‘আমি যা দেখি তুমি কি তা দেখো?’—আমাদের শৈশবে এটা ছিল খুব আনন্দের একটা খেলা। ওই বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর আর খেলা হয়ে ওঠে না। ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় আলোকচিত্রী গোলাম মোস্তফা। বলছিলেন, প্রত্যেক ফটোগ্রাফারের অবশ্যই এই খেলাটা খেলে যাওয়া উচিত সবসময়। কারণ সবকিছুকেই তার ভিন্নভাবে দেখার চোখ থাকতে হবে।
এই একটা কথা দুর্দান্ত এক অনুভূতির জন্ম দিলো আমার ভেতর। শিল্পের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই কথা খাটে। শুধু শিল্পই নয়, প্রতিটি মানুষভেদেই দেখার বা অনুভবের ব্যাপার ভিন্ন হয়। অনেক মানুষ একসঙ্গে যখন ঘুরতে যায় কোথাও, সবার ভালো লাগা এক রকম হয় না। এমনকী সবাইকে একই বিষয়ও আকর্ষণ করে না। তাই একজন ফটোগ্রাফার নিজের দেখায় যত বেশি ভিন্নতা আনতে পারবে, তার ফটোগ্রাফিও তত নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু শুধু ভিন্নভাবে দেখে তা ক্যামেরায় তুলতে পারলেই কি সবকিছু ‘ফটোগ্রাফ’ হয়ে ওঠে?
পৃথিবীতে যেকোনো কাজের জন্যেই সেই পথের পড়ালেখাটা ভীষণ জরুরি। কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়েই তা করতে হবে, এখন ব্যাপারটা সেরকম নেই। ওপেন সোর্সের যুগে মানুষ চাইলেই যেকোনো বিষয়ে তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। শিখে নিতে পারছে নিজের মতো করে। কিন্তু আমার মতো স্বঘোষিত ‘আলসে’ মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠান ভীষণ জরুরি। আমি শিখতে চাই খুব এবং চাওয়ার এই তীব্রতা থেকে যাত্রার শুরুতে যখন অজস্র পথ সামনে পাই, ‘কোনটা ফেলে কোনটা নেই’ ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এগোনো আর হয়ে ওঠে না।
ছবি আমি তুলি অনেকদিন ধরেই। এই কোথাও ভ্রমণে গেলাম। নানান মানুষ, সুন্দর জায়গা এরকম বিভিন্ন বিষয়ের ছবি তুলে ফেলি। ফটোগ্রাফি আমার ভালোবাসার জায়গা। তাই মনে হলো আরেকটু গুছিয়েই নাহয় ভালোবাসা যাক। এই ভাবনা থেকে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের ফটোগ্রাফি কোর্সে নাম লিখিয়ে ফেলি। শুরু হয় আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আমার নানান অগোছালো ভাবনা একটু একটু করে গুছিয়ে আসতে শুরু করে সেসময় থেকে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো তো শিখে নেওয়াই যায় ক্যামেরার ম্যানুয়াল পড়ে, অথবা ইউটিউব দেখে, কিংবা নিজেই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে। কিন্তু যেকোনো কাজকে ‘শিল্প’ হিসেবে গড়ে তলার জন্য যে বোঝাপড়ার দরকার, তার জন্য কিছু ভিন্ন পথ পাড়ি দিতে হয় বলে আমি মনে করি। কিছু পড়ালেখা লাগে, দর্শন লাগে, লাগে গুরুর সান্নিধ্য।
বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি যাদের হাত ধরে আজকে এই পর্যন্ত এসেছে, তাদের মধ্যেই কেউ-কেউ আমাদের ক্লাস নেন। এই শিক্ষকেরা আমার অর্জন। দিনের পর দিন আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি এই মানুষগুলোর নিবেদন দেখে। বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করছেন।
