[নবম পর্ব]
আগুন, তুমি কাঁদছ কেন?
১৮ মার্চ ২০১৬, শুক্রবার বাদ আসর তোমার কুলখানি অনুষ্ঠিত হলো ধানমন্ডির বাসায়। মনে হলো তোমার আত্মার উষ্ণতায় আমি একটু একটু করে শক্তি ফিরে পাচ্ছি তোমারই সমাপনী পরিষেবার জন্যে। কত সেবা তোমাকে দেওয়ার ছিল, কত ভালোবাসা বাকি রয়ে গেলো, কিছুই উজাড় করে দিতে পারলাম না সময়ের অভাবে। মাত্রই চাকরির দাসত্বটা শেষ করেছি। জীবিকা-পর্বেই চলে গেলো আমাদের বেশিরভাগ রঙিন সময়। মনে মনে ভেবেছি, এবার শুধু আমাদের সময়, দু’জন দু’জনাকে উপুড় করে ঢেলে দেবো সময়, সকাতরে ভিজিয়ে হৃদয়।
আবার এক টেবিলে মুখোমুখি বসে দু’জন কবিতা পাঠে নিশি-ভোর যাপন করবো সেই শুরুর সুপ্রভাতের মতো। তখন যেমন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণুদে, বুদ্ধদেব বসু, টিএস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার, ভর্তৃহরি, মির্জা গালিবকে নিয়ে চলতো আমাদের দীর্ঘ আড্ডা, ঠিক তেমনি আবার শুরু করবো। পড়ার টেবিল ছাড়া ঘরে তখন আর কোনো আসবাব ছিল না আমাদের।
ছিল কেবল দেয়ালজুড়ে সিলিং পর্যন্ত বুকশেলফে বই আর বই। সেই সেলফের ডিজাইন করে দিয়েছিল শিল্পী কাজী হাসান হাবীব। তখন সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এর উৎকর্ষ ও কাটতি নিয়ে তোমাদের দু’জনারই টাল-মাটাল সময় যাচ্ছিল।
তবু হাবিবকে কথা দিয়েছিলে তুমি, ধানমন্ডির বাসার ছাদের ‘পরে খোলা আকাশের নিচে রাতের চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মুখোমুখি বসে সোনালি শিশির-জলে তুমুল আড্ডা হবে আমাদের। কিন্তু হাবিবের কোলন ক্যান্সার দ্রুত তাকে টেনে নিয়ে গেলো অনন্তের ঘরে। তাই সেই আশা পূর্ণ হলো না আমাদের।
তোমার না বলা কথারা, অপূর্ণ স্বপ্নগুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয়, বাস্তবতা মেনে আমাকে তবু হাত বাড়াতে হয় তোমার শেষ কৃত্যের কাজে।
তোমার অন্তিম শয়ান-পরবর্তী এই অশেষ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, সংস্কৃতি সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান।
তার আর তোমার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায় হওয়ায় আমিও তার কাছে আলাদা এক মর্যাদা পেতাম, সেও তোমার জন্যেই। কবির স্ত্রী বলে কথা! আর যদি সে নিজেও কবিতা লেখার কারিগর হয়, তাহলে তো কথাই চলে না। শাস্ত্রগুণে এখনো কবি ও কবিতার পাগলামিকে মূল্য দেয় সমাজ এ কারণে যে, এখনো পৃথিবীর যেকোনো ভাষার আদি নিদর্শন কবিতায়ই মুদ্রিত হয়েছে প্রথম।
আমাদের দু’জনের সঙ্গে দীর্ঘকালের দীপ্তিময় এই সম্পর্কের জন্যে তোমাকে তিনি কাব্যলোকের দৃষ্টিতে দেখতেন। সম্মান আর ভালোবাসার সৌম্য আঁধারে তুমি ছিলে তার কাছে স্বদেশের মায়াময় মৃত্তিকার মতো। এই কৃতজ্ঞতা তিনি প্রকাশ করেছেন নানাকাজে। ক্লাবের পক্ষ থেকে তোমার কুলখানিতে উপস্থিত জনসমাগম ধারণ করার জন্যে ধানমন্ডির বাসার সামনের উঠোনটায় সামিয়ানা টাঙিয়ে অপরিসর স্থানটিকে প্রশ্বস্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। দলে দলে সেদিন অনেকে এলেন। সব ঘর, বারান্দা, উঠোন ছাপিয়ে মূল রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো বেশ ক’জন অতিথি।
