কখনো সাক্ষাৎ হয়নি কবির সঙ্গে। কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লিখা আর না করে লিখার মধ্যে ব্যতিক্রম নেই। গ্রন্থটির সবগুলো কবিতা পড়েছি। প্রতিটি কবিতা মানসন্মত নিগুঢ় প্রেমের কবিতা। যারা কবিতা পড়ে ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগতে গিয়ে মনের অগোচরে বিচরণ করেন তাদের জন্য এটি একটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ। ভালোবাসা বা প্রেমের প্রকৃত সংজ্ঞা কী হতে পারে? প্রেম জীবনের সুখ কিংবা অতৃপ্তির স্বাদ। জীবনের সুখ-স্বপ্ন-স্মৃতি, বঞ্চনা ও মধু মিশ্রিত স্মৃতি-বিস্মৃতির রোমন্থনের অভিজ্ঞতা এমন কিছু। যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নরনারীর হৃদয়ের মণিকোঠায় সদা-জাগ্রত জ্বলন্ত প্রদীপ। ভবিষ্যতের মতো অনিশ্চিত এবং রোমাঞ্চকর অথবা সম্ভাবনাময় যাত্রার মতো এক অভিযাত্রা। মানুষের জীবনের অপ্রতিরোধ্য নতুন এক আনন্দ অনুভূতির নাম ভালবাসা।
‘আমি তোর রাফখাতা’কাব্যে মামুন রশীদের কবিতাগুলোতে একই রকম প্রেমের গভীরতা অনুভব করা যায়। প্রতিটি কবিতাই বারবার পড়ে বুঝার মতো ভাবনার বিষয়। ‘বর্ণমালা’ কবিতাটি পড়ে মনে হবে প্রেমিকাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা। কিন্তু ‘বর্ণমালা’ কবিতাটি বাংলা বর্ণমালাকে প্রেমিকের চোখে দেখেছেন। এই ভাষার উত্থানের জন্য যে রক্তক্ষয় হয়েছে, সেকথা ও পরোক্ষভাবে দেশের স্বাধীনতার ওপরেও ইঙ্গিত রয়েছে। নিম্নের কয়েকটির কয়েকটি লাইন থেকেও তা বোঝা যায়।
বর্ণমালা রক্তাক্ত যে যাত্রার ভেতর দিয়ে তুমি চির জাগরুক
আবিষ্কারের আগেও যেমন ছুটেছে সময়, তার রথে তোমার
জন্য বিনীত ভাষায় পৌছে দিলাম-ভালোবাসা।
কবিতা বুঝে নিতে হয়। কবি কবিতা লিখে তাতে মনের ভাব গেঁথে রাখেন। বুঝে নিতে হবে পাঠককে কবিতাটি পড়ে-কেমন সে ভাব, যা লুকায়িত রয়েছে। কিন্তু সে কবিতা বুঝতে না পেরে কবির নিকট বুঝতে যাওয়া ঠিক নয়। যারা ভাবনার জগতে বিচরণ করতে ভালোবাসেন একমাত্র তারাই কবিতার রহস্য সহজে বুঝে ফেলেন। কবিতাটির প্রথম প্যারাগ্রাফটি হলো:
বর্ণমালা প্রেমে না অপ্রেমে তাকিয়েছিলাম বুঝিনি।
প্রথম দেখার মুগ্ধতা তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।
তাই রেশ চাইনি হারিয়ে যাক,
তোমাকে ছুঁয়ে দেখা যাবে, তোমার অফুরন্ত
প্রাণ শক্তির ভেতর থেকে
দুঃখ আর আনন্দের ঝর্নাধারা
কবিতার মধ্যস্থলে আছে:
দীর্ঘ হাহাকার পেরিয়ে, আমাকে অম্লান করে রাখতে পারে,
কল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে অস্ফুট শব্দ ক্রমশ আমার হতে পারে,
এই ধারণা তুমুল সাক্ষৎ দিতে থাকে-
টকটকে শিমুলের ঝরে পড়ার ভেতরে।
কবির ‘এক মিনিট’কবিতাটিও প্রেমের ছোটখাটো উপাখ্যান। সে কবিতাটির প্রথম দু’লাইন :
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
মনে হয়, তোমার সঙ্গে আমার দূরত্ব এক মিনিট!
কবির কল্পনার জাল বিস্তৃত রয়েছে কবিতাটির ভেতরে। তিনি রাতের আকাশে হাওয়াই জাহাজ আকাশের মুখে মুখ রেখে উড়তে দেখেছেন। তার কল্পনার মাত্রা এক মিনিট। কবিতাটি শেষ করেছেন নিম্নের তিনটি লাইনে:
শীতকাল এখনো অনেক দূরে, বইছে গ্রীষ্মের লু হাওয়া
তরঙ্গ থেকে তরঙ্গে সেঁতু বাঁধতেও বারবার ভুল হয়।
কিছুক্ষণ থেকে ভেঙ্গে যায়, তাও ঠিক এক মিনিট!
