‘পেটে থাকলে পিঠে সয়’ বাংলা প্রবাদ। এক শ্রেণীর মানুষ লকডাউনের ভেতরও এই প্রবাদ হেঁকেই বের হয়ে আসছে ঘর থেকে। বাংলাদেশে করোনার দুই মাস পূর্ণ হলো শুক্রবার (৮ মে)। এই অদৃশ্য শত্রুটি সম্পর্কে কারও জানতে কমতি আছে বলে মনে হয় না। প্রতিদিন গণমাধ্যমে গুরুত্বসহ করোনার বিষয়ে খবর প্রকাশ হচ্ছে। সংবাদপত্রগুলোর প্রতি পাতায়ই ওই করোনার খবর। খেলা, বিনোদন, সম্পাদকীয়, মতামত, স্পেশাল, ডেইলি ইভেন্ট; সব খবরের সারকথা ওই করোনায় গিয়ে ঠেকে। টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, ব্যবসায়ী অনুষ্ঠান, খবর, টক-শো; সবখানেই প্রাধান্য পাচ্ছে ওই করোনা। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব তো আছেই। এরপর মানুষের মুখে মুখে। অন্ধ, বধির মানুষটিও বাকি থাকার কথা নয়।
করোনার ভয়াবহতা, ছড়িয়ে পড়ার কৌশল থেকে শুরু করে এ থেকে বাঁচার নিয়ম সবই এখন মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। হয়েছেও তাই। তবু থোরায় কেয়ার করে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসছে মানুষ। রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট, হাট-বাজার; সবখানেই সেই ভিড় শুরু হয়ে গেছে। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঈদ সামনে রেখে শর্তসাপেক্ষে হাটবাজার, ব্যবসাকেন্দ্র, দোকানপাট শপিংমল খুলবে। খুলবে ১০ তারিখ থেকে। কিন্তু খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ ছুটে বের হয়ে আসে ওইদিনই। মানুষ যেন এমন একটি ঘোষণারই অপেক্ষায় ছিল। ছিল অবশ্যই। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি যেখানে প্রতিদিন ভয়াবহ হচ্ছে এমন সময়ে? যেখানে ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে করোনাভাইরাস রোধের বড় পদক্ষেপ সাধারণ ছুটির সময়ও বাড়ানো হয়েছে। যে হারে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে তাতে সাধারণ ছুটি বাড়াতেই হবে। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য এ শত্রুটি।
ভয়াবহতা আমরা টের না পেলেও ভাইরাস কিন্তু থেমে নেই। ঘরে থাকার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়নি। বরং বেড়েছে বলা যায়। সেই সময়ে এমন সিদ্ধান্ত কেন; এই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো খুলেছে আগেই। পরে এসেছে মসজিদে নামাজ আদায়েরও ঘোষণা। বাকি আছে সরকারি অফিস, গণপরিবহন আর কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এসবও হয়তো খুলবে আস্তে আস্তে। আন্দোলনে নেমে পড়েছে পরিবহণ শ্রমিকরা। ঢাকার ভেতর ও আন্তঃজেলা বাস চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবিতে গত মঙ্গলবার ঢাকার গাবতলীসহ বিভিন্ন এলকায় মিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন তারা৷ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, ‘পরিবহণ শ্রমিকরা এখন বাধ্য হচ্ছেন মাঠে নামতে৷ আমাদের দেখার কেউ নেই৷ কেউ আমাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেনি৷ পেটে ভাত না থাকলে আমরা করোনা দিয়ে কী করব?’ তিনি বলেন, ‘ঈদ শপিং, দোকাপাট, গার্মেন্টস খুললে আমরা কী দোষ করলাম৷ আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালাবো৷ মাস্ক ব্যবহার করব৷ গাড়িতে স্যানিটাইজার রাখব৷ সামাজিক দূরত্বের জন্য যাত্রী কম নেবো৷ সারাদেশে বাস-মিনিবাসসহ যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক৷’ নৌযান শ্রমিকরাও একই দাবি তুলেছেন৷ অর্থাৎ ক্রমে সবই খুলে দেয়া হবে। জনমনে প্রশ্ন—কেন এমন সিদ্ধান্ত? মনের করিডোর বেয়ে এমন প্রশ্ন এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উঠোনে উঠোনে।
দুঃখের বিষয় এরপরও কোনো বিত্তশালীর এগিয়ে আসার খবর পাওয়া যায়নি। অথচ এটাই ছিল তাদের দায়িত্ব।
