এখন আমরা সবাই হেমন্তকে বলি ‘ঋতুকন্যা’। এই হেমন্তের নাম ‘ঋতুকন্যা’ কে দিয়েছেন? নিশ্চয়ই জীবনানন্দ দাশ। এর আগে হেমন্তকে ঠিক এমনভাবে উপস্থাপন কেউ করেননি। হেমন্তকে ভালোবাসার মতো আগলে রেখেছেন তিনি। সেই সূত্র ধরেই এ ঋতুকে বলি ‘যৌবনের কাল’। আধুনিক কবিরাও তা-ই বলেছেন। কারণ হেমন্তজুড়েই যেন সৃষ্টিসুখের উল্লাস। তবে বৈষ্ণব পদকর্তা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে হেমন্ত তার গৌরবে উপনীত হতে শুরু করেছে।
কেন এই হেমন্তকে নিয়ে এত হৈ-চৈ? কারণ তো অবশ্যই আছে। যেহেতু প্রকৃতির নিয়মেই হেমন্ত নিয়ে আসে হিম হিম মৃদু কুয়াশা। চারিদিকে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ। সঙ্গে শীতের আগমনী বার্তা। কৃষিনির্ভর জনজীবনে হেমন্ত সৃষ্টির আনন্দ-উল্লাসের কবিতার মতো। অভাব-অনটন শেষে সমৃদ্ধির সোনালি উদ্ভাস। আবহমানকাল থেকেই হেমন্ত মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি। ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। চলতে থাকে নবান্নের পিঠা-পায়েসের আয়োজন। সেসব উৎসবে ধ্বনিত হয় কবির আত্মোপলব্ধি।
হেমন্ত নিয়ে জীবনানন্দ দাশ অনেক কবিতা লিখেছেন। হেমন্তের প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ মধুর উপমায় তুলে ধরেছেন। তার বেশকিছু কবিতায় কোনো না কোনোভাবে হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে। তার কবিতার উপমা, রূপক, উৎপেক্ষা ও অলঙ্কারে হেমন্ত অনবদ্যভাবে বাংলা কাব্যে উপস্থিত হয়েছে। অনেকটা চুপিসারে, নিঃশব্দে কবির মনে, হৃদয়ে, মগজে হেমন্তের ছায়া এসে উপস্থিত হয়েছে। কবিহৃদয়ে হেমন্তের উদাসীন প্রকৃতি স্নিগ্ধ মধুর উপমায় মমতাময়ী নারীর সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় উপস্থাপিত হয়েছে।
ঋতুচক্রের আবাহন আধুনিক কবি জীবনানন্দকেও নাড়া দিয়েছে। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য নাড়া দিয়েছে প্রকৃতির কবি, নিসর্গের কবি, রূপসী বাংলার কবিকে। আমার মনে হয়, অন্য কোনো কবির কাব্যে হেমন্ত এলেও জীবনানন্দের মতো কেউ আবেগতাড়িত করতে পারেনি আমাদের। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতায় হেমন্ত এলেও তার কবিতায় হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে ভিন্ন আবহে এবং আদলে। কারণ হেমন্ত আপামর খেটে খাওয়া মানুষের সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতি ও আবেগকে কাব্যিক স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি ষোলোআনা ‘হেমন্তপ্রেমী’ কবি। তার কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্ন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
তার প্রতিটি কবিতায় রূপায়িত হয়েছে হেমন্তের অপরূপ বৈশিষ্ট্য—শিশিরের শব্দ, শিশিরের জল, শিশিরের ঘ্রাণ, ধূসর কুয়াশা, মেটে জোছনা, মাঠ পাড়ের গল্প, বিষণ্নতার ঋতু।
জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি নরেশ গুহ লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটায় আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে, তবু ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য-পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত।… হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস-এরও প্রাণ ভুলিয়েছিলো। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জন্মান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তার উপকরণ হয়ে ছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যের, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।’
শস্যভরা ঋতুকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। কারণ কবি হেমন্তকে দেখেছেন প্রেমে-কামে, দেহে-দেহহীনতায়, সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে, বিরতিতে। ‘পিপাসার গান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—
এদেহ অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখপাখালির পালে
উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ
অঘ্রাণের মাঝরাতে।
কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় পুরো প্রকৃতি। কবির চোখে তাই হেমন্ত কী অসাধারণ—
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কবির প্রাণ ভরিয়েছিল। শিশির-কুয়াশা মিশ্রিত হেমন্ত ঋতু তাকে আকৃষ্ট করেছে। এই ক্ষণস্থায়ী ঋতুকে জীবনানন্দ নতুন করে অবলোকন করেছিলেন। কবি হৃদয়ের গোপন ভালোবাসার আর্তি এই হেমন্ত ঋতু। তাই কেবল জীবনানন্দের কাব্যেই হেমন্ত পেয়েছে শীর্ষস্থান। তার প্রতিটি কবিতায় রূপায়িত হয়েছে হেমন্তের অপরূপ বৈশিষ্ট্য—শিশিরের শব্দ, শিশিরের জল, শিশিরের ঘ্রাণ, ধূসর কুয়াশা, মেটে জোছনা, মাঠ পাড়ের গল্প, বিষণ্নতার ঋতু। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়—
অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু।
হেমন্ত বিষণ্নতার ঋতু, তারপরও হেমন্ত ধরিত্রীর অন্তরঙ্গ সহচরী। হেমন্ত ভরে তোলে গৃহভাণ্ডার। কবির চোখে হেমন্ত শষ্যের ঋতু, তৃপ্তির ঋতু। কবির ভাষায়—
হেমন্তের ধান ওঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।
এমনকি জীবনানন্দ ছাড়া আর কে উচ্চারণ করতে পারেন এমন কথা? তিনি বলেন—‘যখন ঝরিয়া-যাবো হেমন্তের ঝড়ে/ পথের পাতার মতো তুমিও তখন/ আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?’এমন কথা যেন জীবনানন্দকেই মানায়। ব্যক্তিজীবনে মোহহীন এক মানুষ বিষণ্নতা, রিক্ততা ছাড়া আর কী-ই বা পেয়েছেন।
ঝরাপাতার শব্দ ও হেমন্তের রং প্রাণিত করে কবিদের।
বাংলা কবিতার বিপুল ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা পঙ্ক্তিমালা পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, হেমন্তকে কবিতার ঋতু করে তুলেছেন একান্তভাবে জীবনানন্দ। তার কবিতায় ‘ধান কাটা’, ‘নবান্ন’, ‘ইঁদুর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষ্মীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘কার্তিকের নীল কুয়াশায়’, ‘গঙ্গাফড়িং’, ‘কাঁচপোকা’, ‘শ্যামা পোকা’, ‘বেত ফল’, ‘খঞ্জনা’, ‘মুথা ঘাস’, ‘হিজলের ছায়া’, ‘কলমীর ঘ্রাণ’ প্রভৃতি শব্দ ও শব্দবন্ধ হেমন্তের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরে যে, জীবনানন্দ পাঠ করলে যেন পুরো হেমন্তের চিত্রই ফুটে ওঠে। কবি হেমন্তকে স্বাগত জানান তার কাব্যসম্ভার সহযোগে।
শরতের মন্দমধুর হাওয়া, কাশের গুচ্ছ, সাদা জোছনার পালে ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত। তবে অনেকেই হেমন্তকে ‘রিক্ততার ঋতু’ বলে থাকেন। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস ঋতুকন্যার দুঃখঝরা দিন। কারণ হেমন্তের শুরু কার্তিক মাস ফসল তোলার পূর্ব মাস। যার কারণে কৃষকের ঘরে খানিকটা অভাব থাকে বৈকি? আর তাই এই কার্তিককে ‘মঙ্গার মাস’ বলেও অনেকে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু কার্তিকের শেষক্ষণে হরিৎ শস্যক্ষেত্র ধীরে ধীরে হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে। চাষির চোখের স্বপ্ন একেকটি ধানের গোছা পাকা ধানের ভারে যেন নুয়ে পড়ে। তখন প্রকৃতির শোভা অপরূপ সুন্দর দেখায়। কবি বলেন—
হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে:
কোথাও বা সৃষ্টির অন্ধকার রহস্যের সঙ্গে বিজড়িত করেছেন তাকে:
আজকে মানুষ আমি তবুও তো-সৃষ্টির হৃদয়ে
হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল।
অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। গ্রামের ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ। নতুন ধানের গন্ধে অন্যরকম আবহাওয়া বইতে থাকে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নবান্ন আর পিঠেপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।
ঋতুকন্যা হেমন্তে গ্রীষ্ম ও শরতের প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কঠিন সূর্য বনভূমি ও জলাধারে তাপ বিকিরণ প্রত্যাহার করে নেয়। মধুর বাতাস ও সবুজ বনানী ক্রমেই ভিন্ন রূপ ধারণ করে। যৌবনের জলতরঙ্গ নৃত্যময় হয়ে ওঠে হেমন্ত সমীরণে। হেমন্ত আসে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রকৃতি ঝরাপাতার গান শোনাতে থাকে। ফসলের মৃত্যু ঘোষিত হলেও প্রকৃতির গালিচায় বাদামি, লাল, সোনালি পাতার রাশি। ঝরাপাতার শব্দ ও হেমন্তের রং প্রাণিত করে কবিদের। শুষ্ক কঠিন প্রকৃতির পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি নিয়ে নিঃশব্দ চরণে হেমন্তের যেমন আগমন ঘটে তেমনি বাঙালির ঘরে ঘরে সোনার ফসল দান করে রিক্ততার মধ্য দিয়ে শিশিরের মত নিঃশব্দ চরণে বিদায়ও গ্রহণ করে এই ঋতু। জীবনানন্দের ভাষায়—
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই-নুয়ে আছে নদীর এ পাড়ে
বিয়োবার দেরী নাই- রূপ ঝড়ে পড়ে তার
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে।
হেমন্তের পরিণতি শীতের আগমনী গান। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বাংলার আরেক ঋতু শীতের দরজা খুলে দিয়ে আসে হেমন্তের বিদায়ের পালা। আর হেমন্তের দুঃখঝরা দিনে কেবলি মনে পড়ে জীবনানন্দকে। জীবনানন্দ হয়তো গভীরভাবে অবলোকন করেছেন হেমন্তকে। কবিমন যেহেতু সংবেদনশীল; সেহেতু অপরাপর কবিদেরও আগ্রহের কারণ হয়েছে হেমন্ত।
