সমাজের দর্পণ সাহিত্য। শিল্প সাহিতের সব আঙ্গিকেই ফুটে ওঠে সমসাময়িক সমাজের চালচিত্র। কবিতায় ভাবাবেগের মোড়কের আড়ালে ফুটে ওঠে সেই সমাজ, যে সমাজের মধ্যে কবি অবস্থান করেন। তাঁর কল্পিত যে ভাবনা, তাও সেই সমসাময়িক ঘিরে থাকা সমাজ বা সামাজিক অভিজ্ঞতার বাইরের কিছুই নয়। বস্তুত যে সমাজের মধ্যে অবস্থান কবির, যে সমাজ তাঁকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, তাঁর পাঁচটি ইন্দ্রিয় যা পরখ করে, তা থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয় কবির ভাবনা, চিন্তা, কল্পনা ও আবেগ। কলকাতা, ঢাকা, দিল্লি, মুম্বাইয়ের মতো কোনও কংক্রিট শহরে যদি কোনো কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবন, সমাজ জীবন—সব কিছু হয়, তবে তাঁর মননে ঘুরে-ফিরেই আসে সেই অভিজ্ঞতা। কবি তাড়িত হন সেই ভাবনার প্রসব ঘটাতে। যতক্ষণ তা নিঃসৃত না হয় কবির মনে জমে থাকে প্রাক-প্রসব যন্ত্রণা। শিশুর ক্রোমোজম বা ডিএনএ-তে যেমন তার কূলের প্রমাণ থাকে, বিকাশ বৃদ্ধিতে যেমন সেই বাবা-মায়ের মূলের বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র ধরা থাকে, তেমনি কবির কবিতায় ঝরে পড়ে সমাজের সেই সব বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে অবস্থান করে তাঁর ভাবনার উৎসরণ ঘটে।
বর্তমানের নাগরিক জীবনের কর্ম ব্যস্ততা, সংকট, সংঘাত, অবক্ষয় সবকিছুর পরিণতিতে মানসিক নিঃসঙ্গতা, অসন্তুষ্টি, অস্থিরতা, অতৃপ্তি। এসব থেকে মুক্তির একটিই বীজমন্ত্র—তা হলো প্রেম। একমাত্র ভালোবাসাই তার অনুরূপ করুণ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। নগর জীবনের একঘেঁয়ে বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেতে যেমন ইংরেজ কবি জন কিটস ছুটে যান সবুজ প্রকৃতির তৃণশয্যায় তাঁর ‘TO ONE WHO HAS BEEN IN LONG CITY PENT’ কবিতায়, যার মধ্যে নিহিত থাকে কংক্রিটের কঠোর নিরসতা থেকে মুক্তির আকুতি যা কবিকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় শ্যামলিমার কোলে নগর থেকে বহুদূরে কর্মজীবনের সাপ্তাহিক বিরতিতে।
প্রাকৃতিক ও যৌন-প্রেমের এমন একটি সহবাস ঘটেছে কবি কৃষ্ণা দাসের ‘এক মুঠো বুনো আবেগ’ কাব্যগ্রন্থে। নারী ও প্রকৃতি সমধর্মী। তাই প্রেম নারী-বর্জিত হয় না। আর তারপর প্রকৃতি টানে মানুষের মন। সেই নারী ও প্রকৃতির টানেই প্রেম আকর্ষক। প্রথম কবিতায় কোনও এক যুবক যুবতী নগর থেকে দূরে এক গোপন সুযোগে কোনও এক মনোরম উদ্যানে সবুজ আর ফুলে ভরা স্বপ্নময় স্থানে অবসর বিনোদনে গিয়ে নানা রঙের ফুল, সুদৃশ্য নুড়ি ঢালা পথ, পাখির কিচির মিচির শব্দ, মেঘের উড়ে যাওয়া, ঘাসের বিছানায় স্বপ্ন মাখামাখি করেও মূলত ‘হাতে তার একগুচ্ছ বুনো আবেগ তিরতির করে কাঁপছে।’
কবি এমনই এক নগর জীবনের বাসিন্দা, যেখানে ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত এমন কত অভিজ্ঞতা তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতার নির্যাস ঝরে পড়েছে তাঁর এক একটি কবিতায়। যা জমেছিল মনের অন্দরে, তাই একদিন জন্ম নেয় এক একটি কবিতা রূপে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের POETRY IS A SPONTENIOUS OVERFLOW OF POWERFUL FEELINGS-এর মতোই কবিমনের উদ্বেল অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি ঘটেছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের আটত্রিশটি কবিতায়। কবিতায় চাপ বিজ্ঞান তুলনীয়। যেমন চাপের সঙ্গে সমানুপাতিক তরলের বহির্গমন, তেমনি ভাবনা যত গভীর ও আকুতিপূর্ণ হয়ে কবি সত্তাকে যত চাপ দেবে, প্রবলভাবে আবেগ পূর্ণ করে তুলবে, ততই ঝরণার মতো ঝরে পড়বে শব্দরাজি, সৃষ্টি হবে কবিতা।
কেবল আবেগ বর্ষণে কবিতা হয় না। বাঞ্ছনীয় কনটেন্ট ও স্টাইল বা বিষয়বস্তু ও শৈলীরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে সেই উপাদানও রয়েছে বিস্তর। পূর্ব- উল্লিখিত কবিতাটির কনটেন্ট যেন এক অনুগল্প।
আমি বললাম ‘কী চাই?
কী চাই আপনার?’
তার ঠোঁট দুটো অল্প নড়ে উঠলো,
অস্ফূটে বলল, ‘আপনাকে।’
‘আমাকে?’ হেসে উঠে বললাম,
‘কী করবেন আমাকে?’
সে নীরবে মাথাটি তার আমার কোলে রেখে দিল,
যেন পাহাড় অতি সন্তর্পণে মাটির বুকে মিশে গেল,
হাতে তার একমুঠো বুনো আবেগ তখনও তিরতির করে কাঁপছে।
তখনও সে যে বিস্ময় বালক।
কবিতাটি যেন একটি মডেল কবিতা হয়ে উঠেছে। অপূর্ব চিত্রায়ণ। ছোট একটি এপিসোডে বর্তমান নাগরিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসার বাস্তব উপাখ্যান। আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যৌন আবেদন বেশ নান্দনিক শৈলীতে পরিবেশিত। নীলাভা স্বত্বেও নীল কবিতা হয়ে না ওঠে সর্বজন পাঠ্য হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক যুগের সূচনালগ্ন থেকেই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে কবিতার ভাষা করে তোলার প্রয়াস ছিল। আজ সাহিত্যের যে কোনো আঙ্গিকের তুলনায় পত্রিকার ভাষা অনেক বেশি সাধারণ। আলোচ্য কবিতাটিতে একদম সাদামাটা শব্দ চয়নে প্রত্যক্ষ উক্তির ব্যবহারে অতি সাধারণ হয়ে উঠেছে। এ এক সফল এক্সপেরিমেন্ট বলা যায়। হোঁচট খাওয়া শব্দ কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।
আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীপ্তি ত্রিপাঠীর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘আধুনিক কাব্য পরিচয়’-এ যে বৈশিষ্ট্যগুলোর উল্লেখ আছে, সেগুলো আলোচ্য কাব্যগ্রন্থেও মিশে আছে। সাধারণ ভাষা, যৌনতা, বিজ্ঞান, কল্পনা, ভাষার মিতব্যয়িতা, অবক্ষয়, যুদ্ধ, দেশ বিভাগ, মানবতা, শ্রেণিচেতনা, অবক্ষয়, ইতিহাস চেতনা, নাস্তিকতা, রূপক, প্রেম, নারী, প্রকৃতি ইত্যাদি।
জীবনানন্দ দাশে কবিতায় আবেগ ও প্রজ্ঞা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নূরুল হক ‘জীবনান্দ দাশ: আবেগে অনুরাগে’ শীর্ষক এক গদ্যে লিখেছেন—‘অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনা, প্রজ্ঞার চেয়ে আবেগের তীব্রতা-ই জীবনানন্দ-কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দাশকাব্যে বাঙালি স্বভাবের মৌল প্রবণতা—আবেগই বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন কল্পনা ও কল্পনার নানামুখী প্রকাশ।অবশ্যই প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও আচরণের সঙ্গে সে কল্পনা ও কল্পনার প্রকাশ কোনো সংঘাত সৃষ্টি করে না। পরন্তু তাঁর কল্পনা ও চিন্তায় যৌক্তিক যোগসূত্র রয়েছে। এ সবের পরও সত্য—যাপিত জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনাকে যতটা কবিতার অনুষঙ্গ করে তুলেছেন, তারও চেয়ে বেশি যোগ করেছেন কল্পনার প্রাচুর্য ও আবেগের ঐশ্বর্য।এর ফলে দাশকাব্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক উপলব্ধি করতে থাকেন—তার সামনে যে জগত, তা বিপুল রহস্যঘেরা। সেখানে রূপকথা-উপকথা-মিথ-ইতিহাস অভিন্ন হয়ে উঠেছে। এ কারণে কাব্যসত্য-বস্তুসত্যের ভেদও সেখানে অর্থহীন হয়ে পড়ে।’ কৃষ্ণা দাসের এই কাব্য পাঠের সময়ও অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের মতো অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনা, আর প্রজ্ঞার চেয়ে আবেগ বেশি প্লাবিত হয়েছেন তিনি। ‘প্রেম’ কবিতায় লিখেছেন—
