মনু নিজেও জানে না, ঠিক কবে থেকে সে মনোয়ারা বেগম থেকে মনু হয়ে গেছে। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের ঘরে এমন গালভরা নাম সচরাচর টেকে না। গরিব ঘরের মেয়ের নাম মনু হওয়াই উপযুক্ত। ছোটো বেলায় পোলিও হওয়ার কারণে বাম পা-টা একটু লেংচে হাঁটে সে। তাতে তার নিতম্বের গোলক দুটো একটু বেশিই বাইরের দিকে ঠেলে ওঠে। সঙ্গে বুকজোড়াও সামনের দিকে প্রলম্বিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ পুরুষেরই এই দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে। মনুর হেঁটে যাওয়া দেখতে তাই গ্রামের ছেলেরা উদগ্রীব থাকে।
মনুর শরীরের বামদিকের ওপর হয়তো বা কোনো কারণে ওপরওয়ালা নাখোশ ছিলেন। কেননা, কুপিবাতির ওপর পড়ে মনুর গালের বামদিকটা পুড়ে গিয়েছিল। ঠিক কত বছর বয়সে পুড়েছিল, তা মনে করতে পারে না। মেয়েরা গালের হাড়ের উঁচু যে জায়গাটায় রুজ লাগিয়ে গালটাকে আপেল আপেল করার চেষ্টা করে, ঠিক সেখানটাতেই পোড়া দাগ। রৌজ দেওয়ার মতোই গোলাকার। অনেকখানি জায়গাজুড়ে। মিশমিশে কালো গায়ের রঙের সঙ্গে পোড়া দাগটা বেশ ভয়ঙ্কর দেখাতো।
পোড়া দাগ, লেংচানো পা কিংবা গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া, কোনোকিছুই দমিয়ে রাখতে পারে না মনুকে। বরং এই সীমাবদ্ধতার ফায়দা লুটে নেয় সে। লেংচে হেঁটে বুক আর নিতম্বের মাংসপেশীকে লক্ষণীয় করে তোলে। গালের পোড়াদাগটাকে ঢাকতে রৌজটা বাড়িয়ে একটু গাঢ় করে দেয়। তাতে তার গাল দুটোও বেশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অন্য অনেকেই যখন পুরুষের চোখ থেকে নিতম্ব, স্তন আড়াল করতে ব্যস্ত, সেখানে মনুর নিজেকে দেখাতে চাওয়ার এই প্রয়াস গ্রামের ছেলেদের কাছে বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক হয়। তারা মনুর এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে দেখে অন্যসব নারীর শরীরের সুষমা কল্পনা করে। এতে তারা প্রীতবোধ করে। মনে মনে হয়তো মনুর প্রতি কৃতজ্ঞতাও অনুভব করে।
শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর আর জায়ের দুই সন্তান নিয়ে সংসার। সচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। ননদ দুই জনের বিয়ে হয়ে গেছে ওর বিয়ের আগেই। মন্দের ভালো ধরে নিয়ে সব মেনে নেয় মনু।
তবে, পুরুষদের এই ভাবনার কথা মনু ঠিক এভাবে বুঝতে পারে না। সে ধরে নেয়, ছেলেরা তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। একেবারে যে আকর্ষণ অনুভব করে না, তা-ও নয়। তবে সেটা শুধু ক্ষেতের আলে বা বেতের ঝোপে শরীরটা নিয়ে খেলা করার জন্য। যারা ওকে টিপেটুপে ছিবড়ে বানিয়ে দেয়, তারা কেউই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। ল্যাংড়া, গালপোড়া মেয়েকে ঘরে তুলতে চায় না কেউ। তবে, তার নারীত্বের মজা লুটতে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। শারীরিক ত্রুটিগুলো নিয়ে পরিবার, প্রতিবেশীদের নেতিবাচক কথা শুনে শুনে বেড়ে ওঠা মনু নিজেকে গ্রহণযোগ্য, সর্বোপরি বিবাহযোগ্য করে তোলার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছিল। যদিও এসব ক্ষেত্রে উল্টোটাই হওয়ার কথা! নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার কথা। মনুর বেলায় বিপরীত চিত্র দেখা যায়। অন্যদের মজা লুটতে দিয়ে সে নিজেও মজা নেয়। কিন্তু বিয়ে করতে রাজি করাতে পারে না কাউকে।
বিয়ে আর সংসারের আশায় আশায় এভাবেই প্রতিনিয়ত লুট হতে থাকে মনুর মধু। সম্ভবত এই মনোভাবের কারণেই অনেক কিছুতে পারদর্শী হয়ে ওঠে মনু। ফলে যুবা, বৃদ্ধ, ছোকরা, যারাই ওর সংস্পর্শে আসে, সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সুখ দিতে জানে মনু। মনু সুখ দিতে জানে।
মনুর পরিবার বিয়ের চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত। একটা কিছু গতি করতে পারলে মাথার ওপরকার বোঝা নামে। মনুও সাজগোজ করে পাত্রপক্ষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে করতে হয়রান। ভাবি, চাচি, মামিরা সাজিয়ে দেয়। কায়দা করে বামগালের পোড়াদাগ ঢেকে দেয়। এমনভাবে বসার আসন পাতা থাকে, যেন সামান্য হেঁটেই বসে যেতে পারে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন সব জানাজানি হয়ে যায়। ভাঙানি পড়ে বিয়ে। সবাই শুধু বাইরের রূপ দেখে। ভেতরের রূপ কেউ খোঁজে না। গোপন পারঙ্গমতাও জানা হয়ে ওঠে না।
পাত্রের তালিকায় বউ মরে যাওয়া বুড়ো থেকে শুরু করে নানান কিসিমের লোকজন থাকে। তবু কেন জানি, মনুর ভাগ্যটা খোলে না। চোখের সামনে আইবুড়ো হয়ে যেতে থাকে। তবে, ক্ষেতের আড়ালে বা বেতের ঝোপে নিতে কারও অরুচি হয় না। প্রতিবারই নানান ছলাকলা করে আকর্ষণের চেষ্টা করে মনু। মরিয়া হয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বউ হয়ে থাকার ইচ্ছাও পোষণ করে। লাভ হয় না। ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে না।
ইতোমধ্যে গ্রামেও রটে যায় মনুর সুখ দিতে পারার যোগ্যতার কথা। ঘন ঘন বিয়ে ভাঙানি পড়তে থাকে। অতপর একদিন মনুর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। বিয়ে হয়ে যায়। ছেলের মাথায় হালকা ছিট আছে বললেও মনু আবিষ্কার করে ছেলে আসলে পুরোদস্তুর পাগল। সবাই বলাবলি করে, বিয়ে করিয়ে দিলে পুরুষ মানুষের এসব পাগলামি ভালো হয়ে যায়।
শারীরিক সীমাবদ্ধতা জয় করতে এতদিন যে চোখ আর চাহনি সে ব্যবহার করে এসেছে, সে চোখ আর চাহনি আজ স্তিমিত। বিয়ের পর প্রথম প্রথম কেঁদে কেঁদে মুখচোখ ফোলায়। আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়, মেনে নেয়। বাবার পরিবারের বোঝা নেমেছে। খাওয়াপরার অন্তত একটা বন্দোবস্ত হয়েছে, এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মনু। পাগল হলেও রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরের বাতি নিভিয়ে স্বামীর সঙ্গে সোহাগ, আদরে লিপ্ত হয়। যা করার মনু নিজ উদ্যোগেই করে। একসময় বেঘোরে ঘুমায় তার স্বামী। মনু জেগে থাকে। ঘুমাতে পারে না।
