ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে মনে হচ্ছে একটা লোক এদিকে আসছে।
এখন বোধ হয় সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা বাজে। আমি বাড়ির কিনারে, সামান্য দূরে এসে দাঁড়ালাম। ঘরে আমার বউ রুনু সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আসলে নাস্তা বানানো মানে কিন্তু ভাত রান্না করাই বুঝি এখন। ছোটবেলা থেকেই সকালে আমরা রুটি-ভাজি বা রুটি-ডিম খেয়ে অভ্যস্ত। এখন এই গ্রামে এসে আমরা সকালেও ভাত খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এপ্রিল মাসের হিসাবে তেমন গরম পড়ে নাই এবার। এখান থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে প্রশস্ত পদ্মা নদী। সেদিক থেকে গা-জুড়নো বাতাস আসছে। তবে একবার মাথা ঘুরিয়ে ঠিক বিপরীত দিকে চেয়ে দেখলাম আকাশের ওপরে জলরঙের টিউব থেকে যেন নেভি ব্লু রঙ ঢালা হচ্ছে।
এখন দিগন্তের একেবারে কিনারে চিকন পাড়ের মতো নীলচে রঙ লাগানো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। এখন যেহেতু নিচের দিকে বাতাস আছে, তাহলে বাতাসে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গেলে ঝড় হবে না। মেঘেরা সরে যাবে দক্ষিণ দিকে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হতে পারে। কিংবা ঝড়ও হবে হয়তো। এখানে একটা শীতল বাতাস বয়ে যেতে পারে, এর বেশি আর কিছু না। একেই বলা হয় ‘যত গর্জে তত বর্ষে না।’
এখনো লোকটা অনেক দূরে। ঘন সবুজ ক্ষেতের মাঝখানে শুধু লোকটার মাথা দেখা যায়। দেখে মনে হয় সবুজ কার্পেটের ওপর দিয়ে যেন একটা কালো মার্বেল গড়িয়ে আসছে। না, মার্বেলের চেয়েও ছোট দেখা যাচ্ছে তাকে। আসলে মনে হচ্ছে সবুজ একটা কাঁথার ওপর দিয়ে ছোট কালো একটা গুবরে পোকা খুব মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে। এদিকে, মানে এই বাড়ির দিকেই আসছে বলে মনে হয়। যদিও এখন পর্যন্ত বলা যায় না কিছুই, কারণ মাঝখানে ক্ষেতের অনেক আইল এদিক-সেদিক গেছে। লোকটা তারই কোনো একটা দিয়ে যেকোনো দিকে যেতে পারে। গেলে যাক, তার যে দিকে মনে চায়, যে দিকে তার প্রয়োজন, সে দিকেই যাক তাতে আমার কী?
না, সে যেদিকে খুশি সেদিকে যেতে পারে না। এদিকে আসা তার ঠিক হবে না। এই বাড়ির দিকে আসা উচিতই হবে না। কেন উচিত হবে না? এই বাড়ি কি আমার পৈতৃক সম্পত্তি, ন্যূনপক্ষে আমার ক্রয় করা সম্পত্তি? তাহলে লোকটার এদিকে আসায় আমার মনে আপত্তি উঠছে কেন? আমি এখানকার কে? আমি এই দেশের একজন নাগরিক, আমার বাঁচার অধিকার আছে। আমি তো এখানে বাঁচার জন্য এসেছি। বাঁচার অধিকার তো সব নাগরিকের আছে, সবাই কী সে সুযোগ পাচ্ছে? আর আমার ধারণার বাইরেও মানুষের অধিকার আছে। জগতের সব জ্ঞান যে শুধু আমার মগজেই বিদ্যমান তা তো নয়, আমার জ্ঞানের বাইরেও অনেক কিছু আছে। বরং বলা চলে, আমি আর কী জানি? জগতের সবকিছুই তো আমার অধীত জ্ঞাপনার বহির্ভূত। যদি লোকটা এই বাড়ির মালিকের কোনো আত্মীয় হয়, তাহলে আমি তাকে কোন যুক্তিতে বলি, এইদিকে তার আসার অধিকার নাই? আমি নিজে এখানে এসেছি প্রাণবাঁচানোর জন্য। পালিয়ে এসেছি বললেও আমার মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কিছু নাই।
করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি এড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত সরকারি আদেশমতো ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার জন্য এখানে এসেছি।
গতরাত থেকে একটা শব্দ আমার কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে। সকাল থেকেও কানে বাজছিল, একটু আগেও শব্দটি মুখস্থ শব্দের মতো বার বার কানের ভেতর ভোমরার পাখার শব্দের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন কিছুতেই মনে করতে পারছি না। মাঝে মাঝে এমনও হয়, একটা শব্দ দুই-তিন দিন কানে মনের অগোচরেই বাজতে থাকে। তারপর একদিন শব্দটি কোনো বাস্তবপ্রমাণসহ ধরা দেয়। আজ কি এমন কিছু হতে যাচ্ছে? মাঝে মাঝে স্বপ্নের ব্যাপারেও এমন সত্যি হয়ে থাকে। যাকে স্বপ্নে দেখলাম, পরদিন অবশ্যই তাকে কোথাও না কোথাও প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলো এমনিতেই নাকি হয়ে থাকে।
লোকটা যদি মালিকই হয়ে থাকে? তাহলে কেমন হবে? আমি কি এই বাড়ির মালিককে দেখেছি? আমি কি চিনি তাকে? আমার এক অধস্তন আত্মীয়ের কথায় এখানে এসে উঠেছি। আমার ভায়রাবেটা দুলাল আমাকে বলেছে, ‘লকডাউনের এই সময় যদি বাড়িতে থাকা নিরাপদ মনে না করেন, তাহলে চলে আসেন এদিকে, আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা নতুন ঘর খালি আছে, কেউ থাকে না; এখানে নিরাপদে থাকতে পারবেন।’
দেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের লকডাউনের মতো করে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করার পরে শহরের বাসায় থাকা নিরাপদ মনে না হওয়ায় এখানে চলে এসেছি। এখানে এসে নিজে প্রত্যক্ষ করে গেছি একবার। পদ্মার মাঝখানের চর; জনবিরল এলাকা। লোকজনের তেমন ভিড় নাই। বাড়িটা বড়, একপাশে দুলালের শ্বশুরবাড়ি। আর অন্যপাশে দুলালের চাচাশ্বশুরের বাড়ি এটা। বেশ বড় একটা নতুন টিনের ঘর। ভিটি বেশ উঁচু, প্রায় এক পুরুষ সমান। ভিটি পাকা, পিড়াগুলোতে কালোর মধ্যে লাল রংয়ে রঙিন সিমেন্ট দিয়ে আল্পনা আঁকা। এক পাশে রান্নাঘর। অন্যপাশে পাকা বাথরুম, টিউবঅয়েল। আশেপাশে কয়েকটা সন্ধ্যামালতী ফুলের গাছ। বাড়িটা নতুন তোলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউ থাকে নাই। তবে আমরা ঘরে প্রথম প্রবেশ করেই কাঁচা আলুর গন্ধ পেয়েছি। আলুর কোনো বস্তা বা চাঙারি দেখতে পাই নাই। ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে ক্ষেতের আলু তুলে এ ঘরে রাখা হয়েছিল হয়তো। পরে সব আলু বিক্রি করা হয়েছে, অথবা কোল্ডস্টোরে নিয়ে জমা রাখা হয়েছে। বাড়িটিতে বড় কোনো গাছ নাই। শুধু এ বাড়ি কেন, এই চরেই কোনো বড় গাছ নাই। মাত্র কয়েক বছর ধরে এখানে বসতি শুরু হয়েছে। চরটার বয়স পনেরো-বিশ বছরের বেশি হবে না। এ বাড়িতে কয়েকটা আমের চারা লাগানো হয়েছে। চারাগুলো এখনো শিশু বলেই বাঁশের কাঁধে ভর রেখে স্থির থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। বাড়িটিতে সহসা কেউ এসে থাকবে এমন সমূহ সম্ভাবনাও নাই। সে কথা জেনেই দুলাল আমাকে বলেছে। আমিও দুলালের শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বিয়াই, কী বলেন, এখানে কোনো ঝামেলা নাই তো?’
