নৈরাশ্য ও অলীক কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার সচেতন প্রচেষ্টা ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা। ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’র (প্রথম কাব্যগ্রন্থ) ভেতর দিয়ে তার যে যাত্রা বাংলা কবিতার ভূখণ্ডে, সেখানে অবধারিতভাবে, শব্দ ও শব্দহীনতার ভেতর দিয়ে ফজল শাহাবুদ্দীন নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন। সেই খুঁজে ফেরা, সেই তৃষ্ণা শুরু থেকেই যেমন ছিল একা, তেমনি পরবর্তীকালেও।
নিজের কবিতা সম্পর্কে ফজল শাহাবুদ্দীন বলেন, ‘‘কবিতা এক ধরনের স্বগতোক্তি ঘনিষ্ট উচ্চারণ, সে কথা শুধু জাগতিক অর্থে নয়, মহাজাগতিক-আত্মিক অর্থেও সত্য বলে গ্রহণ করেছি আমার কবিতা নির্মাণের সকল ‘ঘোরে’। আমার সকল লৌকিক এবং পারলৌকিক ধারণা ও ধ্যানের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য অবস্থানে এই সবকিছুই গ্রথিত। আমার এই গ্রথিত সত্তা বেঁচে থাকে এক ক্রমাগত এবাদতের মতো। এবং সেই এবাদতের অন্তর্গত হাহাকারের সঙ্গেই বেঁচে থাকি আমি ও আমার প্রকৃতি আকাশ অন্তরীক্ষ, আমার শষ্যকণা, সবুজ পাতার উল্লাস ঝরা পাতার শব্দ, প্রসারিত রৌদ্র আর বিরামহীন বৃষ্টি। আমার সকল শব্দ শব্দহীনতা সকল চাঞ্চল্য সকল স্থৈর্য আমার সকল নাদ নিনাদ এবং আর্তনাদ। বেঁচে থাকে আমার ধরিত্রি কবলিত রক্তমাংসময় জীবন তার সকল তৃষ্ণা ক্ষুধা বাসনা।’’
তিনি সমাজের অর্ন্তগত রূপকেও স্পষ্ট করে তোলেন। যাতে সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির সংকট, তার মনোবিকিলন, তার বিশ্বাস, সমস্ত হতাশা ও নৈরাশ্যকে আশ্রয় করে পরস্ফুট হয়ে ওঠে।
মূলত ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা তার আত্মবিবৃত এই বহুবিভঙ্গ জীবনেরই আর্তনাদ। বিশ শতকের পঞ্চাশ দশকের বাংলা কবিতায় যে সময় এবং সমাজের অনুসন্ধান, ব্যক্তিমন ও মননের জিজ্ঞাসাকে ছাপিয়ে যে অস্তিত্বের পোড়ো জমিনে আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস। ফজল শাহাবুদ্দীন তার কবিতায় শুরু থেকেই সেই সুরকে স্পষ্ট করে তোলায় মনোযোগী ছিলেন। ফলে তার লেখায় আত্মবিবৃতির সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজ ও জীবন। তিনি কল্পনাকে আশ্রয় করেছেন তবে তাকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেননি। ক্লান্তি অনুভব করেছেন, তবে সেই ক্লান্তিকে কবিতার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে নতুন জীবনের সন্ধান করেছেন। দুর্দিনকে মনে রেখেছেন, তবে সেই দুর্দিনকে আঁকড়ে ধরে হতাশায় তলিয়ে যাননি। তিনি অন্তর্গত হাহাকারকে ধারণ করে অবধারিত মুক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন।
আমি কবিতা লিখি তাই সারা আকাশকে আমি
এক মুহূর্তে বন্দী করতে পারি
আমার হাতের মুঠোয়-
আমি কবিতা লিখি তাই আমি ভালোবাসতে পারি
একটি আলপিনকে একটি ঘাসফুলকে
আমি কবিতা লিখি
তাই আমি আপনার দিকে হাত বাড়িয়েছি
কবিতা লিখি তাই আপনাকে আমার চাই’
(আপনি; অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মতো: অন্তরীক্ষে অরণ্য)
ব্যক্তির সংকটকেই প্রাধান্য দিয়েছেন ফজল শাহাবুদ্দীন। তবে এক্ষেত্রে তার কবিতাকে আত্মমগ্নতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ, ব্যক্তির সংকটকে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি আত্মমগ্নতার পরিবর্তে ক্রমাগত কথার পর কথা সাজিয়ে যেতে থাকেন, যেখানে নিজের অনুভূতিকে খুব সচেতনভাবেই অন্যের ভেতরে সঞ্চারিত করে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। তিনি সমাজের অর্ন্তগত রূপকেও স্পষ্ট করে তোলেন। যাতে সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির সংকট, তার মনোবিকিলন, তার বিশ্বাস, সমস্ত হতাশা ও নৈরাশ্যকে আশ্রয় করে পরস্ফুট হয়ে ওঠে। ফলে ব্যক্তির উদ্বেগ ও আর্তির ভেতর থেকেই ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা হয়ে ওঠে গভীর ও ব্যঞ্জনাময়।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা আত্মকেন্দ্রিক। তিনি নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করতে চেয়েছেন সমকাল। পারিপার্শ্বিকতাকে ধারণ করেই, নিজের ভেতরের প্রেরণাজাত অনুভূতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
