মাটি আর জল
মাটি আর জল মিলে কেন কাদা হয়!
ওরা কি সিলভার রঙ মেখে মিশে থাকে
গভীর সঙ্গমে চিরদিন তবে?
দুপুরের ভারসাম্য মিলিয়ে বাতাসের গন্ধে
সন্ধ্যার হাত ধরে জুড়িয়ে নেয় অস্তিত্বের অপূর্ণতা?
তবু, তোমার দিকেই চেয়ে থাকি মহাকাল
তাপহীন সবুজের অনুরণন দেখি মহাকাশে
যে জলে পদ্ম ভেসেছে নিরন্তর,
তার কাছ থেকে ধার নেওয়া হাসির সত্য
বয়ে চলে মানুষ জীবনভর, রহস্যের সঙ্গে
আমি দুঃখ লুকাতে পারি বলেই হাসি
আর নিজের মতো করেই দুঃখের নির্জনে ঘর বাঁধি
একা হতে হতে মিশে যাই বর্ষণসম্ভব মেঘে।
মাটি আর জল মিলে কাদা হয় কেন—
এ প্রশ্নের উত্তর কবে পাব মহাকাল?
শ্রেষ্ঠ অহঙ্কার
কাজ শেষে সবাই ঘরে ফেরে, আর আমি এক পাহাড় অপেক্ষার অহঙ্কার বুকে নিয়ে বসে থাকি। প্রতিদিনের মতো ভাবনার পৃষ্ঠা ওল্টাতে-ওল্টাতে পাঠ করতে থাকি তোমার গোপন কথাগুচ্ছ, কখনও মোহময় শব্দের ঘরে দিবানিদ্রায় মগ্ন হই; তখন রাঙা অভিমানগুলো কি এক তীব্র অনুভবে সুর তোলে হৃদয়ে। সুরের বেহাগে ভেসে যায় অপেক্ষা কষ্টগুলো। কর্মক্লান্তি মুছে তাই বাড়িয়ে রাখি চুম্বনের দৃঢ়তা…
জেনেছি, পথ বেঁকে গেলেও নদী ও পথের সমান্তরাল ভ্রমণ সমাপ্ত হয় না কোনোদিন। তাই যে যা-ই ভাবুক, ভাবতে দিও তাদের মতোই। কেননা, সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে তুমি আমার শ্রেষ্ঠ অহঙ্কার…
সেলফি
জীবন-ফ্রেমের কিছু সময় মুখোমুখি দুজন। সামনে আধুনিক বিজ্ঞানবিশ্বের হাতছানি, ফাইভ ডাইমেনশনের ভৌতিক ছলনা। দুর্বল করে নি আমাকে কারণ, ভরসা ছিলে তুমি! আগলে রেখেছিলে নিজের থেকেও অনেক বেশি। কোটি নক্ষত্রের ভিড়ে তোমার উষ্ণতায় অশান্ত হৃৎস্পন্দন, ভুলে গিয়েছিলাম নীহারিকার অগ্নিস্তূপে আমার জন্মসত্য, আর গোলক বিশ্বের ঘূর্ণ্যমান গ্রহ-উপগ্রহের দিকে ছুটছিলাম তোমাকে নিয়ে। যেন তৃষ্ণার্ত শালিখের মতো সঞ্চিত জলে পিপাসা মেটানোর দায়। তবু দুজনের মাঝে জেগে ছিল অদৃশ্য দেয়ালের অনুভূতি, হতে পারে প্রকৃত ভালবাসা সেখানেই নিহিত!
কনকাঞ্জলি
নগরের পরিশ্রান্ত প্রতিটি রাত যেন মমতায় ঘেরা
অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রাখা প্রিয় একটি চাঁদ!
তুমি রয়েছো তারই মুগ্ধ জ্যোৎস্নায়, সঙ্গোপনে
ভালোবাসি বলেই বলছি—
আমি এক অভিমানী মেঘবালিকা, বৃষ্টিকাতর
কখনও দলছুট বালিহাঁস এক গভীর সমুদ্রে
দেখো, ছুটে চলেছি অবিরত তোমার ভুবনে
তোমার একান্ত কবিতায় বিসর্জন দিতে
জীবনের সকল শূন্যতা…
যদি চাও রাধা হব
গুচ্ছগুচ্ছ কামিনীর সুগন্ধ ছড়াব তোমার হৃদয়ে
কিংবা, নিঃসঙ্কোচ কনকাঞ্জলিতে নিঃস্ব হব প্রতিদিন
তোমার শৈল্পিক বাসনায়…
শ্রমঘন সন্ধ্যার গান
আমার এ আহ্বান কালের চাকায় ঘোরা
জ্বালাময়ী আগুন
রক্তে-ঘামে মিশে আছে শরীরের ধূসর ডানায়,
যে আগুন সভ্যতাকে টেনে তুলেছে বার বার
সংঘাতময় পৃথিবীর ইতিহাস খুঁড়ে।
আমার এ আহ্বান অনন্ত সমৃদ্ধির
উজ্জীবিত স্লোগান
কালের পথ মাড়াতে মাড়াতে তীর খুঁজে পেয়ে
আলোর সংকেতে উঠে আসা রক্তনদী।
ওই দেখো দূরে জ্বলছে দুর্বিনীত আলোকশিখা
সফলতা ছুটছে শ্রমিকের দাঁড় বেয়ে,
এই কৃতিত্ব নিয়ে এগিয়েছে শতাব্দী, এগিয়েছে সব
শুধু ফেরে নি দিনবদলের কারিগরের ভাগ্য, তাই
আর নয় অনিয়মের চাবুক কিংবা শ্রমঘন সন্ধ্যার গান
আজ অধিকার হোক বৈষম্যহীনতার, ন্যায্যতার।
স্মৃতির আশ্রয়
আমি হারাতে চাই না অন্য পৃথিবীর স্বর্ণ-শিখরে।
কেবলি যাত্রী হতে চাই নিজস্বতার
কিন্তুর পাখায় ঘুঙুর বেঁধে কামিনীর সুবাস বিলাতে।
ওই দেখো প্রবহমান জলধারায় পিপাসা মেঠাতে
ছুটছে তৃষ্ণার্ত পাখি, আর আমি
দহনবীণার সুর গচ্ছিত রেখেছি মৌন জলে
যেখানে আকাঙ্ক্ষার পরীরা গভীর নিমগ্নতায়
শিল্প খুঁজে ফেরে
আজ শুধু ধানশালিকের দেশ, নয় কোনও পরদেশি ভূমি
তার কেশরে গেঁথে দিলাম সঞ্চিত আত্মকথা।
আগমনে-বিসর্জনে
শারদীয় সন্ধ্যা যখন অন্ধকার ছুঁতে যাচ্ছে
তখন মন্দিরের বারান্দা ডাকছে আমাকে—আয়
কিছুক্ষণ বসে যা, অঞ্জলি দিয়ে চন্দনের ঘ্রাণ শুঁকে নে।
অন্তরে বেজে উঠেছে সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি
তুমি বলেছ সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাও শীর্ষে, তুমিও মানুষ
অথচ চেয়ে দেখি কালের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি
কম্পিত হৃদয়ে বলেছি—কাছে আসো
আর প্রণামের দীক্ষায় দীক্ষিত করো আমাকে
যে দেহ মিশে আছে তোমার প্রার্থনার মহিমায়,
মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা-গির্জার প্রভেদ না করে।
সৃষ্টির ভেদ কে জানে বলো? সৃষ্টি তো কেবলি রহস্যময়,
আকাশ থেকে মাটি, উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে রয়েছে অনন্তের পথে,
অথচ মানুষে-মানুষে কেবলি বিভেদ—দেবতারাও গৃহহীন
যদি ফেলে যাও কখনো, রেখে যেও মৃত্যুর নীরবতা!
চিরযৌবনা বৈশাখ
অবিনশ্বর প্রেম বিলিয়েছো লাল শাড়ি জড়িয়ে থাকা রাঙা পায়ে, হৈ চৈ মাতমে প্রাণবন্ত মেলা বসিয়েছ বাংলার পথে-ঘাটে-মাঠে। আমি ভেসেছি তোমার স্নিগ্ধতায় শৈশব, কৈশোর; এখন অর্নিবাণ যৌবনের মায়া জ্বেলে ইন্দ্রনীল চোখে দেখি কুসুম প্রেমের চুম্বনমিশ্রিত সকাল, সিঁদুরের মত খল-খল দুপুর, গোধূলির মহুয়া মাখা সূর্যের প্রসন্নতা। হে বৈশাখ, চিরযৌবনা; তুমি সবুজ বাঙলায় কুমারীর পালকে জমানো অশেষ কৌতূহল। সান্ত্বনার বাণী নিয়ে তাই নতুন সমারোহে বিকশিত হও প্রতিবার, প্রাণের উষ্ণতায়।
অনামিকা তুলেছি হেমন্ত আকাশে
হাতের উপর পৃথিবী রেখে কেটেছে পনের বছর
বিলাপ করতে করতে ছুটে গেছে দুঃখনদী
বুকের ওপর দিয়ে রোজ। পাখির পায়ের শব্দে
স্বপ্ন ভেঙেছে শতবার। নিয়ম-অনিয়মের বর্ষায়
ভিজে গেছে সঞ্চয়ের দিন-রাত।
অভাবিত শ্রাবণ ছুঁয়ে ভাদ্রবউ ভেসে গেছে দূরে,
আবছায়া অন্ধকারে।
শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে রোদের সঙ্গে বেঁধেছি ঘর
তোমার আশ্রয়ে, আত্মঅহম বেঁচে আছে তাই।
কেননা রাগের পিয়ালায় মাতাল পানীয় ঢেলে
পান করেছ তুমি আশা-ভঙ্গের নোনা জল
ক্রমে আসবে জেনে আশ্বিনের আলোঝরা দিন…
বৃদ্ধাঙুলের অহংকার দেখে কেটেছে পনের বছর
এবার অনামিকা তুলেছি হেমন্ত-আকাশে।
টুকরো কবিতা
১.
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পাথর
অথচ পর্দার ওপারে কেউ ছিল না
‘র’ চায়ে সখ্য সবার জন্য নয়।
২.
আকাশের নিচে উসকে ওঠে শরীর
স্বাধীনতা মানেও যথেচ্ছাচার নয়
অনুভূতিমালা ভাসিয়ে দিয়েছি জলে।
৩.
মৃত্যু রঙে বিলাপ সাঁতরায় পাঁজরে
শরতের কোনও দোষ ছিল না এতে
সমাজের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে চিহ্ন।
৪.
অচেনা নগরীতে জমে ওঠে ভিড়
বোধের ভাষা ভেঙে হয় খান খান
সভ্যতার খোঁজ নেই আতশীকাচেও।
- অনামিকা তুলেছি হেমন্ত-আকাশে : দীনা আফরোজ, গ্রন্থমেলা ২০১৬, কবি প্রকাশনী, প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান, মূল্য: ১৩০ টাকা