বয়স তখন দুই দশক পেরিয়ে আরও দুই ছুঁই ছুঁই। সাধ্যের চেয়ে স্বপ্ন বিশাল বড়; সেই সঙ্গে আছে তারুণ্যের আস্ফালন, যতটা না বর্ষে, গর্জন তারচেয়ে অনেক বেশি। আর ওই বয়সটায় যা হয়, কাজের চেয়ে অপচয় অনেক বেশি। এটাই তো স্বাভাবিক। নতুন দাঁত উঠলে যদি মাংস ও ইটে, পাত্রে-অপাত্রে সমানভাবে কামড় না বসানো যায়, তবে আর দাঁত ওঠা কেন?
যাই হোক, খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে তখন ২০০৭ সাল। একদিন দুপুর বেলা এক মার্কেটে বসে আড্ডা দিচ্ছি। প্রতিদিন যেমন খাওয়া, নাওয়া ভুলে দেই। এক বড় ভাই কাম বন্ধু এলেন। তিনি তখন যুগান্তরের একটি পেজের কন্ট্রিবিউটর। এসে বললেন, সবাই প্রস্তুত থাকো। যুগান্তরের একটি বিশেষ ঘোষণা আসছে শিগগিরই ঈদ সংখ্যার জন্য।
আমরা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকালাম ঘটনা কী, পুরোটা শোনার জন্য। তিনি কথা বলেন সাসপেন্স লাগিয়ে লাগিয়ে। এতদিন পর তিনি কী বলেছিলেন হুবহু মনে নেই। তবে তার কথার মাজেজা হলো, এবার যুগান্তর ঈদ সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি একজন নবীন ঔপন্যাসিকের উপন্যাস ছাপা হবে। কিছু দিন পরই ঘোষণা আসছে। অতএব প্রস্তুত হও।
আমরা ছয়-সাতজন তো তখন খুশিতে আটখানা। এবার আমাদের দমিয়ে রাখে কে? তখন একেক জনের অবস্থা এমন হলো, আড্ডা ছেড়ে এখনই বাড়ি ফিরে একটি কালজয়ী উপন্যাস লিখে ফেলবো।
এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বেশ কয়েকজনকে বাধ্য করলাম পাঠাগার থেকে বইটি ইস্যু করে নিয়ে পড়ার জন্য। আমি পড়ার জন্য নিয়ে এলাম ‘কসবি।’ এ উপন্যাস তার লেখার প্রতি আমার ভক্তি ও ভালোবাসা আরও শতগুণে বাড়িয়ে তুললো।
যাই হোক, পরের দিনই দুই-এক জনের উৎসাহে ভাটা পড়লো। সেই ভাটার টান এসে পড়লো আমাদের ওপরও। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা কালজয়ী উপন্যাস লেখার কথা ভুলে গিয়ে আগের মতোই সাহিত্যের রাজা-উজির মারতে লাগলাম। তবে আমার মনে টিমটিম করে কৌতূহলের একটা শিখা জ্বলে রইলো। কে হবে সেই ভাগ্যবান তরুণ, যার লেখা এবার যুগান্তরে ঈদ সংখ্যায় ছাপা হবে?
অবস্থা এমন দাঁড়ালো আমার, না লিখেও মনে মনে হবু বিজয়ীকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মনে করতে লাগলাম, ঈর্ষা করতে লাগলাম। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ শিরোনামে যুগান্তরের এই হবু বিজয়ী ঔপন্যাসিক একটি উপন্যাস লিখবেন অনেক পরে তখন কি জানতাম?
তারপর একদিন কৌতূহল নিবৃত্ত করে যুগান্তরের ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হলো। নতুন লেখকের নাম হরিশংকর জলদাস। উপন্যাস ‘জলপুত্র’। লেখকের ছবি দেখে হতাশ হলাম। বয়সে তাকে কিছুতেই নবীন বলা যায় না। তাহলে? নিশ্চয় এটি দুর্নীতি। স্বজনপ্রীতি। উপন্যাস আর পড়ে দেখা হলো না।
এভাবেই হরিশংকর জলদাসের নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। লেখার সঙ্গে পরিচয় হতে সময় লেগেছিল আরও কয়েক বছর। হরিশংকর জলদাসের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। যুগান্তরে প্রকাশিত উপন্যাসটিই তার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। এরপরের বছরগুলোতে প্রকাশিত হতে লাগলো ‘দহনকাল’, ‘কসবি’, ‘রাম গোলাম’। হরিশংকর জলদাসের পরবর্তী বইগুলোও তাকে ব্যাপক আলোচনায় তুলে আনে। ‘দহনকাল’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পায়। ‘কসবি’ যৌনকর্মীদের নিয়ে লেখা উপন্যাস। প্রকাশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ পড়ে যায়।
হরিশংকর জলদাসের লেখা না পড়লেও তার ও তার লেখা সম্পর্কিত লেখা, আলোচনা, সমালোচনা পড়ে, শুনে আমি ধীরে ধীরে উৎসুক হয়ে উঠছিলাম তার প্রতি। ২০১২ সালে ‘রাম গোলাম’ বইটি সুধীজন পাঠাগার থেকে নিয়ে আসি পড়ার জন্য। নিতান্ত অবহেলায়। কিছুটা মনের কৌতূহল মেটানোর জন্য, এ লোকটা কী লেখে? কেমন লেখে? এত আলোচনা কেন তাকে নিয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই বইটি নিয়ে আসা। এছাড়া ওই বছর তিনি বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন উপন্যাসের জন্য।
যাইহোক বইটি পড়লাম। আমি চিন্তাও করতে পারিনি কী পরিমাণ চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! কী কারণে বইটি এত ভালো লেগেছিল, একটু পড়ে বলছি।
বইটি পড়ার পর আমি জলদাসের লেখার মোহে পড়ে গেলাম। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, যখন কোনো বই অসম্ভব ভালো লাগে, তখন সেটা আর দশজনকে না পড়ালে, ওই বইটি না কেনালে শান্তি পাই না। এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বেশ কয়েকজনকে বাধ্য করলাম পাঠাগার থেকে বইটি ইস্যু করে নিয়ে পড়ার জন্য। আমি পড়ার জন্য নিয়ে এলাম ‘কসবি।’ এ উপন্যাস তার লেখার প্রতি আমার ভক্তি ও ভালোবাসা আরও শতগুণে বাড়িয়ে তুললো।
তার উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর প্রধান কুশীলব সমাজের নিম্নশ্রেণীর, নিম্ন পেশার মানুষজন হলেও ‘মোহনা’ উপন্যাসের পাশাপাশি একই বছর তার আরেকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, নাম ‘হৃদয়নদী’। এখানে তিনি মধ্যবিত্ত মানুষের অনালোচিত উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন।
২০১২-তেই তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি সংকলিত বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘নিজের সাথে নিজের দেখা।’ সত্যি, এই বই পড়ে অন্য এক হরিশংকর জলদাসের সাক্ষাৎ পাই। মনে হয় এই জলদাস নিজেই কোনো উপন্যাসের চরিত্র। শূন্য থেকে যিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে করে পূর্ণ হয়েছেন। পুড়তে পুড়তে সোনা হওয়া যে প্রবাদটি আমাদের দেশে প্রচলিত, তা যেন তার জন্যেই প্রযোজ্য। মহৎ জীবন বলতে আমি তখন হরিশংকর জলদাসের জীবনকেই বুঝতে থাকি। সন্ধ্যায় জ্বালানো সলতের যেমন সারাদিনের ইতিহাস আছে, তেমনি হরিশংকর জলদাসও যে এসেই সবকিছু জয় করলেন তার পেছনে আছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সেই সংগ্রামের ইতিহাস কী? কেন তাকে পুড়ে পুড়ে হওয়া খাঁটি সোনা বলেছি, সেই ইতিহাস অনেকেই জানেন। তাই এখানে পুনরায় বয়ান করে লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। যদিও একান্ত কেউ জানতে আগ্রহী হন, তাহলে ‘নিজের সাথে নিজের দেখা’ সাক্ষাৎকারের বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অথবা চলতি বছর মানে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘নোনাজলে ডুবসাঁতার’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
যাই হোক, হরিশংকর জলদাসের সাক্ষাৎকার পড়ার পরে আমার আরেকটি নতুন কাজ দাঁড়ায়, এতদিন কোনো সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু পেলে জলদাসের লেখার গুণগান গাইতাম, এখন নতুন কাজ হলো জলদাসের জীবনগাথা বলে যাওয়া।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় হরিশংকর জলদাসের দুটো উপন্যাস। ‘মোহনা’ এবং ‘হৃদয়নদী’। এভাবে হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস প্রকাশিত হতে লাগলো আর আমি, আমরা তা সাগ্রহে পড়ে অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী উপন্যাসের।
