মার্বেল পাথরের মন
গুলিগুলো কাচের নাকি সিসার—তা জানতে জানতেই
আমরা পেরিয়ে যাই ঝাড়খণ্ড। সামনেই জামশেদপুর,
কিছু ঘুড়ি আকাশে উড়ছে তার স্বাধীনতা নিয়ে, কিছু
মানুষ মিছিল করছে অন্য প্রদেশে, অন্য এক মোমবাতি
হাতে বসে আছেন বিধবা নারী, পুলিশের গুলিতে বিক্ষত
স্বামীদেহ পাশে নিয়ে।
এমন আগ্রাসন এই ভূখণ্ডে আগে ছিল না। এমন
অরাজকতার লালচোখ, এর আগে দেখেনি এই ভূমির
মানুষ। তারপরও বৈষম্য আর বিবাদের মার্বেল ছুড়ে যারা,
করতে চাইছে ধর্মরাজনীতি—এরা কি পড়েনি মহাত্মার
অহিংস নীতি? এরা কি দেখেনি রায়টের কালোরাত?
মানুষের মনের দিকে তাকাতে আর ইচ্ছে করে না আমার।
বরং যে মার্বেল পাথরগুলোই ভেদ করছে মানুষের বুক—
ওদের দিকে তাকাই। পাতাগুলো জলে ভাসে,
. খুব গোপনে একাই কাঁদে মধুগঙ্গা নদী।
গল্প বলার কাল
কিছু কিছু বৃষ্টি মানুষের মাথার ওপর ছাতা
এগিয়ে দেয়। কিছু কিছু ঝড় মানুষকে খুব
কাছাকাছি সমবেত করে।
বৃষ্টিকে আমি যেদিন আগুনের ট্রেনে তুলে
দিয়েছিলাম; সেদিনই ভেবেছিলাম এই শহরে
আর যেন বর্ষা না আসে। আর যেন কেউ
না শোনে শ্রাবণের থৈ থৈ আওয়াজ।
অথবা বলা যায়—
. যে ফাগুন মাথায় নিয়ে আগুনে
ঝাঁপ দিয়েছিল বসন্ত, সে রাতেও আকাশ
ধারণ করেছিল শ্বেতবর্ণ। কোথাও কোনো
নক্ষত্র ছিল না। কোথাও ছিল না কোনো
দোয়েলের শিস।
আমি গল্প বলার কাল অনেক আগেই
পেরিয়ে এসেছি। তারপরও লিখে রাখি—
ছাতা ও ছত্রাকের গল্প
বই ও বৈভবের গল্প
বৃষ্টি ও বিষণ্নতার গল্প
. কারণ,
মানুষ গল্প ছাড়া কিছুই বলতে পারে না।
নিয়ন্ত্রিত নদীস্বর
বোতামের নিচে লুকিয়ে থাকা সুতোর মতো
জেগে উঠছে পৌষ। জেগে উঠছে শীতপক্ষী।
মানুষ নিয়ন্ত্রিত নদীস্বরগুলো জেগে উঠছে।
এই চরে একদিন জন্ম নেবে ভালোবাসার
সবুজ চারা—প্রত্যয় বুকে রেখে জাগছে
. পলিমাটির সংসার।
সংসারী চন্দ্রগুলো মানুষের জন্যেই ছড়িয়ে
যাচ্ছে আলো। আর যেসব অসংসারী মানুষ
সবুজের ডাকে ডাকে নিজেকে বিদীর্ণ করে
বনবাসি হয়েছিল, তারা পুনরায় খুঁজতে চাইছে
শান্তির নিবাস। জমে থাকা ক্লান্তির নিচে যে
রোদ অপেক্ষায় থাকে—
. একদিন প্রজন্মের গায়ে লুটিয়ে পড়বে
সেই আলো; এমন ভবিষ্যদ্বাণী লিখে
সড়কে সড়কে নিজের ছায়া বিলিয়ে দিচ্ছেন
একজন শ্রম—চিত্রগ্রাহক।
কিছু চন্দ্র, তন্দ্রার অধিক
ওরা আমাকে দীর্ঘক্ষণ প্রখর সূর্যের মুখোমুখি
দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তারা চেয়েছিল,
সূর্যের আলো যেন আমার দুচোখের জ্যোতি
হরণ করে; আমি যেন অন্ধ হয়ে যাই।
ওরা বন্ধ করে রেখেছিল আমার পথ।
যাতে মাঘবরণের মেলায় যেতে না পারি—
সে জন্যে;
. আমার পথে বিছিয়ে রেখেছিল কাঁটা।
ওরা চুরি করে নিয়েছিল আমার সবগুলো দিন।
এবং যে রাত আমার জন্যে রেখে গিয়েছিল,
সেই রাত ছিল চন্দ্রবিহীন।
অথচ তারা জানে না—
. সূর্যকে আমি বশ্য করে রেখেছি পূর্বজনমে।
আর পথগুলোকে বলে দিয়েছি—আমি যাবো না।
বরং তোমরাই আমার কাছে এসো।
কিছু চন্দ্রকে তন্দ্রার অধিক জেনে আমি
সাজিয়েছিলাম যে স্বপ্নের মোহনা,
সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে থেকেছিলে আমার অপেক্ষায়।
আমি নক্ষত্রময় আকাশ পেরিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম
. শুধু তোমার দিকে।
উদ্যোক্তাদের গ্রাম
যারা বিজলীর চাষ করতে চেয়েছিল, তারা জানতো
প্রভাবশালী পাপনগরের ইতিহাস। কিভাবে সমুদ্রের
সন্ধানে মানুষ ঘর ছেড়ে যায়, কিভাবে নিখোঁজ হয়
অশ্বখুরে দ্বিখণ্ডিত পৃথিবী—সব কিছুই জানা ছিল ওদের।
এটাও জানা ছিল, লটকে থাকা মাধবীলতার গায়ে
সারাদুপুর বসে থাকে যে প্রজাপতি, সেও
. মানুষের জন্য লিখে রাখে কবিতা।
যারা মেঘবন্দনার উদ্যোগ নিয়েছিল এই গ্রামে—
তাদের নিজস্ব কোনো পুঁজি ছিল না। মৃত শামুকের
কাছ থেকে শিল্পঋণ নিয়ে তারা আকাশে ছিটিয়েছিল
ধূসর জৈব-সার। এবং বলেছিল—
বনজ ঔষধি হে! তুমিই কল্যাণ করো মানুষের।
সমুদ্র খুললেই সীমান্ত
চোখজোড়া দূরবীনের কাছ থেকে ধার নেওয়া।
আর পদযুগল একটি ডাহুক পাখির। যে পাখিটি
দীর্ঘ রাত পেরিয়ে মাড়িয়েছে কুয়াশা, সূর্য দেখবে বলে
. সাজিয়েছে নিজস্ব বাগান।
বাগানহীন পুষ্পগুলোর কাছে হার মেনেছে যে
রঙধনুর মায়া, এর কৃতিত্ব সূর্যমেঘের নয়।
বরং দুপুরকে ভালোবেসে নদীর কিনারে বসে
থেকেছিল যে দুঃখ; তার কাছ থেকে
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই নীল-হলুদ।
লালমাটির বুকে মাথা উঁচু করে জেগে থাকে
যে হলদেক্ষেত—
. মূলত সেটাই মানুষের জন্য সুরক্ষিত আবাস।
কারণ মানুষ পাঁজর খুললেই চন্দ্রপিণ্ড দেখে,
অথবা সমুদ্র খুললেই দেখে যে সীমান্ত;
জগতের ভালোবাসা সেই সীমান্তেই স্বর্ণথালা
পাহারা দেয়। অন্য কোনো মানুষ সেই থালায়