দুলালের শ্বশুর গ্রামের সহজ সরল কৃষক মানুষ, আমার একটা হাত খপ করে ধরে বলে, ‘কী যে কন বিয়াইসাব, আমার ভাইয়ে নতুন ঘরটা তুলছে এখানে থাকার জন্য না। পোলারে বিয়া করাইব, মাঝে মাঝে গেরামের সামাজিকতা রক্ষা করার জন্য ঈদে-চান্দে গেরামে আইব সেই জন্য। আর গেরামে গিরস্তি আছে, আলু লাগানোর সময়, তোলা হইলে একটা ঘর থাকন লাগে। সেই জন্য ঘরটা তুলছে। কিন্তুক এহন থাকনের কেউ নাই। ভাতিজা ইটালি থিকা আহে নাই।’ এই করোনাকালে কেউ হাত ধরলে ভয় পাওয়ারই কথা। আমি হাত ছাড়িয়ে নিলোম। তবে ইতালির কথা শুনে আমার হৃদপিণ্ডে যেন কনফেকশনারির পাউরুটি স্লাইস করার বড় চাকুটা দিয়ে একটা পোঁচ দিয়েছে কেউ। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল মুহূর্তেই। অন্য কোথাও হলে আমি বসে পড়তাম। এখানে শক্ত হয়ে থাকতে হলো। বিয়াই বলেই চলছে, ‘হেই দেশে করোনা না কী এক ব্যারাম ছড়ায়া পড়ছে, হেই কারণে ভাতিজা ঘরে বন্দি হইয়া রইছে। এহন আর দ্যাশে আহিতে পারব না। আপনে চাইলে আরামে থাকতে পারেন।’
এভাবেই আমার এখানে থাকতে আসার মৌখিক আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। এখানে ভাড়ার কথা নাই। দুলাল বলেছে, শুধু বিদ্যুৎবিল দিয়ে দিলেই চলবে। আর কোনো খরচ নাই। গ্যাস নাই তাতে সমস্যা কী? স্থানীয় লাকড়ির অভাব আছে? প্রচুর ধৈঞ্চা আর পাটখড়ি আছে। বাড়ির নিচের দিকে মাচা বানিয়ে স্তূপ করে রাখা আছে। দাম ধরে কিনে সেখান থেকে পুড়তে কোনো সমস্যা হবে না। এখান থেকে বাজার ছয়-সাত মাইল দূরে। গ্রামের লোকদের জন্য হাঁটাপথ, আর আমাদের মতো ভদ্রলোকদের জন্য মোটরসাইকেল সার্ভিস আছে। উত্তরবঙ্গের ছেলেরা এখানে মোটরবাইক চালায়, উঠতে আমার ভয় লাগে। সেদিন না পেরে উঠে এসেছি, কারণ আমার বউ, বাচ্চা আর মালামাল নিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসব কেমন করে? ইটবিছানো এবং কাঁচা রাস্তায় ভো ভো করে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সাইকেল চালায় ওরা। ওদের পেছনে বসে থাকলে পড়ে যাওয়ার ভয় তো থাকেই, তার ওপর এ সময় করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কাও আছে। বিদেশ থেকে আসা এই চরের লোকেরা বাড়িতে গেলে ওদের পেছনে বসেই তো যায়। আর ওদের গায়ের শার্ট-টিশার্ট ময়লা থাকলে ঘৃণাও লাগে। ওদের জামা নিয়মিত না ধোয়া হলে, পিঠে লেগে থাকা ভাইরাস পেছনে বসা যাত্রীর নাক-মুখ দিয়ে শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেদিন ভয়ে ভয়ে উঠেছিলাম। তবে এসব মোটরবাইকে উঠে বাজারে গেলে সিলিন্ডারের গ্যাস আর চুলা নিয়ে আসা যায়।
ঘরটিতে সুন্দর করে ইলেকট্রিক অয়্যারিং করা হয়েছে। একটা ফ্যানও লাগানো হয়েছে। তবে এখানে এখনো ফ্যান লাগে না বরং এখনো রাতে কাঁথা লাগে। অন্যান্য বছরের এই সময় প্রচণ্ড দাবদাহ থাকে, কিন্তু এবার শীত যেন ফিরে যেতেই চায় না। থেকে যাওয়াই যেন তার মনস্থ। দিনের বেলা সূর্যের প্রকাশ্য উপস্থিতিতেও তেমন গরম অনুভূত হয় না। খোলা মাঠের উপর দিয়ে শনশন করে বাতাস আসে, গা শীতল হয়ে যায়। শীতের অনুভূতি প্রবল হয়। বিকাল হলেই যেন সূর্যের দায়িত্ব শেষ। আর তখন থেকেই উদার জমিনের ওপর দিয়ে শীত গড়িয়ে গড়িয়ে আসে। এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি, কাছের এবং দূরের অনেক বাড়ির সামনে ঘাসে ওপর এবং মাচার ওপর বিদেশি কম্বল মেলে দেওয়া হয়েছে। এখনো এখানকার লোকেরা রাতে কম্বল গায়ে দেয়। আমাদের ঘরেও রাতে কাঁথা লাগে। ডাবের ভেতরের লেওয়ার মতো কুয়াশা পড়ে ভোরে।
‘ইতালি’, ‘করোনা’ এসব শব্দ আমাকে বিহ্বল করে দেয়। আমি কোনোদিন কোনো ভাইরাস দেখি নাই, দেখার কথাও না। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম না, কোনোদিন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখও লাগিয়ে দেখি নাই। মানবিক বিভাগের ছাত্র হিসাবে,মানবিক বা কলাবিভাগের বিষয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। এসব সাবজেক্টকে অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা ‘লিপস্টিক সাবজেক্ট’ বলত। কারণ, পড়াশোনায় অমনোযোগী ছাত্রীরা নাকি এসব সাবজেক্ট চয়েজ করে। না পড়েই পাস করে যায়। আর এসব ডিপার্টমেন্টের টুল-বেঞ্চ-টেবিল সবই নাকি অনায়াসে পাস করতে পারে। আমরা মানবিকের শিক্ষার্থীরা মেধায় একটু দুর্বল ছিলাম তা সত্য। আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল বলতেন, ‘তোমরা আর্টসের স্টুডেন্টরা পড়ালেখা করো কিছু? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি ক্লাসশেষে আর্টসের ছাত্ররা হোস্টেলে ফিরে গিয়ে জামা-কাপড় পাল্টে, ক্যান্টিনে খেয়ে, আবার হোস্টেলে গিয়ে শুয়ে ঘুমায়, আর আমরা তখনো সাইন্সের সাবজেক্টের প্রাকটিক্যালের ক্লাস করছি।’
এসব কথা সত্য হতে পারে। বিজ্ঞানে পড়ি নাই বলে, বিজ্ঞানের কিছুই বুঝি না। আমাদের মতো আর্টসের ছাত্ররা বিজ্ঞানের যা জানি এবং শুনি তা পত্র-পত্রিকা এবং টিভির মাধ্যমে। বিজ্ঞানীদের কাছে নাকি এগুলো পিওর সায়েন্স না। এগুলো হলো পপসায়েন্স। পপসঙ্গীত, পপআর্ট ইত্যাদির মতো মিডিয়ার ভোক্তাদের জন্য পানিমেরে তরল করে উপস্থাপন করা জিনিস। কাজেই করোনা ভাইরাস কী জিনিস তা কোনোদিন দেখিও নাই। অন্য কোনো ভাইরাসই দেখি নাই, আর করোনা! যুক্তিছাড়া, প্রমাণছাড়া, শুধুই মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের বিশ্বাস জন্মায়। সেই মিডিয়ার মাধ্যমেই আবার আমাদের মেরুদণ্ডে ভয় ঢুকে যায়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণই যদি জ্ঞান চর্চার উপায় হয়, তাহলে এই যে করোনা কী জিনিস কোনোদিন দেখলাম না, জানলাম না, শুধু শুনেছি। আর শোনা কথা তো ভূতের অস্তিত্বের মতোই বিষয়। দেখেছি অথবা না দেখেছি, একটা ভয় রাতের অন্ধকারে নির্জন স্থানে শীতল বরফের মতো আমাদের জমাট করে দেয়। সেদিন দেখলাম ইতালি, করোনা এসব শব্দের প্রতি তীব্র ভয় সৃষ্টি হয়েছে মনে। আগে থেকেই ভয়ে ভীত হলে নাকি সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে!
সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে আসা ছোট বিন্দুটা সামান্য বড় হয়েছে এতক্ষণে। তবে এখনো বোঝা যায় না, সে নারী নাকি পুরুষ। শিশু নাকি বৃদ্ধ। শুধু দেখছি একজন মানুষ এদিকে আসছে। আর আমি মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে ভয় পাচ্ছি। কেন ভয় পাচ্ছি? সে কি সশস্ত্র কোনো লোক? তার হাতে কোনো অস্ত্র আছে? আমি জানি না। আর অস্ত্রের ভয়টা আমার মেরুদণ্ডে নাইও। দুলাল আমাকে বলেছে, ‘আংকেল এখানে, চুরি-ডাকাতির কোনো ভয় নাই। রাতের বেলা গরু যদি ঘরের বাইরে থাকেও চুরি হয় না।’ আমি ছোট বেলা থেকেই শুনতাম এসব এলাকায় গরুচুরি হয়। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির গরুই চুরি হতো তখন। আমার বড় মামাকে দেখেছি তার এক নাতিকে ঠাট্টা করে ‘গরুচোরাদেশের পো’ মানে পোলা বলত। কারণ পদ্মার এই পারের লোকদের অভিযোগ ছিল পদ্মার ঐপার থেকে ফরিদপুরের লোকেরা রাতে নৌকা নিয়ে এসে গরু চুরি করে নিয়ে যেত। তখনও শরীয়তপুর ছিল ফরিদপুর জেলার একটা মহকুমা। সেই এলাকায় এখন চোর নাই এটা বিশ্বাস হওয়ার কথা না। তবে আমার এক ছাত্রের বাড়ি পদ্মার মাঝখানের এক চরে। সে বলেছে, ‘আগে কোনকালে চুরি হতো জানি না, এখন সবারই কর্মসংস্থান আছে, ঘরে ঘরে বিদেশগামী লোক আছে। আর চর পড়ে পদ্মা এখন অনেক দূরে চলে গেছে। প্রায় সাত-আট মাইল দূরে সরে গেছে। এখন চুরি করতে আসবে কেমন করে? নদীর তীরে হলে না হয় নৌকা নিয়ে এসে দ্রুত ভাগতে পারে।’
আমি দেখেছি কথা সত্য। এখানে চুরির ভয় নাই। আর রাজনৈতিক সহিংসতা থাকলেও যাদের সাথে যাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা পূর্বশত্রুতা আছে তাদের মধ্যেই সে অপরাধ সংঘটিত হয়। বাইরের লোকদের সে ভয় থাকার কথা না। তাহলে আমি ঐ দূরের প্রায় অদৃশ্য লোকটিকে ভয় পাচ্ছি কেন? নাকি আমার মনের সুপ্ত কোনো ভয় যে কোনো একটা রূপ নিয়ে প্রকাশ হতে চাইছে মাত্র? মনোবিজ্ঞানীরা ভয় নিয়ে কী বলেছেন তা জানি না, মনোবিজ্ঞান আমি পড়িও নাই। তবে ভয় নিয়ে আমার নিজের কিছু চিন্তা আছে। আমার মনে হয় ভয়ের অনেকগুলো ধরন আছে। কালগত দিক থেকে পুরাঘটিত ভয়ের কথা সাধারণত লোকে অন্যকে বলে, বা প্রতিক্রিয়ার কারণে লোকে জেনে যায়। যেমন গতরাতে কেউ ভূতের ভয়ে চিৎকার করেছে, তা অন্যেরা শুনে থাকতে পারে, এ কারণে ভয়পাওয়া লোকটাও তা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ঘটমান ভয় লোকে স্বীকার করে না। এই মূহূর্তে যে ভয় পাচ্ছে তা শিক্ষিত এবং পুরুষ মানুষেরা স্বীকার করে না। করতে চায়ও না। আর ভবিষ্যতের ভয় তো অনেকে নিজেই টের পায় না। পেলেও তা ভুলে থাকতে চায়।
আমি এই অনাগত লোকটাকে ভয় পাচ্ছি কেন? এখানে ভয়ের কোনো অতীত নাই। আমি এখানে দুই সপ্তাহ ধরে এসেছি ভয়ের কোনো কিছু ঘটে নাই। রাতে শনশন বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ থেকে ভয় আসে না। দূরের কোনো বাড়িতে উচ্চশব্দে গান বাজানো হলে শোনা যায়। সেদিন কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে, খোলা দিগন্তে বাড়ি, তাই বাতাসের ঝাপটা বেশি লাগে। তবে ঘরটা নতুন এবং বেশ শক্ত হওয়াতে ভয়ের কিছু ছিল না। আমাদের দেশে ছয় ঋতুতে ছয় রকমের বৃষ্টি হয়। যেমন গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির সাথে থাকে বজ্রপাত আর শিলাপাত। ফোঁটা পড়বে তির্যকভাবে। এগুলোতেও তেমন ভয় পাই নাই। বর্ষাকালের বৃষ্টি হবে অবিরাম। ফোঁটা পড়বে খাড়া। নদ-নদী পানিতে ভরে যাবে। তাতেও এখানে তেমন ভয়ের কিছু নাই। কারণ বাড়িটা বেশ উঁচু। বের হওয়ার জন্য সাঁতার কাটতে হবে না, সাঁকো লাগবে না। রাস্তা আছে। আর কিছুদূর কাঁচারাস্তার পরেই ইটবিছানো রাস্তা। আর আমি তো রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য এখানে আসি নাই। বরং গৃহবন্দি থাকার জন্য আসা। করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি এড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত সরকারি আদেশমতো ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার জন্য এখানে এসেছি। যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এদেশে পুরোপুরি সম্ভব না। আর সম্ভব নয় বলেই তো আমি এখানে এসেছি।
এই কাজ আমি করতে পারব না। আর এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা উচিতও হবে না। তাহলে আমার মতো লোক আর করবেটা কী?
ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর এমনকি আমাদের জেলাতেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা দিয়ে যানবাহন এবং দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় নামলে পুলিশ এবং মিলিটারির কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে হয়। মাস্ক পরতে হয়। সমস্যা হলো স্থানীয় লোকজন বোঝে না সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং কাকে বলে। এদেশে চিরকাল কবিরা বলেছেন কবিতায়, নেতারা বলেছেন ভাষণে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যের কথা ধর্মগুলোও বলে থাকে। সেখানে এখন যদি হঠাৎ বলা হয় অনৈক্যের কথা, বিভেদের কথা, দূরত্ব বজায় রাখার কথা, তা সমাজে সহজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আমার মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা যতই বলুক, লোকজন করোনাকে সেভাবে ভয় পাবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করবে না। বিদেশফেরত লোকদের এয়ারপোর্ট থেকে ছেড়ে দেওয়াতেই দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করে অনেকে। তারা চৌদ্দ দিনের হোমকোয়ারিনটিনে থাকার কথা দিয়ে দেশের বাড়িতে ঢুকেই ভুলে যাচ্ছে মহামারীর কথা। তাদের কারণে পাড়ায় পাড়ায় লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। অতিউৎসাহী ছেলেরা গ্রামের রাস্তা, পাড়ার, মহল্লার রাস্তা এবং গলিতে বাঁশবেঁধে যান চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে।
কাজেই সামনে বর্ষাকালেও যদি আমাদের এখানেই থাকতে হয়, তাহলে কোনো ভয় নাই। তাহলে ভয়টা কীসের? গত কয়েকদিনে রাতে সমস্যা হয়েছে। রুনু কোনো অভিযোগ করে নাই কথা সত্য, কিন্তু সকালে মুখভার দেখেই বোঝা গেছে সে রাতের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট ছিল না। আর সরকার এবং স্বাস্থ্যসংস্থা ‘হু’ স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ না করলেও এ সময় স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সর্ম্পক রচনাকেও নিরুৎসাহিত করছে। কারণ বলা হচ্ছে, ঘরের ভেতরও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। একজন আরেকজনের কমপক্ষে তিনফুট দূরে অবস্থান করবে। হাঁচি এবং কাশির সময় টিসু পেপার ব্যবহার করতে হবে। অথবা হাতের কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে বার বার হাত ধুতে বলা হচ্ছে। এসব কথার মধ্যে সরাসরি যেমন অর্থ আছে, আড়ালের ইশারাও আছে। তবে সরকার বা জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা যতই স্বামী-স্ত্রীর মিলনকে নিরুৎসাহিত করুক, আমি তা মানতে পারি না। এসব একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারণ আমার পরিবার নিয়ে আমার পরিকল্পনা আছে। পরিবার পরিকল্পনায় আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব আছে। আমি তো রাষ্ট্রপরিকল্পনাকে অস্বীকার করছি না। তাহলে আমি কেন রাতে ভয় পেয়ে গেছি? রাষ্ট্র বা জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা কি অদৃশ্য তরল শক্তি হয়ে আমার রক্তে মিশে আমার শরীরের প্রধান প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রক্তপ্রবাহও নিয়ন্ত্রণ করছে? না হলে আমি ভয় পেয়ে এমন দুর্বল হয়ে গেলাম কেন?
না কি আমার চাকরি নাই হয়ে গেছে, এই ঘটনা রুনুকে লুকিয়ে রাখার কারণে গোপন কোনো অপরাধ করে ফেলেছি, আর সেই গোপন অপরাধের ভয়ে আমি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছি? একটা বেসরকারি কলেজে আমার মতো একজন পার্টটাইম লেকচারারকে এই দুর্যোগকালে কেন বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে? আর দেবেই বা কোথা থেকে? কলেজের ফান্ড তো তেমন বড় না। এই লকডাউন কত দিন, কত মাস থাকবে তা কে জানে? কাজেই অনিশ্চিত সময়ে আমার বেতন সুনিশ্চিত হবে কেমন করে? আমি তো খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে সকল শর্ত মেনেই চাকরি নিয়েছি। প্রথম এক মাস বসিয়ে বেতন দিয়েছে। পরের মাসেই ‘রফিকুল্লাহ প্রধান ডিগ্রি কলেজে’র প্রিন্সিপ্যাল আমাকে ফোন করে বলেছে, ‘হালিম সাহেব, আমরা আপনাদের মতো কয়েকজনকে রাখার চেষ্টা করেছি, পারছি না। কলেজ বন্ধ, ছাত্রছাত্রীদের বেতন আদায়ে সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, পরীক্ষা এবং নতুন ভর্তিসহ আয়ের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে, এ সময় আপনাদের আমরা রাখব কেমন করে? আপনারা অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা করে নেন। আবার সুদিন এলে আপনাদের আমরা ডাকতে পারি।’ অধ্যক্ষ তো সুন্দর বলেছে। এর বাইরে আর বলার আছে কী? আমি অধ্যক্ষ হলে কী করতাম? এমন সিদ্ধান্তই নিতে হতো আমাকে। এর ব্যতিক্রম হওয়াই বরং আমার পক্ষে অসম্ভব হতো।
কাজেই চাকরিচ্যুতির ব্যাপারটায় অসন্তুষ্টির কিছু নাই। সারা দেশে, সারা বিশ্বে এমনভাবে লাখ লাখ, কোটি কোটি লোক চাকরি হারিয়েছে এর মধ্যে। কত বড় বড় মার্কেটের শত শত দোকান, দামি দামি হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মচারীরা এখন বাড়িতে বসে বেকারত্বের যন্ত্রণা অনুধাবন করছে। আর মালিকদেরও কিছু করার নাই। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও তারা শূন্য আয়ের সময় অতিবাহিত করছে। শিক্ষক সম্প্রদায়ের সমস্যা অবশ্য একটু ভিন্ন। অন্য যে কোনো পেশার লোকেরা যে কোনো কাজ করতে পারে, বা চাইলেও করতে পারবে। সেদিন আসার সময় দেখা গেছে রাস্তায় জরুরি খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকায় তারা কেউ ভ্যানগাড়িতে, কেউ মাথায় বোঝা নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করছে। কী করবে, পেটে ক্ষুধা আছে, পরিবারে লোকজন আছে, সংসারের নানাবিধ চাহিদা আছে। কাজেই যে যেভাবে পারছে, সংসারের ভারে কাজ জুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকদের অর্থসংকট ছাড়াও আছে মানসম্মানের প্রশ্ন। তারা চাইলেও যে কোনো পেশা নিতে পারে না। তারা ফেরিওয়ালা হতে পারবে না। আমি কী পারব? অনেক ভেবে দেখছি। চাকরি চলে যাবার পরে প্রতি রাতেই ভাবি, ভাবতে হয়। আমি কী করব?
কী কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব? ফেরিওয়ালার মতো পণ্যবিক্রয় না করতে পারি, এ সময় বিকাল তিনটা পর্যন্ত সচল আছে মুদি দোকান। আমি কি কোনো মুদি দোকানে কাজ নিতে পারব? আর কেউ যদি কাজ দেয়ও, আমি কি এই বয়সে একটা তরুণ ছেলের মতো ক্ষিপ্রতা নিয়ে সেখানে কাজ করতে পারব? নিজেই কি লাখ লাখ টাকা খরচ করে একটা দোকান দিতে পারব? আমার কাছে ক্রেতা আসবে? সংসার চালানোর মতো আয় প্রতিদিন করতে পারব? এ সময় আর চালু আছে, ওষুধের দোকান। আমি কি ডাক্তারদের দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন পড়ে সঠিক ওষুধ বের করে দিতে পারব? কেউ আমাকে কোনো ওষুধের দোকানে কাজ দেবে? আর এ সময় ওষুধের দোকানের কর্মচারীরা অনেক ঝুঁকিতে আছে। কারণ অনেক করোনারোগী মাস্কছাড়া সে সব দোকানে যাচ্ছে, নিজেরাই লক্ষণ দেখে ঠাণ্ডা-সর্দিজ্বরের ওষুধ কিনে খাচ্ছে। তাদের মাধ্যমে ওষুধের দোকানের কর্মচারী এমনকি মালিকেরাও আক্রান্ত হচ্ছে। আমি কয়েকজন পরিচিত লোকের আক্রান্ত্র হওয়ার সংবাদ পেয়েছি। এই কাজ আমি করতে পারব না। আর এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা উচিতও হবে না। তাহলে আমার মতো লোক আর করবেটা কী?