এবার হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস সম্পর্কে দুই-একটি কথা বলি। জানি, তা দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। এরপরও একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে আমি সংক্ষেপে, আক্ষরিক অর্থেই সংক্ষেপে দুই-একটি কথা বলবো।
উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে হরিশংকর জলদাস যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তা হলো বিষয় নির্বাচন এবং বিষয় বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে। তার উপন্যাসের ক্যানভাসে বিচিত্র কর্মভারে সচল এই পৃথিবীর প্রকৃত কর্মবীর অর্থাৎ নিগৃহীত, নির্যাতিত, মানুষের কথা উঠে আসতে থাকে।
‘জলপুত্র’, ‘দহনকাল’ সাগরতীরবর্তী জেলেদের জীবনাখ্যান। বাংলা সাহিত্যে নদীতীরবর্তী জেলেদের নিয়ে বিখ্যাত উপন্যাস রচিত হলেও সাগরের জেলেদের নিয়ে তিনিই প্রথম উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘কসবি’ উপন্যাসে উঠে এসেছে যৌনকর্মীদের কথা, যারা অন্যের ভোগলিপ্সা মিটিয়ে সমাজের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে আছে। ‘রাম গোলাম’ উপন্যাস গড়ে উঠেছে মেথরদের নিয়ে। সৃষ্টিলগ্ন থেকে কিভাবে তাদের ঠকানো হয়েছে, তাই উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। ‘মোহনা’ উপন্যাস রচিত হয়েছে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। তবে এখানেও কেন্দ্রবিন্দু হলেন সমাজের নিম্নস্তরের লোকজন। কৈবর্ত বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। তার উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর প্রধান কুশীলব সমাজের নিম্নশ্রেণীর, নিম্ন পেশার মানুষজন হলেও ‘মোহনা’ উপন্যাসের পাশাপাশি একই বছর তার আরেকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, নাম ‘হৃদয়নদী’। এখানে তিনি মধ্যবিত্ত মানুষের অনালোচিত উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন।
ঔপন্যাসিকেরও একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, এক উপন্যাসের পর অন্য উপন্যাসে সেটাকে ছাপিয়ে যাওয়ার। এই যে ক্রমশ নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া বা আনন্দসৃষ্টির খেলায় মেতে থাকা, এ সাধনা জগতে কখনো ব্যর্থ হয় না।
এরপরের বছর তার যে উপন্যাস প্রকাশিত হয়, তাও ব্যাপক আলোচিত হয়। ‘আমি মৃণালিনী নই’ । রবীন্দ্রনাথ তার স্ত্রী ভবতারিণী দেবীর নাম পরিবর্তন করে যে তাকে স্বীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, সে বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এই উপন্যাস। ভবতারিণী দেবী যে প্রতিবাদ করতে পারেননি, স্বীয় অধিকার চাইতে পারেননি, হরিশংকর জলদাস যেন তাই করলেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্যজীবনের বেশ কিছু বিষয়ে তিনি নতুন করে আলো ফেলেছেন।
এভাবে তিনি একের পর এক উপন্যাসে নতুন বিষয় নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে এনেছেন ফলে পাঠকের কাছে তিনি একঘেয়ে হয়ে যাননি। দ্বিতীয়ত, বর্তমানের অধিকাংশ উপন্যাসে একটি সার্থক উপন্যাসের যে বিস্তৃতি থাকা প্রয়োজন, তা নেই। এটা পৃষ্ঠার সংখ্যায় ক্ষীণ কলেবর কিংবা বৃহদায়তনের লেখা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এছাড়া আমাদের বাজার কাটতি অনেক উপন্যাসই বড় গল্পের সমধর্মী। ডিটেলসের কাজ সেখানে নেই বললেই চলে।
হরিশংকর জলদাসের সব উপন্যাসকে সার্থক, কালোত্তীর্ণ উপন্যাস বলা না গেলেও একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের সব বৈশিষ্ট্যই কিন্তু তার লেখায় বিদ্যমান। সহজ কথায় হরিশংকরের সব উপন্যাস উপন্যাসই, উপন্যাসের নামে বড় গল্প নয়। তার উপন্যাসের ডিটেলসের কাজ, একের পর এক বোধের উন্মোচন পাঠককে বিমোহিত করে, আশ্চার্যন্বিত করে। তার উপন্যাস পরিণতির দিকে যেতে যেতে রিভার্স করে প্রধান চরিত্রের বা কাহিনির শেকড়ে বা উৎসে চলে যায় অর্থাৎ সাঙ্গীতিক নিয়মে ঔপন্যাসিক মুদারা থেকে তারায় যাওয়ার আগে পাঠককে উদারার সুরও শুনিয়ে আসেন। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস রচনার এই যে কাঠামো এবং দক্ষতা পাঠককে ভাসিয়ে নেন নতুন কোনো দিগন্তে।
তার উপন্যাস পাঠককে বহুদিন আচ্ছন্ন করে রাখবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ তার উপন্যাস না পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য, না শিক্ষাদানের জন্য। আনন্দদানই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। পাশাপাশি ঔপন্যাসিকেরও একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, এক উপন্যাসের পর অন্য উপন্যাসে সেটাকে ছাপিয়ে যাওয়ার। এই যে ক্রমশ নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া বা আনন্দসৃষ্টির খেলায় মেতে থাকা, এ সাধনা জগতে কখনো ব্যর্থ হয় না।