একদম প্রথম দিন বাবু ভাই (মীর শামসুল আলম বাবু) একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আলো দিয়ে আঁকা হয় যে চিত্র, তাই-ই আলোকচিত্র।’
তাহলে যা ক্লিক করবো, তা অবশ্যই একটা ছবি হতে হবে। পার্থক্য হলো, এই ছবি রঙ তুলিতে আঁকা হবে না, হবে আলো দিয়ে। এরপর থেকে ছবি তুলতে গেলেই দেখছি ওগুলো শুধু ‘ক্লিক’ হচ্ছে, কোন চিত্র হচ্ছে না। আমি আবিষ্কার করি, একটা ফটোগ্রাফের সত্যিকারের শিল্প হয়ে ওঠা কত সাধনার ফল, কত নিবেদনের ফল।
কোর্সের অংশ হিসেবে আমরা ফটোওয়াকে যেতাম নানান জায়গায়। কখনো রমনাপার্ক, কখনো আমিন বাজার, কখনো ঢাকার রাস্তা, কখনো কাওরান বাজার। ছবি তুলে পরের ক্লাসে আমাদের তোলা ছবি নিয়ে আলোচনা হতো। প্রত্যেককে বেশ অনেকগুলো করে ছবি জমা দিতে হতো। প্রতিটা ছবির কোন অংশ ভালো হলো, কী করলে আরও ভালো হতে পারতো, কী কী ভুল হচ্ছে প্রতিটা ব্যাপার ধরে ধরে বলে দিতেন জাহাঙ্গীর ভাই (কে এম জাহাঙ্গীর আলম)। এর ফল হিসেবে আমি যা পেয়েছি, এখন যেই ফটোগ্রাফই সামনে আসে, বলে ফেলতে পারি বা ধরার চেষ্টা করি কী হলে ছবিটা আরও ভালো হতে পারতো। তারা প্রত্যেকেই আমার গুরু। এবং যখন তাদের কাছে শুনি, ‘কারও যদি দিনে একটা ছবিও হয়, সেটা বিরাট ব্যাপার’
গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে ভাবতে হয় আসলেই ছবির ‘ছবি’ হয়ে ওঠা এত কঠিন? আমাকে এই ভাবনা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা স্যার। তিনি যেদিন ক্লাসে বললেন, ‘আমার সারাজীবনে ছবি হয়েছে মাত্র চারটা।’
১৯৫৪ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে আলোকচিত্রে হাতেখড়ি হওয়া একজন যুগান্তকারী আলোকচিত্রী, পরবর্তী সময়ে যিনি কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন, তিনি এ কথা বলার পর কবে আমার অন্তত একটা ছবি হবে এই ভাবনায় ছবির পর ছবি তুলে যাওয়া ছাড়া আর অন্যকোনো উপায় থাকে না।
সত্যিকারের একটা ফটোগ্রাফের অপেক্ষায় যখন ছবি তুলে যাচ্ছি, চেষ্টা করে যাচ্ছি কম্পজিশন, অ্যাংগেল, পারস্পেক্টিভ সবকিছু ঠিকভাবে রাখার, ঠিক সেসময়ে নতুন মাত্রা যুক্ত করে দিলেন চন্দন দা (হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন)। মিট দ্য ফটোগ্রাফারের একটা সেশনে পেলাম তাকে। কথা বলছিলেন ‘ভালো ছবি’ কী, তা নিয়ে।
একটা ছবি একটা ভালো ফটোগ্রাফ হয়েছে. তা কী থেকে বোঝা যাবে? ফটোগ্রাফকে সুন্দর হতে হবে, সমস্ত গ্রামার মানতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে অবশ্যই ফটোগ্রাফারের দর্শন যুক্ত থাকতে হবে তাতে। কোনো গল্প বলা না হলে, কোনো ভাবনার জন্ম না নিলে তা ফটোগ্রাফি নয়। আরও বলেছিলেন ফটোগ্রাফারকে অবশ্যই শিল্পের সমস্ত শাখা নিয়ে জানতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে। নয়তো নতুন কোনো ছবির ভাবনা জন্ম নেবে না। ফটোগ্রাফটা শিল্প হয়ে উঠবে না।
