জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা
আমার এক জীবনবাবু ছিলেন
ছল করে তাঁকে পেতে হয়েছিল
শিল্পকলার ভ্রাম্যমাণ চিত্র
প্রদর্শনীর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে
প্রাপ্ত পুরস্কারে তিনি অবস্থান করছিলেন
তাঁর অবস্থান কয়েক ধাপ
নিচে হওয়ায় আমাকে কৌশল
অবলম্বন করতে হল, ইসকুলের
বই’য়ে তাঁকে পাঠে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না
পূর্ণ জীবন আরোহণ করতেই হবে
ভেবে সবার অগোচরে নিচের ধাপ
থেকে মুক্ত করি, জীবনবাবুর অবস্থান
প্রথম হলে আমার প্রাপ্তি সহজলভ্য হয়
স্বেচ্ছাসেবকের প্রথমদিকে নিজ
নাম লিপিবদ্ধ হওয়ায় জীবনবাবু
নাগালে আসেন, অবশ্য আমার কৌশল
আমাকে জীবনে পৌঁছে দিয়েছিল
জীবনবাবুর ওপরের ধাপে সেদিন
যারা ছিলেন তারা ইতোমধ্যে গত হয়েছেন
তাদের এখন কেউ স্মরণ করে না
জীবনবাবু প্রবলভাবে প্রকট হয়েছেন
তাঁর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হয়েছে
আমি জীবনে মাস্ত হয়েছি, ফিদা হয়েছি
জীবনবাবুও তাঁর জীবনে ফিদা হয়েছেন
বসন্তের জন্য এলিজি
শীত ঘুমিয়ে আছে
তুষার আবৃত শীত
কাঁথা গায়ে ঘুমিয়ে আছে
তার বোজা চোখ দেখে মনে হচ্ছে
আরামের ঘুম, সহজে জাগবে না
শীত প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে, শোয়ে থাকতেই
তার আনন্দ, ঘুমাবলি
জপে জপে কাটিয়ে দিতে পারে
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী
ঘুমিয়ে থাকলে শীতকে ডাকা যাবে না
ডাকলে রাগ করে
শীতের রাগ ভয়ঙ্কর হয়, এই ভয়ে কেউ
জাগাতে সাহস করে না
শীত যদি খুব তাড়াতাড়ি না জাগে,
মুশকিল হয়ে যাবে
দরজার বাইরে বসন্ত
তার ঘুমানোর সময়
শীতের পরে তার ঘুমানোর পালা
সে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে
এমনিতেই তার ঘুম পাতলা, বেশিক্ষণ
ঘুমাতে পারে না, ঘুমের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে
তবু অধীর হচ্ছে না, শীতকে বিশ্রামের সময় দিচ্ছে
শীত নির্বিকার জাগানোর কোনো তাড়া নেই
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বসন্তের আর
ঘুমানো হবে না, শীতের ঘুম
বসন্ত ছাড়িয়ে যাবে
বসন্ত নিতান্ত ভদ্রলোক
ঝগড়া ঝাটিতে নেই
ঘুমকাতুরে শীতের বিপরীতে
হামলে পড়বে এমন অসভ্য নয়
বরং শীতের ঘুম যদি প্রলম্বিত হয়
সে আড়ালে চলে যাবে, নিজের অধিকার টুকু
গ্রীষ্মের হাতে সমর্পণ করে আড়াল হয়ে যাবে
গ্রীষ্ম শীতের মত তত ভদ্রলোক নয়
নিজের অধিকার বুঝে
শীতের জোরজবরদস্তি মানতে রাজি নয়
সে চলে এলে শীতকে জাগতে হয়
কাঁথা-বালিশ গুটিয়ে অন্য কোথাও
আশ্রয় খুঁজতে হয়, বসন্তের জন্য
আমাদের আফসোস থাকে
কিন্তু অতি ভদ্র হলে যা হয়
নিজের পাওনা টুকুও
অন্যে কব্জা করে নেয়
বসন্ত কে বুঝতে হবে ভালোমানুষির জামানা
গত হয়েছে, এখন পাওনা আদায়ের সময়
ভালোবাসায় চিড়ে ভেজে না
ভিজানোর জন্য পানির বন্দোবস্ত করতে হয়
আমরা বসন্তের জন্য হাপিত্যেশ করি
তার দেখা প্রায় পাওয়া যায় না
শীত গ্রীষ্মের চাপে অস্তিত্ব নির্মূলের পথে
বসন্তকে কড়া হতে হবে
মেয়েলিপনা স্থগিত রেখে
রুক্ষ পুরুষের মতো
অস্তিত্ব জানান দিতে হবে
তার রুক্ষতা সইতে রাজী
তার তাণ্ডব দেখতে রাজী
আমরা চাই বসন্ত নিজেকে জানান দিক
ভারসাম্যের জন্য তাকে বড় প্রয়োজন
পথ পথিক
আমি একবার দূরত্বে
হেঁটে এসেছিলাম
সে এক দিকশূন্যপুর
পথ হারিয়ে দিশেহারা
যখন নিজেকে পথের
অনুপযুক্ত ভাবতে শুরু
করেছি তখন ফিরতি
পদছাপ নিজ
সাকিনে ফিরতে সাহায্য
করেছিল, অনেক কষ্টে
ফিরে ভেবেছিলাম পথ
আমার নয়, পথিকের…
জীবনে কখনো উঠান
পেরুতে পারিনি, দিগ্বিজয়
করার স্বপ্ন দেখি
পথ অনেক দূরে
ধরাছোঁয়ার বাইরে…
ঘর-বারান্দা এইটুকই
আমার জগৎ
এর বেশি সক্ষমতা নেই
পথ আমাকে ডাকে
তবু পথিকের অধিকার দেয় না