শিং মাছের ঝোল
দুই হাজার কুড়ি, মানুষ ভুলে যেতে চাইবে এই বছরটি। এমন বিভৎস সময়, আধুনিক মানুষের জীবনে আসতে পারে, তা হয়তো কারও কল্পনায়ও ছিল না। কল্পনায় ছিল না, শব্দবন্ধটি হয়তো পুরোপুরি ঠিক হলো না। হয়তো কল্পনায় ছিল কারও কারও। আর ছিল বলেই বর্তমানের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আগেই নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, লেখা হয়েছে বই। আজকের আতঙ্ক এক অণুজীব, যে কিনা না জীব না জড়। এরকম অনুজীব অতীতেও মানুষের জন্য সময়কে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। সে সব স্মৃতিও ফিরে এসেছে বার বার। কিন্তু এবারের মতো মানুষ এভাবে আর কখনও ঘরবন্দি হয়নি। এই সময়ে, যখন দাবি করছি, আমরা উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছি, তখন অণুজীবের প্রলয় নৃত্য দেখতে হবে।
পৃথিবীর প্রায় সাত শ কোটি মানুষ ঘরের দরজা এঁটে পালিয়ে থাকবে; এমনটি কল্পনায় ছিল না। বর্তমান পৃথিবী শাসন করা করোনাভাইরাস, যাকে নাম দেওয়া হয়েছে কোভিড-১৯, তার আগেও তার জ্ঞাতিভাইয়েরা পৃথিবীতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তারাও তাদের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছে। এ রকম আরেক অণুজীব মানুষকে এইডস নামক ঘাতক ব্যধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সে রোগও মানুষ থেকে মানুষেই ছড়ায়। তবে সাধারণ ছোঁয়াছুঁয়িতে না। মানুষের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যেই তার বিস্তার। কিন্তু করোনা, সেই রাখঢাক রাখেনি। সাধারণ স্পর্শ তো বটেই, এমনকি আশপাশে এলেই সে ছড়িয়ে পড়ছে একজন থেকে অন্যজনে।
করোনা যেভাবে বিশ্ব পর্যটক হয়ে, মানুষের দরজায় দরজায় মৃত্যুর সমন নিয়ে এসেছে, এমনটি গত একশ বছরে হয়নি। মহামারীর এই কালে, এই করোনাকালেও গুজবের অন্ত নেই। মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে, মানুষকে আরও বেশি অসহায় করে তুলতে আমাদের মতো আরও কিছু মানুষের বিকৃতির সীমা নেই। গুজব ছড়ানো মানুষ সবসময়, সবকালেই ছিল। এখনো তারা বহাল তবিয়তে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। কারণ গুজব ছড়ানোর মধ্যেও রয়েছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা। তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা। এই চেষ্টা কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক কখনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। এতে লাভ কখনো ব্যক্তির, কখনো ব্যক্তির বাইরে বৃহত্তর কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা রাষ্ট্রের।
তাই একসময় সে ঝড়ও থেমে গেলো। এরপর আর ঢোলকলমি নিয়ে, শিং-মাগুর মাছ নিয়ে বিরূপ কথা শুনিনি। ঢোলকলমি নিয়ে কেন অপপ্রচার ছিল, তার শলুক সন্ধান করিনি।