আমাদের দু’জনের সীমিত সংসারে অনেকবার পয়লা ফাল্গুনে তোমার জন্মদিনে, সর্বশেষ ২১ শে পদক প্রাপ্তি উপলক্ষে অনেককে আমরা ডেকেছি বাসায় কিন্তু বড়লোকদের মতো নানাপদের ব্যঞ্জন রেঁধে চমকে দিতে পারিনি কখনো। সাধ ছিল কিন্তু সাধ্য ছিল না বলে বিব্রত বোধ করেছি দু’জনেই আমরা। অর্থাভাবে কবিদের মতো সাদাসিদে কিছু খাদ্য খেতে দিয়েছি। জানি অতিথিরা অখুশি হয়নি কিন্তু আমাদের তো মন ভরেনি তাতে।
কাজেই তোমার দোয়া ও মিলাদ মাহফিল শেষে ৭০০ লোকের খাবারের ব্যবস্থা রেখেছিলাম আমি। অফিসার্স ক্লাব থেকে অর্ডার করে এনেছিলাম খাবারের প্যাকেটগুলো। ক্লাব সদস্য হিসেবে প্রতি প্যাকেট সুলভমূল্যে (দুশো টাকা) আনতে পেরেছিলাম সব খাবার।
জেনে নিশ্চয় তোমার খুব ভালো লাগবে যে, কুলখানির এই আয়োজনে তোমার আদরের পুত্র রাজিব পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিল, বাকিটা তোমার নির্দেশমতো আমিই ব্যয় সংকুলান করতে পেরেছি। কারও কাছে হাত পাতিনি। জানোই তো, তোমার মতো আমিও কোনোদিন হাত পাততে শিখিনি।
অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন খান অবশ্য প্যান্ডেলের বিলের সমুদয় টাকাটি নিজেই পরিশোধ করেছেন, আমার কাছ থেকে কিছুতেই নেননি। ভালোবাসার দান, তাই ফেরাতে পারিনি।
দারিদ্র্য তাই আমাদের আক্রমণও করেছে যথাতথা। অর্থনীতি কিভাবে পিতৃশোকের বেদনাকে বিনে সুতোয় বেঁধে ফেলে, তার চূড়ান্ত বর্ণনা রয়েছে তোমার এই কবিতায়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তোমার ‘ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস’ কাব্যগ্রন্থটির কথা। যে কাব্যে তুমি তোমার বাবাকে হারিয়ে লিখেছিলে, ‘অযোগ্য পুত্রের পিতৃশোক’নামক একটি বিয়োগান্তক কবিতা।
সারাজীবনই তুমি আর্থিক টানাপড়েনের কারণে তোমার মরমি স্বপ্নগুলোর হাতেখড়ি দিতে পারোনি বলে ম্রিয়মাণ, বিব্রত ছিলে। যে অর্থে জীবনকে উপভোগ করে মানুষ, মানুষের মতো, তা তুমি অর্থাভাবে কখনো মনের মাধুরী মিশিয়ে আদৌ যাপন করতে পারোনি, সে কথা কে না জানে!
যতটুকু সুখ তা খুঁজে নিয়েছিলে পানাহারে আর সৃষ্টিশীল কবিতার অলৌকিক নির্মাণ কৌশলে। ওতেই তুমি তুষ্ট ছিলে অলিখিত সাম্রাজ্যবোধে। একটা ভালো কবিতা দৈনিকের পাতায় প্রকাশিত হলে সেদিন তুমি হাওয়ার মতো ভেসে বেড়াতে আকাশের সাদায়-নীলে। তোমার এত আনন্দ আর খুশি দেখে মনে হতো, যেন রাজধানী শহরের দশটি দরদালানের মালিক তুমি। আর আমি যেন তার অহঙ্কারী এক বাড়িওয়ালী। তখন সদাই মন গুনগুন করে বলতো, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লালা দোপাট্টা মলমল।’
নবলব্ধ কাব্য জগতের এই এক পরম প্রাপ্তিযোগ আমাদের পূর্ণতা দিয়েছে সত্য, কিন্তু সদা সর্বদা এই স্বপ্ন বিক্রি করে আমাদের জীবন তো চলেনি। দারিদ্র্য তাই আমাদের আক্রমণও করেছে যথাতথা। অর্থনীতি কিভাবে পিতৃশোকের বেদনাকে বিনে সুতোয় বেঁধে ফেলে, তার চূড়ান্ত বর্ণনা রয়েছে তোমার এই কবিতায়। ‘সারাটা জীবন ধ’রে দুঃখের প্রান্তর চাষ করে’ অবশেষে ঘুরে-ফিরে ‘পিতৃ’ নামক বৃক্ষের ছায়াতলে তুমি যে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতে, সেই বৃক্ষের দীর্ঘ ছায়া সরে গেলে অপারগ পুত্রসন্তান হিসেবে মানসিক অবস্থার যে বৈকল্য সৃষ্টি হয়, সেসব কথাই ছিল তোমার পুরো কবিতাজুড়ে। তাই নয় কি? মনে পড়ে তোমার, কবিতার শুরু করেছিলে কিভাবে?
