পুরস্কার বলতে ব্যক্তি বা দলগত পর্যায়ে সাফল্যের স্বীকৃতি কিংবা কর্মদক্ষতার উজ্জ্বল নিদর্শনের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত পদক বা সম্মাননাকে বোঝায়। পুরস্কার পেতে কার না ভালো লাগে? পুরস্কারের ক্রেস্ট সাজিয়ে রাখতে কার না ইচ্ছে হয়? এ ছাড়া পুরস্কার হিসেবে অর্থমূল্যকেও বিবেচনা করা হয়। সারা জীবনের পরিশ্রমের এমন মূল্যায়ন, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সবাই তো প্রত্যাশা করেন। যদিও অনেক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান পুরস্কার হিসেবে শুধু ক্রেস্ট, সনদ ও উত্তরীয় প্রদান করে থাকে। আর্থিক বিষয়টি তারা জোগান দিতে ব্যর্থ হন। এখন কথা হচ্ছে- পৃথিবীতে বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন রকমের পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাই সব পুরস্কারের ধরন ও মাপকাঠি এক নয়।
তাই তো যুগ যুগ ধরে যেকোন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পদক বা পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা নিজেকে সম্মানিত এবং গর্বিত মনে করেন। তবে কাজের স্বীকৃতি তো সবাই চান। কিন্তু একই সঙ্গে সবাইকে তা দেওয়াও সম্ভব নয়। ফলে প্রতিবছর যাচাই-বাছাই শেষে বিজ্ঞজনেরা কিছু মানুষের নাম ঘোষণা করেন। সেটা সরকারি বা বেসরকারি যেকোন ধরনের প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। আয়োজকরা যাকে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন, তাকেই পুরস্কৃত করে থাকেন। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার পরও কখনো কখনো পুরস্কার প্রদান নিয়ে নানাবিধ সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আয়োজকদের। অনেকে আবার নানাবিধ কারণে জীবদ্দশায় যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হন। সে অনেক ইতিহাস।
তবে আমাদের আজকের আলোচনা সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে। সে সাহিত্য পুরস্কারের নাম ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার’। এ যাবৎকালে বেসরকারিভাবে কিংবা আঞ্চলিক পর্যায়ে যতগুলো পদক বা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে, তারমধ্যে ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার’ ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বগুড়া থেকে পরিচালিত হলেও পুরস্কারটি উন্নতমানের বা শীর্ষস্থানীয় পুরস্কার হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কারণ সংগঠনটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। বগুড়া লেখক চক্র ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৯ সাল থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘স্বীকৃতি পুরস্কার’দিয়ে আসছে। তাদের পুরস্কার প্রদানের জন্য নির্ধারিত জুরি বোর্ড রয়েছে। এর আগে প্রয়াত প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, মাসুদ খান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, হোসেন উদ্দীন হোসেন, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই এই পুরস্কার লাভ করেছেন।
এবার ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার ২০২০’ পাচ্ছেন কারা? এমন আলোচনা চলছে সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে। অনেকেই বলছেন, এবার কথাসাহিত্যে মনিরা কায়েস, মনি হায়দার অথবা রুমা মোদক পেতে পারেন। সমকালীন কথাসাহিত্যে তারা তিন জনই অগ্রগণ্য। তাদের লেখায় নিজস্বতা বা স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী তিন জনের মধ্য থেকে যেকোন একজন পাবেন পুরস্কার।
