চতুর্থ পর্ব:
চিকিৎসা এক বিভীষিকার নাম
আইসিইউর বেডে সকালে একবার এবং সন্ধ্যায় একবার দেখবার অনুমতি ছিল শুধু আমার। ২/১ বার নিয়ম অমান্য করে আমার বদলে সন্তানেরা গেছে। কখনো ভিআইপি ভিজিটর, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সংস্কৃতিকমন্ত্রী, জনপ্রশাসনমন্ত্রীর কেউ কেউ গেছেন তোমাকে দেখতে।
তাদের সঙ্গে আসতেন বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মী, যাদের অনেকেই তোমার কবিতার অনুরক্ত পাঠক ও ভক্ত ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই তোমার চিকিৎসার আপগ্রেড যেত বিভিন্ন চ্যানেলে। সারাদেশের জনগণ, তোমার পাঠক, ভক্তরা অপেক্ষা করে থাকতো কখন শুনবে তুমি ভালো হয়ে উঠে আবার কলম ধরেছ।
কিন্তু না, আশা-নিরাশার দোলাচলে প্রতিটিদিন কেটেছে আমাদের অসহনীয় এক বিপন্ন অন্ধকারে। মধ্য সমুদ্রে শত যাত্রীসহ জাহাজ ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তের দুঃস্বপ্নে কেবলই খাবি খাচ্ছিলাম। আমরা এতটাই দিগভ্রান্ত যে, কেউ কোনোদিক খুঁজে পালাতে পারছিলাম না মোটেই। কিন্তু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাসায় আসতে চেয়ে এক রাতে হাসপাতালের লোহার বেড থেকে নামতে গিয়ে ডান পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত চামড়া ছিলে গিয়েছিল তোমার। ডায়েবেটিকস বহন করা মানুষ তুমি, ফলে শেষদিন পর্যন্ত এই ক্ষত আর ক্ষতি আর শুকায়নি একটুও। এই ক্ষতের জন্যেই কিনা মাঝে মধ্যেই ভীষণ জ্বর হতো। আইসিইউর বয় বেয়ারাই মাথায় জল দিতো, আমাদের জানতেও দিতো না। হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখেছি সেসব। এরপর তো বেডসোর হয়ে গেলো, ডাক্তারের কথামতো বাইরে থেকে একটা স্ট্যান্ড ফ্যান কিনে বেডের সঙ্গে যুক্ত করে দিলাম, তাতে যদি তোমার সামান্য আরাম হয়। না, সেসব ব্যর্থ করে দিয়ে স্বাধীনতার সৈনিক তুমি স্বাধীনতার মাসের ১২ তারিখে দুপুর দুটোর মধ্যেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে।
এদিকে তোমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে অভিন্ন তার কাজের ল্যাপটপ ফেরত এবং চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তোমার পাশে থেকে সেবা করার উদ্দেশ্যে চারদিনের সময় নিয়ে টরণ্টোর উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেছে। তখন দুবাইর ট্র্যানজিট শেষে টরণ্টোগামী প্লেনে উঠতে যাচ্ছে, ওই সময় ডাক্তার আমাদের ডেকে বললেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ, আপনারা প্রস্তুত হোন, বাইরে কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকলে খবর দিন।’
অভিন্নও মনে হয় চিকিৎসক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে একটু ভরসা পেতো মনে। অভিন্ন চলে যাওয়ার পরে ঘন-ঘন আসতো তবে আমার সঙ্গে সব সময় দেখা হতো না
অভিন্নকে অব্যয় জানালো সব, কিন্ত দুবাই থেকে ফেরার অপশন তখন আর অবশিষ্ট নেই। ফলে টরণ্টো পৌঁছেই পরবর্তী প্লেন ধরে অব্যয়ের স্ত্রী তুলিসহ অভিন্ন প্লেনে চেপে বসলো। এই সংবাদে অভিন্নের বন্ধু ইয়াদ আমেরিকার নিউজার্সি থেকে স্ত্রী নাভিলসহ তেরো ঘণ্টা ড্রাইভ করে সরাসরি পিয়ার্সন এয়ারপোর্টে এসে অভিন্নের পাশে দাঁড়ালো সামন্য সময়ের জন্যে। সান্ত্বনার হাতটি বন্ধুর কাঁধে রাখতেই এত ঝুঁকি নিয়ে সে এসেছে। একই শহরের অন্য বন্ধু শায়ের অভিন্নকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এসেছে প্লেনে তুলে দিতে। শায়েরের স্ত্রী নাভিন আসতে পারেনি, সেই সময় ওর বড় বোন হাসপাতালে, দ্বিতীয় কন্যার জন্ম দিতে চলেছে। অটোয়া থেকে দ্রুত পৌঁছুতে কবির একমাত্র বড় ভাইয়ের পৌত্র শান্ত এয়ারবাস ধরে পাঁচ মিনিটের জন্যে দেখা করে অভিন্নকে তার পিতাহীন বাংলাদেশগামী প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে গেছে।
তবে ইয়াদকে অভিন্ন ঘরের চাবিটা দিয়ে দু’দিন টরণ্টো অবস্থান করে তবে আমেরিকার উদ্দেশে যেতে অনুরোধ রেখে প্লেনে চেপেছিল সেদিন।
আমিও যখন বুঝে গেলাম তুমি আর কিছুতেই ফিরবে না, তখন থেকে মনের মধ্যে একটাই প্রার্থনা ঘুরপাক খাচ্ছিল চক্রাকারে। তোমার চলে যাওয়ার সময় যেন আমি তোমার সামনে উপস্থিত থাকতে পারি। যেহেতু আইসিইউতে যখন-তখন যাওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না, সেহেতু মনে ভয় ছিল কী জানি, আমাকে না বলে না, চলে যাও শেষমেশ!
