[শহরে একটা বুদ্ধিজীবী সভা ডাকা হয়েছে। নানা পদের বুদ্ধিজীবী এসেছেন সেখানে। কেউ সরকার দলীয় নেতা, কেউ শিক্ষাবিদ, কেউ বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় চিন্তাবিদ, কেউ নারীবাদী প্রগতিশীল, কেউ সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রধান কর্তা। তো এতজন মিলে তারা রায় দেবেন এই শহরে কী কী পরিবর্তন আসা দরকার।]
ভাইসব, শান্ত হয়ে বসুন। আমরা চেয়েছিলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা শহর, যেখানে ডাস্টবিনের বাইরে ময়লা থাকবে না, আবর্জনা থাকবে না, ড্রেনভর্তি মশার ডিম থাকবে না। রাস্তাঘাট, ফুটপাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে।
কিন্তু আমরা কী পেয়েছি?
রাস্তাভরা ধুলো, ড্রেনভরা মশার ডিম, ফুটপাথ ভরা হকার, ডাস্টবিন উপচানো আবর্জনা।
আমরা কি এই শহর চেয়েছিলাম?
না, না।
না না, এটাই উন্নয়ন, উন্নয়নের স্বার্থ।
না, না। এটা বিরোধী দলের চক্রান্ত।
উন্নয়ন করতে রাস্তা কাটা লাগে।
সেসব রাস্তায় পানি জমে।
পানি কোনো সমস্যা না।
তাহলে সমস্যা কী?
পানিতে মশা জন্মে।
আমরা পানিতে মাছ চাষ করবো। মাছ মশা খেয়ে ফেলবে।
নগরবাসী উন্নয়ন চলাকালে কীভাবে চলাচল করবে?
আমরা নৌকার ব্যবস্থা করবো, হকার উঠিয়ে দেবো। হকাররা হবে নৌকার মাঝি। নৌকায় থাকবে গান শোনার ব্যাবস্থা।
গানের শব্দে পরিবেশ দূষণ হবে।
হবে না, আমরা উচ্চশব্দে মাইক বাজাবো না।
না, গান শুনলে আমরা গুনাহগার হবো।
ঠিক, ঠিক!
তাহলে আমরা কবিতা শুনবো।
কবিতা লেখার জিনিস, শোনার না।
তাহলে আমরা উন্নয়নের পরিকল্পনা শোনাবো।
না না, এই পরিকল্পনা শুনানোর কিছু নাই।
আছে আছে, অবশ্যই আছে। পরিকল্পনায় ‘পরী’ কল্পনা আমরা করবো। আমরা আইনস্টাইনের কথামতো চলবো।
আইনস্টাইন কী বলেছেন?
আইনস্টাইন সুন্দরী পরী কল্পনা করতে বলেছেন, তিনি বলেছেন-Imagination is more important than knowledge.
নলেজের দরকার নাই।
ঠিক ঠিক, দরকার নাই।
তাহলে কীসের দরকার?
পরিকল্পনার।
না না, মানি না।
মানতে হবে।
না, না মানলে আমরা সারাশহরে হরতাল করবো।
আপনারা পারেন কেবল হরতাল করতে, আমরা করি উন্নয়ন।
আপনারা শান্ত হোন।
না না, আমরা ধুলা থেকে মুক্তি চাই।
সাধারণ মানুষও চায়।
আমরা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে এসি দিয়ে দেবো।
তারা এসি চালাবে কীভাবে?
আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র করবো।
বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে কীভাবে?
নদীর পানিতে বাঁধ দিয়ে
না, না। নদীতে পানি নাই।
সমুদ্র ভরা পানি।
সমুদ্রের পানি ভরা লবণ।
আমরা লবণ বিক্রি করবো, salt বিক্রি করে Solvent হবো।
না না, সেক্ষেত্রে আমরা কয়লা জ্বালাবো।
কয়লা পাবো কোথায়?
আমরা কিনবো।
কেনার টাকা কে দেবে?
জনগণ।
জনগণ টাকা পাবে কই?
আমরা দেবো।
আমরা টাকা পাবো কোথায়?
ব্যাংক থেকে।
ব্যাংক টাকা পাবে কই?
জনগণের থেকে।
সবশেষে ঘুমুতে যাওয়ার প্রাক্কালে শহরের প্রবেশ পথে লিখে দিয়ে এলো-‘বুদ্ধিজীবীদের প্রবেশ নিষেধ!’
