[সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। জন্ম ১৯৫৮ সালের ৩০ মে। শেরপুর। তিনি মূলত কবি হলেও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় রয়েছে তার সমান বিচরণ। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, তৃষ্ণার্ত জলপরী, তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানের সাথে যৌথ), অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো, শহরের শেষ বাড়ি, প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি, সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো, সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব, শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব প্রভৃতি। তার জন্মদিন উপলক্ষে কবি শাহানা আকতার মহুয়ার লেখায় চিন্তাসূত্রের বিশেষ আয়োজন।]
কৈশোর ছুঁই ছুঁই সময়ে মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল বইটার নাম ‘অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো’। কবির নাম সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। কবিতাগুলো আজ আর মনে নেই, শুধু মনে আছে সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলাম।
আমার ভাইয়া জাকির তালুকদারের সুবাদে নতুন-পুরনো লেখকের প্রকাশিত বই বাসায় পেয়ে যেতাম বের হওয়ার পর পরই। তারপর সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পড়ার সুযোগ হয়। যেমন, ‘তবু কেউ কারো নই’ (নাসিমা সুলতানার সঙ্গে যৌথ), প্রেম বিরহের কবিতা, (শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে এক বক্সে)। সর্বশেষ পড়েছি ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘যুদ্ধশিশুর জীবনযুদ্ধ’।
না, দেশে এই কবির সঙ্গে কথা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি কখনো। কানাডায় আসার পরে দুলাল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগটা সহজ হয়ে ওঠে। কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পড়ে কবিকে আর কতটুকু পড়া যায়! দুলাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে খুব বিস্মিত হই। একজন মানুষ কিভাবে পারে চাকরি সামলে, দায়িত্বশীল স্বামী ও বাবার ভূমিকা পালন করে সাহিত্যের এতগুলো দিকে মনোযোগ দিতে? তিনি আবার ইত্তেফাকের কানাডাস্থ বিশেষ প্রতিনিধিও! গদ্য-পদ্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, উপস্থাপনা—কোথায় তার পদচারণা নেই! জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করেছেন ব্যাপক ও বিস্তৃত কাজ। একাত্তরের যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্ককে নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘যুদ্ধশিশুর জীবনযুদ্ধ’। যারা স্বদেশকে ভালোবাসেন, নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে লালন করতে চান, তারা হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্বশীলতা প্রকাশ করতে পারেন। যেমন দুলাল ভাই করছেন।
বর্তমানে কানাডায় ১৯৭১ নামে একটা গবেষণা গ্রন্থের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কানাডার ভূমিকা কী ছিল, কারা কোথায়, কতটুকু কাজ করেছেন—এসব নিয়ে গবেষণা রীতিমতো সময়সাপেক্ষ এবং সংবেদনশীল বিষয়। দুলাল ভাই সেই দুরূহ কাজটা করছেন, নিষ্ঠার সঙ্গেই করছেন। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে তার একটি লেখা পড়লাম। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার মূলধারাকে শাণিত করেছেন, কবিতার বাঁক বদলে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। কিন্তু ঠিক খোঁটাখুঁড়ি করে তার এই লেখায় তুলে এনেছেন যে ‘বঙ্গবন্ধু শুধু কলকাতা বা ঢাকার সাংবাদিকদের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন না, লাহোর তথা দেশের বাইরের সাংবাদিকদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করতেন।’
কোন্ কোন্ প্রবাসী বাঙালি ও বিদেশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন, তা ইতিহাসের গভীর থেকে তুলে আনছেন। ভ্যাংকুভারে শ্রদ্ধেয় রবি আলম ভাইয়ের কাছে একাত্তরে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা নিয়ে টুকরো টুকরো কথা জেনেছি, রবি আলম ভাই ও তার স্ত্রী মেডিলিন আলম কাজ করেছেন। তাই এত তথ্যসম্পদ থাকার পরেও সেটা নিয়ে কিছু লিখতে পারিনি বলে মনের ভেতরে একরকম চাপ অনুভব করি, দুলাল ভাই সেই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছেন, এতে কেন জানি না আমি মনে বেশ শান্তি পাচ্ছি।
এতো ব্যস্ততা, মাথার মধ্যে নড়তে থাকা বিভিন্ন ভাবনার পোকাদের সামলিয়ে দুলাল ভাই কিন্তু ঠিকই তার কাছের মানুষদের, দূরের মানুষদের খবর নেন। খুব মনে পড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবক, মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম যখন অসুস্থ ছিলেন, দুলাল ভাই নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন। রফিক ভাইয়ের স্ত্রী বুলি আপার সঙ্গে, কখনো রফিক ভাইয়ের সঙ্গে, কখনো বা আমার সঙ্গে কথা বলতেন। রফিক ভাই মারা যাওযার কয়েকদিন আগে দুলাল ভাই ‘স্বরব্যঞ্জন’-এর পক্ষ থেকে একটা শ্রদ্ধাপত্র পাঠান, সেটি পড়ে রফিক ভাইয়ের মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা কখনো ভুলবো না। ভুলবো না দুলাল ভাইয়ের এই মানবিক রূপটাকেও।
একটা মজার কথা বলি—আমি যখন লেখালেখি শুরু করি, মূলত লিটল ম্যাগাজিনে লিখতাম, তখন আমার বন্ধুদের অনেকেই নাম ছেঁটে-কেটে নিচ্ছিল, অনেকে নতুন নাম নিয়েছিল। আমি নেইনি। ছেলেমানুষি করে বলেছিলাম— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যদি নিজেদের এতবড় নাম নিয়ে লিখতে পারেন, যদি শামসুদ্দিন আবুল কালাম (কাশবনের কন্যা), আলাউদ্দিন আল আজাদ (তেইশ নম্বর তৈলচিত্র), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো) লিখতে পারেন, তাহলে আমার শাহানা আকতার মহুয়া নামে লিখলে সমস্যা কী?
মানুষ যখন কোনো কাজ করে, তখন আলোচনা-সমালোচনা হয়, বিড়ম্বনা বাড়ে। কিন্তু তাই বলে তো থেমে থাকা যাবে না। ইতিহাসের ইট-কাঠ-পাথর ভেঙে সম্মুখে আনতে হবে সত্যদিনের আলো। যেমন আমরা জেনেছি কানাডায় দত্তক আনা একাত্তরের যুদ্ধশিশু শিখা, ওমর, অরুণ, সাবেত্রি, বাথল, রানী, জরিনা, অনিল, সমর, রাজিব, মলি, রাজিনা, আমিনা, রুফিয়া, প্রদীপ এবং মনোয়ারার কথা। তেমনি অপেক্ষায় আছি ‘কানাডায় ১৯৭১’-এর জন্য।