কী মনে করে, দুপুর ১ টা ২০ মিনিটের সময় আমি আইসিইউতে তোমার বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে তোমার পর্যবেক্ষণকারী ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। তখন তোমার প্রেরসারের মনিটরে তাকিয়ে দেখি নিচে ২০, ওপরের পালস চল্লিশ পঞ্চাশে আপ-ডাউন করছে।
আমি ডাক্তারকে বললাম, প্রেসার এত কম, ওষুধের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন?
ডাক্তার ইতস্তত করে কী যেন বোঝাতে চাইলেন আমাকে। সেদিকে আর কর্ণপাত না করে কবির মৃদু খোলা দু’চোখের পাতা আর অক্ষিগোলকের দিকে তাকিয়ে আছি। এই সময় হঠাৎ অভিন্নের বন্ধু ডা. মিকাইল এলো। এই হাসপাতালেই একজন চোখের ডাক্তার হিসেবে সে কর্মরত। মিকাইল এসেই টর্চের আলো ফেলে কবির দু’চোখ পরীক্ষা করলো।
অভিন্ন অবশ্য যাওয়ার আগে মিকাইলকে বলে গেছিল, আমি ক’দিন থাকবো না, চাকুরিটা ফাইনালি ছেড়ে দিয়ে এসে বাবার পাশে থেকে তার সেবা করবো এবং দেশেই থাকবো। দোস্ত, তুই বাবাকে প্রতিদিন এসে একবার/দু’বার দেখে যাস, যখনই সময় পাস। অভিন্নের স্কুল জীবনের বন্ধু মিকাইল। একসঙ্গে স্কলাস্টিকায় পড়তো। খেলার মাঠেও সহযোদ্ধা। বিখ্যাত ডা. তালুকদারের দৌহিত্র, ওর বাবা-মাসহ এক পরিবারে চারজন ডাক্তারি পেশার মানুষ, প্রত্যেকেই সোনালি হৃদয়ের মানুষ। এদের দেখেই মনে হয় বাংলাদেশের ডাক্তার মাত্রই কসাই নয়।
শুরু থেকেই মিকাইল এসে দেখে যেতো, তবে অভিন্নের সঙ্গে দীর্ঘ সময় তার বাবার অসুখ নিয়ে, ওষুধ নিয়ে, সকাল বিকেলের নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা নিয়ে বিশদ আলাপ আলোচনা করতো চিকিৎসকের ভিউ থেকে। অভিন্নও মনে হয় চিকিৎসক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে একটু ভরসা পেতো মনে। অভিন্ন চলে যাওয়ার পরে ঘন-ঘন আসতো তবে আমার সঙ্গে সব সময় দেখা হতো না।
মিকাইলকে হঠাৎ দেখে মনে হলো অভিন্নের হয়ে ওর বন্ধুই যেন শেষ সময়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। অব্যয় তখন বাইরে ছোটাছুটি করছে, কিছুক্ষণ বাদেই তার বাবা আর ইহলোকে থাকবে না, সব ছেড়ে পারি জমাবে অনন্তলোকে—সেই হাহাকার, সর্বব্যাপী বিষণ্নতার ভার লুকাতে কোথায় যে কিভাবে নিজেকে সে এক লুপ্ত নগরীতে পরিণত করেছে, আমি তাকে খুঁজেও পাচ্ছি না তখন।