শিল্প হচ্ছে সৌন্দর্য। আর সে সৌন্দর্য কখনো গতিশীল কখনো বা স্থির। দিগন্তের ওপারে যেমন আকাশ দেখা যায়, তেমনি শিল্পের ওপারে পড়ে থাকে জীবনবোধ। যা থাকে যাপিত জীবনের রন্ধনশালায়। আরেক অর্থে শিল্প হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু নক্ষত্রের ভেতর আরেক নির্মাণ। সত্য, সুন্দর আর শিল্পের শরীরে যে সৌন্দর্য প্রকাশমান, তা জীবনকে প্রলম্বিত করে। শিল্পের অবয়ব দৃশ্যকল্পের এক-একটি বিস্তৃর্ণ মাঠ।
‘বালক খোঁজে পাখির পালক’ শিরোনামে মিজানুর রহমান শামীমের কিশোর কবিতাগ্রন্থটি পড়তে পড়তে ওপরের কথাগুলো মনে এলো। আর নিজের ভেতর খুঁড়ে দেখার মতো করে দেখলাম তার কিশোর কবিতাগুলো।
শিল্পের ব্যাকরণ আমি খুঁজিনি। আমার ভেতরে কোনো ব্যবচ্ছেদবাসনাও নেই। কেননা, এই কবিতাগুলো কেবলই বোধের ভেতর আঁকা বালক মনের কিছু ছবি। শব্দের গাঁথুনিতে সারি সারি বৃক্ষরূপ এক-একটি কিশোর কবিতা। যা বালক মনের ভেতর আম, আনারস, তরমুজ, আঙুর ইত্যাদি ফলের স্বাদের সন্ধান দিয়েছে।
কখনো কখনো আমিও হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে, সুতরাং অমিমাংসিত ভালোলাগা কবিতার ভিতর দিয়ে এই দাবদাহেও আমায় নিয়ে গেছে জলের কাছে। কবিতার ভিতর প্রতিস্থাপিত এক-একটি পৃথিবী আমাকে ছুটে নিয়ে গেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।
‘বালক খোঁজে পাখির পালক কিংবা পাখির ডানা
পাখির আছে নীল আকাশে উড়াল দিতে জানা’
(বালক খোঁজে পাখির পালক)
কবিতা পাঠের ভেতর যে সুষমা তাকে বাঙ্ময় করে তোলার জন্য নিজের ভেতর রাখতে হয় ক্লান্তিহীন একাগ্রতা, যুক্তি ও প্রযুক্তি বিসদৃশ্য প্রতিভা। কিন্তু যখন ধ্বনিত হয়:
শুকিয়ে তরু হচ্ছে মরু
আমার সোনার দেশ
শরম ছাড়া গরম এখন
চরম পরিবেশ
(চরম গরম)
ক্লান্ত অবসন্ন দেহে গরমের তীব্র দাহের ভেতরও যখন বালকের তারুণ্য চিরসবুজ হতে থাকে, তখন গরম আর বালককে একা, গতিহীন, ক্লান্ত করতে পারে না।
মিজানুর রহমান শামীমের কবিতা বালকদের, কিশোরদের, হতাশ করে না, একা করে দেয় না। বরং কবি মিজানুর রহমান শামীমের বাক্য বালকের হাজার হাজার বন্ধুর আনাগোনা করায়, মন উড়ে যায় অনেক দূরে। কখনো মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি করে। কখনো গোমতী নদীর সাঁকো পেরিয়ে যায়। কখনো আকাশে রামধনুতে যে জরির কারুকাজ করে, তুলির টানে ছবি আঁকে:
মাঠ মানেতো দু’হাত তুলে
উড়তে চাওয়া
ঘুরতে চাওয়া
কষ্টগুলো নষ্ট করে পায়ের তলায় চুরতে চাওয়া।
দুলতে চাওয়া
ফুলতে চাওয়া
পেছন ফেলা শহরটাকে এক নিমিষে ভুলতে চাওয়া
খুলতে চাওয়া
নরম নরম তুলোট মেঘের ভাঁজ
আকাশটাতে রামধনুকের জরির কারুকাজ-
তুলির টানে আঁকি।
সত্যি আমি শহরটাকে আজ দিতে চাই ফাঁকি।
(গোমতী নদীর সাঁকো)
তার কবিতায় বর্ণিলভাবে উঠে এসেছে স্বপ্নসম্ভার। নীল আকাশ, মেঘের তুলোট, কবিভাবনা, উঠে এসেছে মুক্তির আনন্দ। স্বাধীনতার কথা। কবিতার পরতে পরতে, মেঘের ভেলা, মেঘের আদর, বৃষ্টির অপরূপ ব্যঞ্জনা। মায়ের শাড়িকে কবি দেখেছেন দেশ হিসেবে।
সম্ভবত
নদীর মতো
রুপোর সুতোয় গাঁথা
এই শাড়িটার আঁচল জুড়ে দেশ তুলেছে মাথা।
এই শাড়িটা কার?
