এক.
উস্তাদ, ব্রেক! সেই মাল একটা উইঠা পড়ছে গাড়িতে। কথা শেষ হতে না হতেই ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষে। যাত্রীরা একটু ঝুঁকে সামলে নিলো নিজেদের। দুই-একজন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনের সিটে ধাক্কা খেলো। ড্রাইভারকে ধমকে উঠলো কেউ কেউ। তবে নিজেদের সমস্যার কথা ভুলে সবার উৎসুক দৃষ্টি এখন বাসের শেষ দুই সিটের আগের একটি সিটে। কন্ডাক্টর হাত ধরে টানাটানি করছে নামানোর জন্য। জিদ ধরে বসে আছে সে। বোঝা যাচ্ছে গায়ে প্রচণ্ড শক্তি তার। কন্ডাকটরের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়েছে সে, ক্যান? আমি কি তোমারে ভাড়া দিমু না?
এবার খেঁকিয়ে উঠলো কন্ডাকটর—তুই থাকলে আমার যাত্রী উঠবো না, কয়টাকা ভাড়া দিবি তুই? নাইমা কথা ক আগে!
ড্রাইভার অস্থির ভঙ্গিতে সিট ছেড়ে উঠে আসে। দুই জন মিলে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে দিলো বাস থেকে।
বাস ছাড়তে ছাড়তে ড্রাইভার ভ্রূ কুঁচকে সেখানে রাজ্যের বিরক্তি এনে বলে, এইসব ঝামেলাগু কোনদিক দিয় উডে? যদি দেখবার টাইম না পাস, চাকরি ছাইড়া দে, অন্য লোক দেইহা লই।
আনন্দের বন্যায় ভাসলো পরিবার, আত্মীয় স্বজনসহ এলাকার সব মানুষ।
বাসের সামনের সিটে বসা ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা মনে মনে ভাবলেন, এরাও তো মানুষ, এভাবে পথের মাঝে নামিয়ে দেওয়া ঠিক হলো না। একবারের জন্য ভাবলেন শুধু এরপর বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার পাশের হলুদরঙা গম ক্ষেতের সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন।
দুই-তিনজন উঠতি বয়সের ছেলে কন্ডাকটরের পিঠ চাপড়ে বললো, মামা, নামাইলা কেন? সেই ছিল কিন্ত মালডা। ফ্রিতে এন্টারটেইনমেন্ট পেতাম। কথাগুলো বলে একজন আরেকজনের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
দুই-তিনজন লোক খুব বিরক্ত হয়ে ঘড়ি দেখছিলো। কী সব উটকো ঝামেলায় পড়ে অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে আজ—বলে উঠলো ডানপাশের শেষ কোনায় বসা এক ভদ্রলোক। বাকিরা একেবারেই ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে রইলো সামনে। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি, অথবা পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। গাড়িটি চললো বিজয়ীর বেশে। শুধু অচেনা পথের মাঝে রেখে গেলো তাকে। হলুদরঙা গমক্ষেতে টিয়া পাখিদের ব্যস্ততা ভবিষ্যৎ সঞ্চয় জমাতে। সেদিকে তাকিয়ে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, তারই কেবল কোনো ব্যস্ততা নেই ভবিষ্যৎ নিয়ে। বর্তমান যেখানে উপেক্ষিত, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা সেখানে হাস্যকর।
দুই.
মোড়ল বাড়ির চেহারা বদলে গেলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ঘরের মেঝেতে দামি দামি কার্পেট পাতা হলো। দোতলার ঘরগুলোয় পুরনো পর্দার জায়গায় নতুন সিল্কের পর্দা জায়গা করে নিলো। উঠোনজুড়ে আল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো একদল মেয়ে। সদর থেকে দামি চকচকে সোফা এলো ট্রাক বোঝাই করে। ঝাড়বাতি আসতে দেরি করছে বলে বাড়ির কর্তা রেগে গিয়ে ধমকে উঠলো পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারীকে। পালাগানের আয়োজন করা হয়েছে বাগানের এক কোনে। স্টেজ সাজাতে ব্যস্ত কিছু লোক। নানারকম সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে এলাকার লোকদের ক্ষুধা বেড়ে গেলো। আজ এলাকার সবার নেমন্তন্ন মোড়ল বাড়িতে। তিন মেয়ের পর একমাত্র ছেলে এসেছে তাদের সংসারে। তার নাম রাখার অনুষ্ঠান আজ। গ্রামের সবাইকে পেট ভরে খাইয়ে একমাত্র ছেলের জন্য দোয়া চাইবেন ইব্রাহীম মোড়ল। তাই দুই হাতে খরচ করতে একটুও কার্পণ্য করছেন না তিনি।
সেদিন অনেক ভেবেচিন্তে বিজ্ঞজনের আলোচনার সাপেক্ষে নাম রাখা হলো ছেলের আলাউদ্দিন। আনন্দের বন্যায় ভাসলো পরিবার, আত্মীয় স্বজনসহ এলাকার সব মানুষ।
তিন.