ফেসবুক ব্যবহার করেন এমন অধিকাংশ মানুষই এই মুহূর্তে শপিংমল খোলার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন না তারাও প্রশ্ন ছুড়ছেন নানাভাবে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষই সচেতন। ভাইরাসটির ভয়াবহতা টের পেয়েই এমন প্রশ্ন ছুড়ছেন। শপিংয়ের চেয়ে জীবন বড়; উপলব্ধিটা আমাদের মাঝে আছে। তার পরও খোলার পক্ষের সংখ্যা কম নয়। কেন? তাদের কি বাঁচার ইচ্ছে নেই? অবশ্যই আছে। তবে? উত্তর প্রথম কথায় রেখে এসেছি। ‘পেটে থাকলে পিঠে সয়।’ ভাইরাসটি উন্নত সব দেশেও হানা দিয়েছে। সেখানেও কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে। সেখানে তো মানুষ বের হচ্ছে না। কারণ সেখানে মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবারসহ জরুরি পণ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারপরও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আর আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা তো জানাই আছে। পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিশ্চয় বেশি বেশি পরীক্ষা করা গেলে শনাক্তের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তো।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এ পর্যন্ত রোগটিতে ২০৬ জন মারা গেছে। তাছাড়া প্রতিদিনই গণমাধ্যমের খবরে ঠান্ডা-জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়ার খবর পাচ্ছি। গণমাধ্যমের খবরের আড়ালে কি একেবারেই নেই? সে সংখ্যাও নিশ্চয় কম নয়। এসব সমীকরণ মোটেও সুখের বার্তা দেয় না। এসব বার্তা দেখার পর নিশ্চয় বাড়ি থেকে বের হতে ইচ্ছে করবে না। তবু মানুষ বের হচ্ছে। ওই পেটের চিন্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ অর্থনৈতিক জরিপ হয়েছিল ২০১৩ সালে। সেই জরিপ অনুযায়ী কৃষিবহির্ভূত খাতে দেশের মোট ৭৮ লাখ এন্টারপ্রাইজের মধ্যে প্রায় ৩৬ লাখ এন্টারপ্রাইজ হলো পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ কৃষিবহির্ভূত খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশই হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ৮৫ শতাংশ হলো অতিক্ষুদ্র, যাদের কর্মচারীর সংখ্যা ১০ জনের কম। দেশের কৃষিবহির্ভূত কর্মসংস্থানের ৩৫ শতাংশ হয় পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়ের ব্যবসায়। এই ব্যবসা-বাণিজ্যে ২০১৩ সালে নিযুক্ত ছিল প্রায় ৮৪ লাখ মানুষ। গত সাত বছরে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে বছরে প্রায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে। সে হিসাবে বর্তমানে প্রায় ৫৯ লাখ এন্টারপ্রাইজ আছে। আর ২০১৬-১৭ সালের শ্রম জরিপ অনুযায়ী পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় নিয়োজিত প্রায় ৮৭ লাখ মানুষ। আর এসব দোকানপাট-ব্যবসার পেছনে দেশীয় বহু ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন নির্ভর করে। একের সঙ্গে আরেকজন জড়িত। এভাবে চক্রাকারে সবার অবস্থাই করুণ।
প্রত্যেকেরই বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। বাড়ির মালিকেরও চাল-ডাল কিনতে হচ্ছে। উপার্জন বন্ধ হলেও সব খরচই চলমান; সবার। অনেক ক্ষেত্রে খরচ বেড়েছে। এদের ঘরে রাখতে হলে পেটে কিছু দিতে হবে। আর মধ্য আয়ের দিকে হেঁটে চলা একটি দেশের সরকারের একার পক্ষে এসব সম্ভব নয়। এজন্য বড় বড় শিল্পপতিদের এগিয়ে আসার দরকার ছিল। শুরু থেকেই সব মহলে এই আলোচনাটি এসেছে। কিন্তু শিল্পপতিদের কান পর্যন্ত তা পৌঁছায়নি। শেরপুরের এক ভিক্ষুক জমানো ১০ হাজার টাকা ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তার প্রশংসা করেছিলেন। তখনো শিল্পপতিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন সারা বিশ্বে এক মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এত বড় মানবিক গুণ আমাদের অনেক বিত্তশালীর মাঝেও দেখা যায় না। কিন্তু একজন নিঃস্ব মানুষ যার কাছে এ টাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এ টাকা দিয়ে আরও দুটো জামা কিনতে পারতেন, ঘরে খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি তার শেষ সম্বলটুকু দান করেছেন।’ দুঃখের বিষয় এরপরও কোনো বিত্তশালীর এগিয়ে আসার খবর পাওয়া যায়নি। অথচ এটাই ছিল তাদের দায়িত্ব।