আমার সঙ্গে গুজবের পরিচয় ছেলেবেলাতেই। যদিও তখন গুজব আর খবরের পার্থক্য করতে শিখিনি। বরং তখন গুজবটাকেই খবর বলে মনে হতো। কারণ, গুজব ছড়ানোর বিষয়টি যারা নিয়ন্ত্রণ করতো, তারা খবর আর গুজবের মাঝে ফারাক রাখতো না। গুজবকেই খবর হিসেবে প্রচার করতো। স্বার্থ হাসিলই ছিল আসল। প্রায় ত্রিশ বছর বা তার কিছু বেশিই হবে, কম নয়, গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে ঢোলকলমি নামের একটি গাছ নিয়ে ছড়ালো আতঙ্ক। আপাত নিরীহ একটি গাছ, পুকুরের পাড়ে, জলাশয়ের পাশে জন্মায়। সবুজ পাতার মাঝে তার আকাশীনীল রঙের শান্ত ফুল চোখে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। গাছের কাণ্ড ছিল ফাঁপা। নরম ডাটার এই গাছটি আমাদের খেলারও সঙ্গী ছিল। পুকুরে নেমে দীর্ঘ সময় দাপাদাপির ফাঁকে, আমরা যখন পানিতে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকতে চাইতাম, তখন আমাদের সাহায্য করতো ঢোলকলমির কাণ্ড। নরম শরীরের গাছটি অনায়াসে ভাঙা যেতো, ভাঙার পর বেরিয়ে পড়তো সাদা কষ। সেই কষ ধুয়ে ফেলে আমরা ফাঁপা কাণ্ডের একমাথা মুখের ভেতরে নিয়ে অন্যমাথা পানির ওপওে ভাসিয়ে রেখে ডুব দিতাম। এতে পানিতে বেশ কিছু সময় আমাদের অক্সিজেনের অভাব হতো না। ঠিকঠাক মুখে নিতে পারলে, চেপে রাখা মুখের ভেতর দিয়ে যদি পানি না ঢুকতো তাহলে বেশ কিছু সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কাজ চালানো যেতো।
আমাদের মাঝে যারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল তারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই থাকতো পারতো পানির নিচে। তখন টাইম ওয়াচ তো দূরের ঘড়ি দেখার বিষয়ের এত চল ছিল না। তাই ঠিক কত সময় আমরা ঢোলকলমির কাণ্ড ব্যবহার করে পানির নিচে থাকতে পারতাম তার হিসাব নেই, তবে আমাদের কাছে মনে হতো দীর্ঘসময়। যা ছিল আমাদের গর্বেরও। এই ঢোলকলমি তখন কৃষকের ক্ষেতের প্রাকৃতিক বেড়া হিসেবেও কাজ করতো। কারণ, দেখতে সুন্দর হলেও গরু, ছাগল এই গাছ খেতো না। আর অল্প সময়েই গাছটি এত ঘন হয়ে তার বিস্তার ঘটাতো যে, সেই বেড়া ডিঙিয়ে কারও ক্ষেতে গরু, ছাগল তো দূরের মানুষও যেতে স্বস্তি বোধ করতো না। গাছটি সহজে মারাও যেতো না। ঘন গাছের বেড়া ডিঙাতে গেলে হোঁচট খেতে হতো। বিকেলে খেলার সময়ে, বিশেষত লুকিয়ে থাকা বিষয়ক কোনো খেলা হলে, আমরা প্রায়ই ঢোলকলমির ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েছি। সেই নিরীহ ঢোলকলমিকে নিয়েই ছড়িয়ে পড়লো গুজব।
হঠাৎ করেই রব উঠলো ঢোল কলমি বিষাক্ত, এর স্পর্শে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর ফুলের স্পর্শে মানুষ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক বিভ্রৎস আতঙ্ক ভর করলো সবার মাঝে। আজকের মতো বাহারি সংবাদপত্র ছিল না। হাতের গোনায় যারা ছিল, তাদেরও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার জুড়ে ছিল ঢোলকলমি বিষয়ক সংবাদ। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের মৃত্যুর খবর। সেইসঙ্গে দিকে দিকে ঢোলকলমি নিধনের সংবাদ। যে যেখানে পারে, যেভাবে পারে ঢোলকলমি নিধনে মেতে উঠলো।
