একটি দেশ ও জাতির জনগণই ভাষার মালিক।
জনগণের মুখেই ভাষা বেঁচে থাকে, এ কথা যেমন সর্বত্র সত্য, তেমনি ভাষাশিল্পীদের হাতে সাহিত্যিক-ভাষার লালন-পালনসূত্রে তার শ্রীবৃদ্ধি ও উৎকর্ষের মানদণ্ডও সূচিত হয়। কাজেই এক অর্থে ভাষাশিল্পীরা ভাষার শাসকও বটে।
একথা সর্বজন স্বীকৃত, ভাষা শুধু মুখেই বেঁচে থাকে না, একটি জাতির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লিখিত রূপের ভেতরও ভাষা বেঁচে থাকে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যেমন অপরিহার্য আলো-হাওয়া এবং জল-রৌদ্রের যূথবদ্ধ সুপুরিবনের ছায়াশীতল সতেজ আবহাওয়া, ভাষার জন্যেও তা প্রণিধানযোগ্য। ভাষাশিল্পীরা ভাষার কৃত্রিম শাসন-বারণসহ মূলত আদর-সোহাগ ও ভালোবাসায় তার শ্রীবৃদ্ধির কাজটি সম্পাদন করেন জীবনব্যাপী।
কবি ব্রায়ান জিসিন তার কাট-আপ পদ্ধতির কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কবিদের কাজ হলো, শব্দের বুকে যে গান ভরা আছে, সেগুলো তাদের গাইতে দেওয়া।’
বাংলা ভাষার শব্দ স্বয়ম্ভর, এর রয়েছে নিজস্ব সঞ্জীবনী শক্তি-চেতনা। ভাষাশিল্পীরা যে কেউ তাদের সক্রিয় করে তুলতে পারেন। শিল্পীদের কাজই হলো শব্দকে মুক্তি দেওয়া, আত্মনির্ভরশীলতা দান করা। বলা যায়, ভাষার এই সাধনায় জীবন প্রণিপাত করেন একজন ভাষাশিল্পী নিজের সৃষ্টি-কৌশলে। এই কারণেই ভাষা সৃষ্টির অপূর্ব সোপান টপকে তবেই পূর্ণতা পেয়েছে মানবসভ্যতা।
পৃথিবীর ১৪ হাজার ভাষার মধ্যে বিগত ১০০ বছরে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় আট হাজার। এর মধ্য থেকে মাত্র ৪ শতাংশ ভাষা অর্থাৎ শ’তিনেক ভাষা দিয়ে পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করছে।
এই যে এত ভাব, বিভাব, অনুভব; এমনকী অভাব, এর সব কিছুর অন্তরালে মজ্জমান রয়েছে জাতিগত ভাষার অতলান্তিক এক অনন্য স্বভাব। কাজেই বাংলা ভাষার দরবার রাজকীয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান সুদৃঢ় বটে। মোট ব্যবহারকারী বিবেচনায়ও বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলা।
বিভিন্ন পরিসংখান বিশ্লেষণে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ১৩০০ বছরের পুরোনো এই বাংলা ভাষা সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় রয়েছে হাজার বছরের চড়াই-উৎরাই পর্ব। সেসব আলোচনার অবকাশ নেই, স্বল্প কথায় বলা যায়, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ঝরনাতলা থেকে প্রবাহিত হয়ে পূর্বসূরি পালি-প্রাকৃত ও অপভ্রংশের অববাহিকা হয়ে বিভিন্ন নদ-নদীর মতো উপভাষাগুলো আত্মস্থ করে তবেই প্রকৃত বাংলার জন্ম।
কবি হলেন ভাষার শাসক। ভাষার রাজ দরবারে তারাই সম্রাট। কেবল সত্যদ্রষ্টা কবি নন, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিল্পী, গীতিকার—যারাই ভাষার শিল্পী, ভাষা নিয়ে কাজ করেন, তারা সবাই এককথায় ভাষার শাসকগোষ্ঠী।
নদীর মতো তাই ভাষাও গ্রহণ-বর্জন করে। এপার-ওপারের শেকল ভাঙার গান গেয়ে নিরন্তর ছুটে চলে। এঁকে-বেঁকে-পথে-প্রান্তর থেকে খড়কুটোর মতো বিভিন্ন ভাষার শব্দ কুড়িয়ে নিয়ে বাংলা ভাষা তার আপন সৌধ নির্মাণ করে চলে নিরবধি। চারুশিল্পের এই নির্মাণ কখনো শেষ হওয়ার নয়। এ কারণে ভাষা সতত প্রসবকাতর। মায়াচূর্ণে বিভাসিত তার দেহ-মন-আত্মার অগ্নিশিখা। যেন হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলে তার নিজস্ব পথে।
একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারি, বাংলাভাষা তার রূপ পাল্টেছে যুগ থেকে যুগে, যুগান্তরে। শতক পেরিয়ে কালের মন্দিরে তার অব্যাহত যাত্রার ধ্বনি বেহালার সুরে-সুরে বাজিয়ে চলেছে অক্ষর, বর্ণ ও শব্দসমষ্টির সমবায়ে, নতুন নতুন আবিষ্কারে।
কাজেই প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা থেকে বর্তমান সময়ের ভাষার মধ্যে পার্থক্য হয়ে ওঠে যোজন যোজন। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে ভাষাশিল্পীরা, তারাই মূলত ভাষার শাসকশ্রেণীর অংশবিশেষও বটে।
কবিরা কি ভাষার কাঙাল?
না, প্রথমেই বলে নিয়েছি, কবি হলেন ভাষার শাসক। ভাষার রাজ দরবারে তারাই সম্রাট। কেবল সত্যদ্রষ্টা কবি নন, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিল্পী, গীতিকার—যারাই ভাষার শিল্পী, ভাষা নিয়ে কাজ করেন, তারা সবাই এককথায় ভাষার শাসকগোষ্ঠী।
বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাস, তার উৎস, ঐতিহ্য, অন্যান্য ভাষার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক, তার অভিবাসন প্রক্রিয়া, পরিশোধন ক্ষমতা, সর্বোপরি গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে তার মৌলিক পথ ও পাথেয় সম্পর্কে ভাষাশিল্পীরা সব সময়সচেতন থাকেন। তারপরও ভাষা কোথাও দাঁড়ায় না, নিরন্তর ছুটে চলাই তার প্রধান কাজ।
মানুষের মুখে মুখে প্রথম ভাষায় পরিবর্তন আসে, ইতিবাচক শ্রীবৃদ্ধিও ঘটে, তারপরই আসে লিখিত রূপে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের সাড়ে ছেচল্লিশ মতান্তরে পঞ্চাশটি পদের রচয়িতা চব্বিশ জন পদকর্তা। তাদের প্রত্যেকের ভাষা সমকালীন। প্রায় একই রকম। একটি নমুনা পাঠেই বোঝা যাবে এই দীর্ঘ যাত্রায় বাংলা ভাষার অবস্থানে আমরা কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছি।
চর্যাপদের প্রথম পদটির রচয়িতা লুইপাদ, সাহিত্যের ছাত্র মাত্রই মুখস্থ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল একদা। বিশেষত, আমাদের সময়ে। লুইপার প্রথম পদটিতে বাংলা ভাষার নমুনা এমন: ‘কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল।’ আধুনিক বাংলায়: ‘দেহ গাছের মতো, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।’
আবার ভুসুকুপার পদ থেকে, ধারণা করা হয় লুইপা বাঙালি ছিলেন। তার বাংলা ভাষাও লক্ষণীয়,
বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী।
(চর্যাপদের পদ সংখ্যা-৬)
আধুনিক বাংলায়:
বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম।
অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুট করিলাম।
হে ভুসুকু, আজি বাঙালিনী জন্মিলেন।
চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিণীকে লইয়া গেলো।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই হলো প্রথম বাংলা ভাষার নমুনা। যাত্রাকালের এই ভাষা ছিল প্রাচীনযুগের সীমানার মধ্যে। অর্থাৎ দশম থেকে ১২ শতক পর্যন্ত। এই হিসাবে দুই শত বছরের প্রথম দিকে বাংলা ভাষার এই অর্জনকে ধান-দূর্বা দিয়ে মাথায় তুলে বরণ করে নিয়েছি।