ভালোবাসার ফুলগুলো শুকিয়ে যায় দিনে দিনে। সেখানে জন্ম নেয় ঘৃণা নামক অসংখ্য ফল। ঘৃণা বাড়তে বাড়তে একদিন একটা বটগাছ হয়ে যায়। সেখানে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে ঘৃণা, অবহেলা, অপমান, বিরক্তি, বিদ্রূপ। ভালোবাসার কোনো নতুন কুঁড়ি সেখানে গজায় না। শুধু বটগাছের কোঠরে গুমরে মরে মা নামক মায়বী বৃক্ষের হাহাকার। প্রকাশ করার ক্ষমতা যে নেই তার। তবু একদিন কোথা থেকে যেন সাহস সঞ্চয় করে এনে চিৎকার করে—তোমাদের তো জ্বলে না, জ্বলে তো আমার। আমি যে পেটে ধরেছি!
ঘৃণা বটগাছের সবচেয়ে বুড়ো পাতা শরীর বেঁকিয়ে বলে ওঠে—নুন খাওয়াইয়া মাইরা ফালাইতাম যদি একবার টের পাইতাম যে এইডা বেডাও না, মাগীও না। ওইডারে বাড়িতে রাখলে নামাজ কালাম অইবো না। ওরে বাইর কইরা দাও।
গান-বাজনা ওই বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নিলো। গানের জায়গায় স্হান পেলো চিৎকার, চেঁচামেচি আর মধ্যরাত পর্যন্ত চাপা কান্নার শব্দ।
আড়াল থেকে সবার কথা শুনে ডাগর দুটি চোখে অশ্রু জমে। বুক কেঁপে কেঁপে অভিমান ঝরে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারে না তার কোন অপরাধের জন্য ভালোবাসার পৃথিবীটা ঘৃণার বিষবৃক্ষে পরিণত হলো। অন্ধকার আর হতাশা তার জীবনকে গিলে নিলো পুরোপুরি। তার ভুলটা কেউ বলে না—শুধু বুঝিয়ে দেয়, কোনো জায়গা নেই এ সমাজে তার। অযাচিত সে। অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলো আলাউদ্দিন, তাকে সবাই তুই করে বলে। নতুন কারও সঙ্গে দেখা হলেও তাকে তুই সম্বোধন করে সবাই। তুমি বা আপনি শুনতে কেমন লাগে, তা হয়তো কোনোদিনই জানা হবে না তার। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কোনো দুঃস্বপ্ন! ঘুম ভেঙে গেলেই বাবা আগের মতো আদর করে বুকে টেনে নেবে। বোনরা সঙ্গে করে ঘুরতে যাবে, মাথায় বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। পরিবারের চোখের মণি হয়ে উঠবে আবার সে। কিন্তু এ দুঃস্বপ্ন ভাঙার নয়। চলবে জীবনব্যাপী। মা যখন অনেক কষ্টে বলে, তুই আমার জীবনের অভিশাপ, তখন অনেকভাবে বোঝার চেষ্টা করে কিসের অভিশাপ সে, কিন্তু কোনো তল খুঁজে পায় না।
মেজ বোন একদিন কলেজ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে ইচ্ছেমতো পেটালো ওকে—হাঁটার সময় যদি একটুও কোমর নড়ছে তোর, তাইলে তোরে জানে মাইরা ফালাইবো। সোজা ছেলেদের মতো হাঁটবি।
বন্ধুরা ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে, একদম সহ্য করতে পারেনা সুনয়না। বেলকনির পিলারের সঙ্গে বেঁধে পেটালো ওকে। তবু কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না আলাউদ্দিনের মধ্যে।
বাবা দুই দিন খাবার বন্ধ করে রাখলো আলাউদ্দিনের। যে করেই হোক ছেলেকে ঠিক পথে আনতে হবে। এলাকা দিয়ে মুখ লুকিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। আগে লোকজন পেছনে কানাঘুষা করতো। আর এখন তো মুখের ওপর বলতে শুরু করেছে। এইতো সেদিন কয়েকজন রাস্তার মোড়ে বলেই ফেললো—তোমাগো মাইগ্যাডার কী খবর মিয়াভাই?
