[তৃতীয় পর্ব]
দুঃস্বপ্নের রাত
বেডরুমে ঢুকেই অস্থির তুমি, খাটের বাম পাশে যেখানে ঘুমাতে প্রতি রাতে, সেই প্রিয় স্থানটিতে বসে পড়লে প্রথমে, পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালে বাথরুমের দিকে যেতে, নাহ্, আবার শয্যায় ফিরে এলে। যেন তুমি দ্রুত পালাতে চাইছ কোথাও।
অতর্কিতে পুলিশ এসে হ্যান্ডকাপ পরালে যে অবস্থা হয় একজন নির্দোষ মানুষের, সেই অবস্থায় যেন হাবুডুবু খাচ্ছিলে তুমি কেবলই। ততক্ষণে আমি বুঝতে পারছিলাম কোন দিকে নৌকা আমার পাল তুলেছে।
তোমাকে বসিয়ে রেখে ৩/৪টি কল করলাম। প্রথম কলে ড্রাইভার, দ্বিতীয় কলে ভাতিজি লাকি, ভাগনে বাবর, আমার বোনঝি সোহাগ ও তার স্বামী রোমিওকে আসতে বললাম। ছোটভাই শীতলকে সরাসরি শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে অপেক্ষা করতে বললাম।
প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বারডেম কর্তৃপক্ষ জানালো, মাথার ভেতরে রক্তপাত হয়েছে, কাজেই তার আইসিইউর সাপোর্ট লাগবে। কিন্তু এখানে কোনো বেড খালি নেই, এখনই অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে তাকে।
বাবর, শীতল, রোমিও, লাকি; চারজন মিলে বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ বেড খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা পাঁচেক হাসপাতালে তল্লাশি দিয়ে রাত দুটোয় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিতে নিতে অবস্থা আরও অবনতি হলো। এরইমধ্যে বিদেশে অবস্থানরত তোমার সব সন্তান আমাকে ফোন করে বারবার খোঁজ নিচ্ছিল। বাম হাত ফোনে, অন্য হাতটি অভয় মুদ্রার মতো তোমার বুকের বাম পাশে পেতে দিয়ে রেখেছি। কথা বলতে পারছো না বলে এক পর্যায়ে লিখে বোঝানোর চেষ্টায় খাতা কলম চাইলে হাতের ইশারায়। হাতের কাছে পাকা বাঁশপাতা রঙের একটা মোটা খাম ও কলম ধরিয়ে দিতেই প্রথম শব্দটি স্পষ্ট অক্ষরে লিখলে ‘খাবার’পরে আরও লেখার প্রচেষ্টা থেকে কোনো লেখার জন্ম হলো না, পক্ষান্তরে তা মডার্ন আর্টের মতো আঁকিবুকিতে পরিণত হলো। তুমি খাতা-কলম ছুড়ে ফেলে দিলে মাটিতে। জানি না সেই হাত দিয়ে এখনো তুমি কি কবিতা লেখো?
কে তোমার প্রথম পাঠক?
সবুজ নালি দুর্বাঘাস? না, কবরের সোনামাটিজল?
কে তোমার প্রিয়, প্রিয়তর?
দু’চোখের জল সরোবরে ধরে না যে আর! তাকেও আজ শুষে নেয় আত্মবিধ্বংসী সব কবিতার চরণ। শিল্পের অনুচ্চারিত বক্তব্য, বস্তু আর ভাবের অন্তরালে কখন যে হারালো আমার প্রেম, বুঝতেই পারলাম না। নিজের ভেতরে দেখতে পাই আত্মার সেই চিরাচরিত শূন্যতার অ্যালবাম।
এখনো খুব স্পষ্ট মনে আছে ২০১৬ সালের ১২ মার্চ মাসের বেলা ১ টা ২০ মিনিট সেদিন। তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তমতলার আইসিওতে। আমি ৬১১ নং কেবিনে। ১৪ জানুয়ারি (২০১৬)তোমার স্ট্রোকের পাঁচদিন পরেই গায়ে প্রবল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো, সেই জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ওই হাসপাতালে। সিদ্ধান্ত ছিল আমাদের প্রথম সন্তান অভিন্নের।
দুই দিন আগে তোমার অসুস্থতার কথা শুনে টরণ্টো থেকে ছুটে চলে এসেছিল অভিন্ন।
ধানমন্ডির বাসায় আমি তখন একা জ্বরে পড়ে আছি, দহনে পুড়ছি সর্বক্ষণ।বিবর্ণ পাতারা সব আমার পাহারায়। সন্তানের আদর্শ পিতা শুয়ে আছে তার সব চাইতে অপ্রিয় জায়গা, আইসিইউতে। মা পড়ে আছে ধানমন্ডির প্রাচীন দেয়ালে ঠেকিয়ে মাথা, যেন জড় ও চৈতন্যের দ্বৈরথ। কাকে রেখে কাকে দেখবে সে—কাজেই আমাকেও ওই হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো অভিন্ন, যেন দুই শয্যাশায়ী রোগীকে সে একাই দেখভাল করতে পারে। অব্যয় তখনো এসে পৌঁছেনি।
কিন্তু ওদের দুই ভাইকে যখন দেখলে তখন বললে, কেন এলে তোমরা?