. তুলে দেয় বাড়ন্ত অন্ন।
জলবিসর্গের ধুলোঢেউ
কপালে তিলক নেই, তবু দেখে হাসে রাত। সাক্ষাৎ পেলে অন্য কেউ নিয়ে
যেতে পারে ভিন্ন পথে। দিতে স্মৃতির আয়না। বায়না ধরেছে যারা নদীপাড়ে যাবে—
তাদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া আছে একটি করে মার্বেল। খেল শেষ হলেই
তারা মার্বেলগুলো ছুড়ে দেবে জলে। ফলে ভোরের সূর্যও দেখাবে তার ভালোবাসার
মুখ। অসুখ সেরে গেছে নক্ষত্র-বিসর্গের। ছায়াগুলো কাছে রেখে গেছে সনদ, জলের।
প্রশ্নটি ছিল অস্তিত্ব বিষয়ক। একক শক্তি নিয়ে যে চাঁদ ছড়িয়ে যায় রাতের ফোয়ারা—
সেখানে পড়ে থাকে বিবর্ণ পাখির ডানা। অজানা যুদ্ধের সাথে মাটিভাঙা খেলা করে
বধির বালক। পৃথক পরতে লেখা ভাগ্য তার—গড়া আছে ভিন্ন দিবালোকে।
যাকে কেউ সম্রাট ভাবে, আসলে সে ন্যাড়া-সহোদর। প্রতারক রাত
এসে নিয়েছে দখল এই যৌথ জনপদের—কেঁপে উঠছে জলের শহর।
কেউ কি সংরক্ষণ করে লুপ্ত এই আলোর ফেনা। দেনা-ধার সবকিছু
শোধ করে আবার ফিরে কি ঘাটে নিতে জল, স্বরের অমল। সকল মানুষই
মানে জগত এক অভিন্ন শিকল। পরিমণ্ডল ছেড়ে এলে মায়াগুলো হয়ে যায়
কেনা। বেগানা বালির বাধে তবে কে গো, গেড়ে যায় গোলাপ। পাপ যারা করেছে
এর আগে—তারা কি প্রার্থনা সারে, সেই পাপ চির-মোচনের। রূপের রহস্য
খুঁজে নাকি কেউ একাকী নগরে। নাম লিখে রাধিকার—নবীনা মাঘের পাতা ধরে।
তবে কি ঈশান থেকে উড়ে আসে আলোর কাগজ। সহজ সরলরেখায় আঁকে কেউ
চলন্ত বিষাদ। সাধ থাকে সুখী হতে—তবুও তো চোখ ভেসে যায়। কোথায় জলের
নৌকো, কোথায় ধুলোঢেউ জাগে।আগে কি এ শহরে এভাবেই দুঃখবৃষ্টি হতো।অবিরত
অনুধ্যানে মানুষেরা খুঁজে নিতো সিঁড়ি-পিঁড়ি কিংবা পাটাতনে লুকিয়ে থাকতো
চাঁদমাখা রাত। প্রভাত হওয়ার আগে হারিয়ে যেতো সবগুলো ছবি—বুকে রেখে জলের
করাত।
এই স্মৃতি জেগে আছে পাতাদের সংযুক্তি সাধনে। প্রাণে যে কথার মালা, তাকে নিয়ে
কে লিখিবে যৌথ বিজ্ঞাপন। বিপণন খণ্ডগুলো কে তুলিবে কালের খাতায়।যায় যারা
সাধনপুরে—তারা কি আর কভু আসে ফিরে। ঘিরে যে রচিত ভোর—তার হাতে
কে দেয় ফুল। ভুল করে কোন নারী ভুল ঘাটে ভাসায় কলসী। বাঁশি যে বিরহ চিনে—
সেই কথা জানে কি বাদক। শোধক সমুদ্র জানে কত জলে প্রেমের প্রতীক। দিক থেকে
দিগন্তে ছুটে যায় ঢেউ—তাকিয়ে থাকে একাকী নাবিক।
