এক.
মুক্তি, পাপ, কিংবা হিংস্রতার মধ্যে হঠাৎ কেউ বন্ধুর মতো আপন করে নিয়ে কোনো এক নির্দিষ্ট ফ্রেমে যদি আপনাকে সুনিপুণ কোনো গল্প দেখায় রুপালি পর্দায়, তাহলে নির্দ্বিধায় সেই গল্পের কারিগরের শূন্য নামের জায়গায় আপনি বসিয়ে দিতে পারেন মার্টিন স্কোরসেজির নাম। ইতালীয়-মার্কিন অস্তিত্ব, পাপবোধ, মুক্তির ক্যাথলিক ধারণা আর আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় সন্ত্রাসের প্রভাব তার সিনেমায় নিশিপাওয়া মানুষের মতো হয়তো আপনাকে তাড়া করবে কোনো এক অমাবস্যা রাতে। ক্যাথলিক পরিবেশে বড় হওয়া মার্টিন স্কোরসেজি ছোটবেলায় শ্বাসকষ্টের জন্য অংশ নিতে পারতেন না বাচ্চাদের কোনো খেলাধূলায়। মার্টিনের বাবা-মা দুজনই ছিলেন অভিনয় শিল্পী সে সুবাদে এই শ্বাসকষ্ট হয়তো হয়ে এসেছিল সৌভাগ্যের চাবি। এভরি ক্লাউড হ্যাজ অ্যা সিলভার লাইনিং!
মার্টিনকে তাই সুস্থ বিনোদনের জন্য তার বড় ভাই কিংবা বাবা-মা নিয়ে যেতেন সিনেমা দেখতে আর তখন থেকেই হয়তো মার্টিন হয়ে ওঠেন সিনেমাপ্রেমী। রিল ভাড়া নিয়ে সিনেমা দেখতে দেখতে মার্টিন একসময় হয়ে উঠবেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা। আর আমরা সৌভাগ্যক্রমে কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাহায্যে খুঁজে পাবো শাটার আইল্যান্ডকে।
দুই.
জন্ম থেকেই হয়তো কেউ কেউ জানে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য ব্যক্তিগত বিপ্লবের নেই কোনো বিকল্প। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর হয়তো আমাদের সবার মধ্যেই জন্ম নেয় ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ সিনেমার ট্রাভিস বিকল। নিরালম্বের মধ্যে যখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা বসে ডুগডুগি বাজায় তখনো ট্রাভিসরা আমাদের স্বপ্ন দেখায়। সিনেমা প্রসঙ্গে মার্টিন বলেন, ‘আমি নিজেকে ভিজ্যুয়াল ইমেজের মাধ্যমে ন্যারেটিভ সিনেমায় উপস্থাপন করতে সক্ষম, সিনেমায় আমি ঠিক এটাই করি। এই জন্য আমি কিছু টুলস ব্যবহার করি এবং সেটাই একসময় ভাষা হয়ে যায়।’
যে চরিত্রগুলোকে আপনার খোলা চোখে অ্যানটাগনিস্ট মনে হবে তারাই কোনো না কোনোভাবে মার্টিনের সিনেমায় হয়ে ওঠে প্রোটাগনিস্ট। মানুষের যে কালো অধ্যায়গুলো আছে, যা নিয়ে আপনি জনসম্মুখে কথা বলছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, ভয় ভেঙে যেন সেসব অন্ধকার ঘরের দরোজা খুলে দেয় মার্টিনের সিনেমা।
ক্লোজআপ শট থেকে হঠাৎ মিডিয়াম শটে ট্র্যান্সফর্মের মধ্য দিয়ে এভাবেই মার্টিনের গল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোন এক জনপদের চেনা কোন রাস্তার গলি ধরে হাঁটে। মার্টিনের সিনেমার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা নিশ্চয়ই জানেন, মার্টিনের ন্যারেশনের ক্ষমতা সম্পর্কে, বুঝতে পারেন মার্টিন আসলে একটা সময়ের গল্পই বলতে চান সবসময়। একটা নির্দিষ্ট টাইমফ্রেম ধরে গল্প গুলো এগুলেও কোনো এক শক্তিবলে গল্পগুলো হয়ে যায় চিরন্তন। তাই, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ সিনেমার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্যাম ইসমাইল বলেন, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার কিংবা মার্টিনের যেকোনো সিনেমার দিকে তাকালে মনে হয়, ও সেই নিউইয়র্ক সিটিকেই তুলে এনেছে ফিল্মে যার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়।’
