কবিতার দৃশ্যমান দুটি দিক রয়েছে। একটি এর গ্রহণযোগ্যতার, অন্যটি প্রত্যাখ্যানের। সব ধরনের কবিতা সব শ্রেণীর পাঠক সহজে গ্রহণ না-ও করতে পারেন। কিছু কবিতা প্রথমপাঠেই মর্মমূলে পৌঁছে যায়; কিছু কবিতা ‘বারবার পাঠ’ শেষে। আবার এমন কবিতাও রয়েছে, বারবারপাঠ করেও মর্মোদ্ধার সম্ভব হয় না। কিন্তু ওইসব কবিতা পুনঃপুনঃ পাঠে আরও পাঠস্পৃহা বাড়ে। হয়তো ওই সব কবিতার বিশেষ কোনো পঙ্ক্তি বা চিত্রকল্প অথবা উপমা পাঠককে আকৃষ্ট করে বিশেষ কোনো দুর্বল মুহূর্তে। রসবোদ্ধারা হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের নাম দেবেন রহস্য।
একটি কবিতা পুনঃপুনঃ পাঠে যা পাওয়া যায়, তার পুরোটা ব্যাখ্যা করা যায় না। মনের নানা স্তরে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিশেষ-বিশেষ শ্রেণীর কবিতা। ফলে একই কবিতা স্থান-কালভেদে একই ব্যক্তির মনে একেক রকম অনুভূতির জন্ম দেয়। বিষয়টা যতটা রহস্যের, তারও বেশি বিস্ময়ের।
রহস্যও বিস্ময় বোধের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, কল্পনার সীমারেখা ও যুক্তির শৃঙ্খলার। কবিতা লিখতে এসে ব্যক্তি চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবেন বটে, কিন্তু তাকে কল্পনার সীমারেখার মধ্যে বাজিয়েও দেখবেন। একইসঙ্গে মেনে চলবেন যুক্তির শৃঙ্খলাও। মনে রাখতে হবে, কবিতা যুক্তিহীন কল্পনার ফানুস নয়। চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা বটে, তবে স্বেচ্ছাচারিতা নয় কোনোভাবেই। কল্পনার সঙ্গে চিন্তার, আবেগের সঙ্গে প্রজ্ঞার সুসমন্বয়েই কবিতার অন্তরাত্মা ও বহিরঙ্গের সৃষ্টি।
অজস্র রচনা প্রতিদিন মুদ্রিত হচ্ছে। আর অধিকাংশ কবি যশপ্রার্থীর ধারণা—যখন কোনো রচনা প্রকাশিত হয় মুদ্রিত অক্ষরে, তখন তার শিল্পমূল্য অবশ্যই থাকে। কিন্তু বাস্তবটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বক্তা যা ভাবেন, শ্রোতা তা গ্রহণ না-ও করতে পারেন। তেমনি লেখক যা বোঝাতে চান, পাঠক তার বিপরীত অর্থের সন্ধান করেন। এই ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ায় সৃষ্টি হয় উপলব্ধির সংকট।
এতক্ষণেও মনে হয় কবিতার সংকট কী, তা স্পষ্ট করা গেলো না। কারণ, কবিতার সংকট বোঝাতে গেলে, এর পারিপার্শ্ব, স্রষ্টা, রসপিপাসু, সমালোচকের চারিত্র্য সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন।
কবিতায় কবি দুই ধরনের সংকটে পড়েন। একটি নিজে বোঝার, অন্যটি অন্যকে বোঝানোর। যারা লেখেন, তাদের দাবি, কবিতা বোঝার বিষয় নয়, অনুভবের। যারা এর রসপিপাসু, তাদের অভিযোগ—যা বোঝার নয়, তা অনুভবেরও যোগ্য নয়। উভয়পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। প্রথম পক্ষের যুক্তি অনেকটা আপেক্ষিক, তাতে বাস্তবতার চেয়ে স্বার্থপরতার পরিমাণ কিঞ্চিত বেশি। দ্বিতীয়পক্ষের যুক্তির ভেতর রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা। স্বার্থপরতা এই অর্থে যে, এই শ্রেণীর কবিরা কারও অভিরুচির প্রতি সম্মান দেখাতে চান না। কেবল নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চান। আর বাস্তবতা এই অর্থে যে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য রয়েছে প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা-সংকেত। একই ভাষাভাষী-সংকেতভুক্ত গোষ্ঠীর মধ্যে এক জনের লিখিত বক্তব্য কিংবা সংকেত অন্যজন না বুঝলে দায়টা আসলে বক্তা-সংকেতদাতার, শ্রোতা-পাঠক-সংকেতগ্রহীতার নয়।