প্রেম তরঙ্গচারী
গ্যালাকসি থেকে গ্যালাকসি চলেছে
বিরামহীন সঞ্চারী…।’
প্রেমকে মহাকাশে সঞ্চার করিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন-
কোন এক ভাষাহীন প্রাণহীন পৃথিবীর বুকে
একটি অকিঞ্চন অনুভব, একটি ভাবনা নীরব
কথা হয়ে উঠবে সে প্রকৃতির মুখে।
এই কবিতায় কবি প্রধাণত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার তুলনায় কল্পনা ও আবেগ অনেক বিস্তার ও গতিপূর্ণ করেছেন। ভাষার মিতব্যয়িতায় বিস্তর পরিক্রমা সেরে পরিণতিতে আশাবাদকেই আলিঙ্গন করেছেন তাঁর বিশ্বাসের আবেগে।
চেতনায় সুনেমির টান
জাগিয়ে স্বপ্ন কল্পণ
দ্বিখণ্ডিত প্রকৃতি সত্তা।
সংশয় হতাশার পর কবি ফিরে আসেন দর্শন ভাবনায়। মনুষত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে আবার সেই কবির চেতনার উত্তরণ ঘটে। বলেন—
প্রথিত মনুষত্ব বীজ
মহীরূহ হয়ে শাখা ছড়িয়ে
আন্দোলিত সজীব।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। রবী ঠাকুরের বাণীর প্রতিধ্বনি তিনি তাঁর কবিতায় ঘটিয়েছেন মনুষত্বের প্রতি অটল বিশ্বাসে। এভাবেই কবির চেতনার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পরিণতি পায় মনুষত্বের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি অবিচল বিশ্বাস, ভরসায়।
কয়েকটি বড় কবিতার একটি ‘একটি অন্যরকম গল্প’। একটি মেয়েকে নিয়ে ভাবনায় সংশ্লিষ্ট প্রচলিত ভাবনার কোলাজ। ঈশ্বর প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অভিনব ধারণা যা কবির বোধজাত।
ঈশ্বর একটি বোধ, অপূর্ব অভিলাষ
যেমন আনন্দ, যেমন দুঃখ,
যেমন অনাবিল ভালোবাসা।
কিংবা
ভালোবাসা আর নয় কিছু
শুধু ভালো থাকার আবাস।
কবিতার পরিণতি ঘটেছে সেই আশাবাদে যেখানে কবি বলেছেন
এ জীবন আলোকিত হোক
অসীম গভীর বোধে
আমিত্ব নাশি দু’হাত ধরি
এগিয়ে যাওয়া আরদ্ধে
তাই হোক, তবে তাই হোক।
‘মেয়ে’ কবিতায় ৪/৬ লাইনের স্তবকে ক/ক, খ/খ অন্তমিলে একটি মেয়ের জীবনের ঋতুনামচার পর্যবেক্ষণ করেছেন কবি। একজন মহিলা হিসেবে এই নামচা অনেক অনুভূতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিণতিতে নারী আর প্রকৃতি এক হয়ে গেছে তাঁর কল্পনায়। পরিশেষে-
আষাঢ় শ্রাবণ ভাসায় শরীর
নতুন ফসল গন্ধ নাড়ীর।
পুরুষ সত্তা তোকেই চায়
তুই ছাড়া সে অসহায়।
তোর আদেশেই সমন জারি
প্রকৃতি তুই, তুই যে নারী।
প্রকৃতির ঋতু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একটি মেয়ের জীবনযাত্রাকে সমানুপাতী করে তুলেছেন কবি। এভাবে নারী ও প্রকৃতিকে পরস্পর পরিপূরক করে তুলেছেন কবি তাঁর মনের মাধুরিতে।
‘ঝড়’ কবিতায় মানবমনের প্রেমের ঝড় তুলেছেন কবি। এখানেও ঝড়ের পর চাঁদ হাসে কবির ইতিবাদী, আশাবাদী চেতনায়।
তারপর
ঝড় থামল, ভায়োলিন থামল,
থামল প্রহর যাপন।
শুকনো পাতার আস্তরণ সরিয়ে
জেগে উঠল সতেজ পাতা,
আর মেঘের ঘোমটা সরিয়ে
জানি না কেন অলক্ষে হেসে উঠল চাঁদ।
ছোট কবিতা ‘ফের ভিজি একবার’ ছন্দে-গন্ধে বেশ মদিরতা ঢালে।
ওই দেখ নীলডি, যাবি ওখানে?