ফ্রেমের মধ্যে যে গল্প থাকে তা ছাপিয়ে মার্টিন যেন ফ্রেমের বাইরের গল্প দেখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন আর তাই তার গল্পগুলো আপনার আটপৌরে জীবনের একটি অনুষঙ্গ হয়ে যেতে পারে সহজেই। মার্টিনের ক্যামেরা মূলত লংশটে একটি জীবনের পোস্টমর্টেম করে। একজন প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টারের মধ্য দিয়ে স্রেফ ন্যারেশনের মাধ্যমে পুরো সিস্টেমের গালে বন চটকানা মারার অদ্ভুত ক্ষমতাই হয়তো মার্টিনকে করেছে অন্য সবার চেয়ে আলাদা। সমস্ত সিনেমাটিক এলিমেন্ট ব্যবহার করে আপনার সূক্ষ্ম ইমোশনগুলো সাইকোলজিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কোটি মানুষের সামনে উঠে আসে মার্টিনের সিনেমায়। যদি কোনো দিন আপনি সুযোগ পান নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় হাঁটার, নিউইয়র্কের লাইট গুলো দেখার এবং একই সঙ্গে আপনার পূর্ব পরিচয় থাকে মার্টিনের সিনেমার সঙ্গে আমি নিশ্চিত আপনি সাক্ষাৎ পাবেন স্বয়ং ডেজা ভ্যু’র। মনে হবে, এই দৃশ্য আপনি অসংখ্যবার দেখেছেন যখন মাথার ভেতর কোনো বোধ কাজ করে।
মার্টিন বড় হয়েছেন নিউইয়র্কের খুব অদ্ভুত ও সংকীর্ণ এক এলাকায় এবং সেই রুটকে তিনি অসম্ভব সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন তার সিনেমায়। ইতালিয়ান-অ্যামেরিকান এই জীবনযাত্রার স্পষ্ট ছাপ যেমন পাওয়া যায় ‘গুডফেলাস’ সিনেমায় ঠিক তেমন বিভিন্ন শাখানদী পেরিয়েও তিনি মূলত ভেদাভেদহীন মানুষের জীবনের কথাই বলেছেন সবসময়। মার্টিন বলেন, গল্পের চরিত্ররাই তাকে সিনেমার পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। মার্টিনের সিনেমা দেখতে দেখতে আপনি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, মার্টিন মূলত নায়ক কিংবা খলনায়কের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী না বরং এই নায়ক এবং খলনায়কের দ্বৈরথের মাঝে সে সব চরিত্র আছে মার্টিন মূলত তাদের নিয়েই খেলতে বেশি ভালোবাসেন। যে চরিত্রগুলোকে আপনার খোলা চোখে অ্যানটাগনিস্ট মনে হবে তারাই কোনো না কোনোভাবে মার্টিনের সিনেমায় হয়ে ওঠে প্রোটাগনিস্ট। মানুষের যে কালো অধ্যায়গুলো আছে, যা নিয়ে আপনি জনসম্মুখে কথা বলছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, ভয় ভেঙে যেন সেসব অন্ধকার ঘরের দরোজা খুলে দেয় মার্টিনের সিনেমা।
অডিয়েন্সকে যেকোনো কিছু বিশ্বাস করানোই হয়তো একজন মহৎ পরিচালকের ক্ষমতা। এই কাজটা মার্টিন করেন খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সিনেমাটিক ল্যাংগুয়েজের বাইরে তাই এই সিনেমাগুলো চেখভের গল্পের মতো হয়ে ওঠে নির্লিপ্ত সুন্দর।
তিন.