জনকের মৃত্যুতেও যথেষ্ট শোকগ্রস্ত হ’তে পারলাম না—
এমনই অপদার্থ আমি!
……
দারিদ্র্যের প্রতি তার এতটা গভীর ছিল ঘৃণা
আমাকে একলা পেয়ে প্রায়শই বলতেন তিনি—
বানানের ভুল তুই, সাবধান, কখনো করবি না,
একটিই শব্দ শুধু সঠিক বানানে লিখবি না,
এইটুকু শিক্ষা তোর অসম্পূর্ণ থাক, সুখি হবি।পিতৃআজ্ঞা ভুলে গিয়ে নিজেরই অজান্তে শিখে ফেলি
য-ফলা সমেত আমি ‘দারিদ্র্যে’র প্রকৃত বানান!
সংসারে সন্ন্যাসী নই—এতদিনে বুঝতে পেরেছি
দারিদ্র্য কাকে যে বলে, কাকে বলে জীবনযাপন!
দরিদ্রজনের শোক উদযাপনযোগ্য নয় মোটে—
দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কেউ করে না এ-দৃশ্যে অশ্রুপাত!
কেননা, এ শোক মুক্তো হ’য়ে নামে না দু’গাল বেয়ে!
সংশ্লিষ্টজনের জন্যে শুধু প্রাসঙ্গিক এই শোক—রক্তপাত ঘটায় হৃদয়ে আর তপ্ত দীর্ঘশ্বাস
আগুন ঝরায় তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে!
(অযোগ্য পুত্রের পিতৃশোক)
নিজেদের এই অর্থাভাবের কথা মনে রেখেই তুমি আমাকে সব সময় বলতে, ‘দেখো আমি অসুস্থ্য হলে, আমার সুচিকিৎসার জন্যে সাহায্য চেয়ে খবরদার, তুমি কোনো ভিক্ষাবৃত্তি করবে না। মানুষের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক সম্মানের। তোমার নিজের যেটুকু সঙ্গতি আছে, তার বাইরে যাবে না কিন্তু।’
আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, কোনো সাহায্য আমরা নেইনি। তুমি অসুস্থ হলে ১৪ জানুয়ারি। প্রথমে বারডেম, সেখানে আইসিইউবেড খালি না পাওয়ায় আনোয়ার খান মডার্নে ভর্তি করলাম রাত ২ টায়, ডা. হারিসুল হকের তত্ত্বাবধানে।
তোমার অসুস্থতার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ডা. কামরুল খান (সম্পর্কে তোমার ভাগনে)। সকালে আমাকে টেলিফোন করে তোমার প্রকৃত অবস্থা জেনে নিলো। বেলা ১১টায় আমাকে ফোন করে বঙ্গবন্ধুতে নিয়ে যেতে বললো, কেননা আনোয়ার খান মডার্নের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেটআপ অনেক বেশি আধুনিক। চিকিৎসাও মানসম্পন্ন।
এছাড়া সরকারি হাসপাতালের খরচ আমাদের বহন ক্ষমতার মধ্যে থাকবে বলেও আমরা আশা করছিলাম। অন্যদিকে আনোয়ার খান মডার্নের মতো ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ নিয়ে একটু শঙ্কা ছিল। ফলে মডার্ন হাসপাতালের যাবতীয় ফরমালেটিস শেষ করে বেলা ৩টার দিকে তোমাকে নিয়ে এলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই কথাগুলো বলার পেছনে কারণ মনে হয় ছিল এই যে, সেই সময় দুস্থ শিল্পী-সাহিত্যিকের যে কাউকে অনুদান বা সাহায্য হিসেবে হাতে চেক তুলে দিয়ে মিডিয়ার প্রধান খবরে ঘটা করে তা প্রচার করা হতো।
সেখানে ভর্তি করলে আইসিইউর ১ নম্বর বেডটি পেলে তুমি। শুরু হলো স্ট্রোক রোগীর যথার্থ চিকিৎসা। সঙ্গে ডায়েবেটিকস ও কিডনির ক্রিটিনেন সমস্যাও ছিল। ফলে সে চিকিৎসাও চললো পাশাপাশি। মনে একটু বল এলো। আশা জাগানিয়া বোধে উজ্জীবিত হলাম মুহূর্তের জন্যে।
পরেরদিন সকালে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পথেই তোমাকে দেখতে এলেন এলজিআরডিমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এরপর এলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, এলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আরও অনেক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ও শিক্ষবিদ এলেন তোমাকে দেখতে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তোমার অসুস্থতার খোঁজ-খবর রাখছেন বলে জানালেন হাসপাতালের ভিসি ড. কামরুল ইসলাম খান। কোনো এক অনুষ্ঠানে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় তিনি তোমার অবস্থা জানতে চেয়েছেন বলে ভিসি জানালেন আমাকে।