কেউ কেউ ধারণা করছেন, এবার প্রবন্ধে হামিম কামরুল হক অথবা কাজী মহম্মদ আশরাফ পেতে পারেন। সমকালীন প্রবন্ধ সাহিত্যে তারা ভিন্নধারা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের বিষয়বৈচিত্র্য, নিরীক্ষা, গবেষণা অন্যান্য প্রাবন্ধিকের চেয়ে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। একটি সার্থক প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়।
আশা করি, সংগঠনটি তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রেখেই এবারের পুরস্কার ঘোষণা করবে এবং সসম্মানে পুরস্কৃত ব্যক্তির হাতে তুলে দেবে।
কবিতায় শামীম রেজা, কাজী নাসির মামুন বা মামুন রশীদের সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের তিনজনের কবিতাই আলোচনার দাবি রাখে। কবিতার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য মেনেই তারা কবিতা লেখেন। সমসাময়িক কবিতার মধ্যে ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়। জীবনানন্দ পরবর্তী ধারায় বেশ গোছালো এবং রীতিসিদ্ধ গঠনশৈলী লক্ষ্য করা যায় তাদের কবিতার পঙক্তিতে।
সাংবাদিকতায় আরিফ রেহমান, আমজাদ হোসনে মিন্টু বা জেএম রউফ পেতে পারেন। সমাজের দর্পণ খ্যাত তিন সাংবাদিক স্ব স্ব কাজে উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বহু আগেই। তাদের যাবতীয় কাজের স্বীকৃতি তারা পাওয়ার দাবি রাখতেই পারেন।
এ ছাড়া লিটলম্যাগে বীরেন মুখার্জী, মিজানুর রহমান বেলাল বা নাহিদা আশরাফীর হাতে উঠতে পারে পুরস্কার। বীরেন মুখার্জীর ‘দৃষ্টি’, মিজানুর রহমান বেলালের ‘দাগ’ এবং নাহিদা আশরাফীর ‘জলধি’ বহু আগেই জনপ্রিয় হয়েছে। তাদের লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক নানাবিধ কার্যক্রম ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
বিভিন্ন জনের অভিমতের ভিত্তিকে আলোচিত কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের নামগুলো এসেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, একেবারে আলোচনার বাইরের কেউও পেয়ে যেতে পারেন। তবে আলোচনায় যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্য থেকেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এবার যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে- তারা শিল্প-সাহিত্যের স্ব-স্ব শাখায় গুরুত্ব বহন করেন। পুরস্কারের প্রতিটি শাখায় এমন সব ব্যক্তিকে মনোনীত করা হবে, যারা সাহিত্যচর্চায় অগ্রগণ্য এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে।
হয়তো আলোচিতদের মধ্যে এবার সবাই হয়তো পাবেন না। প্রতিটি শাখায় একজন করে পুরস্কার দেওয়া হবে। বিজ্ঞ জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্তে তারা নির্বাচিত হবেন। এ যাত্রায় যারা পিছিয়ে পড়বেন; তারা হয়তো পরবর্তী আয়োজনে পুরস্কার হাতে তুলে নিতে পারবেন। তবে বগুড়া লেখক চক্র কখনোই এমন কাউকে পুরস্কৃত করে না যে, পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠতে পারে। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের পথ চলায় এমন অভিযোগ আছে বলে আমার জানা নেই।
অনেক সময় বহুল আকাঙ্ক্ষিত পুরস্কার প্রাপ্তি আশানুরূপ না হলে কিংবা না পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার ব্যক্তিবর্গ পুরস্কার প্রদান পক্ষপাতদুষ্ট বা স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। এ ছাড়াও অনেক সময় স্থান নির্ধারণীয় পুরস্কার গ্রহণে উপস্থিত হন না। আপাতদৃষ্টে বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার এমন সব অভিযোগ থেকে এখনো মুক্ত। আশা করি, সংগঠনটি তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রেখেই এবারের পুরস্কার ঘোষণা করবে এবং সসম্মানে পুরস্কৃত ব্যক্তির হাতে তুলে দেবে।
যারা পুরস্কার পাবেন সবার জন্য অগ্রিম অভিবাদন ও শুভ কামনা। বগুড়া লেখক চক্রের জন্যও অশেষ শুভ কামনা। সুন্দরের সঙ্গে সত্যের পক্ষে তাদের পথচলা নিষ্কণ্টক হোক। জয়তু বগুড়া লেখক চক্র।