‘রাফখাতা’ কবিতাটিতে ‘আমি তোর রাফখাতা’ কাব্যগ্রন্থটির টাইটেল কেন হলো সে রহস্য খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রেমিকের মনে প্রেমিকার প্রতি অব্যক্ত অভিমান কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে। তরুণকালের প্রেম অত্যন্ত সেন্সেটিভ হয়। তখন প্রেমিক-প্রেমিকার মন ভিন্ন পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকে। যৌবনের প্রথম প্রেমের ক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতার স্বাদ সবাই কম বেশি আস্বাদন করে।এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি থেকেই তার উৎপত্তি হয়।তখন তরুণ-তরুণীর মনে সুপ্ত-প্রেম জেগে ওঠে। তার মধ্যে থাকে অভিমান ও ভালোবাসার টুকরো অভিজ্ঞতার চিরকুট বা চিহ্ন। সেই চিরকুট লিপিবদ্ধ হয় জীবনের রাফখাতায়। ক্ষুদ্র কবিতা, প্রেমপত্র, বিভিন্ন রকম মন্তব্য এবং গান ছাড়াও মোটা রাফখাতায় মনের অজান্তে অনেক কিছু লিখে ফেলে। তন্মধ্যে রয়েছে প্রেমিক প্রেমিকার মান অভিমান ও বিচ্ছেদের ইঙ্গিত।
বয়সের সন্ধিক্ষণে অবেগপ্রবণ মনের গোপন কথাগুলো অতি যত্নের সঙ্গে লিখে। তরুণ মনের প্রেমানুরাগ আরও হাবিজাবি আবোল-তাবোল প্রলাপ বাক্যতে পরিপূর্ণ রাফখাতাটি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। যেন অত্যন্ত গোপন কথাগুলো রয়েছে, যে খাতাটিকে বুকশেলফের কোণায় অতি যত্নে রাখতো সেই রাফখাতাটিকে পরবর্তী সময়ে অনেকে ভুলে যায়। তারপর মনের অগোচরে কোনোদিন বুকসেল্ফে নজরে পড়লে সেটা বের করে বিবর্ণ খাতার পাতাগুলোতে নজর বুলিয়ে আত্মপরিচয় গোপন করতে সেটিকে ঘরের অন্ধকার কোণাতে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর সেটা হাত বদল হয়ে এক সময় ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে স্থান পায়। তারপর খাতার পাতাগুলোতে তৈরি হবে মুদি দোকানের ঠোঙা।
‘বর্ণমালা’ কবিতার প্রেম এবং ‘এক মিনিট’ কবিতার প্রেম ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি কবিতায় কবি একজন নিখাদ প্রেমিক। কবিতাগুলো উপভোগ্য।আমার মতে তিনি একজন উঁচু ধাপের কবি। আশাকরি পাঠক তাঁর কবিতা পড়ে সমৃদ্ধ হবেন।
তরুণ কালের ইতিহাস বিলুপ্ত হয়ে যায় পথের আনাচে-কানাচে। তখন প্রেমিক বা প্রেমিকা বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কবি এই কবিতায় নিজস্ব তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখামুখি দাঁড়িয়ে তার প্রেমিকা–যার সঙ্গে একসময় গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তার কাছ থেকে কোন কারণে মনোমালিন্যের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন ‘আমি তোর রাফখাতা?’কবিতায় প্রেমিকের মনের গভীর ক্ষোভ প্রকাশ কবিতার নিম্নের প্যারাতে রয়েছে:
একেবারেই অনিহামাখা, জোড়াতালি দেওয়া
যত্নের সুখহীন দূরত্বে, মাঝেমাঝে টেনে আলোছায়াহীন,
এক কোনে ফেলে দেওয়া…
আমি তোর রাফখাতা?
নিম্নের প্যারাটিতে:
যত্নের আড়াল টেনে তার পরিচয়ে বাঁধা পরে
দূরে হেঁকে চলা ফেরিওয়ালার ঝাঁপিতে,
বল, সত্যি আমি তোর রাফখাতা?”
গ্রন্থটিতে আরেকটি কবিতার নাম,‘অভিশাপ’।কবিতাটিতে প্রেমিক আত্মাহুতি দিতে ‘টোপ’ হয়ে ঝুলে আছেন। আত্মাহুতির জন্য কেন তিনি টোপ হলেন? তার কারণ পাওয়া যায় কবিতাটির দুটি প্যারাতে লেখা ৯ লাইনের এই ছোট কবিতাটির প্রথম ৪টি লাইনে:
নত হতে হতে কেঁচো হয়ে গেছি
হেরে যেতে যেতে কেঁচোহয়ে গেছি
ভয় পেতে পেতে কেঁচো হয়ে গেছি
মুখোশ পড়তে পড়তে কেঁচো হয়ে গেছি!
এই ক’টি লাইনে কবির মনে কোন কারণে প্রবল উত্তেজনার ঝড় বইছে সে আভাস পাওয়া যায়। কবি কি কোনো অপ্রিয় অবাঞ্ছিত অশুভ এমন কিছু দেখেছেন–যা তিনি কখনো আশা করেননি? অথচ অশুভ যা, তাই তিনি দেখেছেন। তাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেকে তিনি কেঁচোর সমতুল্য মনে করছেন। কী দেখেছেন, তা বোঝা যায় কবিতাটির শেষাংশে:
আমি মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে, লুকিয়ে পড়তে পড়তে…
কিন্তু একি? বেরিয়ে পড়েছে শরীর, পায়ের শেকল,
চারিদিকে চিৎকার, উল্লাস, পুলকিত হাসি…
আমিও টোপ হয়ে বড়শিতে গেঁথে নিষ্পলক অপেক্ষায়
কখন জলের অতল থেকে গিলে নেবে মৃত্যু!
ওপরের প্যারার কথাগুলোর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই মনে করি। তার অর্থ খুঁজে নেওয়ার দায়ীত্ব এখন সকল পাঠকের উপর।কবির লেখা সবগুলো কবিতাতে রয়েছে প্রেম এবং বহুমুখী চিন্তার খোরাক। ‘বর্ণমালা’ কবিতার প্রেম এবং ‘এক মিনিট’ কবিতার প্রেম ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি কবিতায় কবি একজন নিখাদ প্রেমিক। কবিতাগুলি উপভোগ্য।আমার মতে তিনি একজন উঁচু ধাপের কবি। আশাকরি পাঠক তাঁর কবিতা পড়ে সমৃদ্ধ হবেন।