এই শাড়িটা আর কারও নয়
এই শাড়িটা মার।
এই শাড়িটাই দেশ
শাড়ির জমিন সবুজ নীলে দারুন পরিবেশ।
(মায়ের শাড়ি)
রসুনের কোয়ার মতো করে খুলে দেখেছি প্রতিটি কবিতা। কেবল চিত্রকর্ম, বুননের পর বুনন। পরতের ভেতর পরত। স্তরের ওপর স্তর। নিজেকে টুকরো টুকরো করে রচিত এই কবিতাগুলো কেবল অক্ষর নয়। অন্যকিছু। কারণ,
হাসতে পারে
ভাসতে পারে
রঙিন শতদল।
রোদের উপর টানা।
নীল আকাশে দিলখোলা এক মেঘের শামিয়ানা।
(ঘুমকাতুরে খোকা)
আরেকটি চমৎকার উদাহরণ:
ঘাসের ওপর একটু পানির ফোঁটা
কী হতে চায় ওটা?
হীরক কাটা পুঁতির মালা কিংবা কাচের চুড়ি
কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি?
মনের ভিতর ছন্দগুলো দেয় শুধু সুড়সুড়ি।
(ছন্দ)
কবিতার ভেতর ক্রমশ ডুবে মন হতে থাকে নির্মোহ। অন্ধকার রাতে আলোর ঝর্ণাধারা চেতনায় রঙ নিয়ে আসে বাক্য। কবি নির্মাণ করতে থাকেন এক একটি চমৎকার ইমারত, ঘর। কবিতার ভেতর জেগে ওঠে আশার বালুচর। শুদ্ধতার স্রোত পাঠককে নিয়ে যায় গন্তব্যে। এইভাবে নির্মাণ ও বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় কবিতা আর কবিতা থাকে না, হয়ে ওঠে বালকের নিজের ভেতরের কথা।
আজকে পড়া বন্ধ
যতোই বল মন্দ
হাওয়ার সাথে সখ্য গড়ি
বইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব।কারন আজকে ছুটি
পড়ার টেবিল পেছন ফেলে
বাতাসে খুনসুটি।
(ছুটি)
এই কথাগুলো ভেতর দিয়েই উঠে আসে বালকের বাঁধনহারা মনের অপার স্বাধীরতা শব্দের গাঁথুনি, বিন্যস্ত বর্ণমালা নিমজ্জিত শিল্পের জৌলুস হয়ে ওঠে।
কবিতা পড়তে পড়তে কিশোর খুঁজে পায় পাখির পালক। তারপরও কিছু শব্দ কিশোর-বালকদের কাছে দুর্বোধ্য লাগবে বলে আমার মনে হয়। কবিতার শব্দের গাঁথুনি যদি আর একটু আটসাট, মেদহীন, ঝরঝরে হতো, তবে বালকদের পড়তে সুবিধা হতো। ছন্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবি আরও একটু যত্নশীল হতে পারতেন।