ঘুরে-ফিরে প্রায় একই শব্দমালায় ফজল শাহাবুদ্দীন তার কবিতার শরীর নির্মাণ করেন। তার কবিতা আমিত্বময়। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি কবিতায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি। যেন ভাবনাকে বেঁধে রাখায় তিনি বিশ্বাসী নন। তাই তার উদ্বেগ, তার আর্তি যেন দুঃসাহসী এক ভাবনার গভীরে পাঠককে টেনে নিতে থাকে তার ব্যক্তিগত শোক, ব্যক্তিগত উদ্বেগ, ব্যক্তিগত ভাবনা আর ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির ভেতর দিয়ে। কোনো দ্বিধায় জড়ানো কথামালা নয় বরং গোড়া থেকেই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নিজের ভেতরের মানবীয় উন্মাদনাকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
আমি ফজল শাহাবুদ্দীন
জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের অন্য নাম, কবি
এবং তারুণ্যে লেলিহান
জীবন আমার হাতের মুঠোয় বন্দী এবং আকাশ
প্রতিদিন ছুটোছুটি করে আমার চোখের তারায়
যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হাজার হাজার জ্যোতিকণা
জীবন আমার রক্তকণিকায়
শব্দের অবিশ্বাস্য উত্থান পতনে কেবলি ধ্বনিত ঘূর্ণমান
যেন রাত্রির নিঃসঙ্গ পথে
শত শত ট্রাকের সমবেত চীৎকার
আমার রক্তে এখনো সেই আদিম কল্লোল
জন্ম যার কোটি কোটি বছর আগে
চন্দ্রালোকিত পর্বতসানুতে
অরণ্যশীর্ষে
আমাদের আত্মার ভেতরের সেই উপত্যকায়
বাতাসের অবিশ্বাস্য প্রবাহে
(আমি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি: সান্নিধ্যের আর্তনাদ)
ফজল শাহাবুদ্দীন তার কবিতায় বারবারই তুলে এনেছেন প্রবল এবং অনিঃশেষ যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা ব্যক্তি মানুষের, যেখানে কোন সংশয় নেই, নেই কোন সংঘাত। বরং সেই যন্ত্রণা, যাকে একজন মানুষ লালন করে নিজের ভেতরে, যার ভেতর দিয়ে উঠে আসে একজন মানুষের চেতনা ও বোধের উৎসভূমি থেকে জীবনের আত্মপ্রত্যয়। ফজল শাহাবুদ্দিন আলোড়িত হয়েছেন বাইরের জগতের দ্বারা। তবে সেই আলোড়নকে তিনি নিজের ভেতরে ধারণ করে, তাকেই ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে চেয়েছেন। ফলে জাগতিক এবং দৃশ্যমান সভ্যতা এবং সমাজের বিষয়গুলোকে নিজের মতো করে পরিস্থিতি অনুযায়ী বর্ণনা করেছেন। সেই বর্ণনার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে ফজল শাহাবুদ্দীনের আর্তনাদ, হাহাকার।
মানবিক প্রেমের ভেতর দিয়ে, মানবিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তিনি পৌঁছে যেতে চেয়েছেন অতিমানবীয় অনুভূতি, অতিন্দ্রিয় জগতে। যা কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে বাংলা কবিতার ভুবনে করেছে গৌরবান্বিত।
প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহের ভেতর তিনি নিজেকেই স্থাপন করেছেন। এতে করে সকল অসঙ্গতিকেও ধারণ করেও তিনি আশ্চর্য এক কথামালা নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন, যার ভেতর দিয়ে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবির আত্মদর্শন।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা আত্মকেন্দ্রিক। তিনি নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করতে চেয়েছেন সমকাল। পারিপার্শ্বিকতাকে ধারণ করেই, নিজের ভেতরের প্রেরণাজাত অনুভূতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তার কবিতায় হৃদয়জাত অনুভূতি প্রবল। আবেগ প্রকাশে তিনি আন্তরিক। যে আবেগে তিনি আলোড়িত, তার সঙ্গে গভীরভাবে পাঠকেরও পরিচয় করিয়ে দেন, যা শুধুই কবির অনুভবলীলা বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কবির অঙ্গীকার ও স্বাতন্ত্র্যের সুস্পষ্ট সুর।
যদি আমি ম’রে যাই
ম’রে গিয়ে স’রে যাই
স’রে গিয়ে চলে যাই
তুমি সাথে যাবে কদ্দুরযদি আমি বেঁচে থাকি
বেঁচে থেকে ভালোবাসি
ভালোবেসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
ভ’রে দেই
তোমার দুপুর
তবে তুমি যাবে কদ্দুর?’
(যাবে কদ্দুর : অন্তরীক্ষে অরণ্যে)
ফজল শাহাবুদ্দীন ব্যক্তির আমির প্রকাশের মধ্য দিয়ে, প্রকাশিত শব্দতরঙ্গমালার মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের প্রয়াসী ছিলেন। সেই ভাষা, যা তাকে যন্ত্রসভ্যতার বাইরে এসে জীবন ও রুচির ক্রমাগত প্রকাশের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশের আনন্দে মাতিয়েছে; যেখান থেকে নির্মিত হয়েছে সার্থক শিল্পরুচি, বিশুদ্ধ অনুভূতিমালার কবিতা। আবেগের ব্যঞ্জনায় প্রতিমুহূর্তে মূর্ত হয়ে উঠেছে তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার আত্মপ্রকাশ। যেখানে মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতার ভেতর উঠে এসেছে জীবনের অনুষঙ্গ। মানবিক প্রেমের ভেতর দিয়ে, মানবিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তিনি পৌঁছে যেতে চেয়েছেন অতিমানবীয় অনুভূতি, অতিন্দ্রিয় জগতে। যা কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে বাংলা কবিতার ভুবনে করেছে গৌরবান্বিত।