এরপর ছয় শত বছরের দীর্ঘ মধ্যযুগজুড়েই বিভিন্ন দেবতানির্ভর কাব্য-সাহিত্যের নানাধারা আমাদের আলোকিত, চমকিত করলেও ভাষার গতি কিছুটা ধীরে বহে মেঘনার মতোই ছিল মন্থর। এই দীর্ঘ কাল-প্রবাহে ভাষার স্রোত নানা শাখা-উপশাখায় প্রবাহিত হয়েছে যেমন, তেমনি সাহিত্যের ভিত্তিভূমিতে দিনে দিনে সরস পলিও জমেছে খানিকটা। সে কথা অস্বীকার করবার সাধ্য নেই আমাদের।
প্রধানত, মঙ্গলকাব্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, নাথ সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারতের বাংলা অনুবাদ, ইসলামি ধারার প্রণয়োপাখ্যান, বাউল পদাবলি—পার হয়ে আধুনিক যুগ শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের মাঝামাঝি।
শুরুতেই আধুনিকতার প্রাণপুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে(১৮২৪–১৮৭৩)। তবে তার আধুনিক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’(১৮৬১) যুগান্তকরী ভাষার নমুনাও ছিল অভিধাননির্ভর।পরবর্তী সময়ে তার নাটক, সনেট, পত্রকাব্যের মধ্যে দিয়ে ভাষা অনেকটাই সরল হয়ে এসেছিল। কিন্তু মহাকাব্যের ভাষা ছিল দুর্বোধ্য।
আধুনিক মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য অনুসারে মোট নয়টি সর্গে বিভক্ত ‘মেঘনাদ মহাকাব্য’-এর প্রথম সর্গ শুরু হয়েছে ১৪ মাত্রার চরণবিশিষ্ট অমিত্রাক্ষর ছন্দে।
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণী,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে—অজেয় জগতে—
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
এই সময়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭–১৯৫১)। তার প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়শী। আধুনিক মহাকাব্যের ধারায় তিনিই সর্বশেষ পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন তার ‘মহাশ্মশান’ ( ১৯৪০) মহাকাব্যে। এই কাব্যের ভাষা অবশ্য ততধিক সহজ। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীনে আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
মহাকাব্যের পরে বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিকবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৪–১৮৯৪)। তিনি বাংলা ভাষাকে অধিকতর সহজ করে এনেছিলেন গীতি কবিতার এই ধারায়। বঙ্গসুন্দরী(১৮৭০)ও সাধের আসন(১৯৮৯) তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
গীতিকাব্য মূলত একজন কবির একান্ত ব্যক্তি-অনুভূতির সহজ, সাবলীল গতি ও ভঙ্গিমায় সংগীত-মুখর জীবনের আত্ম-প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বাংলা গীতি কাব্য-ধারায় ‘ভোরের পাখি’বলে আখ্যায়িত করেছেন। কাব্য গুরু হিসেবেও মান্য করেছেন।
বিহারীলালের ভাষার নমুনা:
ওই কে অমরবালা দাঁড়ায়ে উদয়াচলে
ঘুমন্ত প্রকৃতি-পানে চেয়ে আছে কৌতূহলে!
চরন-কমলে লেখা
আধ আধ রবি-রেখা
সর্ব্বাঙ্গে গোলাপ-আভা,সীমন্তে শুকতারা জ্বলে!
এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার মনোরম এক বনায়নবীথি সৃষ্টি করে ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুললেন।
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় বললেন,
আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী
বল, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী?