মূলত বৃক্ষই বুঝে প্রকৃতির রূপ-ঋতুকলা। খেলা শেষে ভাটি পথে চলে যায় যে বর্ষার
জল। সফল সে ও তো হয় ভাসিয়ে নিয়ে দুঃখীর সংসার। যার কোনো পথ নেই, সে
কী চিনে গন্তব্যের দ্বার। সবার নিয়তি এসে মিশে তবে নীল যমুনায়! হায়, পাখি-হায়
ভোর সূর্যের লালিমা রাখো লিখে। এঁকে এই ছবিবৃক্ষ—ছায়ামূর্তি হও, তারপর বিসর্গের
হাতে স্বপ্নগুলো তুলে দাও ঢেকে।
পার্বণের রূপজন্ম
পাঁচশ বছর আগে এই পাতাগুচ্ছে আমার কোনও
স্মৃতিচিহ্ন ছিল না—ধূসর ঈগলের নখরের মতো,
এই মাটিতে ছিল না আমার নখের দাগ। অথবা—
একাকী নদীর কিনারে আমার নাম ধরে ডাকে’নি
কোনো বিদগ্ধ জোসনা—
ভাবতে ভাবতে আমার আকাশ নত হয়ে আসে।
জীবনই নমস্য কেবল—এমন কাঁপনধ্বনিতে আবার
প্রাণ পায় শীতের শিশির। মাঘের হাটে,
ফেরি করা বাঁশিওয়ালা তার ঝুলিতে হাত দিয়ে
দেখে—আর কোনো উৎসব জমা নেই।
. পার্বণগুলো পুনরায় রূপজন্ম পেলে মানুষ
ভাসবে বরণবন্যায়, এমন সাহসে—
সহজেরা সেরে নিচ্ছে তাদের যাবতীয় পঠনবিদ্যা।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে
মাঝে মাঝে খুব বেশি ভুল করে ফেলি। অভিমানী পৃথিবীর
দিকে তাকিয়ে দেখি ক্ষয়িষ্ণু বোধের বিকেল, আমাকে গ্রাস
করতে এগিয়ে আসছে। যারা আমার সাথী ছিল, তারা সবাই
বেছে নিয়েছে অকাল অবকাশ। পেরিয়ে মধ্যবয়স তারা আর
কোনো নদীতেই কাটতে পারছে না সাঁতার। অথচ আমরা বার
বার ভাসবো-ডুববো, তারপর কৌশলী ডুবুরীর মতো ভিড়ে
যাবো রৌদ্র উপকূলে, এমন একটা প্রত্যয় ছিল খুব গোপনে।
সব গোপন , সকল সময় আর লুকানো থাকে না। রহিত রাত
এসে আলিঙ্গন করলে একান্ত বিরহও হয়ে যায় মায়াবী বুনন।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে বসে শুধু হাত নাড়ে জলের রুমাল।
সেও ধারণ করে রেখেছে কিছুস্মৃতি, বৈশাখে আমাকে দেবে বলে।
যতি ও মধ্যবিরতি
থেমে যেতে চেয়েছিলাম। কোনও চিহ্ন না রেখেই
হয়ে যেতে চেয়েছিলাম—দূরের নাবিক।
কোনো কোনো জাহাজ সমুদ্র থেকে আর যেমন
কোনো দিনই বন্দরে ফিরে না, অথবা
কোনো কোনো ঝড়, দাগ না রেখেই নগরের ওপর দিয়ে
দ্রুত চলে যায়, ঠিক ওদের মতোই
তুমি আমাকে বিরতি নিতে বললে। অস্ত যাওয়ার পূর্ব
মুহূর্তের সূর্যের মতো, আমার ফ্যাকাশে রঙ দেখে
তুমি বললে—তোমারও যৌবন ছিল!
আমি মধ্য অক্টোবরের ম্যানহাটানে দাঁড়িয়ে আরেকবার
দেখলাম হলুদ পাতা ঝরার দৃশ্য।