শব্দটি যখন ভালোবাসা
একটা শব্দের মধ্যে ইদানীং একটা আতঙ্ক
পোষা ময়নার মতো সারাক্ষণ ডাকছে তো, চেঁচাচ্ছে!
শান্ত শিশু যেমন ময়নার বাচ্চা পেলে খুশি হয়,
কাঠি বা আঙুল দিয়ে টোকা মেরে মেরে তার সঙ্গে
কথা বলতে চায়—তাকে সতত অস্থির করে রাখে।
আমিও তেমন এক শিশু, যে শিশু সে-প্রিয় শব্দটাকে
আতঙ্কের হাত থেকে রক্ষা করে বেঁচে থাকতে চায়।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, অভিধান থেকে খুব যত্নে
শব্দটাকে তুলে এনে আমার বালিশে রাখি, যেন
ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে
আলতো করে চুমু খেতে পারি; তারপর চুমু খেতে খেতে
ভয় ডর তুচ্ছ করে ভাসতে ভাসতে আমি ভেসে যাই—
ভালোবাসা শব্দটিকে সমুদ্রের দিকে ছুড়ে বলি,
সমুদ্রে বয়ার মতো ভালোবাসা—কখনো ডোবে না।
কফিন চলেছে উড়ে
ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ খুলে বাইরে তাকাতেই
দেখি: একটা পাহাড় কাঁধে
প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যের পোশাকে
একটা ভয়ঙ্কর স্তব্ধতা দাঁড়িয়ে আছে
শূন্যতায়, বিশ্ব চরাচরে;
এ কেমন বোবা দুর্বোধ্য স্তব্ধতা!
যে ভাষায় এ স্তব্ধতা কথা বলছে
তার কোনো বর্ণমালা নেই
যা দিয়ে অক্ষর তৈরি হয়, আর
অক্ষরে অক্ষরে শব্দ
শব্দে শব্দে জীবনের মহাজাগরণ;
শব্দগুলো ছুটি নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে
শব্দের অর্থেরা নৈঃশব্দ্যের দুর্গ ভেদ করে ঢুকে আছে
কোন শূন্যতায়!
এ স্তব্ধতার একটা নাম আছে—
এই নাম খুঁজতে খুঁজতে
যে নামটি জানতে পারলাম
তা আর বলতে নেই; বরং
এটাই বলছি
ওই নাম খুঁজে পাওয়ায়
আমার নামটা আর থাকলো না,
ওই নামে সব নাম একদিন মিশে যায়।
মায়ের কথা মনে পড়লে
মা! তুমি আমার কান্না শুনতে পাচ্ছো? তোমার পাশেই
অদূরে সমুদ্র কাঁদে, ঘুম নেই নদীর নয়নে;
নিশিদিন সারাক্ষণ পাতা ঝরা হিজলের মুখ
কেন যে চোখের দ্বীপে দূর থেকে শালিকের মতো
উড়ে এসে বসে থাকে একমুঠো আলোর আশায়!
জয়নুলের কাকগুলো যদি আসে আমার উঠোনে
হয়তো অপেক্ষা শেষে বাড়ি গিয়ে তোমাকে পাবো না—
তারও আগে ঘুম থেকে উঠতে গিয়েচলে গেলে তুমি
যেখানে যাবার জন্য একদিন অতি চুপিসারে
সকলেরে নিতে হয় ধীরে ধীরে চূড়ান্ত প্রস্তুতি;
তোমার প্রস্তুতি ছিল যদিও কষ্টের; এত কষ্ট
আমি কিন্তু কোনো দিন দেখেও দেখিনি; পাছে ছেলে
ব্যথা পাবে দুঃখ পাবে এই ভয়ে তুমি সহে গেছো
যাবতীয় অসুখের বেদনার অন্ধ অভিশাপ!