এভাবেই কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাটক, নাট্যকাব্য, নাটক, প্রবন্ধ রচনার মধ্যে দিয়ে ভাষার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধন করলেন তিনি। পরিশেষে ‘গীতাঞ্জলি’-এর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিলেন বাংলা ভাষার ‘সোনার তরী’। বিশ্ববাসী এই প্রথম পরিচিত হলো বাংলা ভাষা নামের এক নতুন ভাষা-অস্তিত্বের সঙ্গে।
১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির এই ঘটনায়, বাহুল্য বলা যে, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষাকে নতুন করে জেনেছে বিশ্ববাসী। বাংলা ভাষার এই সুবিশাল অর্জনের ইতিহাস সৃষ্টির আগে, সাহিত্যিকভাষা-রীতির প্রবল যে একটি ধারা ছিল, সেটি সাধু রীতির ধারা। সেই ধারায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু সার্থক উপন্যাস। ‘দুর্গেশ নন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ’ ছাড়াও তার প্রবন্ধেও সেই সাধু রীতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
সেখান থেকে কিভাবে আমরা একটু একটু করে সরে এসেছি, ভাষা-সংগ্রামের সে পর্বটিও মনে রাখতে হবে। মানুষের জীবন সংগ্রামের মতো ভাষাকেও নিরন্তর নানাবিধ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আমাদের অনেকের মনে থাকার কথা যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামক একটি প্রবন্ধ ডিগ্রি ক্লাসে পাঠ্য ছিল দীর্ঘদিন। ধারণা করি এখনো আছে। এই প্রবন্ধে তিনি সাহিত্যিক ভাষার রূপরেখা নিয়ে তার কিছু অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সেখানে তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, সাহিত্যের ভাষা কখনো মুখের ভাষা হতে পারে না, আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে যেমন ঘরে পরার কাপড় পরে যাই না, সুটকেসে তোলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে যাই, তেমনি সাহিত্য রচিত হবে একটি তোলা ভাষায়, মুখের কথ্য ভাষায় কখনোই নয়। অর্থাৎ তিনি সাধুরীতির ওপরেই জোর দিয়েছেন সবিশেষ। সাহিত্যিক ভাষারীতির এই বিতর্ক ছাড়াও ওই সময়ে বাংলা বানানেও ছিল নানা রকম সমস্যা।
ইংরেজি, আরবি-ফারসি, পুর্তগিজ, চাইনিজ অনেক রকম বিদেশি শব্দকে বাংলা ভাষা ইতোমধ্যে আত্তীকৃত করে বসে আছে। অন্যদিকে সংস্কৃত, তৎসম, তদ্ভবসহ বিভিন্ন শব্দের বিচিত্র বানান নিয়ে চলছিল অরাজকতা। ইতোমধ্যে উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাধু রীতির শৃঙ্খল ভেঙে চলিত রীতির প্রথম ব্যবহার শুরু করেছেন। এরপর প্যারীচাঁদ মিত্রের রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সংবলিত গ্রন্থ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোমপেঁচার নকশা’জাতীয় রচনায় এই চলিতরীতির বিকাশ শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮–১৯৪৬) ‘সবুজপত্র’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতি প্রবর্তন করেন। এই পত্রিকায় তিনি ‘বীরবল’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে ‘বীরবলের হালখাতা’নামে শুরু করেছিলেন চলিত রীতির এই চর্চা। আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’কে কেন্দ্র করেই ১৯১৪ সালের দিকে এই গদ্যরীতি সাহিত্যিক স্বীকৃতি ও পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। ফলে বাংলার লিখিত দুটো গদ্যরীতির প্রথমটি যে সাধুরীতি এতকাল দোর্দণ্ড প্রতাপে বহাল ছিল, দিনে দিনে তার ব্যবহার সংকুচিত হয়ে এলো।
নতুন সৃষ্ট চলিতরীতি জনচিত্তকে তুষ্ট করে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। ফলে আধুনিক যুগে চলিত ভাষার ক্রমাগ্রসর প্রভাব, প্রসার ও প্রতিপত্তি আকাশছোঁয়া। চলিত রীতির স্বীকৃতির বছর যদি ১৯১৪ সাল ধরি, তাহলে প্রায় ১০৬ বছর বয়সী এই চলিত রীতির পরিবর্তন কি আসন্ন অপরিহার্য অথবা সময়ের দাবি ছিল?