এজন্যে হাসপাতালে কিছুতেই থাকতে চাচ্ছিলে না তুমি। সন্তানদের বারবার তুমি অনুরোধ করছিলে বাড়িতে নিয়ে আসতে।
আমি বলেছিলাম, বাবা-মায়ের সংকট মুহূর্তে আসবে না তো কখন আসবে? মানুষ তো সন্তান চায়, এজন্যে যে, বাবা-মায়ের অসুস্থতায়, অথবা যেকোনো সংকটকালে দুর্দিনে, দুঃসময়ের মুখোমুখি হলে অবশ্য যেন তারা পাশে থাকে। ওরা ওদের দায়িত্ব পালন করেছে।
তুমি নির্লিপ্ত চোখে তাকালে শুধু। মুখের ভাষা তখন তোমার হারিয়ে গেছিল, চোখের ভাষায় বলতে সব। অব্যয় আসার সময় আধুনিক এক ডিজিটাল স্লেট নিয়ে এসেছিল, তুমি যেন চাইলে আঙুল ঘুরিয়ে লিখে বোঝাতে পারো তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সব কথা। প্রথম ২/৩ দিন লিখে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলে, পরের দিকে আর তাও সম্ভব হচ্ছিল না।
আমরা যখন তোমার ইশারার ভাষা, সবটা বুঝতে পারতাম না, তখন যেন সগৌরবে ফিরে আসতো তোমার সেই দ্রোহ, রাগ ও ক্ষোভের অন্তর্দহন। এই রাগ, ক্ষোভ দ্রোহই তো—নতুন রূপে ভাষা পেয়েছিলে তোমার কবিতায়।
প্রাচীন আলঙ্কারীকদের মতে, কবিতার নির্ধারিত বিষয়বস্তু প্রেম ও আদর্শের ধারণাকে পাল্টে দিয়ে দুঃখ, ক্ষোভ, দ্রোহ থেকে জাতগালিও যে কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে, তা দেখিয়েছিলে তুমি চূড়ান্ত এক শৈল্পিক দক্ষতায়। কতকাল আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুধা ও সৌন্দর্যের দারুণ এক মিথস্ক্রিয়ায় লিখেছিলেন সেই অমর পঙ্ক্তি—‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ তুমি লিখলে,
‘ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে-প্রতিপলে-সর্বগ্রাসী ক্ষুধা!
………………………………………………………
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবি,
অনেকে অনেক-কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি—কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—
ভাত চাই—এই চাওয়া সরাসরি—ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হলে
কোনো ক্ষতি নেই—মাটির শানকি-ভর্তি ভাত চাই:
দু’বেলা দু’মুঠো হ’লে ছেড়ে দেবো অন্যসব দাবি।
…………………………
ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো
এই রাগ, দ্রোহ তখনো তোমাকে ছেড়ে যায়নি। আইসিইউর অসহায় বেডে শুয়েও সেদিন দর্পভরে ফুঁসে উঠতে দেখেছিলাম তোমাকে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে, শেষ নিঃশ্বাসের আগে তোমার জবান কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল তোমার দ্রোহ। দ্রোহ ছিল হাসপাতালের চিকিৎসা ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও। এক রাতে তিনবার নাকে ঝোলানো রাইসটিউব তুমি খুলে নিয়েছিলে সহ্য করতে না পেরে। হাসপাতালের নাছোড় ডিউটি ডাক্তার সামান্য বিশ্রাম না দিয়ে, অমানবিক ও নিষ্ঠুরের মতো সঙ্গে সঙ্গে তিনবারই তা পুশ করেছে তোমার নাসিকান্দ্রিয়ে। আমরা জানতে পেরেছি, পরের দিন সকালে যখন তোমাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছি। এজন্যে হাসপাতালে কিছুতেই থাকতে চাচ্ছিলে না তুমি। সন্তানদের বারবার তুমি অনুরোধ করছিলে বাড়িতে নিয়ে আসতে।
ভেবেছিলে, তোমার বাধ্য-অন্ত প্রাণ, আদর্শ সন্তান, তারা বুঝি তোমার কথা রাখবে। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শের বাইরে তো আমরা কেউ যেতে পারছিলাম না। আমাকে তো আরও বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল, তুমি তো কেবল রাহুল, অভিন্নের পিতা নাও, আমার হৃদয় রাজ্যের সম্রাট নও কেবল। একজন মহান মুক্তিযোদ্ধাও। কাব্য জগতের অন্যতম অধিশ্বর, ভক্ত-পাঠককূলের অতি প্রিয়জন, দেশ ও দশের সম্পদ। আমি অথবা তোমার সন্তানেরা ইচ্ছে করলেই কি তোমাকে বাড়ি নিয়ে এসে রাখতে পারতাম কাছে?
তখন শতমুখে বলতো, বিনে চিকিৎসায় তোমাকে আমরা মেরে ফেলেছি, যারা হৃদয়হীনভাবে এসব কথা বলতো—সেই মিডিয়া জগতের সামাজিকতাকেও তো অগ্রাহ্য করার সাধ্য কি আমাদের ছিল? আমাকে ভাবতে হয়েছে আরও অনেক কিছু।
এছাড়া প্রতিদিনই তো আমরা তোমার আরোগ্য লাভের অপেক্ষায় ছিলাম। আর ডাক্তার যা বলেছে, যেমন যেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধের রদবদল করতে বলেছে, সেভাবেই বিনা বাক্যে তাই করেছি কেবল তোমার সুস্থতার আশায়।
চলবে…
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-২॥ দিলারা হাফিজ