[৭ম পর্ব]
মরচুয়ারির শীতলতা ছুঁয়ে
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্সে করে রাস্তার ওপারে বারডেম হাসপাতালের মরচুয়ারিতে তোমার লাশ রাখা হলো। হাসপাতালের সব বিল মিটিয়ে আমি ধানমন্ডির বাসায় চলে এলাম। সেই সময়ে আমার কর্মক্ষেত্রের বহুদিনের পুরনো এমএলএস মতিন প্রায় আমার সন্তানদের একজনের মতোই সময়ে-অসময়ে ডাকলেই পাশে এসে দাঁড়াতো।
ইতঃপূর্বে দীর্ঘদিন তিতুমীর কলেজে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, পরে অধ্যক্ষ হিসেবে থাকার সময়ও মতিন আমার সঙ্গে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং কর্তব্যপরায়ণ। মতিনের সঙ্গে আমার বাসার কাজের সহায়তাকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একজন মারমা ছেলে, নাম তার কল্যাণ। সেও প্রায় বারো বছর থেকে আমাদের কাছেই আছে। কবিকে সেবা-যত্ন করছে খুব। কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে মতিন সব কিছু গুছিয়ে বাসায় নিয়ে এলো।
এই ৫৮ দিনের হাসপাতাস বসবাসে অনেক কিছু জমেছিল। তোমার জন্যে কেনা উদ্বৃত্ত কিছু ওষুধপত্র, ডাইপার, কবির শারীরিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার বিভিন্ন রিপোর্ট, এক বান্ডেল দৈনিক পত্রিকা, যেখানে তোমাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে নানাজনের লেখা এবং তোমার অসুখের আপগ্রেট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাংবাদিকদের প্রতিবেদন।
অভিন্ন গভীর রাতে এসে পৌঁছালো টরন্টো থেকে। অভিন্ন আসার ফলে রাতের অন্ধকারে ঝিমিয়ে পড়া শোক নতুন করে সজীব হলো। সন্তান ও স্বজনদের চোখের জলে ভেসে ভেসে পাথরচাপা বাকি রাতটুকু শেষাবধি কোনোমতে কাটলো।
ভোর হলো, সূর্য উঠলো প্রতিদিনের মতোই। শুধু তুমি আর জেগে উঠলো না মরচুয়ারির শীতলতা ছুঁয়ে। বরফ ঠাণ্ডায় জমে বোধ করি তুমি আরও বেশি পাথরের তৈরি মূর্তি হয়ে শুয়ে ছিলে সে রাতে।
ভোর হতেই বিয়ে বাড়ির মতো জন-আড়ম্বর আর নানা ধরনের প্রস্তুতি চলছে। তবে, তা খুবই নিঃশব্দে এবং মৃদুলয়ে বিয়োগান্তক নাটকের শেষ অঙ্কের দৃশ্যায়ন যেন।
যেখানে অনাবিল হাসির পরিবর্তে দু’নয়নের গভীর জলে জানায় প্রণতি।
রাহুল, অভিন্ন ও অব্যয়—তোমার-্বিআমার তিন পুত্র, তোমার একমাত্র বড় ভাই নূরুল ইসলাম খান, তার পুত্র হেদায়্তুল ইসলাম ফারুক, একমাত্র বোনের বড় ছেলে সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, আমার তিন ভাই, পুত্রপ্রতিম রোমিওসহ সবাই আগে আগে চলে গেলো বারডেম হাসপাতালের মরচুয়ারিতে। মরচুয়ারি থেকে তোমার লাশ দেখামাত্র অভিন্ন বাবা বলে চিৎকার দিয়ে তোমার বুকের ওপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। রাহুল দুই হাতে অভিন্নকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলে আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হয় বটে, কিন্তু পিতা হারানোর গভীর শোক, শূন্যতার বোধ, জমাটবাঁধা বেদনা আগ্নেয়গিরির লাভার মতো হঠাৎ অভিন্নের ভেতরের মানুষটাকে যেন দগ্ধ দহনে নিঃসাড় করে তোলে।
কেননা, সে চেয়েছিল চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে টরন্টো থেকে ফিরে আসবে পাঁচ দিনের মাথায়। বাংলাদেশেই থাকবে, বাবার সেবা-যত্ন যা প্রয়োজন নিজ হাতেই করবে। ডাক্তারও তাকে সে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। যে কারণে বাবার মৃত্যুকালে পাশে থাকতে না পারার বেদনা তাকে নিঙড়ে নিচ্ছে বেশুমার।
পিতার মৃতমুখ দেখার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পুত্রত্রয় তোমার কফিন কাঁধে নিয়ে ওঠালো গাড়িতে।
এমনকি মানুষের জীবনে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনও আসে প্রস্তুতিহীনভাবে। মৃত্যু তো বটেই।