কলেজে চাকরি করে একটা সম্মান পাই, হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা আর বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশনীর উচ্চশিক্ষিত বিক্রয় প্রতিনিধিরা সালাম দেয়, মনে তৃপ্তি পাই। এই সালাম আজ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যে এমন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দুর্যোগের কালে কোমরের সুতা সাপ হয়ে উঠবে তা কেউ কখনো ভাবে নাই। আমার ভাবনায়ও ছিল না। আমাদের এলাকায় সরকারিভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক সচ্ছল ও ধনী লোক প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করেছে। অনেকে বার বার পেয়েছে। চাউল, ডাইল, আলু, তেল, চিনি, লবণ, সাবান, স্যানিটাইজারসহ আরো অনেক কিছু। আমাদের শহরের বাসার আশেপাশের অনেক মধ্যবিত্তও পেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঐযে সালাম পাই বলে আর কিছু পাই নাই। সবার ধারণা আমরা সরকারি বেতন পাই। কারণ অনেক সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সাথে চলাফেরা করি। সচ্ছলদের মতো অভিনয় করে চলি। নিজেকে সরকারি বেতনপ্রাপ্ত নিয়মিত শিক্ষক গণ্য করে ভান করে চলি। আমার ভাতের পাতিলের অবস্থা কেমন তা কি মহল্লার স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা জানে? আমরা কি এসব কখনো জানতে দেই? সামাজিক মর্যাদা রক্ষাকে প্রাণরক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ছিল আমাদর মতো ঘরের ভেতর শূন্য থালাওয়ালাদের লোকদেখানো সংস্কৃতি। লাইনধরে প্রকাশ্যে দিবালোকে যারা রিলিফ গ্রহণ করতে অপারগ, তাদেরকে প্রশাসনসহ নানা দিক থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু আমি পাই নাই। আমার পক্ষে কেউ সুপারিশ করে নাই। আমিও কাউকে জানাই নাই। আর শহরের বাসায় থাকার সময় বিপদটা এভাবে টের পাই নাই। আর তখন তো প্রিন্সিপ্যালের সেই তালাকনামার মতো কলজেচিপেধরা ফোনটাও পাই নাই।
আগের যুগে দুর্ভিক্ষে মানুষ অনাহারে শুকিয়ে শুকিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যেতো। আর এ যুগে ঐ রকম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না, তার আগেই আত্মহত্যা করে।
হালাকু খান যখন বাগদাদ ধ্বংস করেন কিংবা নাদির শাহ যখন দিল্লি ধ্বংস করেন, তখন কি সে সব শহরের মানুষদের ঠিক এমনই লেগেছিল? এখন আমার যেমন লাগছে। আমার মনে হয় ঠিক এভাবে করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত জনপদের মানুষষের অনুভূতি সেই সব শহরের মানুষের চেয়েও ভয়ংকর। আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা দিয়ে অনেক কিছু বিবেচনা করি, পরিমাপ করি। হালাকু খানের একটা চাওয়া ছিল। তার অত্যাচারী সৈন্যদেরও চাওয়া ছিল। পারস্যের নাদির শাহের সৈন্যদেরও চাওয়া ছিল। এমনকি দিল্লির মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মতো অত্যাচারী শাসকেরও চাওয়া ছিল। সে সব চাওয়া পূরণ করতে পারলে শত্রুরাও রক্ষা পেতে পারত। বিদেশি শাসক বা সেনাপতির দালালি করলে মানুষ আত্মরক্ষা করতে পারে, এটা যুগে যুগেই প্রমাণিত। কিন্তু করোনা ভাইরাস যখন চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে তখন জনগণ বুঝতে পারে নাই যে, করোনা কোনো হালাকু খান না, নাদির শাহ না, মুহাম্মদ বিন তুঘলকও না। তার কোনো চাওয়া নাই, যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। এটা সে সব দেশের সংক্রামিত বড় শহরের নাগরিকরা বুঝতে পারে নাই। ইতালির মিলানে যখন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুসোলিনির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কিশোর বয়সে অকুতোভয় লড়াই করা গর্বিত সৈনিকরা নব্বই বা তদোর্ধ্ব বয়সে সগৌরবে আয়েসী জীবন যাপন করছিলেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন যে করোনা ভাইরাস আজ মুসোলিনির চেয়ে, হিটলারের চেয়ে অন্ধ হয়ে হামলা করবে? আর হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সরকার বয়সভিত্তিক বিবেচনায় এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হেেব যে, প্রবীণদের অক্সিজেন দেওয়ার চেয়ে, ভেন্টিলেশন দেওয়ার চেয়ে একজন তরুণকেই আমাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত? যার দিন বিগত, তারচেয়ে যার দিন অনাগত তাদেরকে নাগরিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা কি কারো কল্পনায়ও ছিল?
ইতালির, স্পেনের প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে ভয় ছিল না, ভরসা ছিল। আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতি ভরসা ছিল। যে রাষ্ট্র কল্যাণমূলক, যে রাষ্ট্র মানবিক, যে রাষ্ট্র উদার, সে রাষ্ট্রে নাগরিকদের ভয় থাকতে পারে না। কিন্তু যখন সেই প্রবীণরা প্রবল শ্বাসকষ্টে হা করে মারা যাচ্ছেন, ঘরে ঘরে মারা যাচ্ছেন, হাসপাতালের বেডে মারা যাচ্ছেন, তখনও তাদের ভরসা ছিল কেউ তাদের বাঁচাবে। কারণ তারা নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রকে নানা রকম কর দিয়ে গেছেন সারা জীবন। কিন্তু সে ভাবেই হা করে তারা ওপরের দিকে তাকিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাদের মনে ভয় ছিল না। ভয় আছে আমাদের মধ্যে। অগ্রিম ভয়। সম্রটা আকবর বঙ্গবিজয়ের সময় কয়েকটা নৌকা বিশাল বড় বড় পেটানো কাঁসা বা তামার ডেগ বোঝাই বাঙালি সৈন্যদের মাথা কেটে দাউদখান কররানিকে উপহার দিয়েছিলেন। নিজ দলের এত সৈন্যের কাটামুণ্ডু দেখে যেন দাউদখান কররানি ভয় পেয়ে বাঙলাকে আকবরের কাছে হস্তান্তর করেন, অথবা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যান। দাউদখান কররানি আকবরের বিশাল সেনাবাহিনী কিংবা ডেগবোঝাই স্বস্নেহে পালিত নিজপক্ষের নিহত সৈন্যদের কাটা মাথা দেখে ভয় পান নাই। যুদ্ধ করেই তিনি নিহত হন। কারণ ছিল তার আত্মমর্যাদা। রাজমহলের সেই যুদ্ধে আকবরের ছিল এক ধরনের প্রেস্টিজ, দাউদখান কররানির ছিল আরেক ধরনের প্রেস্টিজ। দাউদখানের ভয় ছিল না। আকবরের তো না-ই।
আমি কি আকবরের মতো মর্যাদার পতাকা বয়ে নিয়ে চলি? দাউদখান কররানির মতো নির্ভীক হতে পারি? আমার যে মর্যাদার পতাকা তা আমাকে আরো বেশি ভয় দেখায়। বিশ্বজুড়ে লকডাউনে চাকরি হারিয়ে অনেক লোক আত্মহত্যা করেছে। দেশেও প্রায় প্রতিদিন একজন না একজনের আত্মহত্যার খবর এসছে ফেসবুকের নিউজ ফিডে, লিংকে। এখানে আসার পরে অবশ্য ফেসবুক চালানো হয় না। এখানো মোবাইল ফোনের টাওয়ার নাই, তাই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এখানে বিদ্যুৎ আছে কিন্তু নেটওয়ার্ক নাই। এখানে আসার পরে যেহেতু সেই ভয়ের সংবাদগুলো দেখা হয় না, তাহলে ভয় কেটে যাওয়ার কথা।
কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি কেন? রাতে শোয়ার সময় মনে হয় ঘরের আড়াগুলো যথেষ্ট শক্ত কিনা। আমার মতো সত্তর কেজি ওজনের একজন পুরুষ মানুষের ওজন সইতে পারবে কিনা। কেন এমন লাগে? আমিও কি মরে যেতে চাই? আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনো অশুভ শক্তি যদি আমাকে লড়াইতে পরাস্ত করে জিতে যায়, তাহলে সে নিজেই দড়ির ব্যবস্থা করে আমাকে ঝুলিয়ে দিতে পারে। আমার এমন মনে হয়। কাউকে বলি না, বলতে পারি না। বলা উচিতও না। সেই যে ভেবেছি ভবিষ্যতের ভয় কাউকে বলা উচিত না, লোকে বলেও না।
আমাদের দেশের যে অবস্থা, জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মানে না। রাস্তায় পুলিশ-আর্মির গাড়ি দেখলে কিছুটা মানে, তারা চলে গেলে যেই সেই। সেই দেশের জনগণ যে কী পরিমাণ আক্রান্ত হবে তা ভাবনার অতীত। আর দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা না বললেও চলে। ইতালির মতো, ইরানের মতো, স্পেনের মতো পথে-ঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকবে বলে সবার ধারণা। ঘরে ঘরে মরে পড়ে থাকবে। কাফন-দাফন করার মতো কেউ থাকবে না। এ দেশে নিরাপদ থাকার সুযোগ নাই। নিরাপদ থাকতে চাইলেও পারা যায় না। আমি যে কারণে আমাদের বাড়ি থেকে এখানে চলে এলাম। আমি অনেক চেষ্টা করেছি করোনার এই সময় পরিবার নিয়ে যেন নিরাপদে থাকতে পারি। কিন্তু কোথায় যাব? আমাদের বাড়িতে নানা বাড়ির লোকজনের আনাগোনা। পানির সংকটের কারণে আমি কোথাও যেতে পারি নাই। আসলে পানির সংকট আমাদের না। আমাদের বাড়ির টিউবওয়েলের পানি আশেপাশের অনেক বাড়ির লোকজন নিয়ে খায়। নদীর পারের এলাকার অনেক টিউবঅয়েলই বন্ধ হয়ে গেছে। ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বেশিরভাগ টিউবওয়েলেই এখন আর পানি ওঠে না। হাতপাম্পে চাপ দিলে কলগুলো শুকনা গলায় খ্যাসখ্যাস করে কাশি দেয়, পানি দেয় না।আমাদের বাড়ির গভীর নলকূপে ভালো পানি ওঠে; তাই সবাই নিতে আসে। আর বাড়ির ওপর দিয়ে সামাজিক রাস্তা। এ কারণে বাড়ির গেটে তালা লাগানো কঠিন। নানাজন নানা কথা বলে বেড়াবে। আর খাওয়ার পানি বন্ধ করা উচিত হবে না। তাহলে এজিদের বংশধর বলে গণ্য হব। সমাজে বাস করতে হলে সামাজিকতা মেনেই চলতে হয়। দশজনের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হয়। আমি না হয় সারাদিনে ঘরে রইলাম বের হলাম না। আমার সন্তানেরা বের হবে, অন্য শিশুদের সাথে মিশে ভাইরাস নিয়ে আসবে। ওদের থেকে আমার আক্রান্ত হওয়ার ভয় আছে।
আমাদের মতো পেশার লোকেরা শারীরিকভাবে নাজুক হয়, আমাদের করোনায় ধরলে আর রক্ষা নাই। মৃত্যু আমাদের সন্নিকটে। আমি যদি আমার নিজের কথা ভাবি, তাহলে কোনো আশার আলো দেখতে পাই না। যে ভরসায় এখানে এসেছি, এখানে আসার পরে চাকরিচ্যুতির খবর পেলাম, সে ভরসা এখন আর নাই। তাহলে এখানে থাকব কেমন করে? মাসশেষে বাজার করার টাকা কোথায় পাব? খাব কী? ইদানিং যে ক্ষুধায় আত্মহত্যার ঘটনা দেখতে পাচ্ছি তাতেও আত্মমর্যাদার একটা ব্যাপার আছে। আগের যুগে দুর্ভিক্ষে মানুষ অনাহারে শুকিয়ে শুকিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যেতো। আর এ যুগে ঐ রকম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না, তার আগেই আত্মহত্যা করে। আমাকেও কি নিজেকে হত্যা করতে হবে?
এই দুঃসময়ে কে কাকে ধার দেবে? সবারই তো সংকট চলছে। আর ধার পরিশোধ করার উপায় কী? চাকরি নাই শুনলে কেউ ধার দেবে না। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কী ভাববে আমার সম্পর্কে? কী বলবে তারা আমাকে নিয়ে? আমার তো ব্যাংকে কোনো টাকা নাই। সে দিন আসার পথে একজনের সাথে কথা হলো, এলাকার শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা তাদের বাসাবাড়ি ছেড়ে দেশের বাড়ি চলে যাচ্ছে। সাগরকলার ভিটা ধ্বংস করে বস্তি তুলে ঘর ভাড়া দিয়েছিল বেশি লাভের আশায়। লকডাউনে সকল পাবলিক পরিবহন বন্ধ থাকলেও ট্রাকের ভেতরে যাত্রী তুলে ত্রিপলে ঢেকে পণ্যপরিবাহী সাজিয়ে বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছে চালকরা। তাদের আর দোষ কী? তাদেরও তো সংসার চালাতে হবে! যারা ঘরভাড়া দিয়ে চলে, এখন তাদের অবস্থাও সঙ্গীন। তাহলে আমি কী করব, করণীয় কী তা জানি না? আমি চলে এসেছি, প্রধানত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এখন দেখছি এখানে থাকা যাবে না। বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। যেখানেই যাই, খাব কী?
ছ্যাঁত করে শব্দ হলেও তা আমার কানে এলো না। অন্য কোনো কারণে আমার কান হয়তো ব্যস্ত ছিল।
লোকটা এখন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। দেখা যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষ ক্ষেতের আইল বেয়ে এদিকেই আসছে। আমার ভয় হচ্ছে। এদেশে যতই বলা হোক চোর-ডাকাত নাই, দেশের যে পরিস্থিতি তাতে অনেকেই চুরি-ডাকাতিতে নেমে পড়বে। অনেক জায়গায় ডাকাতআতঙ্ক ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। যদিও গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুকে কেউ গুজব রটালে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তবে জনগণের দীর্ঘকালের একটা গণঅভিজ্ঞতা আছে। দেশের কোন পরিস্থিতিতে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পায় তা দেশের সামাজিক ইতিহাসের অলিখিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকলেও জনগণ তা প্রতিনিয়ত বুঝতে পারে। যদি লোকটা চোর হয়, কোনো অজুহাতে ঘরের সামান্য জিনিসগুলো দেখে যায়, রাতে আসতে পারে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সদলবলে ডাকাতি করে যেতে পারে।
