকোনো লেখার মান ও নির্ভুল বানান গ্রন্থের শিল্পসৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে অনেকগুণ।যদিও আমাদের দেশে এখনো সে কালচার গড়ে ওঠেনি।
সর্বোপরি ব্যতিক্রমধর্মী কল্পনাশক্তির মায়ারোদ মাখা তার আড্ডার মোহময়, সমুজ্জ্বল যে দীপ্তি—সব মিলিয়ে নবীন কবি হিসেবে অন্যদের মতো আমিও তার মতো সম্পাদক ও সম্পাদনার ভক্তই ছিলাম। কী হতে যেন কী হয়ে গেলো, জীবনের রেশমি সুতোর এক অনবদ্য গ্রন্থিতে জড়িয়ে পড়লাম দু’জনেই। ফলে ১৯৮৩ সাল থেকে আমার অধিকাংশ লেখার প্রথম পাঠক ছিলেন কবি-সম্পাদক রফিক আজাদ। লেখাটি পাঠের পরে তার মন্তব্য ও সম্পাদনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্বসহ অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। সব সময় যে মেনে চলেছি, তাও কিন্তু নয়। তবে, সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই আমরা জানি এবং মানি যে, আবেগ এবং কল্পনাশক্তিই হলো যেকোনো রচনার জননী। ভালোবাসার আবেগ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্ম সম্ভব নয়, হোক তা মানবশিশু নয়তো শব্দশিশু।
এরকম অনেকদিন আমাদের দুজনের ক্ষেত্রেই ঘটেছে যে, এক বসাতেই কোনো একটি কবিতা বা রচনা সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তখন সেই লেখাটি প্রকাশের জন্যে প্রাণে আকূতিও অনুভব করেছি। লেখার পরের দিন হয়তো কোনো কাগজে ছাপতেও দিয়েছি।
একদিন সাকুরা থেকে ফিরে এসে রফিক আজাদ এক বসাতেই পাঁচটি কবিতা লিখেছিলেন, দুদিন পরে কাগজে সেই কবিতাগুলো পড়েই কবি শামসুর রাহমান সকালবেলা রফিক আজাদকে টেলিফোন করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।
শামসুর রাহমানের উচ্চপ্রশংসায় কবি এত আপ্লুত ছিলেন যে, ঘটনাটি তিনি তার অনিয়মিত ডাইয়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। আবার এমনও হয়েছে কোনো লেখা শেষ করেও মনে হয়েছে, শেষ হয়নি, এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। সেই লেখাটির জন্য অবশ্যই সময় দিতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে উপযুক্ত সময়ের জন্যে।
আমার কবিতা পড়ে কবি যেদিন বলতেন, কয়েকদিন ফেলে রাখো। আমি উল্টো জিজ্ঞেস করতাম, কেন, কবিতাটি ভালো হয়নি? এ রকম অবস্থায়, রফিক আজাদ আমাকে বলতেন, লিখেই ছাপতে দেওয়ার জন্যে এত ব্যাকুল হতে নেই। যে আবেগ থেকে লেখাটির জন্ম, সেখান থেকে দূরে যাও, দু-চার দিন লেখাটি ফেলে রাখো। দ্বিতীয়বার নিয়ে বসো, প্রয়োজনে আরও কিছুদিন যাক, ততক্ষণে তোমার তাৎক্ষণিক আবেগ চলে যাবে। এবার তাকে মস্তিষ্ক দিয়ে পড়ো, শব্দের গ্রহণ-বর্জন, ছন্দের প্রয়োজন আছে কি না ভাবো, তারপর তুমি নিজেই বুঝবে লেখাটি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশীলিত ও অনবদ্য হয়েছে কি না।
কয়েকদিন অপেক্ষার পরে বুঝতে পারতাম, আমি যে আবেগে থরথর হয়ে রচনাটি লিখেছি, সেই আবেগের বল্গাহীন আতিশয্য হয়তো প্রথমবার লেখায় প্রকাশ পেয়েছে অতিমাত্রায়। কিন্তু শব্দে-ছন্দের সম্মিলিত পরিমিতিবোধ হয়তো শিল্পের দাবি পূরণ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সম্পাদককে দেখতে হয় বিষয়বস্তু ও প্রকরণশৈলী দুটোই। এক কথায় আধার ও আধেয়ের সম্পর্ক ঠিকঠাক আছে কি না, তাও সম্পাদককে বিবেচনা করতে হয়। এজন্যে অবশ্যই সম্পাদনার প্রয়োজন আছে। তবে কবি বা লেখকের প্রথম সম্পাদক তিনি নিজেই। প্রকাশনা শিল্পের যদি নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদ থাকে, সেক্ষেত্রেও যেকোনো লেখার মান ও নির্ভুল বানান গ্রন্থের শিল্পসৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে অনেকগুণ।যদিও আমাদের দেশে এখনো সে কালচার গড়ে ওঠেনি।