নুড়ি ঢালা পথ হাসে, ওরা সব জানে।
মহুয়ার গন্ধে প্রাণ আনচান
তুই আমি দু’জনেই রোদ্দুরে স্নান।
মেঠোপথ, চোর কাঁটা পায়েতে লুটায়,
আমাদের হাসিতে রূপকথা গায়।
কবিতাটি পড়েই বোঝা যায় প্রেক্ষাপট, অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা বা সংলগ্ন অঞ্চলে দুই আদিবাসী যুবক যুবতীর প্রেমের আবেদনে সিক্ত মদিরতা ঝরে পড়ে যা কবিতা পাঠের পরেও রিনরিন করে পাঠকের মনে।
‘অযুত নিযুত বছর পরে’ কবিতায় প্রেমের উন্মেষ ঘটাতে এক বিস্তর বৈজ্ঞানিক রূপকের ব্যবহার অদ্ভূতভাবে বিবেচিত। যেখানে ‘অ্যাসিড বৃষ্টি ভেজা ঘোলাটে সকাল’, ‘কোয়ান্টাম থিওরির বিপরীত প্রতিফলন’, ‘জেট ফ্লাই,’ ‘আল্ট্রাভায়োলেট রে,’ কে অগ্রাহ্য করে বকের উড়ে যাওয়া, ‘সিলিকন ক্যাবিন’, ‘অক্সিজেন পাউচ’ ইত্যাদি ‘রাষায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে’ কবির ‘মনের গবেষণাগারে’।
আবার ‘পাঞ্চালীর চোখ চাই, পাঞ্চালীর চোখ’ কবিতায় মহাভারতের প্রেক্ষাপটে পাঞ্চালীর চোখের রূপকে নারীর দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতায় অনন্যতা বিস্তার অভিব্যক্ত হয়েছে। অর্জুনের পাঞ্চালীর প্রতি দুর্নিবার প্রেম ও তাকে সম্পূর্ণ করে না পাওয়ার যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।
‘আবার ফিরব আমি’ কবিতায় আশাবাদ ফুটে উঠেছে। যতুগৃহের ধ্বংশভূমি থেকে বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে লড়াইয়ের ইতিহাস জিতে যেমন পাণ্ডবরা ফিরে পেয়েছিল তাদের পৈত্রিক ভূমির অধিকার, গড়ে নিয়েছিল সুনগর তেমনি কবি সেই ‘….বারাণাবত ঘুরে,/বিষণ্ন স্মৃতির আলস্য ঘুম ভেঙেচূরে’…. ‘চেনা মাটি চেনা পথে’ ফেরার শপথ নিয়েছেন প্রথম পঙ্ক্তিতেই। শেষ পঙ্ক্তিতেও সেই দৃঢ় শপথের উচ্চারণ, ‘আবার নতুন দিনে পুরাতন আমি ফিরব আবার।’
অন্য একটি ছোট কবিতা ‘ফিরিয়ে দাও’ সময়ের কাছে এক নিবিড় প্রার্থনা। কবিতার স্বার্থে কবি হিন্দু বংশোদ্ভূত হয়েও সময়ের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ‘ফিরিয়ে দাও আমার শিশির ধোয়ানো / পবিত্র ভোরের আজান,…’ একজন সহনশীল প্রকৃত সৎকবির পক্ষেই ধর্মবর্ণের কাঁটাবেড়া ভেঙেচুরে সবকিছু তছনছ করে ফেলা সম্ভব। তিনি ফিরে পেতে চাননি পবিত্র ভোরের ঘণ্টার ধ্বনি বা শঙ্খনাদ। কবিতাই কবির একমাত্র ধর্মাচারণ। বাকি সব বাহ্য।
আবার ঠিক পরের ‘থাকব প্রতীক্ষায়’ কবিতায়-
আমার ভোরের আলো,
সন্ধ্যার প্রদীপ, পূর্ণিমা
তুমি,
শুধু ক্লান্ত দুপুর
আর অমাবস্যার অন্ধকার রাত
আমার একার,
আমার অসাফল্যের,
আমার পরাজয়ের।
কবি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার যুগে মনে করিয়ে দেন কল্লোল যুগে যাঁরা কলম, তুলি ধরে ছিলেন দেশ বিভাগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সামগ্রিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তাদের কথাও।
