প্রেমের সীমারেখাকে বিস্তৃত করলে বলা যায়, পৃথিবীর সব কবিতাই প্রেমের কবিতা। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পৃথিবীর সব কবিতাই বিরহের কবিতা। অতৃপ্তির কবিতা। মিলনের কবিতা যে নেই, তা নয়। আছে। তবে তা সংখ্যায় কম। নগণ্যই বলা চলে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষা ধার করে বলা যায়, ‘সকলেই জানেন যে সুখী কবি বিরল।’ কারণটাও বুদ্ধদেব বসু বলেছেন। বলেছেন, ‘দুঃখের গানই হয়তো আমাদের মধুরতম গান।’ এর একটা মানে দাঁড়ায়, সুখ, সুখ করলেও আমরা দুঃখবিলাসী। অন্তত কবিতা-গানে। নাটকে-উপন্যাসে আমরা মিলনাত্মক সমাপ্তি মেনে নিলেও কবিতায়, গানে তা যেন মেনে নিতে কিংবা মনে নিতে চাই না। এর হয়তো অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে একটা কারণ হতে পারে, কবিতা নামক পঙ্কজের জন্মই হয়েছে দুঃখের নোনাজলে। ব্যাধের তীরের আঘাতে কোঁচ বকের মৃত্যুর ফলে বাল্মীকির মনে যে বিরহ জন্ম নিয়েছিল, তাই আদি কবিতা লেখার কারণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এজন্যই লিখেছেন, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়/তার বক্ষে বেদনা অপার…।’
আমরা আমাদের রক্তে হয়তো বাল্মীকির স্মৃতিকে আজও বহন করে চলেছি। তাই কবিতাতে বিরহই আরাধ্য। বেদনাকে মধুর মনে হয়।
কবি জাকির জাফরানের ‘অন্ধের জানালা’ কাব্য পড়তে গিয়ে উপরিউক্ত কথাগুলো মনে এলো। ‘অন্ধের জানালা’য় জাকির জাফরান নির্মাণ করেছেন এক অনুভূতির জগৎ। যা বিরহের রঙে রাঙানো। ‘অন্ধের জানালা’র কবিতাগুলো তিনি দুটো উপ-শিরোনামে গ্রথিত করেছেন। ‘রজনীগন্ধার সেতু’ উপ-শিরোনামে রাখা হয়েছে তেত্রিশটি কবিতা আর ‘অন্ধের জানালা’ উপ-শিরোনামে রয়েছে একাত্তরটি অনুকাব্য। যাদের নিজস্ব কোনো শিরোনাম নেই। ক্রমবাচক সংখ্যায় চিহ্নিত করা হয়েছে শুধু।
যে রাষ্ট্র ঘরের মধ্যে থাকা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে জানে না, বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে না, ঘোচাতে পারে না বেকার ভাইয়ের মনে জমাট বেঁধে থাকা কষ্টগুলোকে।
আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘চিত্রকল্প-ই কবিতা।’ জাকির জাফরান যেন সেই কথাকেই মান্য করে এই বইতে একের পর এক চিত্রকল্প নির্মাণ করে তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক পৃথিবী। নানা অলঙ্কারের ভূষিত করে কবিতাগুলোকে করে তুলেছেন আর হৃদয়গ্রাহী। যদিও আল মাহমুদের পূর্বে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘উপমাই কবিতা।’ আর এই চিত্রকল্পই উপমার একটি প্রসারিত রূপ।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগতে পারে অন্ধের জানালার প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে মনে পড়ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতার কথা। যেখানে কবি সুরদাস নিজেই নিজের চোখের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলেন যেন কামবাসানার ঊর্ধ্বে উঠে তার প্রেয়সীকে ভালোবাসতে পারেন। অন্ধত্ব মানেই সব শেষ নয়। কখনো কখনো অন্ধত্ব মানে শুরু। চোখের আলো যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মনের আলো ঠিকরে পড়ে পৃথিবীর ওপর। মনের আলোয় দেখা সে-ই পৃথিবী সুন্দরের চেয়েও সুন্দর। অন্ধের জানালা মূলত তার মনের জানালা। চলুন, মনের জানাল দিয়ে দেখা যাক জাকির জাফরানের কবিতার পৃথিবী।
কাব্যের প্রথম কবিতা ‘নীলাভ স্নায়ু’র শুরুতেই বলেছেন,
কী এক নীলাভ স্নায়ু দিয়ে
দেখছি তোমাকে,
পিঁপড়ের ডিমের মতো আমার দুঃখগুলো
তোমার কাছেও দেখি নিরাপদ নয়।
কবি শুরুতেই অপার্থিব স্নায়ুবিক ঘোর তৈরি করেছেন কবিতায়। প্রকৃতির অনুষঙ্গে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তার হাহাকার। জীবন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ রক্তের গন্তব্য যেমন হৃদপিণ্ড, তেমনি প্রেমিকের গন্তব্য তার প্রেয়সী। প্রেয়সীর কাছে ছুটে যাওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য।
কবি হাফিজ বলেছেন,
তোমার ঘরে যাবার যে পথ
পা চলে না সে-পথ ছাড়া
(অনুবাদ: কাজী নজরুল ইসলাম)
আহসান হাবীব লিখেছেন,
আমার একটাই গন্তব্য ছিল, তুমি।
(তুমি)
তেমনি কবি জাকির জাফরানের শেষ গন্তব্যও এই তুমি। ‘তুমি’র দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কবির যাওয়ার কোনো পথ নেই। গন্তব্য নেই। তিনি লিখেছেন,
আর ধরো একটি বকুল গাছ যদি
উদ্যেশ্য প্রণোদিত হয়ে গন্ধ ছড়ায় চারিদিকে,
তবে আমি, এই আমি, তুমি বিনা, কোন দিকে যাব?