আমি মোস্তফা স্যারের কথাটা অনুধাবন করতে পারলাম চন্দনদার এই কথাগুলো পাওয়ার পর। আর ওই যে বলছিলাম ভিন্নভাবে দেখতে পারলেই তা ফটোগ্রাফ হয়ে ওঠে কী না? ভিন্নভাবে দেখার সাথে এই সমস্তকিছু এক হলে তবেই একটা ছবি ফটোগ্রাফ হয়ে ওঠে।
এই হচ্ছে আমার ফটোগ্রাফির বোঝাপড়া। তো এখন আসি ক্যামেরা প্রসঙ্গে। এই ডিজিটাল যুগে সময়ের সাথে সাথে আধুনিকতর হয়ে উঠছে ক্যামেরা এবং তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এখন প্রতিনিয়ত যদি নিজের ক্যামেরাকে আপডেটেড করে যেতে থাকি তো পড়তে হবে অকূল সাগরে। এত টাকা কোথায়। তারচেয়ে বড় কথা, যত আধুনিক ক্যামেরা, ফটোগ্রাফও কি ততই ভালো হবে? কদিন আগ পর্যন্তও আমার ডিএসএলআর ছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার ক্যামেরা যে ডিএসএলআর না, বরং কমপ্যাক্ট ক্যামেরা, তাও আমি জানতাম না।
আমাকে নিকন কুলপিক্স পি৫৩০ কিনে দিয়েছিলেন মা। ক্যামেরা কিনতে গেলাম যেদিন, নানান দোকান ঘুরে দেখছি। ছোট ডিজিটাল ক্যামেরা, আরেকটু বড় ক্যামেরা, আবার কিছু ক্যামেরা দেখলাম যার সঙ্গে আলাদা লেন্স লাগিয়ে নিতে হয়। কোনটা কেমন হবে, কোন ধরনের ক্যামেরা দিয়ে কেমন ছবি হবে, কোনো ব্যাপারে ধারণা নেই বিন্দুমাত্র। এক দোকানে গিয়ে ডিএসএলআরের দাম জানতে চাইলাম। বললো, ন্যূনতম ছাব্বিশ হাজার। সঙ্গে আলাদা লেন্স কিনতে হবে। আবার জানতে চাইলাম লেন্সের দাম কত? এই আমি তখনো জানি না যে লেন্স কোম্পানি, ম্যাটেরিয়াল, ফোকাল লেংথ অনুযায়ী নানান দামের হয়। যেহেতু আগের অভিজ্ঞতা আমার এক লেন্সেই সব কাজ, তাই ভেবেছিলাম লেন্স তো একটাই হবে। সেই ক্যামেরা বিক্রেতা হয়তো মনে মনে হেসেছিলেন।
তো যাই হোক, আমার ক্যামেরা যে কমপ্যাক্ট ক্যামেরা, তা জানতে পারলাম ফটোগ্রাফি ক্লাসের প্রথম আউটিংয়ে। তাতে অবশ্য খারাপ লাগলো না। খারাপ লাগলো আরেকদিন। দ্বিতীয় আউটিংয়ে গেলাম আমরা। ক্যামেরার চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় আমার এক সহপাঠীর ক্যামেরা নিয়ে কিছু ছবি তুলবো। তার ডিএসএলআর। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে এবং শাটার বাটনে প্রেস করার পর অবাক হলাম ভীষণ! এত ঝকঝকে! এত ফাস্ট! নানান ধরনের লেন্স দিয়ে কী দুর্দান্ত সব ছবি তোলা যাচ্ছে। তখন একটু খারাপ লাগা শুরু করলো একটা ডিএসএলআর না থাকায়।
ক্লাসে অনেকের তো ক্যামেরাও ছিল না। কাজেই মনের এই ক্ষতে প্রলেপ দিতেন আমাদের শিক্ষকেরা। তারা ঠিক বুঝতেন নানান জনের নানান ক্যামেরা অনেকের মধ্যে হীনণ্মন্যতা তৈরি করবে। তাই বলতেন সবসময়, পৃথিবীতে বিখ্যাত ছবিগুলোর কোনোটাই কোনো দামি ক্যামেরায় তোলা হয়নি। ভালো ছবির জন্য ডিভাইস কোনো ব্যাপার না। এই কথাটা মাথায় একদম শক্ত করে গেঁথে গেলো।
কোর্স শেষ হলো। তার কিছুদিন পর আমি একটা ডিএসএলআরের মালিক হলাম। সবসময়ের মতো এবারও উপহার মায়ের। সঙ্গে হলো কিট লেন্স, জুম লেন্স ও ওয়াইড লেন্স।
