এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে চাণক্য বাড়ৈর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘জলমানুষ’। গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কাচের মেয়ে’। চাণক্য বাড়ৈ মূলত কবি হিসেবে পরিচিত। তবে ‘কাচের মেয়ে’ উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দুটি বই-ই কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের কল্যাণে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্য বলছি এ কারণে যে, কবি চাণক্য বাড়ৈর দুটি উপন্যাসই চমৎকার গল্পের। এ ছাড়া বুনন আর কাহিনি বিন্যাসে অনন্য। কবির হাতে যখন উপন্যাসের কলম উঠেছে, তখন কাব্যময়তা তো রয়েছেই। পাশাপাশি ব্যতিক্রম কাহিনি উঠে এসেছে আমাদের সামনে।
এবারের জলমানুষও সে অর্থে আমার কাছে আলাদা ধাচের কিছু মনে হয়েছে। ‘জলমানুষ’ নামকরণেও লেখকের সার্থকতা রয়েছে। যে মানুষগুলো জলকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে, মরে যাচ্ছে; তারাই তো জলমানুষ। তবে পেশায় তারা বনদস্যু। তবে কি ‘বনমানুষ’ হলে ভালো লাগতো? নিশ্চয়ই নয়। লেখক হয়তো অনেক ভেবে-চিন্তেই নামটি বাছাই করেছেন। কারণ তারা সুন্দরবন অধ্যুষিত নদীপথে ডাকাতি বা রাহাজানি করে থাকেন। উপন্যাসে আমরা অনেকগুলো নদী দেখতে পাই। এখানে বয়ে চলে পশুর নদী, সোনাখালি নদী, পানগুছি নদী, ভোলা নদী, বেতমুড়ি নদী, বলেশ্বর নদী, মালঞ্চ নদী, মোংলা নদী ও পাঙ্গাশিয়া নদী প্রভৃতি। তাই তাদের জলদস্যুও বলা হয়ে থাকে। যেহেতু তাদের ক্রীয়াকলাপ আবর্তিত হয় নদীকে ঘিরে। এ জন্যই তারা ‘জলমানুষ’। সে হিসেবে নামকরণের সার্থকতা এখানেই।
জলমানুষ উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে এভাবে—‘ঘন অন্ধকার। কোনোদিকে জনমানুষের সাড়া নেই। কয়েকটি ভয়াল বন্যপ্রাণীর ডাক শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। দুয়েকটি বাদুড় উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। তাদের ডানা ঝাপটানির শব্দও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কোনোটি নদীর ওপার থেকে এপার আসছে। আবার এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে কোনো কোনো পাখি। কোনোটির পা অথবা ঠোঁট থেকে টুপটাপ করে খসে পড়ছে সুন্দরী, কাঠ বাদাম অথবা ছৈলার ফল। ফলগুলো বেশ ওপর থেকে নদীর জলের ওপর পড়ায় ‘টুব্বুৎ’ করে শব্দ হচ্ছে তার। দূর থেকে কোনো নিশাচর পাখির গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। তা শুনে গা ছমছম করে উঠছে তামজিদের। তবু সে চুপচাপ। কারণ এখানে কথা বলা নিষেধ। কোনো অবস্থাতেই মুখ খোলা যাবে না। যে কথা বলবে, তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। এটাই নিয়ম।’ মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম-প্রণয় আর করুণ পরিণতির কাহিনি এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের শেষ দিকে লেখক বলেছেন, ‘জীবনে কখনো কখনো এমন কিছু পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়াতে হয়, যখন সিদ্ধান্ত যত বড়, সময় নিতে হয় তত কম।’
অসংখ্য কিংবদন্তি রয়েছে এই ম্যানগ্রোভ বন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবিকে নিয়ে। কিংবদন্তি রয়েছে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক জলদস্যুদের নিয়েও। কিন্তু এর সবই কি কিংবদন্তি, না-কি বাস্তবতাও কিছু আছে?
