[কিস্তি-৬]
পরদিন দুপুরের আগেই দুই বন্ধু হাজির অনীল ধোপার বাড়ি। উঠোনের এককোনে গাছের নিচে আসন গেড়েছে তারা। বিকেলে আসার জন্য বলেছিল অনীল ধোপা। কিন্তু উত্তেজনার চোটে তারা দুপুরের আগেই এসে হাজির। খানিক পর পর গিয়ে নন্দীর জন্য ঘাস ছিঁড়ে আনছে অতুল। তখন নূর আলম পাহারা দিচ্ছে নন্দীকে। আবার নূর আলম কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে আনতে গেলে অতুল পাহারা দিচ্ছে। এভাবে সময় কাটাচ্ছে তারা। ওদিকে বাড়ির ভিতরে বেশ অস্থির সময় কাটাচ্ছে অনীল ধোপা। কাল ছেলে দু’টোর কাছ থেকে জামাটা নিয়ে সে কোথায় রেখেছে মনে করতে পারছে না।
সাধারণত যে কাপড়গুলো ধোয়া হবে, সেগুলো আলাদা একটা জায়গায় রাখা হয়। ধোয়া কাপড়ের আলাদা স্থান। আয়রন করে ডেলিভারি করা কাপড়ের আলাদা স্থান। জামাটা ধোলাইয়ের গাদায় থাকার কথা। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো হদিস মেলেনি তার। কাল এমনিতেই বিশেষ একটা ব্যথায় অস্থির ছিল অনীল। মনোযোগ সেদিকেই বেশি ছিল তার। অন্যমনস্ক অবস্থায় জামাটা কোথায় রেখেছে, সেটাই এখন মনে করতে পারছে না সে। জামাটার কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ছেলে দুটো গাছতলায় এসে বসার পর সেটার কথা মনে পড়েছে তার। এখন কাঁচার জন্য খুঁজে হয়রান হচ্ছে। ধীরে ধীরে তার মেজাজের পারদও চড়ছে।
সারা দুপুর খুঁজেও জামাটা পেলো না অনীল। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। দুটি আশাভরা কচি মুখের দিকে জানালা দিয়ে কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখেছে সে। তাদের দেখে আরও মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। কালকের ঘটনার জন্য ওরাই তো দায়ী। আবার ওদের কাজের জন্যই সে হয়রান হচ্ছে। ভেবে রাগ আরও বেড়ে যায় তার। বাড়ির লোককজনকে গড়ে একবার মেজাজ দেখিয়েছে। বাইরে থেকে সেই ঝাঁজের একটু আভাস পেয়েছে দুই বন্ধু। কিন্তু ঝাঁজের কারণ তাদের অজানা। খানিক পর অনীল ধোপাকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় দুই বন্ধু। আশায় দোদুল্যমান চাহনিতে চেয়ে থাকে। রাগ দেখিয়ে ভাগিয়ে দেবে বলে মনস্থির করে এসেছিল অনীল। কিন্তু তাদের সামনে এসে আর রাগ দেখাতে পারে না। বরং একটা দ্বিধাগ্রস্ত দোটানা তাকে টানতে থাকে। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। হ্যাঁ অথবা না-এর মধ্যেই থেকেছে সে আজীবন। কিন্তু আজ এই নতুন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কেমন যেন খাবি খাওয়া অবস্থা হয় তার। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘জা-জামাডা খুঁ-খুঁজে পাচ্চিনে। তুমরা সন্দের দিকি একবার এসো।’ কণ্ঠের সেই ঝাঁজ কোথায় গেলো, নিজেও জানে না অনীল। একটা অপরাধবোধে ছেয়ে থাকে তার মন।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। হাত-পা-মুখ কিছুই চলে না তাদের। আশাভঙ্গের ব্যথায় অসাড় হয়ে গেছে ওদের সমস্ত জগত সংসার। ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারে না অনীল। ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায় সে।
তবু খটকা লাগে, ধোপার বাড়ি থেকে এমন চকচকে পলি পেপার মোড়ানো জামা আনবে কেন অতুল? বড় জোর খবরের কাগজে মোড়া থাকবে—তুই কি জামা কিনিচিস অতুল? টাকা কনে পালি? নন্দী কনে? গলা কাঁপে নুর আলমের।
—তুই বাড়ি যা তালবেলেম। স্থির কণ্ঠে বলে অতুল।
—হুম? ধ্যান ভাঙে যেন নূর আলমের। চোখ তুলে তাকায় অতুলের দিকে, মুখে কথা জোগায় না।
—আমি জামা নিয়ে আসচি, যা বাড়ি যা। হেসে বলে অতুল।
এই হাসির কোনো অর্থ করতে পারে না নূর আলম। কেমন যেন অশুভ ঠেকে তার কাছে। হঠাৎ অতুলকে খুব পরিণত একজন মানুষের মতো লাগে তার কাছে। ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার কোনো আগ্রহ বোধ করে না। সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন ঠেকে তার কাছে।