এই পর্যায়ে একটি বিরতি নেওয়া হলো। দামি মদ আনা হলো। নারীদের জন্য দেওয়া হলো টকটকে লাল ওয়াইন, পুরুষদের দেওয়া হলো দেশি গঞ্জিকা। বেজে উঠলো সুর, বিটোভেনের সপ্তম সিম্ফোনি। সবাই বলে উঠলো-চিয়ার্স! অতঃপর মদ পান শেষে আধাঘণ্টা পর যথারীতি শুরু হলো সভা।
ভাইসব, শুনুন। আমরা বুদ্ধিজীবী। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ আছে।
আমরা শহরের মানুষের কথা ভাববো।
অবশ্যই ভাববো।
সাধারণ মানুষ কী চায়?
সাধারণ মানুষ বুদ্ধিজীবীদের মতো মদ চায়।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শহরে সব ধরনের মদ পাওয়া দরকার। আমরা মদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবো।
মদ খাওয়া ভালো না। লিভার নষ্ট হয়, কিডনিতে পাথর হয়…
আমরা কিডনির পাথর বিক্রি করবো।
সেই পাথর বেচা টাকায় আমরা সবুজ গঞ্জিকা চাষ করবো, প্রকৃতি রক্ষা পাবে।
আমাদের দরকার নিরাপত্তা।
আমরা প্রার্থনা শিখিয়ে দেবো, জনগণ বুকে ফুঁ দেবে।
আবর্জনার গন্ধ কমাতে হবে।
আমরা ফুলের পাপড়ি ছিটাবো।
ফুলের পাপড়ি পচে দুর্গন্ধ বেরুলে?
আমরা পাউডার ছিটাবো।
সারা শহর পাউডারে সাদা হয়ে গেলে?
আমরা আলকাতরা ছুড়ে মারবো।
আলকাতরায় সবাই কালো হয়ে গেলে?
আমরা পানিতে ঝাঁপ দেবো।
পানি কুচকুচে কালো হয়ে গেলে?
আমরা প্রথম ‘ব্ল্যাক ওয়াটার সিটি’ হিসেবে বিশ্বে নাম করবো!
এইপর্যায়ে সবাই তালি দিয়ে উঠলো।
তাহলে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিলাম?
আমরা কেবল মদ খাবো।
আমরা উন্নয়ন করবো।
আমরা সবুজ গঞ্জিকা চাষ করবো।
আমরা মাছ চাষ করবো।
আমরা মশাখেকো মাছ দিয়ে মশা তাড়াবো।
তারপর আমরা শহরের সব মূর্তি ভাঙবো। আমরা আনন্দ করবো!
আমরা গান গাইবো-আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে…
গান গাওয়া শেষ করেই তারা আনন্দে দুই চারটা মূর্তি ভেঙে দিয়ে চলে এলো আর মনে মনে ভাবলো-বেশ করলো! এমন না করলে কেমন করে সমাধান হতো?
কিন্তু তাদের মধ্যেকার একজন বললো, কেবল সমাধানই জানে তাকে পরে কেমনতর সব সমস্যা পোহাতে হবে!
তার কথা কেউ বিশেষ পাত্তা দিলো না।
তারা উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা তৈরির আনন্দে ছোট বড় সব মূর্তি ভেঙে ফেললো।
ইতোমধ্যে সমস্যা শুরু হলো।
মূর্তি ভাঙার শব্দে শহরের লোকেরা ঘুম থেকে জেগে উঠলো। তারা মাতাল বুদ্ধিজীবীদের হাসতে দেখে ক্রোধে চিৎকার করে উঠলো। এরপর সব বুদ্ধিজীবীকে পিটিয়ে মারলো। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বাকিদের ভরে দিলো জেলখানায়। তারা ঠিক করলো তারা আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আরাম করে ঘুমাবে। ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে প্রত্যেকে একটা করে সুখনিদ্রা বড়ি কিনলো। সেই বড়ি খেয়ে ঘুমুনোর জন্য প্রস্তুতি নিতে নাকে তেল দিলো ও কানে তুলো গুঁজলো।
সবশেষে ঘুমুতে যাওয়ার প্রাক্কালে শহরের প্রবেশ পথে লিখে দিয়ে এলো-‘বুদ্ধিজীবীদের প্রবেশ নিষেধ!’
তালা ভাঙার পালা
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
প্রচ্ছদ: রহমান আজাদ
প্রকাশনী: পেন্ডুলাম
মূল্য: ১৮০টাকা
অমর একুশে গ্রন্থমেলা,
স্টল নম্বর-২৭১