আম, নারকেল, তেঁতুল আর সুপারি গাছের সারি পেরিয়ে দোতলা একটা পোড়োবাড়ি। বহু বছরের পুরনো অভ্যাসের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটির ইটগুলোর চুন-সুরকি খসিয়ে দিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। অনেকগুলো পরগাছা শেকড় বসিয়েছে আজ বহুবছর, স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে যেন। বাড়িটার চারপাশে শুকনো পাতার স্তূপ। বাড়ির ২৫-৩০টা জানালার মধ্যে তিনটা জানালার পাল্লা আছে, তাও নামমাত্র। বাড়িটার ঠিক পেছনে সিঁড়ি বাঁধানো বড় পুকুর। ব্যবহৃত না হতে হতে ঝোঁপ-জঙ্গল আর পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এত গাছপালা আর ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে সূর্যের আলো খুব অল্প পরিমাণেই সেখানে পৌঁছাতে পারে। এই আলো ছায়াঘেরা জায়গায় স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িটা গ্রামে ভুতুড়ে বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়িটা কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই, দুই চোখ যেদিকে যায় শুধু চাষের জমি চোখে পড়ে। এ বাড়ি নিয়ে লোকমুখে একটা গল্প প্রচলিত আছে।
অনেক অনেক বছর আগে এটা ছিল জমিদার বাড়ি। তখনো দেশ ভাগ হয়নি। কোলকাতার এক হিন্দু জমিদারের ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করে অন্য ধর্মের এক মেয়েকে। মুসলিম মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেয়নি জমিদার নীলরঞ্জন চৌধুরী। ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তিনি। জমিদারের ছেলে বাবার ওপর অভিমান করে চলে আসেন এই বসন্তপুর গ্রামে। কিনে নেন আম কাঁঠালের গাছসহ বিশাল জায়গা। দোতলা বাড়ির ঠিক পেছনেই বিশাল পুকুর কাটেন, ঘাট বাঁধিয়ে দেন গ্রামের সব মানুষের সুবিধার জন্য। খুব ভালো সময় কাটছিল তাদের।
জমিদার হিসেবে আশেপাশের গাঁয়ের লোকজন তাকে মানতে শুরু করে। গরিবের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেন জমিদার নির্মাল্য চৌধুরী। গোলাপ ফুলের খুব শখ ছিল তার। গোলাপের বাগান ছিল সর্বত্র। ছাদ, ঝুল-বারান্দা, পুকুর ঘাট এমনকি শোয়ার ঘরেও ছিল গোলাপের গাছ। গোলাপের মাতাল করা ঘ্রাণে নেশা হয়ে যেতো নির্মাল্য চৌধুরী। সেই নেশা প্রেয়সীকে ভালোবাসার নেশায় রূপান্তরিত হতো। তিনি বাড়ির নাম দেন গোলাপকুঞ্জ। সবকিছু স্বপ্নের মতোই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেলো৷ ডাকাত পড়লো গোলাপকুঞ্জে। সব ধন-সম্পদ নিয়ে যাওয়ার সময় সুন্দরী রানিকে ওরা কিছুতেই ছেড়ে গেলো না। নির্মাল্য চৌধুরী মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলো। পরদিন সকালে গোলাপকুঞ্জের পুকুরে পাওয়া গেলো রানির লাশ। নির্মাল্য চৌধুরী রানির মৃত্যু মানতে পারে না সহজভাবে, মানিসক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি, শেকল দিয়েও তাকে বেঁধে রাখা যেতো না।
ডালের জন্য রসুন কুচি শেষ করে পেঁয়াজ কাটতে শুরু করেছে, এমন সময় ইলিয়াস শেখের চিৎকার শুনতে পায় রেশমা। বটি একপাশে সরিয়ে সেজ মেয়ে রুমাকে চুলার পাশে বসিয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসে রান্না ঘর থেকে রেশমা
একদিন হঠাৎ শেকল ভেঙে ঘর ছেড়ে কোথায় চলে যায় তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে, শোনা যায় সন্ধ্যার পরপরই রানি মাকে গোলাপকুঞ্জের চারপাশে ঘুরতে দেখতো লোকে। রানি মরে ভূত হয়ে গেছে, এটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সেই থেকে ওই বাড়ির পথ আর কেউ মাড়ায়নি। ধীরে ধীরে ভূতের বাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে নির্মাল্য চৌধুরীর গোলাপকুঞ্জ।
আজ অনেক বছর পর সেই গোলাপকুঞ্জের দিকে ছুটছে মানুষ। সকাল-সন্ধ্যা ছুটছে। শুধু এ গাঁয়ের নয়, দূর গ্রাম থেকেও ছুটে আসছে মানুষ। পিঁপড়ার সারির মতো পিলপিল করে ছুটে আসছে। যেমন করে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে ভারতের দিকে ছুটেছিল মানুষ।
দুই.