ছবি আঁকার জন্য আপনি কাগজ, কলম নিয়ে বসলেন। প্রথমে একটি গাছের ছবি আঁকলেন, তারপর গাছটিকে পূর্ণতা দিতে কিছু পাখি, পাখিকে কমপ্লিমেন্ট দিতে কিছু মেঘ আর মেঘ থাকা মানে আকাশ তো কোথাও না কোথাও আছে! মার্টিন যখন সিনেমাতে একটি চরিত্রকে দিয়ে বারবার বলাচ্ছে, ‘আর ইউ টকিং টু মি, বাট আই অ্যাম দ্য অনলি ওয়ান হেয়ার’ তখন ওই শূন্য ঘরে কথাগুলো বারবার হাওয়ায় হাওয়ায় গোত্তা খেয়ে তরঙ্গায়িত হয়ে ঢেউ তুলছে আপনার মনে, আপনার তখন মনে হচ্ছে, আপনিও কি এমন না? আপনিও কি এইভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নগ্ন হয়ে যান না ক্রমাগত? মার্টিন মূলত এইভাবে ছবি আঁকে। প্রথমে তৈরি করেন পরিবেশ, তারপর চিত্রায়িত হয় দৃশ্য। মার্টিন যখন মাফিয়াদের নিয়ে সিনেমা করেন, তখন মাফিয়াদের ড্রেসের কলার কেমন হবে সেটা নিয়েই তিনি থাকেন অবসেসন, যার ফলে আপনি যখন তার সিনেমা দেখতে বসবেন, তখন আপনার কাছে ওই জগৎটা রুপালি পর্দার কোনো জগৎ মনে হবে না বরং মনে হবে এটাই অথেনটিক ওয়ার্ল্ড। অর্থাৎ, ডিটেলিংয়ে মার্টিন অনবদ্য এই বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের বিশেষ সুযোগ নেই কোনো।
একটা দৃশ্যে ক্যামেরা ফেইস টু ফেইস রোল করছে এবং আপনি অডিয়েন্স হয়ে বুঝতে পারছেন যে সবাই সবাই’কে দেখছে যেমন’টা হয় ভেগাসে কোনো এক জুয়ার টেবিলে, ‘ক্যাসিনো’ সিনেমার এডিটিংয়ে এই মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু অসম্ভব ভালো এডিটিংয়ের জন্য আপনি দৃশ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবেন সহজেই।
সিনেমায় অথেনটিসিটি তখনই আসে, যখন আপনি পলিটিক্যালি এবং ইকোনোমিক্যালি কারেক্ট থাকবেন, সিনেমায় মার্টিন সম্ভবত এই ফর্মুলা’র চূড়ান্ত ব্যবহারে অন্যতম। ‘গ্যাংস অব নিউইয়র্ক’ সিনেমা দেখতে দেখতে আপনি বুঝতে পারবেন ওই অ্যানশিয়েন্ট সময়ে ফাইটিং’টা মূলত কেন কালচারের অংশ ছিল। ভায়োলেন্স’ও আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভায়োলেন্স ইজ অলসো অ্যা ম্যাটার অব এক্সপ্রেশন, তো এই এক্সপ্রেশন’কে সত্যি হিসেবে যতটুকু পর্দায় উপস্থাপন করা সম্ভব, মার্টিন তার সবটুকু করতে পারেন বলেই আমার বিশ্বাস। আপনি যদি মার্টিনের সিনেমা দেখতে থাকেন, তাহলে আপনিও দ্বিমত করবেন না আশাকরি। মার্টিনের সিনেমায় ভায়োলেন্সগুলো অবশ্যই আনন্দের উপসর্গ হয়ে আসে না, একদমই না। বরং আপনাকে ঠেলে দেবে একটি নেভার এন্ডিং অস্বস্তির দিকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে যখন আপনি আপনার যাপিত জীবনযাপনে ক্লান্ত হয়ে যাবেন, তখন মেটাফোরিক্যালি হলেও আপনি এই অস্বস্তির মধ্যে যে নিদারুণ সত্য লুকিয়ে আছে তার সন্ধান পাবেন।
চার.
‘আর নয়, আর নয় জনপথ ধ্বংস হয়ে যায়’, আর ধ্বংসের মধ্যে কোথাও বাঁশি বাজায় নিরো কিংবা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হেঁটে যায় সমুদ্রের দিকে আর আপনার মনে থাকে শুধু কৃষ্ণের বাঁশি’র সুর। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সিনেমায় ঠিক এমন অনুভুতি’র জন্ম দেয়। ওই গল্পের অনুভূতির মতো, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ টাইপ অনুভূতির মধ্য দিয়ে দৃশ্য শেষ হওয়ার পরেও মিউজিক আপনাকে দীর্ঘক্ষণ আলোড়িত করে রাখতে সক্ষম। মার্টিনের ক্যামেরা শটের সঙ্গে মিউজিক যেন সাত জন্মের জন্য বাঁধা পড়ে থাকে সাত পাকে। তাই মার্টিনের সিনেমা শুধু দেখার বাইরেও শোনার জন্য আপনাকে দিতে হবে এক্সট্রা মনোযোগ কিংবা এমনও হতে পারে শুধু মিউজিকের জন্য একটি দুর্বল দৃশ্যও আপনার মনে হবে অকল্পনীয়।