এখানে অবশ্য আমাদের বাড়ির যে ঝামেলা, তেমন কিছু নাই। একদিকে চিন্তা করলে বেশ শান্তিরই জায়গা। আদিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের কিনারে এই বাড়ি। সবুজ শস্যের ওপর দিয়ে পরিচ্ছন্ন বাতাস আসে, বুকভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেনে শ্বাস নেওয়া যায়। পাড়াবেড়ানো মানুষের ঝামেলা নাই। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সময় কাটছে। এখানে ভিক্ষুকের আনাগোনা নাই। ফেরিওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি নাই। নিঝুম সবুজ নিসর্গের মধ্যে যেন গভীর অবগাহন। রাতে টিনের চালে শিশিরবিন্দুর পতনের শব্দ শুনি। এই শব্দের সাথে আমি আগে কখনো পরিচিত ছিলাম না। কারণ, ছোটবেলা থেকেই ইটের ছাদের নিচে বড় হয়েছি। শিশিরপাতের যে শব্দ হয় তা জানতাম না। এখানে এসে তা শুনতে পাই। রাতে ঘুম ভাঙলে এ শব্দ শুনতে ভালো লাগে। কবে নাগাদ দেশের পরিস্থিতি ভালো হবে তা কে জানে! যদি বর্ষাকাল পর্যন্ত থাকতে হয় তাহলে খারাপ লাগবে না। বর্ষায় টিনের চালে শব্দ হবে। নৌকা নিয়ে ঘোরা যাবে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাবে। শাপলা-শালুকে এইসব জমি ভরে যাবে। দেখতে ভালো লাগবে। তুলতেও বেশ আনন্দ লাগবে। ভরা বর্ষার সময় পদ্মার ইলিশ এখানে বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। শাপলা ডাঁটি দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধলে অসম্ভব রকম ভালো লাগে। রুনুর রান্নার হাত বেশ ভালো। আমিও রান্না করতে পারি।
ঘন সবুজ রঙের টিশার্ট পরা লোকটা এই বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার একদিকে এই লোকটা, সে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। আর অন্য দিকে কালবৈশাখীর তুমুল আয়োজন চলছে। টিউবের নীল রঙ এখন অনেক আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোনো সময়ে ধেয়ে আসতে পারে। আমার এখন উচিত রান্না ঘরে গিয়ে রুনুকে আকাশের কথা বলা। যাতে রান্না শেষ করে চুলা নিভিয়ে ঘরে চলে যায়। আমাদের মতো যারা সারাজীবন গ্যাসের চুলায় রান্না করে, তাদের জন্য লাকড়ির চুলায় রান্না করার ব্যাকরণ আয়ত্তে আনতে হয়। ঝড় দেখলে দ্রুত চুলা নিভিয়ে কয়লা বা ছাইয়ে পানি ঢেলে দিতে হয়। অনেক সময় কালবৈশাখী ঝড় বৃষ্টিসহ না এসে শুধু শুকনাঝড় নামে। তখন চুলার জ্বলন্ত কয়লা বা ছাই বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে বাড়ি-ঘরে বা খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। আমার দাদির কাছে ছোটবেলায় এসব শিখেছি।
আমি কি রান্নাঘরে গিয়ে রুনুকে কথাটা বলে আসব? লোকটা এর মধ্যে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। নাকি তাকে ঠেকাব? লোকটা যদি এই বাড়িতে প্রবেশ করতে চায়? তাকে তো অন্য একটা ঘর দেখিয়ে দিতে হবে। আর লোকটা তার নাক বরাবর ঝড়ের আয়োজনটা অনেকক্ষণ ধরে দেখে আসছে। সে এই ঝড়ের সময় এই বাড়িতে আশ্রয় নিতে চাইতে পারে। এই দিক থেকে আগে আমাদের থাকার ঘরটা, তারপরে দুলালের শ্বশুরের ঘর। কাজেই আমাদের বাস করা এই ঘরেই তার আসার সম্ভাবনা বেশি। আর ঘরটা নতুন এবং দেখতে বেশ মজবুত। দূর থেকে দেখতেও বেশ ভালো লাগে। কাজেই এই ঘরটা তাকে বেশি আকর্ষণ করবে।
দূরের পদ্মা থেকে জাহাজের হুইশেল আসছে। বোধ হয় কোনো বড় জাহাজ ঝড়ের আয়োজন দেখে নোঙর ফেলতে যাচ্ছে। দিগন্তের একটা কোণে তাকিয়ে দেখি, ঠিকই একটা জাহাজের হলুদ রঙের ক্রেন দেখা যায়। সে অনেক দূরে হলেও ফসলের জমির ওপর দিয়ে মাথাটা দেখা যাচ্ছে। জাহাজটা বেশ বড় বলেই মনে হচ্ছে। তবে মাঝপদ্মায় ঢেউ উঠলে এর চেয়ে বড় জাহাজেরও ঘাম ছুটে যাবে। একবার লঞ্চে করে শরীয়তপুর যাওয়ার সময় দেখেছি পদ্মার কী ভয়ঙ্কর রূপ! সেদিন সেদিন ঝড় ছিল না। শান্তিপূর্ণ ভাবেই পদ্মা-মেঘনার মোহনা পার হয়ে পদ্মায় ঢুকে বিস্তীর্ণ এই জলরাশি পাড়ি দিচ্ছিল। ষাট বা পঁয়ষট্টি হাত দীর্ঘ লঞ্চটাকে পদ্মার মাঝখানে ছোলাবুটের খোসার মতো মনে হচ্ছিল। আমি তখন ভয় পেয়েছিলাম। তবে এটাও ভাবছিলাম যে, এত বড় লঞ্চটায় পদ্মাপাড়ি দিতে আমি ভয় পাচ্ছি, প্রতিটি যাত্রীই পাচ্ছিল। আর কলম্বাস মাত্র ছাপ্পান্ন ফুট দীর্ঘ কাঠের জাহাজ নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে ছিলেন। এজন্যই তিনি সত্যিকার কলম্বাস। আমি বা আমাদের মতো কোনো লঞ্চযাত্রীই সে সামর্থ্য রাখি না।
দূরের জাহাজটার শব্দ উদার জমিনের ওপর দিয়ে বাতাসের সাথে এতদূরে ভেসে আসছে। হুইশেল থেকে গেছে। এখন গড়গড় শব্দ হচ্ছে। নোঙর নামানোর শব্দ। ক্যাপস্টান ঘুরে ঘুরে শেকলের প্যাঁচ খুলে নোঙরটা নিচে নেমে যাচ্ছে। পশ্চিম আর উত্তর দিকের কালিমা সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ যেন এক সহসা সন্ত্রাস! আমার কোনো দিকেই যাওয়া হচ্ছে না। লোকটা বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। আকাশেও মেঘ ছড়িয়ে গেছে। আর হয়তো পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝড় শুরু হয়ে যাবে। এখনই রুনুকে বলা উচিত, দ্রুত যেন ঘরে চলে যায়। আর চুলাটা নিভিয়ে দেয়। বাড়ির আশেপাশে অনেকগুলো খড়ের গাদা আছে। আর আছে ধৈঞ্চা আর পাটখড়ির গম্বুজ। এর যে কোনো একটায় যদি জ্বলন্ত ছাই বা কয়লা উড়ে গিয়ে পড়ে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সহসা একটা শীতল বাতাসে গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। বাতাসটাকে মৃত্যুর মতো শীতল আর সর্বনাশী ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী মনে হলো। আমাকে যেন একটা প্রচণ্ড লাথি দিয়ে দাঁড়ানো থেকে নিচে ক্ষেতের আইলে ফেলে দিয়েছে। আমি উঠে এক দৌড়ে ঘরে না গিয়ে পারলাম না। রুনু তখন গরম ভাতের পাতিলটা রান্নাঘর থেকে ঘওে নিচ্ছিল। অল্পের জন্য দুজনের মুখোমুখি ধাক্কা খেলাম না। ধাক্কা লাগলে গরম ভাতের পাতিলটা রুনুর হাত থেকে পড়ে যেতো। আর আমাদের দুজনেরই পা পুড়ে যেতো। এরপর রুনু রান্নাঘর থেকে তপ্ত কড়াইটা ঘরে নিয়ে এলো। আমি দ্রুত রান্না ঘরে গিয়ে চুলা নেভানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাতের কাছে পানি পেলাম না। ঘর থেকে এলুমিনিয়ামের ভরা কলসিটা নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে চুলায় উপুড় করে ঢেলে দিলাম। ছ্যাঁত করে শব্দ হলেও তা আমার কানে এলো না। অন্য কোনো কারণে আমার কান হয়তো ব্যস্ত ছিল।
চুলাটা ভালো করে নিভিয়ে ঘরে গিয়ে দেখি লোকটা আমাদের ঘরে গিয়ে উঠেছে। ঝড় শুরু হয়ে গেছে, এখন কেমন করে লোকটাকে বের হয়ে যেতে বলি? আর গ্রাম অঞ্চলে কাউকে ঘর থেকে এভাবে বের করে দেওয়াও যায় না। লোকটার মুখে মাস্ক থাকলে আমি বা আমরা মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু লোকটা মাস্কও পরে নাই। দৌড়ে এখন ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে তো বসতে দিতেই হবে। লোকটার বয়স বেশি না, আমার প্রায় অর্ধেক। তেইশ থেকে পঁচিম হতে পারে। সবুজ রঙের দামি টিশার্ট তার গায়ে। নীল জিন্সের প্যান্ট। শরীর থেকে দামি পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। পায়ের জুতাও মনে হয় দামি। আমাদের এক মাসের বেতনের টাকা দিয়েও এমন একজোড়া চামড়ার শু কিনতে পারব না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে এসেছে লোকটা। বেশিদিন হয়ও নাই বোধহয়।