এই বোঝা ও না-বোঝার ব্যাপারটা একটু জটিল প্রকৃতির। ভাষা-সংকেত পাঠক বা সম্ভাব্য-সংকেতগ্রহীতা না বুঝলে বক্তার উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। এতে পাঠক বা সংকেত-গ্রহীতার চেয়ে বক্তা-সংকেত প্রেরকের ক্ষতি বেশি। এমন জটিল পরিস্থিতিতে প্রায় পাঠক-সংকেত গ্রাহক দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তোলেন কবি-সংকেত প্রেরকের বিরুদ্ধে। তবে এই দুর্বোধ্যতা আপেক্ষিক। কারণ, ভাষা-সংকেত মূলত ভাব আদান-প্রদানের মৌলিক মাধ্যম। অর্থাৎ পরস্পরের ভাবনাবিনিময়ের মূল মাধ্যম এই ভাষা-সংকেত। অবশ্যই ব্যক্তি যখন নিজেদের মধ্যে ভাবনা-বিনিময় করবেন, তখন উভয়পক্ষেরই অভিন্ন ভাষা-সংকেত হতে হবে। একজন ফরাসি বলবেন, অন্যজন ইংরেজিতে বুঝতে চাইবেন, তাহলে উভয়েই ভাবনার আদান-প্রদানে ব্যর্থ হবেন। একই শর্ত প্রযোজ্য কবি-পাঠক উভয়ের ক্ষেত্রেও। কবি যে ভাষা-সংকেতে লিখবেন, পাঠককেও ওই একই ভাষা-সংকেতেরগ্রাহক হতে হবে।
অভিন্নভাষা-সংকেতের প্রসঙ্গ যখন উঠলো, তখন এ-ও মনে রাখতে হবে—কবিরও নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড ও নিজস্ব ভাষা-সংকেত রয়েছে। অবশ্যই কিছু ব্যতিক্রম বাদে। পরাধীন রাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া কবির নিজস্ব ভূ-খণ্ড না-ও থাকতে পারে। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের পাশাপাশি কবিকে হতে হয় কালসচেতনও। তার স্থান-ভাষা-সংকেতের সঙ্গে-সঙ্গে কালিক চেতনা কবিতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। স্থান, কাল, ভাষা ও সংকেত—এই চারের সুসমন্বয়ে কোনো একব্যক্তির রচনা হয়েও কবিতা পরিণত হতে পারে সর্বজনীন সম্পদে।
এতক্ষণেও মনে হয় কবিতার সংকট কী, তা স্পষ্ট করা গেলো না। কারণ, কবিতার সংকট বোঝাতে গেলে, এর পারিপার্শ্ব, স্রষ্টা, রসপিপাসু, সমালোচকের চারিত্র্য সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন। কবিতার সংকট বলতে আসলে কী বোঝাতে চাই, এমন প্রশ্নের সোজাসুজি কোনও উত্তর আপাতত নেই। তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা বলা হবে, তার সারাংশ মোটামুটি এ রকম—কবির প্রস্তুতি, খ্যাতির মোহ; ছন্দ-অনুপ্রাস-অন্ত্যমিল; চিত্রকল্প, ভাষা-সংকেত; আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট; রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি, ভৌগলিক-কালিক সীমা রেখার আন্তঃসম্পর্ক যত সুনিবিড় হবে, কবিতাও হবে তত হৃদয়গ্রাহী, বিশ্বস্ত। কিন্তু এ সবের সঙ্গে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তবে কবিতার অপমৃত্যু অনিবার্য।
দুর্বোধ্যতা
আধুনিক বাংলা কবিতার আদিপাপ নিঃসন্দেহে দুর্বোধ্যতা। উত্তর-রৈবিক বাংলা কবিতায় দুর্বোধ্যতার জোরালো অভিযোগ ওঠে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণুদে প্রমুখ কবির বিরুদ্ধে। জীবনানন্দ দাশের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ খোদ রবীন্দ্রনাথই তুলেছেন। এক চিঠিতে জীবনানন্দকে তিনি লিখেছেন—‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই।–কিন্তু ভাষা প্রকৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।’ কারও-কারও মতে, এই মন্তব্য জীবনানন্দকে মূল্যায়নের পক্ষে সহায়ক। কিন্তু নির্মোহ বিচারে ধরাপড়ে, এই মন্তব্যে জীবনানন্দের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ দুর্বোধ্যতারই অভিযোগ তুলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো—রবীন্দ্ররীতির বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র স্বরসৃষ্টিতে মগ্ন জীবনানন্দকে দুর্বোধ্য মনে হলো কেন রবীন্দ্রনাথের? ওইসময়ে তো আরও দুজন কবি রবীন্দ্ররীতি-রুচি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। প্রথমজন কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিতীয়জন জসীমউদদীন। রবীন্দ্রনাথ এই দুজনের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তুললেন না কেন? কারণও স্পষ্ট। নজরুল-জসীমের কবিতার স্বর ভিন্ন হলেও অন্তর্গতসুর রবীন্দ্রানুসারীই ছিল। রোমান্টিকতা, দেশীয়মিথ, রূপকথা-উপকথায় পরিপূর্ণ নজরুল কাব্য-জসীমকাব্যের সঙ্গে রবীন্দ্রকাব্যের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একারণেই রবীন্দ্রনাথ এই দুইকবির বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তুলতে চাননি।
কেবল রবীন্দ্রনাথের চোখে নয়, অনেকের চোখেই সেদিন জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত প্রমুখ কবি দুর্বোধ্য। অথচ রবীন্দ্ররীতি থেকে স্বতন্ত্র হওয়া পরও সহজবোধ্য নজরুল-জসীম। কিন্তু কেন? নজরুল-জসীমের কবিতায় বাংলার পাশাপাশি আরবি-ফারসি-উর্দুর প্রচুর শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে। এ সব শব্দ বাঙালি রসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ফলে এই ধরনের শব্দপুঞ্জকে বাইরের মনে হয়নি তাদের। বাঙালির দাপ্তরিক-পারিবারিক কাজে এসব শব্দই ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। এছাড়া এই দুজনের কবিতার মিথ, চিত্রকল্প, উপমা গৃহীত হয়েছে হিন্দু পুরাণ, মুসলমান পুরাণ, রূপকথা, উপকথা থেকে। দুই কবির সৃষ্ট জগৎ বাঙালি পাঠকের চিরচেনা ভূমণ্ডল থেকে স্বতন্ত্রও নয়। ফলে এ সব শব্দ বুঝতে, গ্রহণ করতে ও জগৎ চিনতে পাঠকের কোনো সমস্যা হয়নি। বিপরীতে জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত-বিষ্ণুদে প্রমুখ কবি বাংলার পাশাপাশি গ্রহণ করেছেন গ্রিক মিথ, ইংরেজি শব্দ, ল্যাটিন পরিভাষা। শেষোক্তদের সৃষ্টজগৎ বাঙালির প্রায় অচেনা। আধো আলো, আধো অন্ধকারে দেখা অস্পষ্ট দৃশ্যের মতো।
আদিপাপের যেমন শুরু আছে, তেমনি আছে প্রবহমানতাও। কাল থেকে কালান্তরে তার বিস্তার। প্রথম আধুনিকদের মতো, বর্তমানকালের কবিদের বিরুদ্ধেও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠছে। তবে জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত প্রমুখ কবির বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ছিল একপেশে। কিন্তু এই সময়ের কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ যুক্তিনিষ্ঠ। প্রথমোক্তদের পাঠ-প্রস্তুতির কাছে, সেকালের পাঠকদের পাঠ-প্রস্তুতি ছিল যৎসামান্য। ফলে বিদ্যা-বুদ্ধি-বিশ্ববীক্ষায় অনগ্রসর পাঠকশ্রেণীর সামনে উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত কবির রচনা দুর্বোধ্য ঠেকার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু আজকের কবিতায় নতুন বক্তব্য, নতুন চিত্রকল্প না থাকলেও রয়েছে প্রায়-অসংলগ্ন বাক্য-অর্থহীন শব্দপুঞ্জের কসরৎ। যার অধিকাংশেরই ব্যাখ্যা স্বয়ং কবিযশপ্রার্থীরাই দিতে ব্যর্থ। অথচ তাদের এই অক্ষমতার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো রয়েছে অহমিকা। এ সময়ের কবিতাকে স্বয়ং কবিরাও দুর্বোধ্য বলতে পছন্দ করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এই রচনারাশি দুর্বোধ্য নয়, অবোধ্য। অর্থাৎ, আদিপাপী দেবতাদের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ কিঞ্চিৎ পরিমাণে সত্য হলেও, বর্তমানের কবিতার বিরুদ্ধে অবোধ্যতার অভিযোগ শতভাগ সত্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, বর্তমানের অধিকাংশ রচনায় কবিতার লেশমাত্র নেই। যা আছে, তা অবচেতন মনের অর্থহীন প্রলাপ, যার মর্মোদ্ধার স্বয়ং রচনাকারীও করতে ব্যর্থ।
অগভীর চিন্তা-অদূরদর্শী কল্পনার দাসত্বে আজকের কবি আচ্ছন্ন। বিশেষ করে তারা, যারা গত বিশ-বাইশ বছর ধরে কবিতা চর্চা করছেন।
এ প্রসঙ্গে আবুল ফজলের মন্তব্য স্মর্তব্য। ‘’কবিও কবিতা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, এই কবিতা দুর্বোধ্য। এই অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কবিদের মনে রাখতে হবে কোনো মহৎ কবিই দুর্বোধ্য নন—কিছুমাত্র দুর্বোধ্য নন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো কবিই শুধু নিজের জন্য কবিতা লেখেন না, লেখেন পাঠকের জন্য। তাই যত বেশি পাঠকের হৃদয়দ্বারে তিনি পৌঁছতে পারবেন, ততই তার কাব্য সার্থকতা লাভ করবে। কাজেই কবিকে তার নিজের কবিতার খাতিরেই সহজবোধ্য হতে হবে।’ তবে আবুল ফজল কেবল অভিযোগ উত্থাপন করেই থেমে যাননি। কবিদের পরামর্শও দিয়েছেন। বলেছেন,’কবিকে তার নিজের কবিতার খাতিরেই সহজবোধ্য হতে হবে।’ তার এ পরামর্শ নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কবির সৃষ্টি তো পাঠকের জন্যই। পাঠক যদি কবির ভাষা-সংকেত উপলব্ধিই করতে না পারেন, তাহলে সে সৃষ্টির মূল্য কী?
প্রথম আধুনিকেরা সংশয়ী ছিলেন। তাদের সংশয়ী চেতনা পরবর্তী সময়ের কবিদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, বিনয় মজুমদার, শঙ্খঘোষ, শক্তি চট্টপাধ্যায়, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, আবিদ আজাদ প্রমুখ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা-প্রভাব ছিল যথাযথ। কিন্তু গত বিশ-পঁচিশ বছর, বিশেষ করে শেষ দশ বছর সংশয়ী চেতনা হারিয়ে গেছে। বিপরীতে বাসা বেঁধেছে হয় গোঁড়ামি-উগ্রবিশ্বাস, না হয় অন্ধ-অবিশ্বাস। এই দুই দলের কেউ-ই যুক্তির ধার ধারেন না, তবে তর্কের ঝড় তোলেন চায়ের কাপে। উভয়পক্ষই কথা বলেন একইসঙ্গে, সমস্বরে। উভয়পক্ষই বক্তা, কেউ কারও কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না।
তবে বাঙালির বৃহত্তর অংশটি প্রশ্ন করে না, তর্কভীরু। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যেকোনো প্রথা বিনা প্রশ্নেই মেনে নেয়। যদি দেখে ওসব প্রথা মেনে নিলে তার কোনো আর্থিক, সামাজিক মর্যাদাহানি ঘটে না, উল্টো সমাজ থেকে নানা সুবিধা মেলে, তাহলে ওসব প্রথাকে সে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চায়। কারণ, বাঙালি এক আধবার ফোঁস করে জ্বলে ওঠে সত্য। তবে সেটা ষোলো আনা বুঝে-শুনে-জেনে নয়। তাদের ঘুমন্ত দশা থেকে জাগানোর জন্য এক-দুজন দূত কিংবা বংশীবাদকের প্রয়োজন হয়। না হলে তারা যেমনটি চলছিল, তেমনটিতেই স্বস্তি বোধ করে। তারা মেনেই নেয়, দাসত্বের শৃঙ্খল।
কবে কোন যুগে একজন নেতাজী সুভাষ বসু, একজন কাজী নজরুল ইসলাম, একজন বঙ্গবন্ধু তাদের আত্ম-সম্মানকে জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, সে যাত্রা তারা একটু খানি নড়েচড়ে বসেছে। বাকিজীবন ওই একই ভাঙা রেকর্ড শুনিয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রথা যেমন তারা মেনে নিতে পারে না, তেমনি পারে না, ভঙ্গুর জেনেও পুরনো প্রথাকে প্রত্যাখ্যান করতে। তারা সহজেই সম্মোহিত হয়। সহজেই প্রভাবিত হয়। এরমধ্যে সৃজনশীল বাঙালি শ্রমবিমুখ, দ্রুত খ্যাতি-প্রার্থী। ফলে বিপুল প্রস্তুতি, কঠোর সাধনায় তার আগ্রহ নেই তেমন। তারা অল্পজ্বালে সিদ্ধ হয়, ডুবেও অল্পজলে। তারা দেখে কেবল ছোট-ছোট ঢেউ, অল্প একটু আঁচ।
অগভীর চিন্তা-অদূরদর্শী কল্পনার দাসত্বে আজকের কবি আচ্ছন্ন। বিশেষ করে তারা, যারা গত বিশ-বাইশ বছর ধরে কবিতা চর্চা করছেন। তাদের বেশিরই ভাগই সহজপথে গন্তব্যে পৌঁছতে চান। তারা পাঠকের সঙ্গে সুক্ষ্ম প্রতারণা করছেন, অবোধ্য বাক্যগঠন, অর্থহীন শব্দপুঞ্জ জড়ো করে। অথচ কবিতা অপাঠ্য থাকার জন্য দোষ দিচ্ছেন পাঠকের ওপর। তাদের মনে রাখতে হবে, আগেই বলেছি—প্রথম আধুনিকদের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ এবং আজকের কবিদের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ একই অর্থ বহন করে না। প্রথম আধুনিকেরা যে পরিমাণশিক্ষিত-প্রস্তুতিসম্পন্ন ছিলেন, তাদের তুলনায় ওই সময়ের বৃহত্তর পাঠক শ্রেণীর প্রস্তুতিহীনতা ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু আজকের পাঠকের পাঠ প্রস্তুতির কাছে কবিদের প্রস্তুতিপ্রায়-শূন্যের কোঠায়। আজকের কবিতা কোনোভাবেই দুর্বোধ্য নয়, অবোধ্য। আজকের কবিদের কবিতা রচনার আগে, ছন্দ-অলঙ্কার, ভাষা-সংকেত সম্পর্কে আরও বিপুল পঠনপাঠনসহ প্রস্তুতি নিতে হবে। না হলে উত্তরকাল বা মৃত্যুর পরই নয় শুধু, জীবদ্দশায়ই তারা হারিয়ে যাবেন কালের ধূলায়।
আঙ্গিকের বৈচিত্র্য ও ছন্দ
সাহিত্যের যেকোনো শাখার মতো কবিতায়ও প্রয়োজন অর্থবোধক বাক্য গঠন। শুদ্ধ বানান, অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন ও স্তবক বিন্যাসের ফলেই একটি কবিতা পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে ছন্দের প্রয়োগও প্রয়োজন। ছন্দহীন বাক্যযুক্ত রচনা কাব্যিক হতে পারে, কিন্তু কখনো কবিতা হয়ে ওঠে না। কাব্যিক রচনা আর কবিতার মধ্যে তফাত কোনো ব্যক্তি ও ওই ব্যক্তির ছবির মতোই। একটি ছবি কোনো একজন ব্যক্তির পরিচায়ক হতে পারে, কিন্তু ওই ছবি দিয়ে ব্যক্তির মানবিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা মেটানো যায় না। সঙ্গত কারণে ব্যক্তির সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। তেমনি কবিতাকেও কবিতা-ই হতে হবে, কোনো রচনাকে কাব্যিক করে তুললেই তা কবিতা হয়ে যাবে না। হয়ও না।
এককালে কবি ছিলেন সর্বশাস্ত্রে জ্ঞানী। সর্বশাস্ত্র যিনি জানতেন, তাকেই কবি খেতাব দেওয়া হতো। এবং কবি ও পণ্ডিতকে অভিন্নার্থেই সমাজে গ্রহণ করা হতো। কবিরা রাজসভায় বসতেন এবং রাজাকে কবিতা শোনানোর ছলে নানা বিষয়ে জ্ঞানও দিতেন। রাজারাও কবিদের সমীহ করতেন, সমাদর করতেন। এর কারণ কী? কারণ একটাই। কবিরা সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন।
তাই নয়, কবিকেও আরও মনে রাখ হবে—হৃদয়বৃত্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাবল্য দেখা দিলে বুঝতে হবে, লোকটা কবিতা লিখতে আসেননি, জ্ঞানচর্চা করতে এসেছেন। অথবা সমাজসেবা করতে আসেননি, সমাজের নেতা হতে এসেছেন।
আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কবির শক্তিমত্তার পরিচয় মেলে। যিনি যত বড় শক্তিমান, তাঁর কবিতায়ও নিরীক্ষার তত প্রমাণ রাখেন। তবে, অবশ্যই, কবি প্রচলিত আঙ্গিক অনুসরণ করেই নিজের পথ হাঁটেন। এরপর ধীরে-ধীরে পরিবর্তন শুরু হয় তাঁর আঙ্গিকে। অগ্রজের দেখানো পথে হাঁটতে হাঁটতেই একদিন চিনে নেন নিজের পথ। তৈরি করেন, স্বতন্ত্র প্রান্তর—কেবল পথেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। কবিকে মনে রাখতে হয়, নিয়মের ভেতর থেকেই নিয়মের বন্ধনকে ছিন্ন করতে হয়। কবি জানেন, অচেনা জগতের নিয়ম না জানলে সে নিয়ম ভাঙাও সম্ভব নয়। নিয়মকে আত্মস্থ করেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব। সমীল পঙ্ক্তি ভেতরেও গদ্যের চাল দেওয়া সুকঠিন নয় তাঁর পক্ষে, আবার অমিল পঙ্ক্তির ভেতরও নিরূপিত তিন ছন্দের চাল-সুর ধরে রাখাও অসম্ভব নয়। এর জন্য জানতে হয়, কী করে একটি পঙ্ক্তির ভেতর পর্বগুলো সাজাতে হবে। পঙ্ক্তিভুক্ত পর্বগুলোর দৈর্ঘ্যসাম্য রক্ষা না করেও ছন্দের ভারসাম্য রক্ষা করে কী করে একটি কবিতায় আঙ্গিকের পরিবর্তন আনা যায়—তার সাধনায় কবিকে নিমগ্ন হতে হয়।
তবে আঙ্গিকের কঠোর নিয়ম কিংবা ছন্দের দাসত্বে কবিকে শৃঙ্খলিত হলে চলবে না। তাই কবি আঙ্গিকের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করবেন। তবে, তার আগে তাকে ঠিক করতে হবে—কী ধরনের কথা বলবেন, কোন ছন্দে বলবেন। গুরুগম্ভীর বক্তব্য প্রকাশের জন্য হালকা চালে ও সমপার্বিক অন্ত্যমিল সর্বস্ব স্বরবৃত্তে পঙ্ক্তি রচনা করলে বক্তব্য হাস্যকর বিষয়ে পর্যবসিত হবে। আবার লঘু বিষয়কে অসম পার্বিক অমিল পঙ্ক্তি যোগে লিখলেও একই ফল বয়ে আনবে। এজন্য কবিকে জানতে হবে কবিতার নিয়মকানুন। জানতে হবে ছন্দ, মাত্রা, আঙ্গিকের আন্তঃসম্পর্ক। একথা কে না জনেন—যেকোনো সমাজে যারা প্রচলিত আইন-কানুন মানেন না, তাদের অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। তাদের অপরাধের ধরন বুঝে শাস্তির আওতায় আনা হয়। কখনো-কখনো শাস্তি দিতে না পারলে তাদের প্রতি থাকে সমাজের সভ্যশ্রেণীর তীব্র ঘৃণা। তেমনি শিল্পে-সাহিত্যেও যারা দাবি করেন, কোনো নিয়ম মানবেন না, তারা ওই রাষ্ট্রীয় ভঙ্গকারী উগ্র-সন্ত্রাসীদেরই শ্রেণীভুক্ত। তাদের সঙ্গে জঙ্গি-উগ্রপন্থীদের কোনো তফাত নেই। উভয় শ্রেণীই সভ্যসমাজের ঘৃণার পাত্র।
এর জন্য কবিকেই ঠিক করতে হবে—কোন বিষয়কে তিনি কিভাবে উপস্থাপন করবেন। ছন্দ ও আঙ্গিকের সঙ্গে বিষয়বস্তু; এর সঙ্গে আবেগ-বুদ্ধিবৃত্তির সম্পর্ক বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। কবিতাকে কবিতা করে তুলতে হলে কবিকে মনে রাখতে হবে—বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তি বেশি হলে প্রেমিক হয়তো হওয়া যায়, কিন্তু সুস্থমস্তিষ্কের মানুষ হওয়া যায় না। যিনি বুদ্ধির ধারকে অস্বীকার করে, চিন্তার প্রাখর্যকে উপেক্ষা করে কেবল হৃদয়বৃত্তির নামে প্রলাপ আওড়াতে চাইবেন, আর যাই হোক তিনি কবিতা লিখতে পারবেন না। যাঁর আবেগ প্রজ্ঞার শাসনে নিয়ন্ত্রিত, বুদ্ধি মনকে প্রবোধ দেয়, আবেগকে করে তোলে সংহত, তিনি-ই প্রকৃত কবি। তাই নয়, কবিকেও আরও মনে রাখ হবে—হৃদয়বৃত্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাবল্য দেখা দিলে বুঝতে হবে, লোকটা কবিতা লিখতে আসেননি, জ্ঞানচর্চা করতে এসেছেন। অথবা সমাজসেবা করতে আসেননি, সমাজের নেতা হতে এসেছেন। এটা মনে রাখা জরুরি যে—কবিতা শেষপর্যন্ত কবিতা-ই। কবিতা কোনোভাবেই জ্ঞান প্রচারের মাধ্যম নয়। আবার সংসারের আর দশটা প্রয়োজনীয় বস্তুর মতো খুব দরকারি কিছুও নয়। আবার অদৃশ্য মুক্তবাতাস যেমন সরাসরি উপকারের প্রমাণ দিতে পারে না, কবিতাও অনেকটা সেরকম। এর প্রত্যক্ষ উপকারী কোনো দিক নেয়। সবই অপ্রত্যক্ষ। কিন্তু এ অপ্রত্যক্ষ দিক পরিষ্কার হয়ে উঠবে তখনই, যখন ছন্দবৈচিত্র্য ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করতে পারবেন। ব্যত্যয়ে কবিতাও আর দশটা সাধারণ ও তুচ্ছ বিষয়ের মতো সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক রুচিশীল মানুষের কাছে হাস্যকর প্রপঞ্চে পর্যবসিত হবে।
সর্বজনীনতার অভাব
কবিতার যত সংকট রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কবিতার সর্বজনীন রূপ অর্জন। কিন্তু একথা সত্য যে, কবিতা কখনোই সর্বজনীন হতে পারে না। হয়ও না। একথা বলা অসঙ্গত হবে না—জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস চর্চা-গবেষণার মতো সাহিত্য কখনো সর্বজনীন নয়; কবিতা তো নয়-ই। বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে বিশেষ শ্রেণীর জন্য রচিত। সাহিত্যও বিশেষ শ্রেণীর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রচনা করেন। পৃথিবীতে সর্বজনীন বলে আসলেই কি কিছু আছে? সর্বজনীনতা মূলত একধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি মাত্র। সমাজের-রাষ্ট্রের কোনো কিছুই সর্বজনীন নয়। কৃষি কাজ থেকে শুরু করে, কামার-কুমুরের কাজ, পিয়ন চাপরাশির কাজ থেকে শুরু জজ-উকিল-সচিব, এমপি-মন্ত্রী, রাজা-বাদশা—প্রত্যেকেরই কাজের নিজস্ব অঞ্চল রয়েছে। প্রত্যেকের কাজেরই রয়েছে বিশেষ উপকারভোগী শ্রেণী।
যখন যার যে বিশেষ বস্তু বা জিনিসের প্রয়োজন, তখন সে বিশেষ ব্স্তুটির সেবা নেয়। এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীর রুচিকে গ্রহণ করে না, আর এক শ্রেণীর বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানকে অন্য শ্রেণীর কাছে অন্তসারশূন্য-অযাচার বলেই মনে হয়। তবে কখনো-কখনো দায়ে পড়ে কিংবা বাধ্য হয়ে ক্ষমতাবানদের কোনো কোনো রীতি বা নিয়ম মেনে চলে। অথবা মনে মনে না মানলেও চুপ থাকে, প্রতিবাদ করে না। ঠিক এরকমই সাহিত্যও সর্বজনীন নয়। একান্তই তা শ্রেণী বিশেষের।
কী করে?–সাদা কথায় লিখিত সাহিত্য মাত্রই শিক্ষিতজনদের একাংশের জন্য। সব শিক্ষিতজন কিন্তু সাহিত্য পাঠে আগ্রহী নন। যারা আনন্দলাভের জন্য বাঈজী নাচ দেখার সুযোগ পান, কিংবা নিছক যৌনসম্ভোগকে আনন্দলাভের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেন, তারা কখনোই সাহিত্যের রস আস্বাদনে আগ্রহী হন না। এছাড়া, যারা সমাজের উচ্চবৃত্ত, রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে শুরু করে, দেশের প্রধানপ্রধান শিল্পকারখানার মালিক, পরিচালক, তারা সাহিত্যপাঠে যেটুকু সময় ব্যয় হবে, সে সময়কে অপচয় হিসেবেই ধরে নেন। তাদের সামনে, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের বইয়ের চেয়ে হিসাবের খতিয়ান অনেক প্রিয়; জরুরিও।
জন্য কেবল কবিকে সংবেদনশীল হলেই চলে না, পাঠককেও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়।
তাদের যদি পড়ার একান্ত প্রয়োজনই হয়, তাহলে তারা খবরের কাগজের রাজনৈতিক খবর, বাণিজ্যিক খবর, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খবরটুকু ধোঁয়াওঠা চা’য়ের কাপে চুমুক দিতেই পড়ে নেন। এর বাইরে ছাপার অক্ষরে কিছু পাঠের সময় কিংবা রুচি কিংবা প্রয়োজন আদৌ তাঁদের হয় না।
এ তো গেলো উচ্চবৃত্ত, ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ। এবার নিম্নশ্রেণীর কথা বলা যাক। একেবারের শ্রমিক শ্রেণী, অশিক্ষিত শ্রেণীর জন্য সাহিত্যপাঠ কেবল অসম্ভবই নয়, অপ্রয়োজনীয় এবং সময়ের অপচয় মাত্র।
তবে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো গল্প কেবল পাঠের বিষয় নয়। গল্প শোনারও বিষয়। একদা বাড়ির বারান্দা-উঠোনে বসে বাড়ির বয়োবৃদ্ধ, বৃদ্ধারা সবাইকে গল্প শোনাতেন। তখন মানুষের হাতে সময় ছিল প্রচুর। বিনোদনের বিকল্প কোনো উপকরণ ছিল না। কিন্তু এখন, বিনোদনের অজস্র উপকরণ রয়েছে। সেই গল্পজানা বৃদ্ধরাও আর নেই। যারা এখন বৃদ্ধ তারা রূপকথা-উপকথার রাজকন্যার গল্প বলার চেয়ে বাড়ির পাশের সোমত্ত কৃষাণীকন্যাটি প্রেমেই মজার পক্ষে। অতএব, গল্প শোনার দিনও শেষ।
তাই, টোটাল সাহিত্য যেখানে সবশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে নির্বাসিত প্রায়, সেখানে কাদের জন্য কবিতা?
সোজা কথা, কবিতা কেবল তারা-ই পড়বে, যাদের হৃদয়ে এখনো অসম্ভব কোনো বস্তুকে পাওয়ার বাসনা জেগে থাকে। যারা নিজের মনের ভেতর একটি কল্পজগতৎ তৈরি করে রাখেন, সে জগতে নিজের মতো করে দৃশ্য রচনা করেন, তাদের জন্য। বিশেষ করে যারা লেখালেখিকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের জন্যও।
শেষপর্যন্ত সত্যটা হলো—কবিতা কোনোকালেই সর্বজনীন ছিল না। এখনো নয়। কবিতা চিরকালই বিশেষ শ্রেণীর জন্য। বিশেষত যারা তীব্র আবেগে থরোথরো কাঁপতে ভালোবাসেন। যারা অগ্নিকুণ্ডে বসেও হাসেন পুষ্পের হাসি। এ কারণে এসব বিষয়কে আপাতত কবিতার সংকট হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, শেষপর্যন্ত বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। রসপিপাসুদের কাছে দুর্বোধ্যতা, আঙ্গিকের বৈচিত্র্য-ছন্দ ও সর্বজনীনতার অভাব—এসব বৈশিষ্ট্য কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত। এজন্য কেবল কবিকে সংবেদনশীল হলেই চলে না, পাঠককেও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়। তবেই আপাততদৃষ্টিতে কবিতায় যে বিষয়গুলোকে সংকট হিসেবে ধরা হচ্ছে, সেগুলোই রসপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটানোর প্রধান উপাদেয় অনুষঙ্গে পরিণত হবে।