ব্যক্তিজীবনে পাঁচ বার বিয়ে করা এবং অসংখ্যবার বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যাওয়া মার্টিনের অবশ্য দীর্ঘদিন সংসার করতে হয়েছে মিউজিকের সাথে শুধু সিনেমায় উপযুক্ত জায়গায় ব্যবহারের জন্য। ‘উলফ অব ওয়ালস্ট্রিট’ সিনেমায় এফবিআই রেইড দেওয়ার সময় যখন পপ মিউজিক বেজে উঠলে দৃশ্য হয়ে যায় আরও ইনটেন্স। এমন উদাহরণ আরও অসংখ্য দেয় যাবে, আপনি যখন মার্টিনের সিনেমা দেখবেন তখন সিনেমার মধ্য দিয়ে আপনার ইউটিউব প্লেলিস্টে উঠে আসবে অসংখ্য অপরিচিত গান অনেকটা মুরাকামি’র উপন্যাস পড়ে যেমন পাওয়া যায় তেমন।
পাঁচ
একটা ভালো শট বাজে এডিটিংয়ের জন্য হয়ে যেতে পারে বরবাদ। এইদিক থেকেও মার্টিন বিস্ময়কর। চমৎকার পরিচালনার পাশাপাশি চমৎকার এডিটিংয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। শুরুর দিকে নিজের অধিকাংশ সিনেমার এডিটিং তিনি নিজেই করেছেন। একটা দৃশ্যে ক্যামেরা ফেইস টু ফেইস রোল করছে এবং আপনি অডিয়েন্স হয়ে বুঝতে পারছেন যে সবাই সবাই’কে দেখছে যেমন’টা হয় ভেগাসে কোনো এক জুয়ার টেবিলে, ‘ক্যাসিনো’ সিনেমার এডিটিংয়ে এই মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু অসম্ভব ভালো এডিটিংয়ের জন্য আপনি দৃশ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবেন সহজেই। এমন উদাহরণ আরও শ’খানেক দেওয়া যাবে, তবে তাতে করে লেন্দি হয়ে যাবে এই আলোচনা আমি বরং মার্টিনের মতো বল আপনার পায়ে তুলে দিতেই রাজি, গোল দেওয়া না দেওয়া আপনার সিদ্ধান্ত।
ছয়.
সিনেমা টেকনিক, শট সিলেকশন, সিকুয়েন্স, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কালার টোন এইসব টুলসের মহৎ ব্যবহারের বাইরেও মার্টিনের জগৎ অনেক বিস্মৃত। শুধু ভায়োলেন্স ব্যাড ল্যাংগুয়েজ কিংবা অস্ত্রের ঝনঝনানি’ই মার্টিনের মূল শক্তি না বরং ‘হুগো’র মতো সিনেমায় মার্টিন দেখিয়েছেন, একজন এতিম মেকানিক্যাল জিনিয়াসের জার্নি। স্বাভাবিক জগতের বাইরে একজন শয়তান টয়মেকারের সঙ্গে ‘হুগো’র ফ্যান্টাসি দ্বৈরথ টেকনিক্যালি আপনি চাইলেই নিজের জীবনের যেকোনো সময়ের সঙ্গে মিলাতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, ‘গ্যাংগস অব নিউইয়র্ক’ নিয়েও আলাদা করে আলোচনা করা যায়। নিজের সিগনেচার গ্যাং কালচার’কে এই সিনেমায় মার্টিন দেখিয়েছেন ভিন্ন এক এরা’কে ব্যবহার করে। বাবার খুনের বদলা নিতে ছেলে নিউইয়র্কে ফিরে আসলে ক্রমাগত গ্যাংযুদ্ধ এবং যৌন অত্যাচারের মধ্য দিয়ে একটি সমাজব্যবস্থা’র চিত্র এই সিনেমায় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
এই সিনেমায় যে ফিলোসফি নিয়ে ডিল করেছেন মার্টিন সেটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী কাজ। সিনেমার শেষেও দর্শক হিসেবে আপনি এমন এক কনফিউশনে আটকে থাকবেন যে সমাধানের জন্য এই সিনেমার কাছে আপনার ফিরে আসতে হবে বারবার।
‘কিং অব কমেডি’ সিনেমায় মার্টিন কাজ করেছেন একদম ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন অবসেসিভ এবং গুফি মিডিওকোর ব্যক্তিকে প্রোটাগনিস্ট করে এগিয়েছে এই সিনেমার গল্প এবং এটা একটি কমেডি সিনেমা। এই যে টপিক সিলেকশনে ভ্যারিয়েশন এটাও মার্টিনকে মোটা দাগে নিয়ে যায় অন্য উচ্চতায় এবং এই সিনেমার একজন অভিনেতার ভার্সেটালিটি মার্টিন এক্সপ্লোর করেছেন চমৎকারভাবে এবং দিন শেষে এই সিনেমার পরিণতিও হয়েছে স্বাভাবিক রিয়েলিজমে। ‘অ্যাভিয়েটর’ সিনেমায় মার্টিন অ্যাভিয়েশনের দৃশ্য ধারণকে রীতিমতো সুন্দরের চূড়ায় নিয়ে গেছেন। এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়ার মধ্য দিয়ে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার যে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেটা আপনাকে আলাদা করে ভাবতে বাধ্য করবে। ‘ক্যাসিনো’ / ‘মিন স্ট্রিট’ / ‘গুডফেলাস’ কিংবা রিসেন্ট সিনেমা ‘আইরিশ ম্যান’কে যদি মার্টিনের সিগনেচার মুভি হিসেবে আপনি কাউন্ট করেন তাহলে এইসব সিনেমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বেশকিছু সিমিলারিটি আপনি খুঁজে পাবেন।
বিশেষ করে শট সিলেকশন, কন্টিনিউটি এবং শহর’কে বেইস করে গড়ে ওঠা কাহিনীগুলো ন্যারেটিভ রিয়েলিটিকে কোনো একভাবে মক করে পরিণতির দিকে আগায়। সিনেমার শেষে আপনার কাছে মনে হবে, একটা গোটা জীবন এক বসায় দেখে শেষ করা গেলো। ‘রেইজিং বুল’ সিনেমা দেখতে দেখতে আপনার মনে হতে পারে, আপনি হয়তো মার্টিনের শৈশব থেকে ঘুরে আসছেন। এই সিনেমাটি ইতালিয়ান-অ্যামেরিকান ফ্যামিলি লাইফের এক অদ্ভুত সুন্দর সৃষ্টি। ডেলিকেট স্টোরিটেলিং এই সিনেমা’র মূল উপজীব্য। একজন প্যারানয়ায় আক্রান্ত ফাইটার যে রিংয়ের ভেতরে এবং বাইরে কোথাও ধরে রাখতে পারে না নিজের রাগ তার ট্র্যান্সফরমেশন মূলত সিনেমার মূল গল্প। ‘দ্য ডিপার্টেড’ সিনেমাতে দেখা যায় ইভিল বনাম ইভিল ফাইট। দুটো আলাদা দলের মধ্যে আনএথিক্যাল কনফ্লিক্ট অডিয়েন্স হিসেবে আপনাকে ডিলেমায় ফেলে দেবে। ‘শাটার আইল্যান্ড’ ব্যক্তিগতভাবে আমার অসম্ভব পছন্দের সিনেমা। এই সিনেমায় যে ফিলোসফি নিয়ে ডিল করেছেন মার্টিন সেটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী কাজ। সিনেমার শেষেও দর্শক হিসেবে আপনি এমন এক কনফিউশনে আটকে থাকবেন যে সমাধানের জন্য এই সিনেমার কাছে আপনার ফিরে আসতে হবে বারবার। সেট, প্রফ সবকিছু মিলিয়ে এই সিনেমায় মার্টিন নিজের জায়গা থেকে সরে গিয়ে বরং এক নোলানীয় ফিল দেবে আপনাকে।
সাত.
অ্যাকাডেমি পুরস্কার থেকে শুরু করে এক জীবনে জিতেছেন অসংখ্য পুরস্কার। তবে, এসব অর্জনের বাইরেও মার্টিন স্কোরসেজি’র সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়তো একটা লিগ্যাসি তৈরি করা। সুপারহিরো আর সায়েন্স ফিকশনের এই যুগে ভি এফ এক্সের বদৌলতে যখন থিয়েটার কাঁপতে থাকে থরথর করে এবং সিনেমা আসার সঙ্গে-সঙ্গে জম্বির মতো মানুষ লাইন ধরে টিকেট কাটে তখন মার্টিন স্কোরসেজির মতো ন্যারেটিভ রিয়েলিজম নিয়ে সিনেমা বানানোর মতো ডিরেক্টর নতুন সিনেমা নির্মাতা কিংবা অফট্র্যাকের দর্শকদের জন্য একটা আশীর্বাদ বটে। তার সিনেমা দেখতে দেখতে আপনি বুঝতে পারবেন, রিয়েলিটি কতটা নির্মম হতে পারে আর মার্টিন স্কোরসেজি নিজেই তো বলেছেন, ‘সহজ বলতে জগতে কিছু নেই। সহজ খুব কঠিন জিনিস।’