ধীরে ধীরে মোড়ল বাড়ির পর্দায় ধুলো জমলো। আল্পনার রঙ ফিকে হয়ে শ্যাওলা জমলো সেখানে। গান-বাজনা ওই বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নিলো। গানের জায়গায় স্হান পেলো চিৎকার, চেঁচামেচি আর মধ্যরাত পর্যন্ত চাপা কান্নার শব্দ।
চার.
সেদিনের ঘটনার পর মোড়ল বাড়ির পাঠ চুকলো তার। আশ্রয়টুকুও হারাতে হলো। পথের মাঝে ঠিকানা তৈরি হলো।
শুক্রবার ছিল সেদিন। বড়বোনের বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। ছেলে আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। ছেলের বাড়ি থেকে আংটি পরাতে এসেছিল কয়েকজন আত্মীয়স্বজন। আলাউদ্দিন কী ভেবে বড় বোনের নতুন ওড়না দেখেই গায়ে জড়িয়ে নাচতে শুরু করলো মনের আনন্দে। ছেলের মা আলাউদ্দিনকে দেখে চিৎকার করে ওঠে। এরপর চেঁচামেচি, কান্নাকাটি শুরু হলো। একপর্যায়ে বিয়ে ভেঙে গেলো বোনের।
মাছ বাজার, সবজি বাজারের সব কালেকশনের দায়িত্ব এখন আলেয়ার।
আলাউদ্দিনের শাস্তির মাত্রা ঠিক করলো ওর দাদি। টয়লেটে তিনদিন আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একথালা ভাতের বিনিময়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে রাজি হয়ে গেলো আলাউদ্দিন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই মায়ের জন্য বুকটা কেমন করে উঠলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে একথালা ভাত মায়ের মুখের চেয়েও আপন মনে হলো।
পাঁচ.
গুরু মা আলেয়াকে সমীহ করে চলে। এই কমিউনিটি চালান তিনি প্রায় ৩০ বছর। নিজের হাতে ট্রেনিং দিয়েছে হাজার হাজার হিজড়াকে। কিন্তু এই আলেয়ার মতো এমন ব্যক্তিত্ব কারও মধ্যেই পাননি তিনি। আলেয়া প্রায় ১৫ বছর এই কমিনিউটি তে আছে। মাত্র একবারের জন্যই ওকে কাঁদতে দেখেছে গুরু মা ওকে। একবারের জন্যই ওর মুখে শুনেছিল ওর পরিবারের নাম।
মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে ছুটে গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি। কিন্তু মায়ের মুখটা পর্যন্ত ওকে দেখতে দেয়নি, যেতে দেয়নি কবরের কাছে। পালাক্রমে কবরের কাছে পাহারা বসিয়েছিল বোন জামাইরা। পাপকে কিছুতেই কবরের কাছে যেতে দিতে চায়নি তারা। অবশেষে লোক দিয়ে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিল ওকে।
মাছ বাজার, সবজি বাজারের সব কালেকশনের দায়িত্ব এখন আলেয়ার। নিজের মৃত্যুর পর এই কমিউনিটির দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করতে পারবে আলেয়া, এটা বুঝতে পেরে গুরু মা নিশ্চিন্ত! আলাউদ্দিনের আলেয়া হওয়ার গল্পটা গুরুমা না শুনলেও বুঝে নেয় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার দামে।
নতুন একদল কে ট্রেনিং করাচ্ছে আলেয়া। পাশের ঘর থেকে আলেয়ার কণ্ঠ ভেসে আসছে:
আয়রে আনন্দের বাচ্চা পালনা ঢোলে
আয়রে গোপাল আমার খেলেনা খেলে
নীল মনিগো আমার, কাজল ভ্রমরা আমার
বার বার কোলের বাচ্চা কান্দাইও না
নামও না জানি, তোমার নামও না জানি…