কবরের উল্টো দিকে জীবনের গলি
আমি চোখ বন্ধ করে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি
পাহাড়ের গ্রীবা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ আকাশ;
আকাশের তলপেটে মেঘবন্দি জলের শিশুরা
নক্ষত্রের চোখ দিয়ে খুঁজতে থাকে জরায়ু নীলিমা
অনন্তের হাত ধরে; ভোর থেকে সূর্য আলো-আশা
ছড়িয়ে ছড়িয়ে পথ পাড়ি দেয় দিগন্তের ঢেউ—
নির্ভীক মাঝির মতো—ওখানে তো মৃত্যু কিংবা
স্থবিরতা বলে কিছু নেই! নুড়ি বা পাথর নয়, হাতে
জীবনের পুষ্পভরা পূর্ণিমাকে ধরে যে-মানুষ
শূন্য থেকে মহাশূন্যে যুগে যুগে স্বপ্ন উড়িয়েছে,
কল্পনার কত রূপ কত ছবি আঁকে অবিরাম—
সে-মানুষের মৃত্যু নেই, সে-মানুষ কখনো কি মরে!
আমার জন্মের আগে পৃথিবীতেকিছুই ছিল না—
আমার মৃত্যুর পর পৃথিবীতে কিছুই থাকবে না!
দুই.
জানি ব্যক্তি খুব একা; কিন্তু মানুষ তো একা নয়।
সেই আদি যুগ থেকে শুরু করে এখন অবধি
লক্ষ কোটি জীবনের গর্ভ থেকে প্রত্যেক মুহূর্তে
যে-মানুষ আকাঙ্ক্ষার শস্যবীজ স্বপ্ন বুনে আসছে
সে আসলে একা নয়—এক থেকে বহু জনে জনে
জীবন ছড়িয়ে আছে ফুরোবে না তার পথ চলা,
এক জীবনের মাঝে তার আছে হাজার জীবন
হাজার জীবন থেকে বের হয় অগুনতি জীবন।
জীবনের গানে গানে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়
মানুষের অন্তহীন স্বপ্নযাত্রা—কখনো থামেনি;
সাময়িক বিপর্যয়ে না-থেমেও তাকে যেতে হয়
কুয়াশা তাড়িয়ে দূরে অন্ধকারে আগুন জ্বালাতে—
জয় বা বিজয় ছাড়া মানুষের আর কিছু নেই
মানুষে মানুষ মিলে তাড়াবেই অশুভ করোনা।
তিন.
মহামারী ঝড় ও ঝঞ্ঝায় কিংবা দৈব দুর্বিপাকে
ব্যক্তির জীবন দৃষ্টি-সৃষ্টি-পথহাঁটা সব কিছু
প্রকৃতির নিজের নিয়মে একদিন থেমে যাবে—
মৃতকে কবরে রেখে আলো হাতে স্বজনেরা ফেরে,
এটাই তো স্বাভাবিক; এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে না।
দেখতে দেখতে দিন যায় রাত আসে আগের নিয়মে
আবার দিনের শুরু লাল সূর্যটাকে মুখে নিয়ে
নদীতে উদ্দাম বেগে চলমান জীবন জোয়ার
মানুষ এগিয়ে চলে সমুদ্রের স্বপ্ন বুকে জ্বেলে;
বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলে সামনে হাঁটে প্রবল বিশ্বাসে;
মৃতকে কবর দিয়ে শোনে নবজাতকের কান্না:
একটি জীবন শেষে পুনরায় জীবনের শুরু
পাতা ঝরা শেষ হলে শোনা যায় বসন্তের গান
কোকিলের কুহু ডাকেঘুম ভাঙে নতুন দিনের।
চার.
ব্যক্তির গন্তব্য, জানি, বেদনার—খুব কষ্টকর;
অথচ মানুষ কোনো ঠুনকো জীব নয়—সাক্ষী তার
পেছনের আলোকিত দীর্ঘ ইতিহাস; জয় ছাড়া
পরাজয় তার নামে লেখা নেই কালের খাতায়।
মানুষ কখনো যদি পরাজিত হয়, তাহলে যে
ঈশ্বর নিজেই তার পরাজয় ঠেকিয়ে দেওয়ার
অস্ত্রখানি তুলে দেবে মানুষের হাতে; যাতে করে
মানুষ বিজয়ী হলে ঈশ্বরের পূর্ণ জয় হয়।
দিন ও রাত্রির মাঝখানে একবিন্দু জায়গা আছে;
ওটাকে সবাই বলে মুহূর্তের বাড়ি—আমি বলি
ঈশ্বরের অফুরান প্রাণের মোহনা;—এখানেই
ভোর ও সন্ধ্যার চোখে তার নামে কোমল পলিতে
জীবনের চর জাগে, ফুল ফোটে হরেক রকম—
ফুলে ফলে ভরে ওঠে আদমের নতুন সংসার।