এক.
বহু বছর আগের আমরা দুজন যেন আজ আমার চোখের সামনে। ভদ্রলোক আর স্ত্রী চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অনেকক্ষণ। আজ আমার ছেলে শুভর জন্মদিন। হয়তো এবারও তার বাবা ভুলে যাবে ছেলের জন্মদিনের কথা, তাই আমাকেই দ্রুত বাড়ি ফিরে ছেলের মনরক্ষা করতে হবে। অথচ আজই ভীষণ পেশেন্টের চাপ। বারকয়েক জাফরকে ফোন করেছিলাম—রিসিভ করেনি। সন্ধেটা সে নীলার ফ্ল্যাটে কাটায়—এটা আমি জেনেছি। তবু আমাদের একমাত্র ছেলে শুভ, আজ তার জন্মদিনে বাবা-মা একজনকেও কাছে পাচ্ছে না ভেবেই ফোন করা।
অ্যাটেন্ডেন্স জনিকে বলে দিলাম, আজ আর রোগী দেখতে পারছি না, জরুরি কাজে এক্ষুনি বের হবো। বাকি রোগীদের ফেরত চলে যেতে হবে, আমার কিচ্ছু করার নেই। আমাদের নিজেদের অশান্ত জীবন শুভর ওপর প্রভাব ফেলছে খুব, তা আর বাড়তে দেওয়া যায় না। টেবিলের সামনের রিপোর্টগুলো সাইন করার অপেক্ষায়। একটা দুটো রিপোর্ট ছেড়ে না দিলেই নয়। রিপোর্টে চোখ বুলাচ্ছি, হঠাৎ আমার জন্য ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করা রোগী দম্পতির দিকে চোখ পড়ে গেলো। পাশাপাশি বসে আছেন দু’জন, হঠাৎ স্বামীর গায়ে পা লাগতেই ঝুঁকে প্রণাম করে নিলেন মহিলা। স্বামীও তৎক্ষণাৎ হ্যান্ডসেনিটাইজার স্প্রে করে দিলেন স্ত্রীর হাতে—যে হাত দিয়ে তার স্ত্রী পা স্পর্শ করেছেন। এরপর খুব যত্ন করে স্ত্রীর মুখের মাস্কটা ঠিক করে দিলেন। এরপর আবার নির্লিপ্ত হয়ে প্রতীক্ষা—যদি ডাক্তার একটু সময় দিতে রাজি হন।
তবে, ঈশ্বরের কৃপায় ডাক্তারের মর্জি হয়েছে পরে। ডাক্তারের অ্যাটেডেন্স এসে ডেকে নিলে তাদের—ডাক্তারের চেম্বারে।
আবার জনিকে ডেকে বললাম, সামনে অপেক্ষারত দম্পতিকে ডেকে দিতে। রিপোর্ট আগামীকাল সাইন করবো না হয়।
দুই.
বরাবরের মতো রগচটা, অস্থির সুব্রত আর গোছানো নীলিমার সংসার কি করে টিকে আছে—এটাই এক রহস্য! নীলিমা ছায়ার মতো পাহারা দেয় সুব্রতকে। নইলে এতদিনে যে কী কী কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলতো সে, ঈশ্বরই জানেন! এই আজই তো প্রলয় ঘটাতে যাচ্ছিল সুব্রত। সকাল থেকে এক নম্বরে শ’ খানেকবার ফোন করে কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনোয়ারা সুলতানার সিরিয়াল নেওয়া গেছে। সুব্রত বরাবরই না করছিল, কিন্তু নীলিমা ইদানীং এই ডাক্তারের বেশ নামডাক শুনতে পাচ্ছিল বলে একরকম জোর করে নিয়ে গেলো সুব্রতকে। সেখানে গিয়েও সিরিয়ালের অপেক্ষা করছিল ঘণ্টা দুয়েক। নীলিমার দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। কারণ সুব্রত অস্থির। যেকোনো মুহূর্তে ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে রাগ করে বেরিয়ে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতটা বয়স হলো, তবু এই অস্থিরমতি, খামখেয়ালিপনা গেলো না।
নীলিমা যা নিয়ে শঙ্কিত ছিল তাই হলো শেষ পর্যন্ত। হঠাৎই ডাক্তার কি মনে করে সিরিয়াল ক্যানসেল করে দিলেন। আজ রোগী দেখবেন না। শুনেই সুব্রত রেগে কাঁই। কী যে করে না মানুষটা! তবে নীলিমার দিকেও খুব নজর তার। প্যানডেমিক সময়ে সর্বোচ্চ সতর্ক সে। সুব্রতের শরীরের দিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি থাকলেও নিজের ব্যাপারে চূড়ান্ত অবহেলা। ঝুপ করে নীলিমা যখন তখন পায়ে হাত দিয়ে ফেলে সুব্রতর। বহুবার বকেছে, কাজ হয়নি। অগত্যা হাত সেনিটাইজ করে রাগ চাপে। তবে, ঈশ্বরের কৃপায় ডাক্তারের মর্জি হয়েছে পরে। ডাক্তারের অ্যাটেডেন্স এসে ডেকে নিলে তাদের—ডাক্তারের চেম্বারে।
তিন.
—আমার সাথে এসব হিপোক্র্যাসি কোরোনা জাফর। তোমার কোথাও কোনো অপূর্ণতা নেই, তবে কেন আসো বারবার আমার কাছে?
—কখন বললাম অপূর্ণতা নেই? ভালোবাসার নানা অপূর্ণতা থেকেই মানুষ নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। তবে তুমি আমার স্ত্রীর বিকল্প নও, প্রতিদ্বন্দ্বী নও, সমকক্ষও নও। তোমরা দুজন ভিন্ন, কিন্তু তোমাদের দুজনকেই আমার বড্ড প্রয়োজন।
বাপ-ছেলে মিলে মনোয়ারার সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। মনোয়ারাও কপট রাগ দেখাতে ভোলে না কিন্তু।
জাফরের এসব কথা নীলার কাছে হিপোক্র্যাসি ছাড়া কিছু মনে হয় না। যদিও, অস্বীকারও করা যায় না তাকে, এড়ানো যায় না। প্যানডেমিকে নীলা আজকাল নিজের ঘরেই অফিসের যাবতীয় কাজ করে। জাফর সন্ধেটা এখানেই কাটিয়ে যায়। কখনো ডিনার একসঙ্গেই সেরে নেয়, কখনো তার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে রওনা হয়ে যায় হাসপাতালে। জাফরের সুন্দরী স্ত্রী মনোয়ারা কার্ডিয়াক স্পেশালিষ্ট, একটি মাত্র সন্তান নিয়ে সুখের কোনো কমতি খুঁজে পায় না নীলার চোখ। তবু প্রায়শই বাৎস্যায়নের সন্ধ্যে নামে প্যানডেমিক অনলাইন অফিসের নির্জন ব্যস্ততার ফাঁকে।
চার.
সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুভ আর জাফর হৈ হৈ করছে–কী এক নতুন গেম নিয়ে। আজকাল শুভ অনেক কিছুই বুঝতে পারে, বুঝতে পারে হয়তো মনোয়ারার ভেতরের মলিন চেহারাও। তবু যতক্ষণ অবসর পায় হৈ হৈ করে মাতিয়ে রাখে ঘর। জাফরও কি বুঝতে পারে না মনোয়ারার ভেতরের ক্ষরণ? তবু, সেসব উহ্য এই মনোরম সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে। বাপ-ছেলে মিলে মনোয়ারার সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। মনোয়ারাও কপট রাগ দেখাতে ভোলে না কিন্তু।