আমরা তখন সরকরি কোয়ার্টারে থাকতাম। কোয়ার্টারের ভেতরের বড় পুকুর, তার পাড়েও ছিল ঢোলকলমির ঝোপ। মুহূর্তেই তারা সাবাড় হয়ে গেলো। রোদের আলোয় ঝলমল করে উঠলো পুকুরের পানি। এর মাঝে খবর এলো ঢোলকলমির পাতা না, ওই গাছে বাসা বাঁধা একটি পোকার কামড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। পাতা বা পোকা সে যাই হোক মানুষ তো মরছে। অতএব ঢোলকলমির উধাও হতে দেরি লাগলো না। খুব সহজেই প্রকৃতি থেকে হারয়ে গেলো একটি উদ্ভিদ। যা ছিল কৃষকের সঙ্গী, বিনে খাটুনিতে বিনা পয়সায় কৃষকের ফসলের পাহারাদার। জলাশয়ের পাড়ের মাটি ধরে রাখার ক্ষেত্রেও এর জুড়ি ছিল না। এই সময়েরই কিছু আগে বা পরে ছড়ানো হলো আরও একটি খবর। সেটি ছিল মাছ বিষয়ক। বলা হতে লাগলো মাছের শরীরে ঘা হচ্ছে, ঘায়ের কারণে মাছ বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই বিষাক্ত মাছ খেলে মৃত্যু না হোক কাছাকাছি কিছু একটা হচ্ছে। একে একে বিভিন্ন এলাকাতেই এ ধরনের কথা শোনা যেতে থাকলো। তাও সব মাছের শরীরে না, বলা হলো শিং, মাগুরের শরীরেই এই ঘা দেখা যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।
বাড়িতে বাড়িতে ভয়ে মাছ আসা কমতে থাকলো। বাজারে যেখানে মাছ বিক্রি হয়, সেদিকেও মানুষের আনাগোনা কমতে লাগলো। শুধু যাদের সামর্থ কম, তারাই মাছ বাজারে যেতো, কারন মৃত্যুর চেয়ে তাদের কাছে পেটের জ্বলুনি কমানোই ছিল জরুরি। শুধু ভাত তো খাওয়া যায় না, সাথে নুন লাগে, সালুন লাগে। সেক্ষেত্রে কম দামি মাছই ভরসা। ঘায়ের কারণে মাছের দাম পড়ে গেছে, সে সুযোগ হাতছাড়া করবে কেনো গরীব মানুষের দল? তারা কি এতোই বোকা?
বাড়িতে সংবাদপত্র আসতো, স্পষ্ট মনে আছে সংবাদপত্রেও দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছের গায়ে ঘায়ের খবর প্রকাশ পেতো। বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই, কোথায় সেই মাছ খেয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে কাছে টেনে নিয়েছে সে খবরও আসতো। পুকুরে ভেসে ওঠা ঘা জর্জরিত মাছের শরীরের ছবি। যে সাজ সাজ রব, যুদ্ধাঙ্গী মনোভাব নিয়ে মানুষকে ঢোলকলমির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, ঢোলকলমি নিধনে মেতেছিল, ঠিক একইভাবে মানুষ জোটবদ্ধ হলো শিং, মাগুর মাছের বিরুদ্ধে। আজ থেকে তিন, সাড়ে তিন দশক আগে, ঢোলকলমি অথবা শিং-মাগুর মাছের শরীরের ঘায়ের খবর, মানুষকে কতোটা আতঙ্কিত করেছিল, আজকের অবস্থায় থেকে তা বোঝানো অসম্ভব। বাঙালি কোন বিষয় নিয়েই একটানা পড়ে থাকে না। তাই একসময় সে ঝড়ও থেমে গেলো। এরপর আর ঢোলকলমি নিয়ে, শিং-মাগুর মাছ নিয়ে বিরূপ কথা শুনিনি। ঢোলকলমি নিয়ে কেন অপপ্রচার ছিল, তার শলুক সন্ধান করিনি।
গ্রামে ফিরে, প্রতিবেশী মহিলা- যাদের কখনও সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়নি, যারা জানেও না সিনেমা কি, তাদেরকে তিনি অভিনয় করে করে দেখাতে থাকেন সিনেমার দৃশ্যাবলী।
আর সন্ধান না করলেও শিং-মাগুর মাছের ঘায়ের কারণ অনেক পরে বুঝেছি। মিলিয়ে দেখেছি। যখন মাছের ঘায়ের কথা প্রচার হয়, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারপর সেই আতঙ্ক থামার অল্প পরেই বাজারে চলে এলো আফ্রিকা থেকে আসা পরিবেশ বিরুদ্ধ রাক্ষুসে মাছ, আফ্রিকান মাগুর। বলা হলো দেশি শিং-মাগুরের মতো এর শরীরে ঘা হয় না। এটি থেকে সুস্বাদু, শরীর আরও বেশি মাংসল। বাজারে খুব দ্রুত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো এই রাক্ষুসে মাছের সঙ্গে, তারও সঙ্গে সেই রাক্ষুসের ছোবলে হারিয়ে যেতে থাকলো আমাদের দেশি মাছ। একইসঙ্গে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই মাছটিকেই প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে ক্রমশ জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা হতে লাগলো দেশি শিং-মাগুর মাছের বিপরীতে। রাক্ষুসে মাগুরের খাদ্য তালিকাও বিভ্রৎস। মাঝের ঘায়ের খবরের সময় থেকেই শিং মাছ খাইনি, আর রাক্ষুসের মাগুরের বিভ্রৎস খাদ্যতালিকা জানার পর সেও বাতিল হয়ে গেছে আমার পছন্দ থেকে। শিং-মাগুর শেষ কবে খেয়েছি, তা মনে না থাকলেও শিং মাছের স্মৃতি আমাকে চিনিয়েছে ভালোবাসা শব্দটি। বুঝিয়েছে আন্তরিকতা কাকে বলে। জানিয়েছে অমৃতের স্বাদ কেমন।
এই আতঙ্কিত সময়ের কিছু আগে, স্কুলের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। চরাঞ্চলে, আমাদের গ্রামটিও জেগে ওঠা একটি চর। বহু বছর আগে জেগে ওঠা চরটি ফুলজোড়ের ভাঙা আর গড়ার মধ্য দিয়ে আজও টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব। বালুমাটির গ্রামে তখন গাছের সংখ্যা ছিল খুবই কম। একে তো গ্রামের তিন পাশেই নদী, তার ওপর তপ্ত বালু অধিকাংশ স্থানে, ফলে গরম ছিল খুব। দুপুরের আগে আগে গাছের ছায়ায় বসে আছি, সে সময় আমার এক চাচা বাইসাইকেল নিয়ে এসে আমাকে বললেন, ‘ভাতিজা চলো ঘুরে আসি’। আমিও লাফ দিয়ে চাচার বাইসাইকেলে উঠে বসি। কিছু সময় গ্রামের বালুময় পথে উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরির পর, চাচাকে বলি, পাশের গ্রামে নিয়ে যেতে। সেখানে আমার আব্বার ফুফু থাকেন। ছেলেবেলা থেকেই যতোবার আমরা বাড়িতে যাই, উনি খবর পেয়েই ছুটে আসেন। শৈশবে গ্রামে গেলে আমার অধিকাংশ কাটতো তার কোলে। আমার সেই দাদী এবং দাদা আমাকে এতো আদর করতেন, ভোলার নয়। আজ আমরা যে সাধাসিধে গ্রামীন মানুষের গল্প বলি, আমার দাদী ও দাদা ছিলেন সেই সাধাসিধে মানুষের সত্যিকারের উদাহরণ। এমন সহজ-সাধারণ মানুষের দেখা গল্প উপন্যাসেই শুধু মেলে। একবার আমার সেই দাদী (আব্বার ফুফু) আমার দাদীর সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এলেন।
তখন ছিল সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার চল। পরিবারের সবাই মাসে অন্তত একবার সিনেমা হলে যাওয়া হতো। সেই ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের বিশুদ্ধ বিনোদন। আব্বা আমার দুই দাদীকে নিয়ে যান সিনেমা দেখাতে। আমার সেই দাদীর ওটাই ছিল প্রথম এবং শেষ ছবি দেখা। মানুষ পর্দার ভেতরে কথা বলছে, নাচছে, গাইছে- তা তাকে বিষ্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। তিনি এতো খুশি, এতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন- আমাদেরকে বারবার সে কথাই বলছিলেন। গ্রামে ফিরে, প্রতিবেশী মহিলা- যাদের কখনও সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়নি, যারা জানেও না সিনেমা কি, তাদেরকে তিনি অভিনয় করে করে দেখাতে থাকেন সিনেমার দৃশ্যাবলী।
সংসারে অভাব ছিল তাদের, কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না। সেই ভালোবাসার স্পর্শ তারা দুজন আমাদেরও দিয়েছেন। সঙ্গে মানবিক স্মৃতিও। আর ভালোবাসাময় শিং মাছের ঝোলের স্বাদ।
সেইসঙ্গে বর্ণনা তো আছেই। মহিলানরা খুব দ্রুত সেই খবর পৌঁছে দেয় ঘরে। ঘর থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাইরে। ফলে গ্রামে সালিও বসে। দাদাকে নানান কথা শোনানো হয়, এরকম বে-শরিয়তি কাজের খেসারত হিসেবে আমার সেই দাদা-দাদীকে একঘরে করারও হুমকি দেয়া হয়। দেয়া হয় প্রাথমিকভাবে কিছু নির্দেশনাও। শালিসের পর, আমার সেই দাদা বাড়ি ফিরে রাগে হাতের কাছে পাওয়া লাঠি দিয়ে আঘাত করেন দাদীকে। ওনার মাথা ফেটে যায়। পরে উপজেলা সদর থেকে চিকিৎসাও নিতে হয়। আমরা জেনেছিলাম, অনেক পরে।
বাইসাইকেলে চাচার সঙ্গে সেই দাদা ও দাদীকে দেখার জন্য রওনা হই। তপ্ত দুপুর রোদের ভেতরে বালুময় রাস্তা পেরিয়ে আমরা যখন দাদীর বাড়িতে পৌঁছি, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাড়িতে ঢোকার পর, কারো সাড়া শব্দ পাইনা। উঠোন পেরিয়ে দাদীর দরজায় ডাক দেই। দাদী ঘুমিয়েছিলেন, আমার ডাক শুনে প্রথমে ভেবেছেন স্বপ্ন, ঘোর কাটতে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসেন। আমাকে দেখে, কি করবেন, কি বলবেন-এতোটাই অস্থির হয়ে ওঠেন। আমার চাচাকে খুব বকা দেন, দুপুরের রোদে কেন আমাকে নিয়ে বেরিয়েছেন। আমাদের মুখ দেখেই বুঝে যান, দুপুরে কেউই খাইনি। উনি সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে একটি মাটির হাড়িতে পানি দিয়ে জিইয়ে রাখা শিং মাছ বের করে কাটতে শুরু করেন। আমরা দুজনেই বলি, বাড়ি ফিরে খাবো। আপনাকে দেখতে এসেছি, কাউকে বলেও আসা হয়নি, সবাই খুঁজবে। তিনি আমাদের কথা না শুনে মাছ কাটা শেষ করেন। এর মাঝে চুলায় ভাত তুলে দেন।
আঙিনার পাশের গাছ থেকে বেগুন তুলে এনে রান্না করেন শিং মাছের ঝোল। গরমে অস্থির আমি চুলার পাড়ে বসি, দাদী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকেন অনবরত। রান্না শেষ হয়। টিনের থালায় গরম ভাত, তারও বেশি গরম ধোয়া ওড়াতে থাকে। আউষের চালের ভাত, ভোরের শিশির ভেজা শিউলির মতো ঘ্রাণ ছড়ায়। হালকা লালচের সঙ্গে সাদা রঙের ভাতের ওপর ছড়িয়ে পড়ে বেগুনসহ শিং মাছের ঝোল। আমি হাপুশ হুপুশ খেতে থাকি। গরম আর ঝাল নাক ও চোখের পানিকে মিলিয়ে দিতে থাকে। অমৃত বলে যে খাবারের কথা শুনে এসেছি বহুকাল, সেই খাবারকে আজ তাই-ই মনে হয়। আমরা খাচ্ছি, দাদী পাখা হাতে অবিরাম হাওয়া করছেন। গরমে ঘামতে ঘামতে খেতে থাকি অমৃত। ভালোবাসায় আমার দাদীর চোখ ভিজে আসতে থাকে, তিনি বারবার চোখ মোছেন, আর বলেন-তোকে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। এমন সময়ে এলি। সেই দাদা ও দাদী দুজনেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন দুই দশকের বেশি আগে। সংসারে অভাব ছিল তাদের, কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না। সেই ভালোবাসার স্পর্শ তারা দুজন আমাদেরও দিয়েছেন। সঙ্গে মানবিক স্মৃতিও। আর ভালোবাসাময় শিং মাছের ঝোলের স্বাদ। আমার স্মৃতি হয়তো মৃত্যুর মুহূর্তেও এ ধরে রাখবে।
চলবে…
সোনার খাতায় ছড়ানো জীবন-২৩॥ মামুন রশীদ