এক.
ললিতকলার বিবিধ অনুষঙ্গের ভেতর সাহিত্য সর্বত্র বিরাজমান। পার্থিব পৃথিবীর সবকিছুই ধারণ করে সাহিত্য। পৃথিবীর শুরুটা ছিল দর্শনের; অধ্যাত্ম ও আধ্যাত্মের সম্মিলিত রসায়নে জগৎ সংসারের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একেক সময় একেক মাত্রায় লড়াই করেছে। এতে বড় বড় দার্শনিকেরপ্রজ্ঞার সম্মিলন ছিল। মানুষ নিজের জীবন ও জীবিকার একটি আশ্রয় যখন নিশ্চিত করেছে, তখনই সে শারীরিক ও
মানসিকভাবে থিতু হয়েছে। ঠিক এভাবেই দর্শনের মধ্য দিয়ে কল্পনা ও আবেগের সমন্বয়ে মানুষ এগিয়েছে তার নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী পরিকল্পনায়। এভাবে নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এসেছে বিজ্ঞান। দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে বিজ্ঞান। পৃথিবীর বড় বড় বস্তুগত বিপ্লব ও মনোজাগতিক বিপ্লব মানুষকে আজ একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মানবজাতির রয়েছে পুরুষ ও নারীনামক দু’টি সত্তা। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। রয়েছে অপরিমেয় ক্ষমতা ও শক্তি। অথচ আজ আমরা নারীর ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে রমণী, কামিনী, ললনা, অবলা আর গণিকা শব্দ দিয়ে আক্ষরিক শব্দের সমার্থকে বেঁধে ফেলেছি। বুঝতে চাইনি এর রাজনীতি ও উপযোগিতা কী।
শিল্প সাহিত্যে কোনো কালেই নারীর অবস্থান অস্বীকার করার সুযোগ ছিল না। আমরা যদি বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই পৃথিবীর প্রথম নারী কবি এনহেদুয়ান্না (২২৫০ খ্রি.)। প্রার্থনা সংগীত ও কবিতার জন্য যিনি খুবই সম্মানিত ও দেবীর আসনে পর্যন্ত অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই উপ-মহাদেশের সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখবো কথিত আছে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবিকে, যার নাম খনা। যিনি একজন প্রজ্ঞাবান, বিদূষী হিসেবে চিহ্নিত (সময়কাল: মতান্তরে ৮০০-১১০০ খ্রি.)।খনার সেই সময়ের প্রাজ্ঞ বচন ও ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।
প্রাচীন চর্যাপদেও কুক্কুরিপা নামক একজন নারী প্রতিনিধি আছেন। এছাড়া বাংলাদেশের সাহিত্যেও প্রথম নারী প্রতিনিধি চন্দ্রাবতী। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় যার বিস্তৃতি ও কিংবদন্তি অনন্য হয়ে আছে। কামিনি রায়, কুসুম কুমারী দেবী, সরলা দেবী, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নূর জাহান, বেগম ফজিলাতুন্নেসা, জাহানারা ইমাম, তারামন বিবি, নভেরা আহমেদ, নীলিমা ইব্রাহীম, রাবেয়া খাতুন ও সেলিনা হোসেন পর্যন্ত (প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং আধুনিক শিল্প সাহিত্যসহ ভারতীয় অবিভক্ত বাংলা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক নারীসহ) প্রত্যেক বঙ্গ নারীর রয়েছে জাগরণের আলাদা শক্তি ও শৌর্য। কুসংস্কার, অন্ধতা ও মৌলবাদিতার মতো শতো-প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অনেকে আজ কালের সাক্ষী হয়ে আছেন।
বর্তমান শিল্প সাহিত্যের একটি অংশ এখন যারপরনাই এমন একটি অসুস্থ সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে আছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্ব সাহিত্য ও বিশ্ব ইতিহাসেও কিংবদন্তিসহ নানাভাবে আমরা বহু সংগ্রামী নারীর অস্তিত্ব দেখতে পাই। মায়া অ্যাঞ্জেলো, অপেরাহ উইনফ্রে, এমিলি ডিকিনসন, ডোরিস লেসিং, সিমন দ্য বোভোয়ার ও জে.কে রাউলিংসহ অনেক নারী শিল্পী প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও নিজেদের অভিমত, শক্তি ও সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন।
দুই.