নদীর তীরে একটা মরা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়ে নূর আলম। সূর্যটা একটা লাল গোলার মতো হয়ে যায় চোখের সামনে। তারপর ধীরে ধীরে গাছ-পালার আড়ালে আত্মগোপন করে। কেমন একটা বিষণ্ন লালিমা ছড়িয়ে থাকে আকাশের গায়ে। দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে।
ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির পথ ধরে নূর আলম। চোরের মতো নিঃশব্দে বাড়িতে ঢোকে। দু’টি কূপি বাতির আলোয় ছোট্ট উঠোনের অনেকটা অংশ আলোকিত হয়ে আছে। তাদের বাড়িতে মাত্র একটি বাতি। একটির বদলে দু’টি কূপি বাতি কেন জ্বলছে, তা চট করে মাথায় আসে না তার।
বিকেল পেরিয়ে গেলেও নূর আলম বাড়ি ফেরে না। ছেলের চিন্তায় উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে সুকবাসী। সন্ধ্যায় নুরুজ্জামান বাড়ি ফিরলে ছেলের অন্তর্ধানের কথা জানায়। সঙ্গে সঙ্গে ছেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে নুরুজ্জামান। আশপাশে খুঁজে না পেয়ে দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করে বাড়ি ফেরে। এর খানিক বাদেই কূপি হাতে অতুলের বাবা-মা ছেলেকে খুঁজতে নূর আলমদের বাড়িতে হাজির হয়। অনেকক্ষণ ধরে তারা ছেলে দু’টিকে খুঁজছে, এটা জানার পর সুকবাসী আর নুরুজ্জামানের উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। কাল সকালে কোরবানির ঈদ। ছেলে দু’টি এভাবে কোথায় যে গায়েব হয়ে গেলো! নানা ধরনের দুশ্চিন্তা তাদের মনে ফনা তুলে নাচানাচি করতে থাকে।
উদ্বেগের নদীতে যখন দুই বাবা-মা হাবুডুবু খাচ্ছে তখন নিঃশব্দ পায়ে বাড়ি ঢোকে নূর আলম। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার ওপর। ঝাঁজ মিশিয়ে তাই কাছে ডাকে সুকবাসী। কৈফিয়তের সুরে জানতে চায়, সারাদিন কনে ছিলি? জবাব দেয় না নূর আলম। মারার জন্য চড় তোলে সুকবাসী। কিন্তু মারার আগে খপ করে হাতটি ধরে ফেলে মাধবী। নরম সুরে জানতে চায়, কী হইচে বাপ? কনে ছিলে সারাদিন? অতুল আর নন্দী কনে জানো?
নরম সুরের প্রশ্নগুলো নূর আলমের ব্যথার ক্ষতটি যেন খুঁচিয়ে দিলো। চোখ থেকে টপটপিয়ে পড়া পানির দুটো ফোটা জোব্বার গায়ে কালো নকশা এঁকে দিলো। এর চেয়ে মায়ের হাতের মার খেতেও বুঝি ভালো লাগতো তার। চোখভর্তি পানি নিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে শুরু করে সে। এক সময় কথা শেষ হয়ে যায়। বিষাদময় একটা আবহ রাতের পরিবেশটিকে আরও আড়ষ্ট করে তোলে।
নূর আলমের কথা শুনে নুরুজ্জামান আর মনোরঞ্জনের চোখের কোন চিকচিক করছিল। পরস্পরকে ফাঁকি দিয়ে তারা চোখ মুছে নেয়। অস্ফুট স্বরে সুখরঞ্জনকে নুরুজ্জামান বলে, অনেক রাত হলো, চলেন দাদা দেরি না করে ছেলেডারে অনীল ধুপার বাড়িত্তে নে আসি।
—চলেন যাই। সম্মতি দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মনোরঞ্জন। কয়েক পা এগুতেই বাড়িতে ঢোকে অতুল। হাতে একটা কাগজের প্যাকেট। আবছা আলোয় তাকে হঠাৎ চেনা যায় না। তার ওপরে সঙ্গে নন্দী না থাকায় তাকে আলাদা করে চিনতে একটু বেগ পেতে হয়। নিজের বাবা-মাকে নূর আলমদের বাড়িতে দেখতে পাবে আশা করেনি সে। একটু যেন ঘাবড়ে গেলো অতুল।
কী বলবে বুঝতে না পেরে, এই দেক, জামা নে আইচি। বলে হাতের প্যাকেটটি বাড়িয়ে দেয় নূর আলমের দিকে। তারপর মুখে অপ্রস্তুত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে ভেতর থেকে জামা বের করে নূর আলম। হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তার সেই নতুন জামা। তবু খটকা লাগে, ধোপার বাড়ি থেকে এমন চকচকে পলি পেপার মোড়ানো জামা আনবে কেন অতুল? বড় জোর খবরের কাগজে মোড়া থাকবে—তুই কি জামা কিনিচিস অতুল? টাকা কনে পালি? নন্দী কনে? গলা কাঁপে নুর আলমের।
(শেষ)