একটু গরম ভাব পড়তে না পড়তেই চারপাশে জ্বর, হাম আর গুটিবসন্ত দেখা দিচ্ছে গ্রামে। রেশমা করলা ভাজি নামিয়ে মসুর ডাল সিদ্ধ বসিয়েছে চুলায়। ছোট মেয়েটা কালোজিরার ফোঁড়নের সঙ্গে আম-ডাল খুব পছন্দ করে৷ সকাল বেলা জমির শেখদের আমতলা থেকে ছোট কয়েকটা কাঁচা আম কুঁড়িয়ে এনে বলেছে, মা একটু আম ডাইল রানবা আইজক্যা?
ডালের জন্য রসুন কুচি শেষ করে পেঁয়াজ কাটতে শুরু করেছে, এমন সময় ইলিয়াস শেখের চিৎকার শুনতে পায় রেশমা। বটি একপাশে সরিয়ে সেজ মেয়ে রুমাকে চুলার পাশে বসিয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসে রান্না ঘর থেকে রেশমা। কাপড়ের আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জানতে চায়, আপনের না পরশু আসনের কতা আছিল?
দুই দিন আগে আইসা তোরে খুব ঝামেলায় ফালাইয়া দিলাম মনে অয়? তয় যাইগা, পরশুই আসমুনে। এ কথা বলেই ইলিয়াস শেখ ব্যাগ হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, কী কন এইসব আপনে? আমি কি তাই কইলাম? জিগাইলাম এমনি।
-যা যা সইরা যা সামনের তন। খাড়াইয়া খাড়াইয়া মুদ্দা করিস না। মুদ্দা করা মাইয়া মানুষ আমার সইয্য অয় না।
-রূপা তোর বাজানরে বাতাস দে, পাখাডা নিয়া শিগগিরই আয়। মেয়েকে এসব কথা বলতে বলতেই রেশমা স্বামীর জন্য টিউবওয়েল থেকে ঠাণ্ডা পানি আনতে যায়।
ইলিয়াস শেখ পানির গ্লাস মুখের কাছে নিয়েই রেশমার গায়ে ছুড়ে মারে, মাগি, তোর পানি তুই খা। গেলাসে কাঁচা পিঁয়াজের গন্ধে বমি আহে। ও আমারে আইছে পানি খাওয়াইতে।
রেশমা কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তো নতুন নয় এই ব্যবহার। ১৬ বছর বিয়ের বয়সে এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা। রেশমা চুপ করে রইলো। ও জানে, এখন কথা বললেই তাকে মারধর করবে ইলিয়াস। শরীরে আর সহ্য হয় না, মানুষ তো! রেশমারও যে ব্যথা লাগে, তা বোঝে না স্বামী বা শাশুড়ি; দুজনের কেউ-ই।
১৫ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিল এ বাড়িতে রেশমা। সৎ-মায়ের খারাপ ব্যবহার থেকে মুক্তি পাচ্ছে জেনে বিয়েতে আনন্দের সীমা ছিল না তার। কিন্তু তার ভাগ্যে যে সুখ নেই, তা বুঝেছিল বিয়ের পরেরদিন সকাল থেকেই। ভাগ্য রেখে কোথায় যাবে সে, সবই ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলা!
রেশমা চুপচাপ রান্না ঘরে চলে আসে। রুমাকে পাঠায় বাবাকে পানি দেওয়ার জন্য। ডাল সিদ্ধ হয়ে এসেছে। হলুদ লবণ দিয়ে ডাল ঘুটে পানি দিয়ে দেয় পরিমাণ মতো। কয়েট টুকরো রসুন কুচি আর কাঁচা মরিচের ফালি ছেড়ে দেয় ডালের পানিতে। নামানোর আগে কালোজিরা ফোড়ন আর আমের টুকরো দিয়ে নামিয়ে নিলেই হবে। আম বেশি আগে দিলে ডাল টক হয়ে যায়, কেউ খেতে চায় না। এরমধ্যেই শাশুড়ি চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। রেশমা হাসলো মনে মনে। যেন এর অপেক্ষায় ছিল সে। মা-ছেলে মিলে গায়ে হাত না তোলা পর্যন্ত শান্ত হবে না পরিবেশ। প্রতিবেশীরা সবাই বলে, রেশমা তুই তো চুপ কইরা থাকবার পারোস! এত মুখে মুখে তর্ক করোস ক্যান? আবার কেউ কেউ বলে, মুখের জন্যই তো মাইর খায়। ইলিয়াস কি এমনি এমনি মারে? আমরা ছোড বেলা থাইক্যা ইলিয়াসরে চিনি, কোনো খারাপ কিছু দেহি নাই কোনোদিন৷ তোর দোষ না অইলে ইলিয়াস মারে না।
আবার কেউ ফোড়ন কাটে, ইলিয়াসের কোনো বাইরের মাইয়া মাইনষের দোষ নাই, মদ খায় না, গ্যাঁজা খায় না, খাবারে কষ্ট দেয় না, কাপড়ে কষ্ট দেয় না। খারাপ কিসে ইলিয়াস? পুরুষ মানুষ একটু আধটু মারলে কী অয়? মুখখান বন্ধ রাখলে তো আর মাইর খাওয়া লাগে না বাপু!
