প্রথমে একটা স্বস্তির খবর দেই।
মনটা চনমনে হোক। সোমবার একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশংসা জানিয়ে একটা বিশেষ লেখা প্রকাশ হয়েছে। ‘সংবাদকর্মীরাও প্রথম সারির সৈনিক’ শিরোনামের লেখাটিতে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিশ্ববিপর্যয়ের এই সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মতৎপড়তার প্রশংসা করা হয়েছে।
অনেক গণমাধ্যমকর্মী লেখাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। ক্যাপশনের চোখেমুখে আনন্দ চিক চিক করছিল। আমারও ইচ্ছে হয়েছিল শেয়ার করতে। লেখাটির জন্য লেখক শ্রদ্ধেয় আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার প্রশংসার দাবিদার। মন ভারি করা নানা সংবাদের মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য এতটুকু স্বীকৃতি অনেকখানি উৎসাহ জোগায়। হয়তো স্যারদের অতটুকু স্বীকৃতি, উৎসাহ আর প্রেরণার কারণেই আমরা এত-শত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছি। করতে পারছি।
এবার শুনুন আসল কথা। উৎসাহ যোগানো সংবাদটি প্রকাশ করেছে যে পত্রিকাটি সেই পত্রিকার সংবাদকর্মীরা বেতন পান না তিন মাস ধরে। কয়েকদিন আগে হঠাৎই এমন একটি মেসেজ এলো। ওই প্রত্রিকায় ডেস্কে কাজ করেন। জানালেন ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের বেতন হয় না। ‘আমাদের মালিকপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১০ কোটি টাকা দিয়েছে। সব ফোর্সেসকে খাবার ও সুরক্ষা সামগ্রী দিয়েছে। বিস্তর খরচ করে হাসপাতাল করছে। অথচ ব্যবসায় লসের কথা বলে সাংবাদিকদের বেতন দিচ্ছে না। আমরা এখনো ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনই পাইনি। নিজের ঘর অন্ধকার রেখে তারা মসজিদে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে।’ এমন মেসেজটি অনেকের ইনবক্সেই ঘুরেছে; পরে জেনেছি।
যখন তখন চাকরি যাওয়ার অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই কাটছে গণমাধ্যমকর্মীদের জীবন। করোনা একটি উপলক্ষ মাত্র।
এই করোনা সংকটের সময়ে যখন সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া, যখন অফিস করতে হয় বাড়তি ভাড়ায় রিকশায় চড়ে, যখন গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সুস্থতার কথা চিন্তা করে একটু ভালো খাবার খাওয়ার কথা; তখন মালিকপক্ষের এমন প্রহসন! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বের হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করছে যে সাংবাদিকরা দিন শেষে বাসায় ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। এই একটি-দুটি প্রতিষ্ঠান নয়, অসংখ্য প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের বেতন না দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যারা বেতন দিচ্ছে না হয়তো পরে দেবে। কিন্তু এই ক্রান্তিকালেও যারা সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করছে? যে সব সাংবাদিকরা চাকরি হারাচ্ছে, তাদের অবস্থা কী? সোমবার আরও একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে। ‘করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানেও সাংবাদিক ছাঁটাই’ শিরোনামের ওই সংবাদটিতে তুলে ধরা হয়েছে চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের দুরাবস্থার কথা। খবরটিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলাডটনেট থেকে এক ডজনেরও বেশি সাংবাদিককে ছাঁটাই করা হয়েছে এরইমধ্যে।
জাতীয় পার্টির নেতা ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন আহমেদের মালিকানাধীন এসএ টেলিভিশন থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত সাংবাদিক। এছাড়া, আলোকিত বাংলাদেশ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল আগামী নিউজেও ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক বাংলাদেশের খবর, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকাসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র ছাপা বন্ধ রেখে শুধু অনলাইন সংস্করণ চালু রেখেছে।’ তথ্যমন্ত্রী নিজেই সংবাদকর্মীদের ছাঁটাই না করার আহ্বান জানানোর পরও ছাঁটাই থেমে নেই। এগুলো প্রকাশিত খবর। এর বাইরেও অনেক গণমাধ্যমকর্মী মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই করোনা আসার আগেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান দিয়েছে অর্ধেক বেতন। অথচ এসব গণমাধ্যম সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা পূর্ণই পাচ্ছে। গণমাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্র ও সরকার থেকে সুবিধে নিচ্ছে যে সংবাদকর্মীদের কাজের ওপর ভর করে তাদের প্রতিই এমন নিষ্ঠুর আচরণ!
গণমাধ্যমের এমন সংকট নতুন নয়। খুব কম মালিকপক্ষই সংবাদকর্মীদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে থাকে। নিশ্চয়তা নেই মোটেও। প্রাপ্ত সুবিধাদি তো অনেক পরের কথা। যখন তখন চাকরি যাওয়ার অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই কাটছে গণমাধ্যমকর্মীদের জীবন। করোনা একটি উপলক্ষ মাত্র।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক