[দ্বিতীয় পর্ব]
শব্দের শিল্পী যেজন
‘একটি শব্দের জন্য ক্রমাগত তিরিশ বছর যিনি একটানা দীর্ঘ কালো রাত পার করেছে নিদ্রাহীন লাল চোখে।’ ৩০ বছর ব্যয় করে যার জানা হয়নি ‘ভালোবাসা’র মতো একটি মৌল শব্দে কী হয় তার প্রকৃত অর্থ—সেই কবির মুখ ফুটে বেরুচ্ছে না একটিও কাঙ্ক্ষিত শব্দ, এ যে কী ভয়ানক মর্মান্তিক অসহায়ত্ব, চোখে না দেখলে ধারণা করা যায় না।
একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় মানুষ পড়ে গিয়েও যেমন তার আঘাতের ভয়াবহতাকে অস্বীকার করে উঠে দাঁড়াতে চায়, আমাদের দুই জনেরই তখন সেই অবস্থা। অথচ, দেখো আমাদের দুই জনেরই ওইদিনে ডিনারসহ নিমন্ত্রণ ছিল ‘বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’র একটি প্রোগ্রামে; শিল্পকলায়। তুমি যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে। তবু, আমি অনুরোধ করে বললাম, আমি গাড়ি পাঠিয়ে তোমাকে ডিনারের সময় বাসায় থেকে তুলে নেবোখন, নেপালের বিদায়ী অ্যান্বাসেডর কিন্তু খুব আশা করেছিলেন তুমি যাবে। কবিতাও পড়বে।
-না, না আমি আজ বাসায় থাকি। তুমি শাহবাগ থেকে লাকিকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসো। আমার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না।
২০১২ সালে নেপালের সাহিত্য-সংস্কৃতি সোসাইটির আমন্ত্রণে যখন কাঠমান্ডু গিয়েছিলাম তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে, তখনই সেখানকার কবি-সাহিত্যিক ও বিশেষভাবে অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে একটা চমৎকার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যাওয়ার আগে করে ‘বাংলাদেশ নেপাল ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’কে কাগজপত্রে বৈধতা দিয়ে যেতেই এই অনুষ্ঠানের ফরমাল আয়োজন করেছিলেন।
ব্লু লেবেলের সোনালি শিশিরে এই শেষবার তুমি ঠোঁট ভেজিয়েছিলে।
অনুষ্ঠানটি ছিল ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। আমরা এই ঘটনার মাস খানেক আগে অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছি সন্তানদের প্রবাস শহর টরেণ্টো থেকে। বিদায়ের দিন পিয়ার্সন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে অভিন্ন বললো, ‘বাবা, আগামী সামারে কিন্তু চলে আসবে। শীত সহ্য করতে পারো না বলে কিন্তু যেতে দিলাম, মনে রেখো বাবা।’
জবাবে তুমি বললেন, ‘না, না আমি আর আসবো না। বাংলাদেশের গাছ-পালা পথ-ঘাটের ধুলোবালি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে না? তারা আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে। আপাতত, ওদের কাছে কিছুদিন থাকি, পরে দেখা যাবে বাবা।’
দেশে ফেরার দু’দিন আগে এইটিন ইয়াংয়ের বাসায় বসে আড্ডার মুডেই অভিন্নকে ডেকে বললে তুমি, ‘বাবা আমার জন্যে যে ব্লু-লেবেল কিনে রেখেছ, যাওয়ার আগে সেটা খেয়ে যাবো না?’
অভিন্নের জবাব ছিল, ‘না, বাবা। দু’দিন পরেই তুমি ফ্লাই করবে। এখন সামান্য খেলেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো, এত বড় জার্নি, ধকল নিতে পারবে না তোমার শরীর। বাবা বাদ দাও এ যাত্রায়। জানোই তো তুমি, আমি তো নিজে কিছু পান করি না বাবা। তোমার জন্যে তোমার প্রিয় পছন্দের ডিংকগুলো কিনে কিনে জমা করে রাখি। তোমার শরীরটা আর একটু ঠিক হয়ে এলেই খেতে পারবে তুমি।’
অভিন্নের মুখে এমন কথাবার্তা শুনে তোমার মুখটা সেদিন মলিন এক পর্দায় কে যেন ঢেকে দিয়ে গেলো। তোমার সেই অসহায়, কাতর, করুণ মুখ দেখে আমি নিজেই লাগাম ছেড়ে দিয়ে অভিন্নকে বললাম, ‘বাবা, দাও একটু খেতে, এতদিন ধরে আশা করে বসে আছে আনন্দ করে খাবে বলে। নিরাশ করো না। তোমার বন্ধু শায়ের, নাভিন ও শায়েরের শ্বশুরকে ডাকো, ছোটখাটো একটা আড্ডা হয়ে যাক, আমাদের চলে যাওয়ার আগে।’ ব্লু লেবেলের সোনালি শিশিরে এই শেষবার তুমি ঠোঁট ভেজিয়েছিলে।
এরপর বাংলাদেশে ফিরেও আর পান করোনি। অভ্যেসবশত আড্ডার জন্যে ‘সাকুরা’য় দু’দিন গিয়েছিলে বটে, তবে হাতে ছিল ফ্রেস ওয়াটারের বোতল। তোমার ভক্তরাও খুব অবাক হয়েছিল, চাইলে তুমি এতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারো নিজেকে। ভাবাই যায় না! বলা বাহুল্য যে, তখন তোমার ‘সাকুরা’ যেতেও তেমন মন নেই আর।
সামার এলে আবার সন্তানদের কাছে যাবে বলে জানালে আমাকে। কেননা, সন্তানদের যত্ন-আত্তি, ভালোবাসার কলরব ছেড়ে এসে খুব নিঃসঙ্গবোধ করছিলাম দু’জনেই। তোমার সোনালি শিশির পানে ডাক্তারেরও নিষেধ ছিল। লিভারে তোমার ৬৭ শতাংশ চর্বি জমে গেছে। কাজেই একটু খেলেই শরীর খারাপ হয়ে যেতো বলে তুমি নিজেও আগ্রহ কিছুটা হারাচ্ছিলে দিনে দিনে। হয়তো জীবনের প্রতিও নিজের অজান্তেই মায়া কাটাতে শুরু করে দিয়েছিলে! বছর দেড়েক থেকে দিনের বেশিরভাগ সময় শুয়ে কাটাতে। কিছুক্ষণ পরপর উচ্চকণ্ঠে মা-আ-আ-আ বলে ডেকে উঠতে। অনেক সময়ই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সেই পাগলা মেহের আলীর কথা মনে পড়তো আমার। বেশ কিছু দিন এই সশব্দ মা ডাক শোনার পরে একদিন খুব আলতো ভঙিতে তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মনে পড়ে? তুমি যখন এভাবে ডেকে ওঠো, তখন তোমার ভেতর মন্দিরে কেমন অনুভূত হয়? বলবে তুমি আমায়?’
তুমি বলেছিলে, ‘তখন ভেতরটা খুব হালকা লাগে, মা ডাকের সঙ্গে সঙ্গে বড় করে শ্বাস নিতে পারি।’
তোমাকে সান্ত্বনা দিলেও মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম সেদিন। মৃত্যুর আগে এবং পরে পরিবারে বা বন্ধু বান্ধবের পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের যত গল্প বা ঘটনা শুনেছি, জেনেছি তার সঙ্গে এই স্বপ্ন-সিরিয়ালেরও বড্ড বেশি মিল খুঁজে পেয়েছিলাম
ভাবলাম, মায়ে অনুরক্ত সন্তান বুঝি এভাবেই ‘মা’ বলে ডেকে ডেকে হৃদয়ে শান্তি পায়। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই ডাকো তুমি। তোমার ঈশ্বর, আল্লাহ, খোদা অথবা প্রকৃতি যাই বলি না কেন, সবই তো খুঁজে পেয়েছিলে তুমি, তোমার মা নামক ঈশ্বরে। নিরাকার ঈশ্বরকে তো দেখতে পাইনে আমরা, কল্পনায় তাকে বানাই নিজের মতো করে। কিন্তু জন্মদায়িনী মাকে দেখতে পাই ঈশ্বরের ছায়ারূপে, আকারে-সাকারে।
চূড়ান্ত ঘটনা ঘটবার ঠিক দু’দিন আগে এক স্বপ্ন দেখার কথা বললে তুমি। তোমাদের এক চাচা ছিল। তোমরা সবাই তাকে ডাকতে টুপা কাক্কু বলে। ছোটবেলায় তিনি খুব দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে তাকে ভয় পেতে, এমনকি এড়িযেও চলতে খুব। বহুকাল আগেই গত হয়েছেন তিনি। সেই টুপা কাক্কু কিনা তোমার শয্যা পাশে পায়চারী করছিলেন বারবার। আর তুমিও ছোটবেলাকার মতো ভয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছিলে। জীবদ্দশায় তাকে দেখে তুমি শিশুকাল থেকে ভয়ও পেতে ভীষণ। এ রকম স্বপ্ন দেখে তুমি নিজেও খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলে যেন।
‘ও কিছু না’ বলে তোমাকে সান্ত্বনা দিলেও মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম সেদিন। মৃত্যুর আগে এবং পরে পরিবারে বা বন্ধু বান্ধবের পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের যত গল্প বা ঘটনা শুনেছি, জেনেছি তার সঙ্গে এই স্বপ্ন-সিরিয়ালেরও বড্ড বেশি মিল খুঁজে পেয়েছিলাম।
কিন্তু কিচ্ছু তো করার নেই আমাদের। সময়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। এতটাই অসহায় প্রকৃতির সন্তান বা মানুষ আমরা।