আমারে দিয়া কাম করানোর সময় মনে আছিল না? একটু জিরাবার দেন নাই। জিরাইলেই কইছেন, অবেই তো ওই মাইয়ার ছাতা। অত ঢং কইরা কী লাভ? আপনাগো মা-পুলার জন্যই আমার পুলা মরছে।
তাই রেশমা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে চুপ করে থাকবে। কোনো কথা বলবে না। এই তো পনের দিন হলো, একটা মরা ছেলে জন্ম দিয়েছে রেশমা, শরীরের দুর্বলতা এখনো কাটেনি। সেই অপরাধের শাস্তি এখনো শরীরটা জানান দিচ্ছে। আর ব্যথা সহ্য করতে পারে না রেশমা। তাই যা খুশি হোক, আজ কোনো কথার উত্তর সে দেবে না।
-কোন দেশের জমিদারের মাইয়া আনছোস বাজান? কাম কইরা হপ্তাহ পর বাড়ি আইসাও এক গ্লাস পানি পাওয়ার কপাল তোর নাই। সবই আমার কপালের দোষ! বিয়াই পোলারে বিদ্যাশ নেবে আশা কইরা যে ভুল কাম করছি, তার খেসারত দিয়া যাইতে অইবে সারাজীবন রে বাজান। বিদ্যাশ নেওয়ার কোনো নাম নাই, ওইদিকে শ্যাল ৫টা জন্মানো সারা। এই শ্যাল ৫টা নামাইতে গেলেই তো আমার পোলার জীবন শ্যাষ। তা ও ওই মাগীর মাইয়ার দেমাক যায় না।
প্রায় প্রতিদিন এই কথাগুলো শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে রেশমার। একটা ছেলের আশায় পাঁচ মেয়ের মা হয়ে গেছে রেশমা। মেয়েগুলোও যেন কেমন ধরনের, মায়ের দুঃখ বোঝে না। কথা শোনে না, পড়ালেখায় একদম আগ্রহ নেই, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতেই থাকে। রেশমার যে এ সংসারে কোনো গুরুত্ব নেই, তা বুঝতে পেরেছে ওরা। তাই রেশমার কথারও কোনো মূল্য নেই ওদের কাছে।
কালোজিরা ফোঁড়ন দিয়ে রেশমা কয়েক টুকরো আম ছেড়ে দিলো ডালে। আজ সে কারও কথায় কান দেবে না। যে যাই বলুক। চুপচাপ রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে সে।শাশুড়ি এবার রান্না ঘরের দরজায় এসে শুরু করল, এই হারামির ঝি, তোর এত দেমাক কিসের? আমার পোলারে এক গ্লাস পানি খাওনের সময় নাই, তোরে কি রূপ দেহনের লাইগা আনছি? কাপড়ের গাট্টি নিয়া কত পথ ঘুইরা আইছে, কোনো মায়াদয়া নাই? সিমারের ঘরে সিমার। এমন মাইয়া জন্ম দিলো ক্যামনে? তোর মায়ের কবরের ওপর ঝাড়ুর বাড়ির দেওনের কাম।
রেশমা আর চুপ করে থাকতে পারে না। আর কত সহ্য হয়? সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে!-আম্মা, আমার মা’রে গাইলান কেন? হে কি দোষ করছে? আর আমি তো আপনার পুলারে পানি দিলাম, আপনার পুলাই তো পানি হালাইয়া দিলো। হুদাই আমার মারে টাইনা আইনেন না কইয়া দিলাম।
-কী? আমি হুদাই গাইলাই? আমিই ঝগড়া লাগাই? আমার পুলায় কষ্ট কইরা কামাই কইরা আনে, বইসা বইসা গিলোতো টের পাওনা। তুমি পুলার দরদ বুঝবা কেমনে, তোমার তো পুলা নাই। যা এডা অইলো, তারেও খাইয়া থুইছো। জন্মের সময় মারেও খাইছো, এমন রাক্ষস আমি কি দেইহা আনছিলাম গো আল্লাহ!