বর্তমানে সাহিত্যের নামে কিছু উদগ্র উল্লম্ফন আমরা দেখতে পাচ্ছি। চলছে আমি-তুমিময় (নানা পুরুষে, নানা বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনামে) আবেগ সম্পন্ন কবিতার ছদ্মবেশে নিছক প্রসারণ। যেখানে কোনো কবিতা নেই। নেই কোনো শিল্প। অনেক পুরুষ লেখক নারীর মনোরঞ্জনের দাওয়াই-বটিকা দিয়ে নিজের আবেগকে ফ্রেমে বাঁধছেন। অনেক নারী শিল্পীও স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা বাদ দিয়ে পুরুষের মতো একই কাজ নানাভাবে সম্পন্ন করছেন। কিন্তু মহাকাল বড় নির্মম। ‘সোনার তরী’র মতো কবিতার লাইনে বলতে পারি—‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী।’ অর্থাৎ মহাকাল তার সৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়। এখানে স্রষ্টা বা মালিকের কোনো স্থান নেই। স্রষ্টার (ব্যক্তির) উপার্জিত যা কিছু মহাকাল নামক তরী (কর্ম) সেটাই গ্রহণ করবে, কিন্তু স্রষ্টাকে সে গ্রহণ করবে না।
আমাদের বর্তমান শিল্প সাহিত্যে ছড়া, পদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস নামের (নানা বিশেষণে) কিছু উদ্ভট কর্ম আবিষ্কৃত হচ্ছে, যা শিল্পী নামধারী কিছু ভুঁইফোড় ব্যক্তির উদ্যোগে উৎপাদিত হচ্ছে, আবার তারা দ্রুত ফুরিয়েও যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’
সংকলনে ‘নানা কথা’ গদ্যে বলেছেন—‘যেদিন দেখিব পৃথিবীতে নূতন কবি আর উঠছে না সেদিন জানব, পুরাতন কবিদের সম্পূর্ণ মৃত্যু হয়েছে।’ সময়ের এই অস্থিরতা আর ঠুনকো শিল্পের প্রাবল্যে রবি ঠাকুরের গদ্যের সারমর্ম আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এইসব লেখায় ন্যূনতম শিল্পও যদি অন্তত থাকে, তাও মেনে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। কারও সম্ভাবনা ও বিকাশের খাতিরে সাহিত্য নামে (প্রাথমিকভাবে) কিছুটা উল্লম্ফন আমরা হয়তো মেনে নিতে পারি। কিন্তু এই তথাকথিত শিল্পের জন্য যদি রাষ্ট্র ও সমাজের বড় স্বীকৃতি, সম্মান ও পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটে; তখন তা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এতে শিল্প সাহিত্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ, যোগ্য শিল্পীর মর্যাদা ও গুরুত্ব কমে যায়। তারা হয়ে পড়ে অভিমানী, কোণঠাসা, পরিত্যক্ত।
বাংলা সাহিত্যে এমন বড় বড় উদাহরণ অনেক। এভাবে অনেকে পাদপ্রদীপের আলো থেকে ছিটকে পড়েন। আবার এদের অনেককে নিয়ে আলোচনা হয় শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে। তাও ক্ষীণ। এর থেকে বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষা, জন মানুষের শিল্পরুচি কোন পর্যায়ে আটকে আছে।
আমাদের মুখস্থপ্রবণ বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষ নেমেছে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা (নিম্ন রুচির) ক্রান্তিকালের বিশাল একটি চরায় আটকে গেছে। শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নিজস্ব প্রচেষ্টায় একাগ্রতা ও নৈতিক শক্তির জোরে কেউ কেউ টিকে আছেন; অনেকটা স্রোতের বিপরীতে নীরবে কেউ কেউ শিল্প সাহস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। একটি দেশের শিক্ষার মান, রুচি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্ন ও বিচ্ছিন্ন হলে শিক্ষিত, শিল্পসম্মত সমাজ গোষ্ঠী তৈরির অন্তরায় হয়ে পড়ে। আমরাও যেন সেই দিকে পথ বাড়িয়েছি। অনেকটা নিছক অর্থে বেঁচে থাকার মতো বিনোদন। শিল্প সাহিত্যে এইসব চর্চা ও পরিচর্যা যখন বেড়ে যায়, বেড়ে যায় অসুস্থ মানুষের প্রবেশ। নারীপ্রীতি, মোহ ও স্ট্যান্টবাজির মতো নিম্নসংস্কৃতির চর্চা তখন প্রকৃত শিল্পের দরোজায়ও আঘাত হানে। বর্তমান শিল্প সাহিত্যের একটি অংশ এখন যারপরনাই এমন একটি অসুস্থ সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে আছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক করুণ গাথার মধ্য দিয়ে আজকের এই দেশ বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে, একটি সুস্থ জাতীয় রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। এর প্রয়োজনীয়তা দিনকে দিন বাড়ছে। এখানেও দরকার নারী-পুরুষের সম্মিলিত সহায়ক শক্তি ও শৌর্য। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নারীপ্রীতি বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি উভয়ের সমন্বিত সুস্থ শিল্পনীতি। লেখার শিল্পমান না দেখে সরাসরি তাদের আবেগ মাখা তরল কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাহিত্যে একইকথার চর্বিতচর্বণ চলছে। বক্তব্যে বা শিল্পে নতুন কোনো যুক্তি ও সম্ভাবনা নেই। অনেকের মেধা ও যোগ্যতা থাকার পরও নিজেকে নিজে চিনতে পারছে না। সুসম্পাদনার অভাব, মোহ, দুর্বলতা, স্বজনপ্রীতিসহ অসুস্থ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন অনেক নারী। কিছু কিছু মিডিয়ায় স্ট্যান্টবাজিকর কারণে অনেক পাঠক ও শিল্পী প্রতারিত হচ্ছেন। তারা প্রকৃত সমঝদারের চাহিদা ও শিল্প রুচির ক্ষুধা নিবারণ করতে পারছে না।
শিল্প সাহিত্যে অসুস্থ নারীপ্রীতি, মোহ ও স্ট্যান্টবাজি কমিয়ে একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি।
ইউরোপের শিল্পবিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবোত্তরে শিল্প সাহিত্যে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ‘আর্টস ফর আর্টসশেক’ (শিল্পের জন্য শিল্প) আর ‘আর্টস ফর লাইফ শেক’ (জীবনের জন্য শিল্প) নামে দু’টি নতুন শিল্প চিন্তা ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল। এর মধ্যে আর্টস ফরআর্টস শেককে বিমূর্তবাদী শিল্প ধারা বলে অনেক বিজ্ঞ শিল্পী খাটো করে দেখলেও সাহিত্যের সঠিক নির্ণায়কের জন্য (নানা সূচকে) এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। এছাড়া ইউরোপীয় সাহিত্যে প্রতীকবাদের মতো শিল্প আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনেকগুলো শিল্প আন্দোলন সম্পন্ন হয়েছে। খণ্ডিত রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যেও তার প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। এর মধ্যে রোমান্টিসিজম বা রোমান্টিক শিল্প আন্দোলনের দুই বড় শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই বড় দুই শিল্পীর নন্দন-ভিন্নতা, উপযোগিতা ও শক্তির গভীরতাকে আত্মস্থ না করে একটি তরল সাহিত্যের বাজার তৈরি হয়েছে। আমাদের শিল্পসাহিত্য অঙ্গনেও উল্লিখিত বিপ্লব বা নান্দনিক শিল্প ধারাগুলোর উৎস কোথায়, কেনই বা এর সৃষ্টি, সে সম্পর্কেও (নতুন লিখতে আসা) অনেক লেখক শিল্পী অবগত নন। এই আন্দোলনের মুষিক প্রসবে পুরুষের পাশাপাশি নারীও জড়িয়ে পড়েছে। এভাবে নারী পুরুষ পরস্পর পরস্পরের পিঠ চুলকানিসহ অসুস্থ মোহ ও মায়া তৈরি করেছে; যা প্রকৃত শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
শিল্প সমাজে অসুস্থ পুরুষতান্ত্রিকতাও বেড়েছে। এই অসুস্থ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে মোকাবিলা করতে নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হয়ে নয়, পরস্পরের সহযোগী ও সমব্যথী হয়ে কাজ করতে হবে। জেন্ডার-সমতায়, দু’জনকেই হাতে হাত রেখে সমানে এগিয়ে যেতে হবে। প্রকৃতিগতভাবে উভয়ের মাঝেই আছে একটি চমৎকার বোঝাপড়া ও ভারসাম্য। নারীকে নিয়ে নজরুল বলেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা’, আহমদ ছফা একটি উপন্যাসও লিখেছেন ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ নামে। এই সময়ে এসেও যথার্থ ভাবতে পারি নারী জাগরণ এর (‘জাগো গো ভগিনী’ও ‘অর্ধাঙ্গী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের লেখক] অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার সেই দূরদর্শী চিন্তার। নারীর বহিরাভরণের আলাদা সৌন্দর্য ও আচরণের সৌন্দর্য মিলিয়ে তার রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
এই সৌন্দর্য তখনই ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন থাকে উভয়ের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান। বর্তমান শিল্প সাহিত্যের কিছু জায়গায় এসবের বালাই নেই। শিল্প সাহিত্যে অসুস্থ নারীপ্রীতি, মোহ ও স্ট্যান্টবাজি কমিয়ে একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি।