[পর্ব-১]
তুমি যখন গভীর ঘুমের অতল সমুদ্রপাতে
আমি যখন থাকবো না, তোমার মতোই লুকিয়ে যাব গভীর ঘুমের অতল সমুদ্রপাতে।
তখন কি তোমার সঙ্গে দেখা হবে আমার?
সকল বিরহ-বিষাদের সরোবর পেরিয়ে,
শিশিরে ভেজা অনবদ্য কোনো এক সোনারঙ ভোর-সকালে আবারো দেখা হবে আমাদের?
যখন শিল্পীর রঙতুলিতে আঁকা অসাধারণ এক সোনালি সূর্য-ওঠা আনন্দময় ভোর রাঙিয়ে দেয় মানুষের মন। সে রকম এক নিসর্গ-প্রাণ সময়ে?
তখন তোমার আমার মন চিরন্তনী সঙ্গীতে পাবে কি ছাড়া?
‘আমার রাত পোহালো শারদও প্রাতে,
আমার রাত পোহালো,
বাঁশি, বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাবো কাহার হাতে?
আমার রাত পোহালো শারদও প্রাতে।’
তখন কি তোমার বুকেও বাজবে সেই সুরধ্বনি। না কি আগেই বেজেছিল, আমিই কেবল বুঝতে পারিনি। তোমার কি মনে আছে, ভাঙা ডিম থেকে কিভাবে পিছলে বেরিয়ে আসে অপূর্ব রঙিন কমলার মতো কুসুমটি? সেই ভাঙা ডিমের দিকে তাকিয়ে এখনো কি মনে পড়ে তোমার সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। যার কবিতা এক সময় তোমার প্রেরণার উৎস ছিল। জানোই তো, কাব্য সমালোচকেরা এখনো তোমাকে সুধীন্দ্রীয় ঘরানার কবি বলতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ওই যে, ‘ক্রন্দসী’ কাব্যের সেই ‘উটপাখী’ কবিতাটির কথাই তো বলছি, ‘আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি’—এই প্রথম পঙ্ক্তি থেকে পাঠ শুরু করে বারোটি পঙ্ক্তি তুমি চমৎকার আবৃত্তি করে শেষ দুই পঙ্ক্তিতে এসে হঠাৎ থেমে যেতে—ধীরে ধীরে ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তকে টেনে প্রায় অক্ষরবৃত্তের মতো অতি ধীর লয়ে পাঠ করতে। স্বগতোক্তির মতো:
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
আমি পরের আটটি চরণ খুব উৎসাহের সঙ্গে পাঠ করতাম:
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনও বিপদপ্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে।
তুমি তখন আমার মুখের দিকে এমনভাবে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে যে, মনে হতো তুমি বোধ হয় অনিন্দ্য সুন্দর এক ভোর বেলাকার সূর্য দেখছ সবিস্ময়ে।
কবিতার শেষে কি চমৎকার করেই না বলেছ। আর আমি বোকার মতো তোমার কবিতার সেই অঙ্গীকারকে বিশ্বাসও করেছিলাম।
আজ মনে হয়, এই কবিতা তো শুধু অলৌকিক রসাত্মক বাক্য ছিল না সেদিন, তা ছিল আমাদের ব্যঞ্জনাময় জীবনকে ঘিরে দুর্দান্ত এক প্রণয়-লাবণ্যের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের চাষাবাদ। আমরা দু’জনেই ছিলাম আমরণ সেই অমরাবতীর যুযুধান।
আজ এতকাল বাদে সেই অনিন্দ্য এক ‘সুন্দর’কে আমি দেখে ফেললাম কী করে? একা, একাকি? কেন দু’জনে মিলে দেখা হলো না সেই অপূর্ব সুন্দর এক সকাল? অমলিন নিসর্গের অসীম উদারতা, যেখানে জড়িয়ে ছিল হিরণ্ময় এক অলৌকিক জ্যোতিধারা, ছিল মর্ত্যের মাটিতে ঝরা শেফালির অফুরন্ত বিশুদ্ধতা।
অকস্মাৎ আকাশের জরায়ু ফেটে নানা বর্ণিল ছটায় গোলাকার সূর্য যেন বেরিয়ে পড়েছিল ডিমের কুসুমের মতো। তুমি কি দেখেছিলে এমন দৃশ্য কখনো? দিনাজপুরের জ্যোৎস্না দেখেছ জানি। বিরাট গোলাকার চাঁদ ও মস্ত খোলা আকাশ দেখেছ মানি, পলা ও আধিয়ারদের জীবন-বিন্যাসসহ আরও কত কী দেখেছ তুমিও একা ও একাকি।
মানি, সে প্রতীক্ষা ছিল আমারই জন্যে। কবিতার শেষে কি চমৎকার করেই না বলেছ। আর আমি বোকার মতো তোমার কবিতার সেই অঙ্গীকারকে বিশ্বাসও করেছিলাম।
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকবো অমল বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার পায়ে
শিকড় গজাবে—
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরাবে না…
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি তোমার কথা রাখলে না। আমাকে ফেলেই অনন্ত ঘুমের শিশিরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে তুমি। আমি তো জেগে আছি আজো আমাকে সঙ্গে নিয়ে আর একটি বারও কি দেখবে না, অমন সোনা ঝরা আকাশ—যা পৃথিবীতে স্বর্গ এনে দিতে পারে আচম্বিতে? আর একটি বারও কি পৃথিবী ফিরে তাকাবে আমার পানে?
আমাকে কাছে পেয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বেডরুমের দিকে আসতে চাইলে, পাশাপাশি কথা বলার জন্যে অনর্গল চেষ্টা করছ যত, তত জড়িয়ে যাচ্ছিল তোমার কথা
না—জানি, তার হাতের সময় ফুরিয়ে এসেছে, কৃষ্ণ পক্ষের সময় এলে জ্যোৎস্না যেমন হারিয়ে যায় অসময়ে। বলো তো কেন, এভাবে চলে যেতে হলো তোমাকে? জলে-স্থলের কোথাও হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা পাইনি বলে কি আমরা চলে যাই গভীর ঘুমের অতল সমুদ্রপাতে? জগৎ-সংসারের টানাপড়েনে আমরা কি খুব বেশি ক্লান্ত, ক্লিষ্ট হয়ে পড়ি? সে জন্যে কি অন্য এক ‘তাঁহার’ কাছে ফিরে যেতে এত তাড়না বোধ করি? না কি শেষের দিকে জীবন অতিশয় অর্থহীন মনে হয় বলে মহাভারতের ভীষ্মের মতো ‘ইচ্ছে মৃত্যু’কে আমরা ডেকে নেই কাছে? আমাদের মায়াডোর কেন ছিন্নপত্রের মতো ভেসে যায় এত অনায়াসে। কে বলবে আমায়, বলো তো! কিন্তু তুমি তো যেতে চাওনি।
তখনো ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলে আয়েস করে। আমি ওয়াশরুমে। শুতে যাওয়ার আগে মুখে পানির ছিঁটা দিচ্ছিলাম, আর আয়নায় তাকিয়ে মুখের দাগগুলোর হাল দেখছিলাম। প্রতিদিন একটু একটু লক্ষ্ করছিলাম বয়স বেড়ে যাচ্ছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে। অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছুটে এসে দুষ্টু কিশোরীর মতো আয়নায় কুয়াশা ছড়িয়ে দিলো। আমার মুখটা তখন ততোধিক ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেলো, যেন সময়ের হাতে হাত রেখে।
কী মনে করে যেন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলে তোমার বাম দিকের পাটা নড়ছে না, টেনেও যখন তুলতে পারছিলে না, তখনই আর্তচিৎকারে ‘মুমু-মুমু’ বলে আমাকে তিনবার ডেকে উঠেছিলে।
এই ডাকটি ছিল সকল অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে বাঘের সামনে পড়ে যাওয়া মানুষের শেষ আর্তনাদের মতো। আমি দৌড়ে এসে ধরতে না ধরতে তোমার পাশে দাঁড়ানো আমাদের গৃহকর্মী মারমা মেয়ে পেঁইছানো তোমাকে ধরে তুলতে চেষ্টা করছিল। আমাকে কাছে পেয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বেডরুমের দিকে আসতে চাইলে, পাশাপাশি কথা বলার জন্যে অনর্গল চেষ্টা করছ যত, তত জড়িয়ে যাচ্ছিল তোমার কথা। সেই অসহায় মুহূর্তটিকে আমি ভাষায় আঁকতে পারলাম না, অন্য কেউ পারবে কি না, আমি জানি না।
চলবে…