এমন সময় যাচ্ছে তো যাচ্ছে। অবস্থার উন্নতি না হয়ে অবনতি হচ্ছে আরও। সংস্কৃতিমন্ত্রী তোমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে সরকারি খরচে চিকিৎসার কথা বললেন আমাদের ডেকে। কথাটি বিশ্বাসও করলাম এ কারণে যে, তুমি তো শুধু কবিই নও, দেশবরেণ্য একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও বটে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত দল যখন ক্ষমতায়, তখন তো একজন মুক্তিযোদ্ধার সুচিকিৎসার জন্য এইটুকু দায় সরকার বহন করতেই পারে।
দুই লক্ষ মা-বোনসহ ত্রিশ লাখ শহীদ এবং যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা জীবিত সব মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই তো দেশটি একদিন স্বাধীন হয়েছিল।ক্ষমতাসীনেরা ছাড়াও তাদের ঘিরে থাকা অসংখ্য লোক যদি এত সুবিধা পেতে পারে তাদের সুন্দর সমৃদ্ধ জীবন যাপনের জন্যে, তবে মৃত্যুপথযাত্রী একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালির শিল্প-সাহিত্যের ধারকবাহক তথা দেশের অন্যতম প্রধান একজন কবি হিসেবে তুমি কি এইটুকু সুচিকিৎসার অধিকার পেতে পারো না? হয়তো তোমার পরিবার চাইলেও তা পাবে না, সেটি বুঝেই হয়তো তুমি এমন কথার অঙ্গীকারে আমাকে বেঁধেছিলেন আঁটোসাটো করে।
আমি যেন কোনো সাহায্য সরকার থেকে গ্রহণ না করি। এই কথাগুলো বলার পেছনে কারণ মনে হয় ছিল এই যে, সেই সময় দুস্থ শিল্পী-সাহিত্যিকের যে কাউকে অনুদান বা সাহায্য হিসেবে হাতে চেক তুলে দিয়ে মিডিয়ার প্রধান খবরে ঘটা করে তা প্রচার করা হতো।
তখন প্রচারিত সেই খবর দেখে আহত ও হতাশ হয়েই বলেছিলে কথাটি তুমি। এখনো মনে আছে, কোনো এক কবিকে হাতে চেকতুলে দিতে দেখে অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক কণ্ঠে বলেছিলে, ‘এই সাহায্য যেন মানবাত্মার অপমান। একজন শিল্পীর অমর্যাদা।’ পুঁজিবাদী সমাজের এই প্রচারের কালচারকে তুমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করেছ, খানিকটা বা বীতশ্রদ্ধবোধে আচ্ছন্নও ছিলে তুমি।
যেখানে তোমার অনিশ্চিত নশ্বর দেহ-ঘড়ির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও উপস্থিত সবার মনে-প্রাণে ছিলে তুমিই একমাত্র অখিল-দেবতা। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে লেখা তোমার আগুন কবিতাটিকে।
ফলে সংস্কৃতিমন্ত্রী যখন এমন কথাও বললেন যে, আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে একটা আবেদন দিলে মন্ত্রীর জন্য দ্রুত কবিকে দেশের বাইরের নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কাজটি অনেক সহজ হবে; তখনো আমি চুপ, অভিন্ন নানাভাবে চেষ্টা করছে। সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী আমার ছোট ভাই সুইজারল্যান্ডের হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ নিচ্ছে তাদের।
এই অবসরে আবেদন দেবো কি না, তা নিয়ে দিনক্ষেপণ হলো বেশ। তোমার ভাতিজি ড. নীরু আমাকে আবেদন দিতে অনুরোধ করে বললো, ‘কাকি একটা আবেদন দিলে যদি দেশের বাইরে গিয়ে কাকার সুচিকিৎসা হয়, তবে তা দিচ্ছেন না কেন?’