‘কালো মেয়ের কথা’ কবিতায় কবির শ্লেষ ঝরে পড়েছে সমাজে কালো মেয়েদের অপছন্দের প্রচলনে। তাই সেই কালো মেয়েদের সহানুভূতিতে কবি লিখেছেন,
আমার আমিকে দেব আমি সেদিনই অঞ্জলি
যে জন আমায় ডাকবে কাছে নামে কৃষ্ণকলি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন তার ‘কালো আফ্রিকা’ কবিতায় তৎকালীন লড়াকু আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সংহতি ও সম্প্রীতি বোধে ভূমিষ্ঠব্য সন্তানের গায়ের রঙ কালো হলে নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘কালো আফ্রিকা’, ঠিক তেমনি আলোচ্য কবিতায় কবি কালো মেয়ের নাম ‘কৃষ্ণকলি’ রেখেছেন পরম সহানুভূতিতে।
তাঁর সমাজ সচেতনতা অভিব্যক্তি তিনি আরও ঘটিয়েছেন ‘আগে দাও ভাত বাবু পরে তুলো শ্রম’ কবিতায়। শিশু শ্রমের বিরূদ্ধে কিন্তু শিশুদের খিদের যন্ত্রণা অনুভব করে কবি লিখেছেন:
আমরা শিশুশ্রমিক শুধু ভাত চাই
শিশুশ্রম তুলে দিলে পেটে ভাত নাই।
আগে দাও ভাত বাবু পরে তুলো শ্রম
পেট বড় যম বাবু পেট বড় যম।
এই কবিতায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী শিশুদের নিরন্ন করুণ দুর্দশায় বিচলিত কবি প্রতিবাদী আবেদন পেশ করেছেন এই শ্রেণী-বিভক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে। এখানে তাঁর শ্রেণীচেতনার বিকাশ ঘটেছে।
‘প্রসঙ্গ শান্তি’ কবিতায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান—
প্রতিবাদ চাই, প্রতিবাদ, তা সে কলমে বা সোচ্চারে,
রাষ্ট্রসংঘের তাতে যদি তবে কিছুটা টনক নড়ে।
ধ্বংসের পর ধ্বংস শুধু বাড়াবে বুকের জ্বালা
আর না এবার বন্ধ হোক বিভৎসতার খেলা।
তা না হলে বাপুজির ‘অসহযোগ’ রইল রাস্তায় পড়ে।
আর কত রক্ত ঝড়বে বলো আর কতদূর শান্তি !
রবীন্দ্রোত্তর যুগের মুক্তক ছন্দেই তার অধিকাংশ কবিতা রচিত। ভাষার সাবলীলতা, সাধারণ মানুষের মুখের শব্দচয়ন, বিজ্ঞান-শ্রেণী-সমাজচেতনা ইত্যাদির নির্যাস কবিতার পরতে পরতে। কবিতার সঙ্গে কবির বোঝাপড়া না থাকলে এমন সমৃদ্ধ উৎপাদন সম্ভব হয় না। এলিয়ট মনে করতেন, বোঝার আগেই পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কবিতার। কবিতার কনটেন্ট, টোন, অ্যাপ্রোচ, স্টাইলের সঙ্গে পরিপ্রেক্ষিত, ভাষার সার্থক মিলন ঘটিয়েছেন কবি। আবার যে পাঠক একাত্ম হয়ে কবিতা পড়তে আগ্রহী, তিনিও একাত্ম হতে পারবেন কৃষ্ণা দাসের সঙ্গে।
কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। সেই বিবেচনায় ভালোবাসার দলিল স্বরূপ প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবি কৃষ্ণা দাসকে ‘কেউ কেউ কবি’র স্থান দেবে। কবির স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায়।
- একমুঠো বুনো আবেগ: কৃষ্ণা দাস, মউল প্রকাশনী, দুর্গাপুর, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, মূল্য: আশি টাকা, পরিবেশক: বইওলার বই আপন, ৫৩ পটুয়াতলা লেন, কলকাতা ৯