ক্যামেরা আর লেন্সের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম বাবু ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছে। ওয়াইড লেন্সের ব্যাপারে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের একটা কথা মনে ধরেছিল। ওয়াইড লেন্সে যাই তোলা হয় ভালো লাগেই। কারণ এতে অন্যরকম একটা এপিয়ারেন্স পাওয়া যায়। ওয়াইড লেন্স, জুম লেন্স এগুলোতে কাজ করলে পরে অন্য কোনো লেন্সে কাজ করতে অনেকেরই ভালো লাগে না। কাজেই আমি যদি কনফিডেন্ট থাকি তাহলে নিতে পারি। আর তারও আগে আমার উচিত ফটোগ্রাফির কোন অংশে কাজ করতে আগ্রহ পাই, তা খুঁজে বের করা।
একটা প্রোজেক্টের জন্য ওয়াইড লেন্সটা নিয়ে নেয়া জরুরি ছিল। পরে নানান লেন্স দিয়ে নানান ছবি তুলে যাচ্ছি, আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি ক্যামেরা আর লেন্স। সঙ্গে প্রচুর মুভি দেখছি। এসময়ের, সেসময়ের। দেখছি সময় ভেদে ক্যামেরার কাজ। একসময় উপলব্ধি করলাম, প্রযুক্তি হাতের কাছে চলে আসায় একে সৃজনশীলতায় কাজে লাগানোর পাশাপাশি এর সুবিধাও নেওয়া হচ্ছে। যার কারণেই হয়তো সত্যজিৎ, ঋত্বিক বা কুরোসাওয়া যেভাবে তৃপ্তি দিতে পারেন, এখন অনেক সময় তা আর পাই না।
তখন আমি ভাবতে বসলাম, আমার লেন্সগুলোর মধ্যে কোনটা কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করবো। সম্ভবত গ্রুপ ছবি, হেরিটেজ/আর্কিটেকচার, কখনো ল্যান্ডস্কেপের জন্য ওয়াইড লেন্স, পোর্ট্রেট আর ওয়াইল্ডলাইফের জন্য জুম লেন্স, আর ১৮-৫৫ কিট লেন্সটা স্ট্রিট ফটোগ্রাফি এবং সবধরনের এক্সপেরিমেন্টাল ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করবো। যদিও পোর্ট্রেটের জন্য প্রাইম লেন্সই আদর্শ। প্রাইম লেন্স না থাকায় পোর্ট্রেটে জুম লেন্স একটা ভালো অপশন বলে আমার এক্সপেরিমেন্ট বলে।
ফটোগ্রাফি সবারই করা উচিত বলে মনে করি আমি। কারণ ফটোগ্রাফি করতে গেলে ভিন্নভাবে দেখতে পারার অভ্যাস তৈরি হয়। এবং এই অভ্যাসের প্রভাব ব্যাক্তি জীবনে পড়ে, পড়ে চিন্তাধারায় আর ভাবনায়। একটা ছবি তোলার সময় ফ্রেমের ভেতর কী আছে, কী রাখতে চাচ্ছি, কী বাদ দিয়ে তুলতে পারলে ভালো হয় এই ভাবনাগুলো ছোট ছোট সবকিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখার মানসিকতা তৈরি করে। এবং সবকিছুতে সৌন্দর্য্য খুঁজে নেয়ার যে অভ্যাস রন্ধ্রে ঢুকে যায়, আমার কাছে তা অন্যতম বড় প্রাপ্তি।
ফটোগ্রাফিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শাখা তৈরি হচ্ছে। যত বেশি মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হবে, ফটোগ্রাফি তত দৃঢ় এক শিল্প মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নেবে।
ফটোগ্রাফিতে যেহেতু মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগ ঘটে, অর্থাৎ একজন ফটোগ্রাফার তার ফ্রেমে যা ধারণ করেন মানুষ তাইই দেখতে পায়; তাই একটা ফটোগ্রাফে শুধু সৌন্দর্য থাকার চেয়েও বেশি জরুরি ফটোগ্রাফারের ভাবনা ফুটে ওঠা।