আমরা তা চেষ্টা করেছি অনুসরণ করতে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ভাষার প্রতি সেই ভালোবাসাটা যেন আগের মতো নেই বলেই মনে হয়।
নিশ্চয় আমরা তা মনে করি না, এজন্যে যে, বর্তমানে বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। এছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলা ভাষার এই বিস্তার লাভের পরেও কথা থেকে যায়। নতুন করে শুরু হওয়া ভাষা-বিতর্কের বিষয়টিও কিন্তু অস্বীকার করতে পারি না আমরা।
বিভিন্ন নাটক, কিছু দৈনিক, এফএম রেডিওসহ প্রায় আটাশটি বিভিন্ন রেডিওয়ের অনুষ্ঠানে ইদানিং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে এক ধরনের ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। হাসি-ঠাট্টা করে এ স্টাইলের নাম দেওয়া হয়েছে বাংলিশ। মানুষকে না দেখে শুধু কথা শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ার জন্যে যারা কথা বলেন, তাদের বলা হচ্ছে আরজে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই আরজে পোস্ট দখল করে বাংলিশ ভাষায় কথা বলার এমন অসুস্থ প্রতিযেগিতা দেখে অত্যন্ত পীড়িত বোধ করি আজকাল।
আমাদের শিক্ষকেরা বলতেন, কথা বলার সবচেয়ে বড় গুণ হলো শুদ্ধ উচ্চারণ। ইংরেজি কথা বলার সময় শুধু ইংরেজি ও বাংলা কথা বলার সময় শুধু বাংলায় কথা বলতে হবে। আমরা তা চেষ্টা করেছি অনুসরণ করতে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ভাষার প্রতি সেই ভালোবাসাটা যেন আগের মতো নেই বলেই মনে হয়।
জানি, ভাষা দূষণের পাশাপাশি বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য নানা ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়াও বর্তমান আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়েও ভাষার দূষণ প্রতিরোধে কাজ চলছে। তার মধ্যে আমরা বাংলা ভাষার শিক্ষকেরা স্বউদ্যোগে ২০০৯ সাল থেকে ‘বাংলা ভাষা পর্ষদ’ নামের একটি সংগঠনের ছায়াতলে ভাষার দূষণ প্রতিরোধ এবং শুদ্ধবাংলা ব্যবহারের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি।
ভাষাশিল্পীরাও আসুন, বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারের অনুশীলনে শুদ্ধ বাংলার মর্যাদা রক্ষা করি আমরা। জেনে অবাক হবেন যে, অতি সম্প্রতি হিন্দু সংহতি আয়োজিত বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মোৎসবের এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, বিদ্যাসাগরের ভাষাকে বিকৃত করে যে ভাষা আজ বাংলাদেশে চলছে, তাকে কি বাংলা ভাষা বলা যায়? কাজেই ‘বাংলাদেশি ভাষা পৃথক করো, সনাতনী বাংলা রক্ষা করো’ব্যানারে তারা আন্দোলনে নেমেছে। ভাবুন তো কতটা দুঃসাহস!
ভিন্ন একটি রাষ্ট্র থেকে আমাদের ভাষা নিয়ে এই ধরনের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো উচিত বলেই মনে করি আমি। ভাষার আত্মমর্যাদা বলেও তো একটা কথা আছে। যখন আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি দাবি করছি, সেই সময়ে ভাষাকে ব্যবচ্ছেদ করে আঞ্চলিকতার নামে খণ্ড-বিখণ্ড করা কিংবা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বাংলিশ তৈরি করার েআদৌ কোনো অধিকার রাখে কেউ?