‘জলমানুষ’ উপন্যাসের চরিত্র রুস্তম, খালেদ, তাহের, তামজিদ, তন্দুরী, আফসানা, নাবিল, ফুলমতি, মানিক, সুবল, নকাই, হাসিব, জয়নাল, গুলবদন বিবি, সানোয়ার মোল্লা, আব্দুল মমিন, জিনিয়া, আলতাফ, রশীদুদ্দীন পাটোয়ারী, আনিকা, স্টুয়ার্ট, নজু গুনিন, ফখরুল, রীনা বেগম ও আলোমতি—সবাই যেন স্ব স্ব অবস্থানে চমৎকার হয়ে উঠেছেন। কী চরিত্রে, কী সংলাপে, কী বর্ণনায়—একেকটি চরিত্র যেন পাঠক চোখ বন্ধ করলেই আলোকিত হয়ে ওঠে। পাঠকও যেন চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পান তাদের। চরিত্র ছাড়াও ভৌগলিক বর্ণনা, প্রকৃতি, পরিবেশ, অবস্থান ও প্রেক্ষাপট নির্মাণেও লেখক সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
উপন্যাসের স্থান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। রহস্যঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর এই নদী-জঙ্গলের মূর্তিমান আতঙ্ক রুস্তম বাহিনী। সরকার তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে বাহিনীর সর্দার এই প্রস্তাবে রাজি হয়। জটিলতার শুরু এখান থেকেই। কারণ জলদস্যুদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পণের বদলে বিদ্রোহ করে। এর সূত্র ধরে গহীন সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য ছোট ছোট দল। এক সময়ের রুস্তম বাহিনী থেকে জন্ম নেয় খালেদ বাহিনী, তাহের বাহিনী ও তামজিদ বাহিনী। বনে-জঙ্গলে লাগামছাড়া দস্যুবৃত্তি চালায় তারা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বনের স্বাভাবিক পরিবেশ।
পশুর নদীর তীরঘেঁষা বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লীর বাসিন্দা ফুলমতি। তার কাছে দস্যুসর্দার রুস্তমের নিয়মিত যাতায়াত। রুস্তমের ইচ্ছা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে ফুলমতিকে বিয়ে করে সংসার পাতবে। কিন্তু ফুলমতি জানে, এটা কখনো সত্য হওয়ার নয়। তাই সে বড় কিছু পাওয়ার লোভে বিদেশি বিলাস বহুল জাহাজের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের শয্যাশায়ী হন। দালালের মাধ্যমে পৌঁছে যান সেই বিশাল জাহাজে। বানিয়াশান্তার পতিতা জাহাজে গিয়ে রূপসজ্জা আর অন্তর্বাস পাল্টে হয়ে যান ম্যাগনোলিয়া। হয়তো ফুলমতিদের জীবনের পরিণতি হয়তো এভাবেই লেখা হয়েছে যুগ যুগ ধরে। জাহাজে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা লেখকের বর্ণনায় এমনভাবে উঠে এসেছে, মনে হবে লেখক সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে তাহের বাহিনীর তরুণতম সদস্য তামজিদ। রুস্তমকে খুন করে সে ‘বাঘা তামজিদ’ হয়ে যায়। বেশ কয়েকটি অপারেশনে সাহস আর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সর্দার তাহের আর অন্যদের নজরে আসে সে। কিন্তু দুর্ধর্ষ এক দস্যুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা তার বিরহী হৃদয় ধিকিধিকি পুড়তে থাকে দিন-রাত, অতি গোপনে। দূর গ্রামে তার পথ চেয়ে বসে থাকে প্রণয়িনী তন্দুরী। এদিকে তাহেরের স্ত্রী আফসানা একমাত্র সন্তান নাবিলকে হারিয়ে প্রমাদ গোনে। নিয়তির অমোঘ নিয়মে তার আশ্রয় হয় বানিয়াশান্তার নিষিদ্ধপল্লিতে। একসময় মৃত্যুই তাকে টেনে নেয় কোলে। ভুল বোঝাবুঝির সূত্র ধরে তাহেরকেও গুলি করে মারে তার বন্ধু খালেদ। এসব করুণ পরিণতির কাহিনি নিয়ে উপন্যাসের গল্পটি এগিয়ে যেতে থাকে শেষ অবধি।
ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সম্পর্কও বিনাশ হয়। স্বপ্নের ঘোরে গড়ে তোলা আশাও একদিন নিঃশেষ হয়। তাই তো তামজিদকেও একসময় হারিয়ে যেতে হয়। এসব গল্পে বা কাহিনিতে আসলে পরিণতি বলতে কিছু থাকে না। লেখক সব চরিত্রের পরিণতিই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে বিশ্বাস, ভালোবাসা, উচ্চাশা, ক্ষোভ, ক্ষমা-মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে।
উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়েছে, লেখকের আগ্রহের বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে প্রকৃতি। এর কারণ হতে পারে, তার বেড়ে ওঠা। লেখকের শৈশব-কৈশোর কেটেছে প্রকৃতির বিস্ময় সুন্দরবনের উপকণ্ঠে। সত্যিই প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই সুন্দরবন। অসংখ্য কিংবদন্তি রয়েছে এই ম্যানগ্রোভ বন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবিকে নিয়ে। কিংবদন্তি রয়েছে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক জলদস্যুদের নিয়েও। কিন্তু এর সবই কি কিংবদন্তি, না-কি বাস্তবতাও কিছু আছে? সে সবই উঠে এসেছে উপন্যাসে। কখনো মনে হবে কল্পকাহিনি। কখনো মনে হবে সত্যি।
এখানে ভারত থেকে চোরাই মাল আসে। আবার বনের কাঠ চোরাচালানের মাধ্যমেও পাচার হয়। সুন্দরবনকে ঘিরে অনেক পেশাজীবী মানুষের জীবিকা জড়িত রয়েছে। এখানে জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল, রেণু শিকারী, কাঁকড়া সংগ্রহকারী, সরকারের কর্মকর্তা, পতিতা, বিদেশি বণিক ও পর্যটকসহ সব ধরনের মানুষ রয়েছে।
সেই ভাবনা থেকেই হয়তো লেখক দৃষ্টি ফেরান সুন্দরবনের ইতিহাসের দিকে। হাতের কাছে যেসব বই পেয়েছেন, পড়েছেন। ইন্টারনেট ঘেঁটেও দেখেছেন। তা না হলে জলদস্যুদের এমন সুচারুরূপে ফুটিয়ে তোলা তার পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। তবে ইতিহাস বলছে, সেই কোম্পানি আমলেও সুন্দরবনের প্রধান সমস্যা ছিল জলদস্যু; বর্তমানেও আছে। এখনো পর্যটক, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী আর বনের প্রতিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এই জলদস্যুরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনকে জলসদ্যুমুক্ত ঘোষণা করলেও বিবিসিসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে উঠে এসেছে এর ভয়াবহ চিত্র। নদী আর জঙ্গলে এখনো সক্রিয় রয়েছে অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা।
কী কারণে একজন মানুষ জলদস্যুতার মতো অন্ধকার আর ঝুঁকিপূর্ণ জীবনকে বেছে নেয়? স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয় বনের প্রতিকূল পরিবেশে? এর দায় কি কেবলই তার? নাকি সমাজেরও কোনো দায় আছে? কারা এদের প্রতিপালন করে? প্রেম-সহমর্মিতা বলে কি কিছুই নেই এদের? সমাজ-সংসার ছেড়ে তারা কেন ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয় এমন গর্হিত অপরাধে। তারাও জানে, তারা অপরাধী। রাতের অন্ধকারে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে হয়। সারা জীবন পিঠে পুলিশের বন্দুকের নল ঠেকানো থাকে। কাঁধে থাকে হুলিয়া। তবে কি কেবল কৌতূহল? কৌতূহল মেটাতে গিয়েই তারা জড়িয়ে পড়ে বিশাল জালে?