প্রথমে নেওয়া হলো তোমার একসময়ের কর্মস্থল বাংলা অ্যাকাডেমিতে। সেখানে বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান, মহাপরিচালক, ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানসহ অ্যাকাডেমির সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা শেষ শ্রদ্ধা জানালেন তোমার প্রতি। কান্নায় ভেঙে পড়লেন অনেকেই। বিশেষভাবে তুমি যখন যেখানেই কাজ করেছ, সেখানে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা জানি না, কেন জানি কবিকে খুব ভালোবেসেছেন, ভক্তি শ্রদ্ধায় আপ্লুত করে রেখেছেন। তাদের প্রতি তোমার কোমল হৃদয়ের দয়া, মায়া, মমত্ববোধ সর্বোপরি তার মানবিকতাবোধ চাকরির ঔপনিবেশিক সব বিধি-প্রথা ভঙ্গ করে অসামান্য এক মনুষ্যত্বের ভুবনে অবস্থান করতো। এজন্যেই বোধ করি উনিশ বছর আগের কর্মস্থল বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল অ্যাকাডেমি থেকে তার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সহকর্মীরা তোমাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে এসেছিলেন সদলবলে, আমাদের ধানমন্ডির বাসায়।
আশুতোষ হাজং, আর্নিস মান্দা, সুলোচনা, সান্ত্বনাসহ অ্যাকাডেমির ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই এসেছিলেন।
এরপর শহীদ মিনারে কবির লাশ নিয়ে এলো সকাল ১১টা নাগাদ। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিক, লেখক সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, কবির ভক্ত পাঠকেরা পুষ্পস্তবক হাতে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তোমাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
পরিবারের সব সদস্যসহ আমিও সেখানে উপস্থিত হলাম। তোমার অন্য পুত্র রাজিব বিদেশ থেকে সকালে পৌঁছে সরাসরি শহীদ মিনারে এসে বাবার লাশ দেখলো। কবি সাহিত্যিক বিদগ্ধজনের বলা শেষ হলে পরিবারের পক্ষ থেকে তোমার বড় ভাই, সন্তানদের মধ্যে অভিন্ন এবং দীর্ঘদিনের সঙ্গী হিসেবে আমাকে কথা বলতে হলো।
আমি জানি না কী বলা উচিত এরকম মুহূর্তে, এ রকম নিষ্ঠুর ডাকাতিয়া সময় মানুষের জীবনে একবারই আসে। যার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না। এই পৃথিবীতে মানুষের জন্ম-মৃত্যু দুটোই খুব প্রস্তুতিহীন ঘটে যায়। এমনকি মানুষের জীবনে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনও আসে প্রস্তুতিহীনভাবে। মৃত্যু তো বটেই।
এই সব অচেনা পর্বে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না হাতে। তা এত আকস্মিক যে, ঘটনার সংঘাতে মানুষ মাত্রই তার অতিচেনা মুখের ভাষা হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। আমারও অবস্থা তাই। তবু ভেতর থেকে কবিতার অনুপ্রেরণার মতো যা অনুভব করলাম, চোখের জল সংবরণ করে তাই বললাম।
একজন ঋষিতুল্য মানুষ একজন আপাতমস্তক কবি ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে জীবন জড়িয়ে সাঁইত্রিশ বছর আমি অনাবিল প্রেমময় একটি জীবন কাটিয়েছি। আমার সৌভাগ্য যে, খুবই ক্ষুদ্র একজন মানুষ হিসেবে প্রতিদিন আমি তোমার কাছ থেকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পাঠ নিতে পেরেছি। তোমার মতোই মানুষের দেওয়া শত দুঃখ-কষ্টকে নির্মল আনন্দে উপভোগ করতে চেষ্টা করেছি।
তুমি আমার জন্যে দেবদূতের মতো সন্তানদের রেখে গেছ।আরও রেখে গেছ অসংখ্য কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে জাতীয় পতাকা দিয়ে কফিন আচ্ছাদিত করে বিউগল বাজিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সূর্যসন্তান কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদকে শেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হলো।
আমাদের পরিবারের সদস্যসহ উপস্থিত আপামর জনগণ তোমার কফিনকে ঘিরে অধোমুখে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য অবলোকন করলো চোখের জলে।
চিন্তা করো না আমিও তোমার সঙ্গে হাঁটবো, এখন থেকে নিয়মিত হাঁটতে বেরুবো দু’জনে, কেমন?
সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক ভাইয়ের নেতৃত্বে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. সামাদ, সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দসসহ সবাই মিলেই এই পর্বটি সম্পন্ন করলেন বেলা ১টার মধ্যে। এরপর বাদজোহর তোমার দ্বিতীয় জানাজা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে, যার পাশেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি। প্রথম জানাজা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সি ব্লকে। যার পাশের ভবনের আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে তুমি ৫৮ দিন কাটিয়ে ফিরে গেলে সুতোর ওপারে।
জানাজা শেষে তোমার প্রিয় বাসস্থান ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের ১৩৯/৪-এ বাড়িতে নিয়ে এলো তোমাকে। উঠানের নারিকেল বীথিতলে তুমি ঘুমিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ। নূরজাহান রোডের সরকারি বাসা থেকে অন্য সরকারি বাসস্থান হিসেবে পাওয়া ধানমন্ডির এই একতলা বাড়িটিতে উঠেছিলাম ১৯৮৮ সালের জুন মাসে। তখন আমাদের দুই সন্তান খুবই ছোট। অভিন্নের বয়স তিন বছর, অব্যয়ের বয়স সবে সাতমাস।
এই বাড়িতে যখন আসি, তখন কবি আবার বেকার। কবি হুমায়ুন আজাদের কবিতা ছাপার অপরাধে এরশাদ সরকার সাপ্তাহিক কাগজ ‘রোববার’ পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দিলো। কাগজের মালিকও এককথায় চাকরি থেকে তোমাকে বিদায় করে দিলো। আর্থিক অনটনসহ নানা দুঃশ্চিন্তায় তোমার শরীরও অসহযোগিতা শুরু করে দিলো। আমি ছাত্রী পড়িয়ে বাড়তি কিছু টাকা পেয়েই তোমাকে ডাক্তার দেখালাম। ডায়াবেটিকস ধরা পড়লো হাই লেভেলের। সেই খবর শুনে কবি আক্ষরিক অর্থে কেঁদে ফেললে। বললে, ‘আল্লাহ আর কিছু পেলো না আমার জন্যে, শেষমেশ ডায়েবেটিক বরাদ্দ করলো, তারচেয়ে ক্যান্সার হওয়া ভালো ছিল।’ আমি তোমার মুখের ‘পরে আমার ডানহাত চাপা দিয়ে বললাম, কী সব অলুক্ষণে কথা বলো। খবরদার এসব কথা বলবে না আর কখনো। নিয়ম-কানুন মেনে চললে, ডায়েবেটিক রোগী বরং অন্য অনেক সুস্থ মানুয়ের চেয়ে দীর্ঘজীবী হয়, তোমার সামনেই তো ডাক্তার বললেন সে কথা। তাহলে এত কাতর হচ্ছ কেন?’
তুমি বললে, ‘কাতর হবো না, আমি রফিক আজাদ পারলে রান্নাঘরে যাই রিকশায় করে, এক কদম হাঁটতে চাই না। আর আল্লাহ বেটা আমাকেই কিনা দিলো যাবজ্জীবন হাঁটার কারাদণ্ড। এই কি মানা যায়, প্রতিদিন একঘণ্টা, নয়তো কম করে হলেও আধা ঘণ্টা হাঁটতে হবে।’
বললাম, ‘চিন্তা করো না আমিও তোমার সঙ্গে হাঁটবো, এখন থেকে নিয়মিত হাঁটতে বেরুবো দু’জনে, কেমন?’
ভাগ্যিস, মেয়র হানিফ ধানমন্ডিতে হাঁটার রাস্তাটি করে দিয়েছিলেন নেত্রীর কথা ভেবে। নইলে ঢাকার খানাখন্দময় রাস্তা দিয়ে হাঁটাই তো বিপজ্জনক।
ঠিক আছে হাঁটবো, কারাদণ্ড যখন ভোগ করতেই হবে, কী আর করা!
চলবে…
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-৬॥ দিলারা হাফিজ