স্বামীর মাথা খারাপ হলেও পরিবারের মানুষগুলো অতটা খারাপ না। শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর আর জায়ের দুই সন্তান নিয়ে সংসার। সচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। ননদ দুই জনের বিয়ে হয়ে গেছে ওর বিয়ের আগেই। মন্দের ভালো ধরে নিয়ে সব মেনে নেয় মনু।
লেংচে চলা জীবনের গালজুড়ে আগুনে পোড়া দগদগে বিশাল ক্ষতে পরম মমতায় হাত বোলায় মনু।
মনুর বিয়ের পরপরই বড় জা রহিমা বানুর ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়। পানচিনি অনুষ্ঠানে ভাসুর, জা, শ্বশুর-শাশুড়িসহ সবাই যায়। দূরত্ব খুব বেশি নয়। মনুকেও যেতে পীড়াপীড়ি করেছিল। রাজি হয়নি সে। এই দুইদিন স্বামীকে নিয়ে বিশ্রাম করতে চায় একটু। ওরা যেতেই বাড়িটা সুনসান হয়ে গেলো। তার পাগলাটাও কোথায় গেছে, কে জানে! ঘুঘুর ডাক আর দুপুরের তপ্ততায় চোখ বুজে আসে মনুর।
হঠাৎ কে যেন মুখ চেপে জাপটে ধরে। বিস্ফারিত চোখে মনু দেখলো, ভাসুরের সমর্থ হাত ওকে জড়িয়ে ধরেছে। অনেক সুখ দিমু মনু। তর দুঃখ আমি বুজি। এত আচমকা সবকিছু ঘটে যায়! প্রতিহত করার তেমন সুযোগ পায় না মনু। তর ভিতরডা খুব সুন্দর রে মনু। পাগল ভাইয়ের লগে সংসার করার কষ্ট আমি বুজি। তর হগল দুঃখ আমি ভুলাই দিমু। অহন যাই। অগোরে আলাদা গাড়িত তুইলা দিছি। তুই সাবধানে থাকিস। আমি কাইলকাই আইয়া যামুনে।
দরজা খুলতেই দেখে মনুর স্বামী দাঁড়িয়ে। বড় ভাইকে দেখেই সরল, নিষ্পাপ হাসি দিলো পাগলটা। কিছুই বুঝলো না। মনুর ভাসুর আর দেরি করলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।
দিন গড়িয়ে মাস যায়। এই সংসারে খুব একটা খারাপ কাটে না মনুর। বাপের বাড়িতে আধপেটা খেয়ে বড় হওয়া মনু এখানে পেট ভরে খেতে পায়। তবে ভাসুরের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলে। সময় সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার করে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মুখ বুজে থাকতে হয়। বড় ভাইকে অসন্তুষ্ট করে এই সংসারে টিকতে পারবে না, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না মনুর।
এরসঙ্গে আবার যোগ হয়েছে নতুন বাতিক। ইদানীং শ্বশুরের গা, হাত-পা চাবানো, কামড়ানো বেড়ে গেছে। ছোটো বউ হিসেবে গা টিপে দেওয়ার দায়িত্ব মনুর ঘাড়েই পড়ে। বুড়োটাও যেন কেমন কেমন! সহজে ছাড়তে চায় না। চোখ বুজে নরম হাতের আরাম নিতে থাকে। মনু উবু হয়ে বসে বুড়োর পায়ে গরম তেল মালিশ করে দেয়। তখন কেমন করে যেন তাকায় মনুর দিকে। মাঝে মাঝে মাথাও টিপে দিতে হয়। অনেক সময় মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে ইচ্ছে করে বুকের সঙ্গে লাগায়। সব বোঝে মনু। তার পাগল স্বামী এসবের কিছুই বোঝে না। শাশুড়িও ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। এই জীবনের জন্য কাঁদবে, না কি শুকরিয়া আদায় করবে, ভেবে পায় না মনু।
লেংচে চলা জীবনের গালজুড়ে আগুনে পোড়া দগদগে বিশাল ক্ষতে পরম মমতায় হাত বোলায় মনু।