(নীলাভ স্নায়ু)
কবি এই ‘তুমি’কে কবিতায় সনামে, বেনামে, সর্বনামে, বিশেষণে চিহ্নিত করেছেন বারবার। কবির সব কিছুই তার জন্যে।
বুক যেন বীজতলা, কার?
প্রসবজ্যোৎস্নার মধ্য দিয়ে যে যাওয়া আসা করে―
আমাদের সেই বিপন্ন বালিকার।
(আমাদের বিপন্ন বালিকা)
কবির গোধূলির কথ্য ভাষার গল্প এই ‘বিপন্ন বালিকা’র জন্য। এই বিপন্ন বালিকার জন্য তার পাঁজরে প্রদীপ জ্বলে, শৈশবের জবাফুল কুড়ানোর ব্যর্থতার সবটা জুড়ে আছে এই বিপন্ন বালিকা। তাই কবি আপ্তবাক্যের সব শেষে উচ্চারণ করেন,
তোমার দুঃখরা হোক ধর্মগ্রন্থ
তোমার স্বপ্নরা হোক আজ সংবিধান।
(ঐ)
কবির এই প্রেম যেমন নির্দিষ্ট মানবীর প্রতি, তেমনি আবার কখনো তা পরিণত হয়েছে সমগ্র মানবের জন্য, পৃথিবীর জন্য। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা উঠে এসেছে তার কবিতার বিষয় হয়ে, শতদলের মাধুর্য নিয়ে। ঝর্নার শতধারার মতো কবির শত ইচ্ছেও উঠে এসেছে তার কবিতায়। কত কী হবার ইচ্ছে তার! আসলে প্রতিটি মানুষেরই ইচ্ছেগুলো শতধারায় বিভক্ত হয়ে ছুটে চলে। কত না বিচিত্র তার ইচ্ছে। যে মানুষ প্রেমিক, আবার সেই একই মানুষ বিপ্লবী। তাই কবি যখন বলেন,
ভীষণ সবুজ লজ্জা হবো এক কিশোরের
রাত নিশিতে তোমার গোপন ইচ্ছে হবো
যে কিশোরী স্কুল থেকে পালিয়ে যেত হরহামেশা
আমি তারই জামার ভাঁজে গুপ্ত থাকা
গোলাপ হবো, জানতে যদি!
যে মানুষের ঘরের কোণে হত্যাকাণ্ড ঘটল দেখো
সেই মানুষের ঘরের মাঝে শক্তিশালী রাষ্ট্র হবো
রাষ্ট্র হবো রাষ্ট্র হবো
আমার ভীষণ ইচ্ছে জাগে বকুলতলার পুলিশ হবো
ভর দুপুরে তোমার মনের একলা কোন ইচ্ছে হবো
জানতে যদি এক বিকেলে সান্ধ্যজবা ফুটতেছিল
ঠিক তখনই তোমার চোখের দ্বৈত-ভাষা পড়ার কালে
একটি নিখিল-গাছের তলে
সাতটি তারার জন্ম হলো
সেই তারাদের ছাই জমিয়ে তোমার চোখের কাজল হবো
জানতে যদি সেই বিকেলে।
আকাশটা তো ঘরেই ছিল ঘরেই সবার আকাশ থাকে
বোনের গভীর ইচ্ছে নিয়ে আকাশটা যে কই পালালো!