ওকে তো বলতে পারছি না, তুমি সরকারি এই সাহায্য নিতে আমাকে বারণ করেছ। কিন্তু ওরা তো চাইছে ওদের কাকা শিগগিরই ভালো হয়ে ঘরে ফিরুক। এমনকি আমাদের সন্তানেরাও চাইছে, বিদেশে তার বাবার উন্নত চিকিৎসা হোক। অর্থাভাবে আমরা যেহেতু বিদেশে নিতে পারছি না, সরকারের পক্ষ থেকে এইটুকু সহযোগিতা পেয়ে যদি তাদের মুক্তিযোদ্ধা বাবা ভালো হয়, তবু হোক।
দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় সংকুলান সম্ভব হলেও বাইরে নিয়ে কোটি টাকার চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ আমাদের হাতে নেই। এক টুকরো জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করে যে টাকা সংগ্রহ করবো এবং তারপরে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেবো তোমাকে, সে উপায়ও নেই। প্রতিদিনই তোমার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। উপরন্তু যেদিন জানা গেলো, রক্তে তোমার ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে সেপ্টেসেমিয়া হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বিদেশের কোনো হাসপাতাল তোমাকে চিকিৎসা দিতে আগ্রহী নয়। ভর্তিও নেবে না বিদেশের কোনো হাসপাতাল।
তখন প্রকৃতই আমি ভেঙে পড়লাম। দূরবর্তী যেটুকু আশার আলো এতদিন ধরে রেখেছিলাম, কেঁপে কেঁপে নিভে গেলো তাও। আবেদন করার ইচ্ছে মনের মধ্যে সামান্য উঁকি দিলেও মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো তা হারিয়ে গেলো মুহূর্তে। তুমি যা চেয়েছিলে, সেভাবেই যেন এক এক করে অভিনীত হয়ে চলেছে ট্র্যাজিক নাটকের পুরো এপিসোট।
কাব্য নাটকের দুর্দান্ত প্রতাপশালী এক মহানায়কের অনন্ত যাত্রাপথের দৃশ্যের অন্তরালে বিধ্বস্ত এই আমি প্রতিদিন চোখের জলেভেসে ভাসি। হে মহর্ষী, কবি, আমার অনাথ প্রেমিক, কাব্য জগতের রাজাধিরাজ তুমি, তোমার প্রেমের সঙ্গে বাস করে আমি অনন্তের স্বাদ বুঝেছিলাম, ঈশ্বরের আলিঙ্গনের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলাম আপন আলোকে। সেই তোমাকে নিয়ে আজ আমি আনুষ্ঠানিক কুলখানির মধ্যে দিয়ে মর্মন্তুদ এক বিদায়ের আসর জমিয়েছিলাম। যেখানে তোমার অনিশ্চিত নশ্বর দেহ-ঘড়ির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও উপস্থিত সবার মনে-প্রাণে ছিলে তুমিই একমাত্র অখিল-দেবতা। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে লেখা তোমার আগুন কবিতাটিকে। ভালোবেসে একদিন এই আমাকে নিয়ে এঁকেছিলে বেদনার যে সরাচিত্র, আজ তাই আমার পরম প্রার্থনাসঙ্গীত।
যে আগুনে পুড়ছি দারুণ
এই আগুনটি অচেনা খুব।আগন্তুক এই আগুনটুকু
দিবারাত্রি দহন করে—
আমি কি খুব দাহ্য বস্তু
ফায়ার-উডে তৈরি আমি?পুড়িয়ে সুখ পাবে যদি
এসো তবে দাও পুড়িয়ে
আমার এই দাহ্য দেহ।
আগুন, তুমি কাঁদছ কেন?
(রচনাকাল: ২৫.৯. ১৯৮১ কবিতা সমগ্র পৃষ্ঠা: ১৬৭)চলবে…
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-৮॥ দিলারা হাফিজ