জীবনানন্দ দাশ ‘হেমন্ত’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবি বলেছেন—
বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে
মৃত্যু, বড়, গোল চাঁদ;
গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে।
অনন্য যোদ্ধার মত এসেছে সে কতবার
দিনের ওপারে সন্ধ্যা- ঋতুর ভিতরে প্লাবী হেমন্তকে
দৃষ্ট প্রত্যঙ্গের মত এই স্ফীত পৃথিবীতে
ছুরির ফলার মত টেনে নিয়ে।
এই হেমন্ত ঋতুকে, কার্তিক-অগ্রহায়ণকে তিনিই চেনালেন। কারণ এর আগে হেমন্তকে একটি ঋতু হিসেবে আমরা পুরোপুরি মেনে নেইনি। তবে কাগজে-কলমে হেমন্তকে আমরা চিনতাম সত্য, কিন্তু এমন শৈল্পিকভাবে কবি জীবনানন্দ দাশই আমাদের চিনিয়েছেন।
হেমন্ত টিকে থাকুক কবিতার চরণে চরণে। জীবনানন্দ বেঁচে থাকবেন পাঠকের অন্তরে অন্তরে।
কবি ও কথাশিল্পী আবিদ আনোয়ার বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বর্ষা ও শরৎ, কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় গ্রীষ্ম আর জীবনানন্দের রচনায় হেমন্ত ও শীত। বাংলা কবিতায় হেমন্তের কথা উঠলে সর্বাগ্রেই মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা। ফলে তিনিই দখল করে আছেন আমার এ লেখার বহুলাংশ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তাঁকে ‘হেমন্তের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করলেও অত্যুক্তি হবে না। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত প্রাণ পেয়েছে তার দ্বৈত সত্তা নিয়ে। জীবনানন্দ হেমন্ত ঋতুকে ব্যবহার করেছেন মূলত বিনষ্টি, ক্ষয়িষ্ণুতা ও মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে, আবার একই সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উৎসবের কাল হিসেবে। একদিকে ‘নবান্নের ঘ্রাণ’ আর অন্যদিকে শিশিরসিক্ত ‘নির্জন স্বাক্ষর’ বহন করে হেমন্ত ঋতু জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রিত হয়েছে এক দ্বান্দ্বিক দ্যোতনায়।’
আমরা একনজরে তাঁর কিছু কবিতা পড়ে নিতে পারি। তাহলেই এর সত্যতা আমাদের সামনে জ্বাজল্যমান হয়ে উঠবে। জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত এসেছে ঠিক এভাবে—
১.
‘চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ বুকে তার থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশ’; ‘হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এই ক্ষেতে ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে
এ-সবুজ দেশে
আরো একবার’২.
‘সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে।—বাসি পাতা ভূতের মতন উড়ে আসে
কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস—
যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন’; ‘যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায়
কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায়
ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় হাঁস’; ‘বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে প’ড়ে গেছি ঝরে।’৩.
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে ফেরে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’৪.
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি—বিকেলের এই রঙ—রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম—ঢালু মাঠ—বিবর্ণ বাদামি পাখি—হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে-ঘাসে—কুড়ুনির মুখে তাই নাই কোনো কথা,’৫.
‘যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হ’য়ে—আরো নীল—আরো নীল হ’য়ে
আমি যে দেখিতে চাই;—সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে ল’য়ে
কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে,
আমি যে দেখিতে চাই;— আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে,’৬.
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;’
এমন অসংখ্য কবিতায় আমরা হেমন্তকে খুঁজে পাই। তাই তো তাকে হেমন্তের কবি বলতেও দ্বিধা নেই। সামগ্রিক আলোচনায় যা মনে হয়, তাতে জীবনানন্দকে অগ্রগামী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ তার কবিতায় যতবার হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে, তাতে এ যাবতকালের সবার কবিতায়ও এতোবার হেমন্তের প্রসঙ্গ আসেনি। সে হিসাব না হয় তোলা রইলো। তবু কবিদের কবিতায় ভেসে উঠুক হেমন্তের প্রতিচ্ছবি। হেমন্ত টিকে থাকুক কবিতার চরণে চরণে। জীবনানন্দ বেঁচে থাকবেন পাঠকের অন্তরে অন্তরে।