তাদের তো সব মানবিক বৈশিষ্ট্যই আছে। মায়া-মমতা, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি, ভালোভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা সবই আছে। আমাদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ তারা। কেবল নেই আমাদের মতো স্বাভাবিক একটি জীবন। নিজের অজান্তেই কখন যেন সে জীবন তারা হারিয়ে ফেলেন! আর যখন ফিরে আসার বোধোদয় হয়; তখন জীবনটাই হারিয়ে যায়। তবে তারা যে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন, তা কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবই খুঁজে পাবেন ‘জলমানুষ’ উপন্যাসে। লেখক বলতে চেয়েছেন, একজন ভয়ঙ্কর জলদস্যুর আড়লেও লুকিয়ে আছে একজন প্রকৃত মানুষের রূপ।
চাণক্য বাড়ৈর উপন্যাসে সব বিষয়ই যেন চাক্ষুষ প্রমাণ। প্রেম, সম্পর্ক বা গোলাগুলি কিছুই যেন আরোপিত নয়। প্রয়োজনের তাগিদেই সংঘটিত হয়। তার যে চাক্ষুষ বর্ণনা, তা কেবল নিজ চোখে দেখলেই লেখা সম্ভব বলে মনে হয়। লেখকের বর্ণনায়—‘মমিন দেখলেন এ তো মহা বিপদ! ওরা কী চায়, আগে সেটা জানতে পারলে বেশি ভালো হতো। কারণ, একজন ফরেস্টার, একজন গার্ড, একজন ইঞ্জিন মাস্টার আর তিনজন মাঝিমাল্লা নিয়ে এদের সাথে এই রাতে কোনোভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে না। যদিও মমিনের কাছেই দুটো আগ্নেয়াস্ত্র আছে। কিন্তু মুশকিল হলো, ওরা গুলি ছুড়ছে ডাঙ্গা (স্থল) থেকে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। নদীতে বসে বন্দুক কেন, কামান মেরেও ওদের কাবু করা যাবে না। তবু মমিন আর আলতাফকে সঙ্গে নিয়ে তীর লক্ষ করে গুলি চালাতে শুরু করলেন।’
একটি বিষয় লক্ষণীয়, তার উপন্যাসে শুধু জলদস্যুই নয়; উঠে এসেছে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও। কেন ধীরে ধীরে বন উজাড় হচ্ছে, তাও তিনি কলমের খোঁচায় তুলে এনেছেন। বনের সম্পদ রক্ষা ও ভোগের নিয়ম-কানুনও উঠে আসে তার লেখায়। উপন্যাসসূত্রে জানা যায়, ‘বাদায় যারা মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরতে যায়, কাঠ বা গোলপাতা কাটার অনুমতি নিতে যায়, মধু আর মোম আহরণ করতে যায়, তাদের বন বিভাগ থেকে পাশ নিতে হয়। সব কিছুরই নির্দিষ্ট রেট আছে। তবে প্রায়ই এইসব প্রান্তিক মানুষকে বেশি রেট দিয়ে পাশ নিতে হয়। আবার অনেকে অবৈধভাবে অননুমোদিত গাছ কাটার জন্য বড় রকমের আনুতোষিকও দিয়ে থাকে।’ এখানে ভারত থেকে চোরাই মাল আসে। আবার বনের কাঠ চোরাচালানের মাধ্যমেও পাচার হয়। সুন্দরবনকে ঘিরে অনেক পেশাজীবী মানুষের জীবিকা জড়িত রয়েছে। এখানে জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল, রেণু শিকারী, কাঁকড়া সংগ্রহকারী, সরকারের কর্মকর্তা, পতিতা, বিদেশি বণিক ও পর্যটকসহ সব ধরনের মানুষ রয়েছে।
ভবিষ্যৎ রুস্তম-তামজিদ-ফুলমতিরা সতর্ক হয়ে উঠুক। জীবনই হোক বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। জলদস্যুদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠুক। আদৌ তা হবে কি না—তা কেবল ভবিষ্যৎই বলে দিতে পারে।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, এখানকার পেশাজীবীদের কাজই যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা। সে কথা লেখকই খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘কাজই যাদের মৃত্যুর সাথে খেলা করা, জীবন তাদের কাছে একেবারে তুচ্ছ বিষয়।’ আসলেও ঠিক তাই। জীবনকে তুচ্ছ জেনেই তারা এসব কাজ করতে আগ্রহী হয়। সে সরকারি কর্তা হোক বা জলদস্যুই হোক। স্থলভাগের বাইরে এ যেন ভিন্ন এক জগত। বিচ্ছিন্ন এক জীবনে সবাই ছুটছে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে। সবাই ছুটছে সুন্দর এক পৃথিবীর সন্ধানে। ছুটছে ভোরের আলো খুঁজে পেতে। বনের আঁধার পেরিয়ে দিগন্তের কিরণরেখায় নিজেকে খুঁজে পেতে তাদের নিরন্তর চেষ্টা।
এখানে ফুলমতি-পাপিয়ারা স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পেতে চায়। বানিয়াশান্তা পতিতালয়ে তাদের বহুরৈখিক জীবনকে তাদের ঘৃণা হয়। বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের মেম সাজতে হয়। জলদস্যুর কাছে কামিনী সাজতে হয়। শুধুই হাত বদল। শরীরের খেলা। পুরুষ বদল করেই কাটে জীবন। তবু তারা জীবনের পরিণতি খোঁজে। তন্দুরী-তামজিদের গোপন প্রণয়ও পরিণতি খোঁজে। পরিণতি খোঁজে দস্যু রুস্তমও। জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ করে। আবার গড়ে ওঠে দস্যুবাহিনী। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তবে কেন এই পরিণতির আকাঙ্ক্ষা? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতেই পড়তে পারেন ‘জলমানুষ’ উপন্যাসটি।
উপন্যাসে মুদ্রণজনিত কিছু ভুল চোখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সুনিপুণ সম্পাদনার অভাব বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। লেখক এবং প্রকাশক উভয়কেই এ বিষয়ে সুদৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। বানান সম্পর্কে সচেতন পাঠক এমন বিভ্রান্তিতে বিচলিত হন। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে বিষয়টি লক্ষ রাখবেন। তবে চাণক্য বাড়ৈ বরাবরই বিষয় নির্বাচনে মুন্সিয়ানা দেখান। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জীবনের ইতিবাচক-নেতিবাচক বিষয় তুলে এনেছেন ‘কাচের মেয়ে’ উপন্যাসে। এবার সুন্দরবনের ইতিবাচক-নেতিবাচক বিষয় তুলে এনেছেন ‘জলমানুষ’ উপন্যাসে। এ জন্য লেখককে মূলত অনুসন্ধানী হতে হয়। পাঠকের দৃষ্টির বাইরে গিয়ে তুলে আনতে হয় এমন কিছু, যা পাঠকের কাছে একেবারেই নতুন বিষয় মনে হবে। বর্তমানের লেখকদের বিষয়-বৈচিত্র্যের বড়ই অভাব। সে হিসেবে চাণক্য বাড়ৈ তার দুটি উপন্যাসেই একধাপ এগিয়ে রইলেন বলে মনে হচ্ছে।
ঔপন্যাসিককে এমন সাহসী পদক্ষেপের জন্য আবারও বিশেষ ধন্যবাদ। একটি ভয়ের অরণ্য বা জলাভূমিকে কেন্দ্র করে এমন একটি সত্যনির্ভর উপন্যাস উপহার দিয়ে পাঠককূলকে উপকৃত করেছেন। ভবিষ্যৎ রুস্তম-তামজিদ-ফুলমতিরা সতর্ক হয়ে উঠুক। জীবনই হোক বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। জলদস্যুদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠুক। আদৌ তা হবে কি না—তা কেবল ভবিষ্যৎই বলে দিতে পারে। চাণক্য বাড়ৈর ‘জলমানুষ’ প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের কদর্য রূপ তুলে ধরেছে। এখন পাঠকের সাড়া পেলেই লেখকের ঔপন্যাসিক অভিধা সার্থক হবে।
জলমানুষ
লেখক: চাণক্য বাড়ৈ
প্রকাশক: ভাষাচিত্র
প্রচ্ছদ: পার্থপ্রতিম দাস
মূল্য: ৩৩০ টাকা
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২০