অশ্রু দিও অশ্রু দিও
বেকার ভাইয়ের গহীন মনের জমাট বাঁধা কান্না থেকে
গোপন কিছু বৃষ্টি দিও।
রাত নিশিতে তোমার গোপন ইচ্ছে হবো ইচ্ছে হবো
যেই মানুষের ঘরের কোণে হত্যাকাণ্ড ঘটল দেখো
সেই মানুষের ঘরের মাঝে শক্তিশালী রাষ্ট্র হবো।
(গোপন কিছু ইচ্ছে হবো)
স্বরবৃত্তে লেখা কবিতাটি সম্পূর্ণই উদ্বৃত্ত করলাম। হীরক খণ্ডের মতো মানুষের বহুবর্ণের দ্যূতি ধারণ করে আছে এই কবিতা। এই কবিতা যেন নষ্ট সময়ের ক্লেদাক্ত জলে ভিজেও মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখা কোনো মানুষের মনের ইশতেহার। শুধু তাই নয়, এই ইচ্ছের উৎস খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে এক ঘুণে খাওয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার করুণ চিত্র। যে রাষ্ট্র ঘরের মধ্যে থাকা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে জানে না, বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে না, ঘোচাতে পারে না বেকার ভাইয়ের মনে জমাট বেঁধে থাকা কষ্টগুলোকে।
সবচেয়ে বড় কথা, তার কবিতার আলাদা একটি স্বর আছে। এই স্বরকে তিনি আরও বিস্তৃত করে তুলবেন, একান্ত নিজের করে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রের, সমাজের অসঙ্গতি তার কোনো কোনো কবিতায় উঠে আসা সত্ত্বেও বলতে হবে, কবি জাকির জাফরানের কাব্য ভাষা ভোরের শিউলী ফুলের মতোই শুভ্র, লাজুক। কেমন নির্জনতা প্রিয়। কোলাহলে এই কবিতাকে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। কিংবা উল্টো করে বলা যায়, জাকির জাফরানের শব্দের এমনই প্রসাদগুণ, পড়তে পড়তে নিমগ্ন হয়ে যেতে হয়, শতজনের ভীড়েও মানুষ হয়ে উঠে একা।
জাকির জাফরান ‘অন্ধের জানালা’ কাব্যের বাহন হিসেবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে অক্ষরবৃত্তের পর্বের কাঠামোকে সময় মান্য করেননি। মুক্তকই তার অধিকতর পছন্দের। প্রবাহমানতার জন্য তার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ হয়ে উঠেছে গদ্য ভাষার কাছাকাছি।
মুক্তক অক্ষরবৃত্ত লেখা একটি কবিতার প্রথম স্তবক তুলে ধরছি,
তুমি আসবে না জেনেও বৃষ্টি হলো সারারত,
আকাশটা নেমে এল জানালার ধারে
বকুল ফুলের ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে,
তুমি আসবে না জেনেও বিশটি রাতের পর এসেছিল
একটি প্রভাত।
(অশ্রুলীন)
স্বরবৃত্তে লেখা একটি সম্পূর্ণ কবিতা পূর্বেই উদ্ধৃত্ত করা হয়েছে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি চরণ তুলে ধরছি,
ধমনীতে তার নীলিমা-খসানো রক্ত
কাউকে বলিনি বুনোতারা এক রাত্রে
আর ছিল এক উল্টানো তানপুরা
গেয়েছিল গান উল্কি বসানো প্রান্তে।
(উল্টানো তানপুরা)
তিন স্তবকে বিন্যস্ত এই কবিতার প্রতি স্তবকে পঙ্ক্তিসংখ্যা চার। ছয় মাত্রার পূর্ণপর্ব। তবে অপূর্ণ পর্ব সবসময় সমতা রক্ষা করেনি। কখনো তিন, কখনো দুই মাত্রার অপূর্ণ পর্ব আমরা এই কবিতায় পাই। তবে তা পাঠের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। তিনি ছন্দকে কবিতার চলন অনুসারেই বাছাই করেছেন। যেহেতু তার কবিতার চলন কিছুটা গুরুগম্ভীর, অন্তর্গত বোধের বয়ান, তাই স্বভাবতই অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেই ব্যবহার করেছেন বারবার।
‘অন্ধের জানালা’ কাব্যে কবি অতীতের সাথে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাই এখানে যেমন গ্রীক মিথের অফ্রোদিতির সাক্ষাৎ পাই তেমনি আমাদের সমসাময়িক জীবনে ব্যবহৃত ‘এলিয়েন’, ‘ইনবক্স’, ‘পাসওয়ার্ড’ প্রভৃতি শব্দেরও দেখা পাই। তবে তিনি উপমা, চিত্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গকেই তুলে ধরেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতার ভিস্তি-অলাকে, বাতি-অলাকে এখন আর কোথাও খুঁজে পাই না কিন্তু মাথার ওপরে সে প্রাচীন চাঁদ আজও জ্বলজ্বল করে। জাকির জাফরান এই চিরায়ত অনুষঙ্গগুলো তার কবিতায় নিপুণ দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন। দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অর্থালঙ্কারের পাশাপাশি শব্দালঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। সবচেয়ে বড় কথা, তার কবিতার আলাদা একটি স্বর আছে। এই স্বরকে তিনি আরও বিস্তৃত করে তুলবেন, একান্ত নিজের করে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
অন্ধের জানালা
লেখক : জাকির জাফরান
প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন
প্রকাশক : বেহুলা বাংলা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মূল্য : ২২৫ টাকা