তাই অধ্যক্ষ আমার দিকে না তাকিয়ে সিনিয়রদের স্বার্থে আমাকে বিদায় করে দিয়েছেন। তবে অনলাইন ক্লাস যদি চালু করতেই হয়, তাহলে কি আমাকে আবার ডাকবে? ডাকতেও পারে।
এখানে আসার পরে আমি ভালোভাবে লক্ষ্য করছি, এখানকার মানুষগুলো বেশিরভাগই একেবারে ক্ষেত। কোনো আদব-কায়দা বোঝে না। সরকারি নির্দেশনা মানে না। মাঝে মাঝে এই চরের লোকজন পাশের বাড়ি এলে, অকারণে এইবাড়িতে এসে মাথা ঢুকিয়ে, জিজ্ঞাসা করে, আমরা কোনখান থেকে এসেছি। ঘরটা ভাড়া নিয়েছি কিনা। কী কাজ করি, এসব কথা জিজ্ঞাসা করে। কাজও না, কী কাম করি তা জানতে চায়। যত সব মূর্খ! এখানকার কলেজপড়ুয়া ছেলেগুলোও একই রকম হাম্বা। ওরা কেন যে কলেজে যায় বুঝি না। একটা বাড়িতে কে থাকে না থাকে, তা জেনে তোর এত দরকার কী? বিদেশ থেকে আসা মূর্খগুলো আরো বেশি মূর্খ! গায়ে দামি প্যান্ট, দামি গেঞ্জি আর পারফিউমের ঘ্রাণ থাকলে কী হবে, এগুলোর মাথায় বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছুই নাই। উন্নত দেশে থেকে ওদের আচার-আচরণ উন্নত হওয়ার কথা, কিন্তু আমার মনে হয় এগুলো সে সব দেশে গিয়ে আরো বেশি গরু হয়ে আসে। সেই দেশের আধুনিক ফিটফাট শহরগুলোরে না জানি কেমন অসভ্য আর নোংরা করে রাখে। সব শহরকে মনে হয় ওরা বরিশাইল্লা বা নোয়াখাইল্লা কলোনি বানিয়ে রাখে। এয়ারপোর্টে যে ওরা কী সব কাণ্ড করে, তা সেখানে গেলেই বোঝা যায়। বিমানে নাকি ওদের আচরণে অন্য যাত্রীরা লজ্জিত থাকে। যদিও আমি বিমানে উঠি নাই এ পর্যন্ত, তবে অনেকের কাছেই এসব কথা শুনেছি। সত্যি বলতে কী, কোনো ভদ্র পরিবেশে গিয়ে ওদেরকে নিজজেরার বলে পরিচয় দেওয়াটাও লজ্জার।
আমি দ্বিধান্বিত, তাকে বসতে বলব কি না। আমার ছেলে দুটি মোটামুটি ভয় পেয়ে গেছে। সে ভয় কি ঝড়ের নাকি মাস্কছাড়া একজন অপরিচিত লোকের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তা জানি না। কারণ ওদেরকে প্রতিদিনই শিক্ষা দিয়েছি, যারা এ সময় মাস্ক পরে না, তারা মানুষ বলে গণ্য হওয়ার নয়। ওদের শিশুমনে মাস্কছাড়া মানুষরা এক একজন শয়তান। ভূতের চেয়েও বিভীষিকাময়। ওরা ভয়ে কেঁদে উঠবে কিনা কে জানে। ঘরের ভেতরও বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আমরা ঘরে যারা আছি, তারা বাইরে ঝড় হচ্ছে কিনা তাই যেন ভুলে গেছি। কারণ মাস্কছাড়া একজন অপরিচিত লোক আমাদের ঘরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! লোকটাকে কি বসতে বলব, নাকি বের হয়ে যেতে বলব, তাই বুঝে উঠতে পারছি না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে রুনু চার্জার লাইটটা জ্বেলে খাটের একটা কোনায় রাখল। এতে ঘরটা সামান্য আলোকিত হলো। গতরাতে চার্জার লাইটটা চার্জ দেওয়া হয় নাই। তাই বেশি আলো দিচ্ছে না।
লোকটা দরোজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। বসতে দ্বিধাবোধ করছে। এটা ভদ্রতাবশতই করছে। কিন্তু সে কি তার অন্যায়টা ধরতে পেরেছে? মনে হয় না। এর মধ্যে আমাদের তিন বছর বয়সী ছোট ছেলেটা ওর মায়ের কোলে উঠে আগন্তুকের দিকে চেয়ে আছে। আমি ঘরের দরোজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে কি না, তা দৃষ্টি ফেরালেই বুঝতে পারি। কিন্তু দৃষ্টি সরাতেই যেন ভয় পাচ্ছি।
লোকটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আমার দিকে ফিরে যেন ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘আপনেরা কি এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন? আপনেগো তো এই গেরামের মানুষ বলে মনে হয় না। তাই জিগাইলাম, কিছু মনে কইরেন না।’
আমি যেন মাকড়শার জালের আঠালো তন্তুতে পা দিয়ে আটকে আছি। কী উত্তর দেবো? আর কী উত্তরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে তাও তো জানি না। ভদ্রতাবশত আমাকে মিথ্যা কথাই বলতে হলো। তবে সব মিথ্যা মুখ দিয়ে বলি নাই। তার কথার পিঠে অর্থহীন হা-হু করে উত্তর দিলাম।
এরপর লোকটা অনেক কথা বলল। তার সব কথা শুনতে পাই নাই। বুঝতেও পারি নাই। তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর! তিন দিন আগে সে ইতালির মিলান থেকে এসেছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে আটকেছিল, সেখানে তার গায়ে জ্বও ধরা পড়েছে। তারপর গ্রামে চলে এসেছে। এখানে আসার পরে পুলিশ তাকে খুঁজছে। তাকে চৌদ্দ দিনের আইসোলেশনে থাকার কথা। সে কথা পুলিশ বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সে কথা রাখে নাই, তাই এখন পুলিশ তাকে ধরে নিতে পারে। তার ধারণা, এগুলো পুলিশের অহেতুক হয়রানি। তার মনে হয় তার গায়ে করোনা ভাইরাস নাই। এই পথ দিয়া সে বাজারের দিকে যাচ্ছিল ওষুধ কেনার জন্য। জ্বর আর গলাব্যথার সামান্য ওষুধ। বাজারের কাছে গিয়ে পরিচিত কাউকে দিয়েও ওষুধ কেনা যাবে। এ বাজারে আজ পুলিশ এসেছে কিনা তা আগে খবর নিতে হবে। এখন ঝড়ের কবলে পড়ে তাকে এই বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ভয়ের কোনো কারণ নাই। কারণ, তার মনে হয়, তার সামান্য জ্বর। হয়তো সর্দিজ্বর বা এ জাতীয় কিছু।
এসব কথা শুনে আমার সারা শরীর যেন শিথিল হয়ে আসছে। আমি দরোজা লাগাতে পারলাম না। বরং দরোজার সামনে থেকে সরে গেলাম। লোকটার কাছ থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে ঝড় হচ্ছে কিনা তা জানি না। কারণ আমাদের ভেতরের ঝড়েই আমরা প্রবলভাবে আহতবোধ করছি।
সহসা আমার মনে হলো আমার একটা চাকরি দরকার। তাহলে অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারব। রফিকউল্লাহ কলেজের চাকরিটা অধ্যক্ষ চাইলেই রাখতে পারতেন। শোনা যাচ্ছে কয়েকদিন পরে অনলাইন ক্লাস শুরু করতে হবে, সকল প্রতিষ্ঠানে। সরকারি নির্দেশনা আসছে। আমার বিভাগীয় বস আর মাত্র কয়েক মাস চাকরিতে আছেন। তিনি সেকালের মানুষ। ঠিকমতো মোবাইল ফোনটাই চালাতে পারেন না। অনলাইন ক্লাস তিনি কেমন করে করাবেন? আমার তো এসব বিষয়ে এক-আধটু ধারণা আছে। এই সামান্য যোগ্যতার জন্যও আমাকে ওখানে রাখা যেতো। কিন্তু সিনিয়র এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বোধহয় স্বার্থগত ঐক্য আছে। তাই অধ্যক্ষ আমার দিকে না তাকিয়ে সিনিয়রদের স্বার্থে আমাকে বিদায় করে দিয়েছেন। তবে অনলাইন ক্লাস যদি চালু করতেই হয়, তাহলে কি আমাকে আবার ডাকবে? ডাকতেও পারে।