একটা সময় ছিল যখন আমি শুধু ‘সুন্দর’ তুলতে চাইতাম। সুন্দর ছবি দেখলে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এখন আমার তোলা সেসব ছবি দেখলে নিজেই বিরক্ত হয়ে যাই। এবং যে ছবিতে আমি কোন দর্শন অথবা গল্প খুঁজে পাই না, বা আমাকে ভাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে না, তা আমাকে আকর্ষণ করে না। আমার ভাবনার এই পরিবর্তনের জন্য আমি আমার গুরুদের কাছে ঋণী।
প্রতিটা ফটোগ্রাফই ইতিহাস হয়ে যায়। আজকে এই মুহুর্তে যা ঘটছে, তা তো কালকের দিনটা এলে আমি আর পাচ্ছি না। আবার আজকে আমি যা তুলে রাখছি, কয়দিন পর হয়তো সে মুহূর্ত, সেই মানুষ, বা সেই জায়গাটা হারিয়ে গেলো। নানান গ্রুপ দেখতে পাই ফেসবুকে; যেমন, চারশ বছরের ঢাকা বা এমন কিছু। সেখানেই হয়তো চোখে পড়লো এখন যেসব জায়গা বিরাট সব হাউজিংয়ের দখলে, সেখানেই হয়তো নদী ছিল।
শিল্প হচ্ছে শিল্পীর একান্ত অনুভূতির প্রকাশ। এই ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও তাই অনুভব করতে পারা জরুরি ভীষণ। হাতে ক্যামেরা থাকলে তাই একের পর এক ক্লিক না করে ওই সময়টা অনুভব করতে হয়, ওই পরিবেশটা উপলব্ধিতে আনতে হয়। ব্যক্তি আমি ছবি তুলি, তখনই ঠিক যেসময় আমার ভেতরের সত্তা আমাকে অনুমতি দেয়।
কখনো আমি অনুভব করি আমাকে ছবি তুলতেই হবে, আবার কখনো সামনে অসাধারণ কোনো মুহূর্ত এলেও ক্যামেরা বের করতে ইচ্ছে করে না আমার। মনে হয় সেই সময়টা চুপচাপ শুধু উপভোগ করার। ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব ওয়াল্টার মিটি’ আমার ভীষণ প্রিয় সিনেমা। এর একদম শেষ অংশে শ্যনের বলা
‘Sometimes I don’t. If I like a moment, for me, personally, I don’t like to have the distraction of the camera. I just want to stay in it.’
কথাটা আমি নিজের সাথে তাই যুক্ত করতে পারি।
ফটোগ্রাফির সবচেয়ে জরুরি বিষয় আমার কাছে মনে হয় দুটো। ধৈর্য্য এবং নিজস্বতা।
একটা ভালো ছবি তুলতে পারার জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় উপযুক্ত সময়ের। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু তো ঘটেই চলে। কিন্তু আমি ঠিক ‘কী’ ধরতে চাচ্ছি তার জন্য সময় দিতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে সেই সময় পর্যন্ত যতক্ষণ না ভেতরের আমিটা আমাকে নাড়া দেবে।
আর নিজস্বতা হচ্ছে নিজের একটা স্টাইল। ভালো ছবির অনুকরণে ছবি তোলা যায়, কিন্তু ফটোগ্রাফে নিজের একটা স্টাইল তৈরির জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা। এবং তা রপ্ত হবে দিনের পর দিন ছবি তুলে গেলে। ছবি হয়তো খুব সাধারণ হবে, কখনো তাতে ভালো ছবির ছায়া পড়বে। এভাবে একসময় হয়তো অজান্তেই নিজস্ব স্টাইল দাঁড়িয়ে যাবে।
ধৈর্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলেও নিজস্ব স্টাইল এখনো রপ্ত করতে পারিনি আমি। নিজের কাজে সৎ থাকতে পারলে, এবং প্রকৃতি সহায় হলে হয়তো একদিন নিজের ছায়া ফেলতে পারবো ফটোগ্রাফে।
আপাতত সেই মুহূর্তের অপেক্ষা।