এবার রেশমার বাঁধ ভেঙে গেলো। পাঁচ মেয়ের পর রেশার একটা ছেলে হলো তাও আবার মৃত। এ যে কী যন্ত্রণার! দশ মাস শরীরের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল একটু একটু করে তার ছেলে, এ বংশ রক্ষাকারী। কিন্তু পাঁচ মেয়ের পর এবারও মেয়ে হবে ভেবে স্বামী, শাশুড়ির কাছ থেকে শুধু গঞ্জনাই পেয়েছে। ভালো কোনো খাবার নয়, না কোনো চিকিৎসা পেয়েছে।
অনেকবার স্বামীকে পেটের ব্যথার কথা জানিয়েছে রেশমা, গুরুত্ব দেয়নি কেউ। শাশুড়ির পানি পড়া আর তাবিজ ছাড়া আর কিছু ভাগ্যে জোটেনি। আর যখন মৃত ছেলের জন্ম হলো, তখন সব দোষ রেশমার। শাশুড়ি তো রাক্ষসী ছাড়া কথাই বলে না।
আহত বাঘিনীর মতো চিৎকার দিয়ে ওঠে রেশমা, আমারে আর একবারও রাক্ষসী কইবেন না কইয়া দিলাম। আমার সন্তানের জন্য আমার চেয়ে আপনার দরদ বেশি তাই না? আমারে দিয়া কাম করানোর সময় মনে আছিল না? একটু জিরাবার দেন নাই। জিরাইলেই কইছেন, অবেই তো ওই মাইয়ার ছাতা। অত ঢং কইরা কী লাভ? আপনাগো মা-পুলার জন্যই আমার পুলা মরছে।
-কী? কী কইলি তুই? আমার আর আমার পুলার দোষ? তোর ওপর আল্লাহর গজব পড়বো, চোরের মাইয়া চোর। মিত্যুকের মাইয়া মিত্যুক।
-গজব তো পড়ছেই আমার ওপর, যেদিন থেইক্যা এই বাড়িতে বউ অইয়া আইছি, সেদিনই।
-ওরে হারামির ঝি, আমরা তোর গজব? এ কথা বলেই রেশমার খোপা ধরে শুইয়ে দিলো রান্নাঘরের মেঝেতে। সারা শরীরে ব্যথা তার ওপর চুলে টান লাগায় জীবনটা বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শাশুড়ির হাত ধরে চুল ছড়ানোর চেষ্টা করলো রেশমা। শাশুড়ি গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে রেশমার চুল টেনে ধরলো। এবার রেশমা মরিয়া হয়ে শাশুড়ির হাত থেকে নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। হাতের নখ দিয়ে শাশুড়ির হাতে চাপ দিলো, ব্যথা পেয়ে চুল ছেড়ে দিল সে।
উঠানে হাত পা ছেড়ে কান্নাজুড়ে দিলো জমিলা বিবি-আল্লাহ গো, মাইরা ফালাইছে, কী রাক্ষস বউ আনছিরে আল্লাহ! তোরা কে কোথায় আছোস দেইখা যা আমার ভাগ্যের দোষ!
ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের হাতে নখের কাটা দাগ দেখে রাগে ফেটে পড়লো। রান্নাঘরের কোণায় সাজিয়ে রাখা কাঠ থেকে তুলে নিলো একটা। ইচ্ছেমতো পেটালো রেশমাকে, যতক্ষণ না রাগ কমলো ইলিয়াস শেখের। রেশমার গগনবিদারি চিৎকার শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা বুঝতে পারলো, ইলিয়াস বাড়ি ফিরে এসেছে।
কেউ কেউ এলো নাটকের শেষ দৃশ্যের মতো-ছিঃ ছিঃ রেশমা, শাশুড়ি হলো মায়ের মতো। তার গায়ে কেউ হাত দেয়? তোর স্বভাবের জন্য তুই এত মাইর খাইলি তোর ঘেন্না অইলো না।
পারেন সমাধানের ব্যবস্থা করতেও। বিনিময়ে কিছুই চান না তিনি। খুশি হয়ে যে যা দিতে চায়, তা ভালোবেসে গ্রহণ করেন। কারণ ভালেবাসার উপহার ফিরিয়ে দিলে খোদ সৃষ্টিকর্তাও যে নারাজ হবে!
একজন আবার বলে উঠল, এতদিন পর স্বামী বাড়ি আইসা একটু শান্তি পাইলো না। এরপর পুরুষ মানুষ আরও বিয়া করলে তাগো দোষ অয়। এ কথা শুনে জমিলা বিবি শক্তি ফিরে ফেলো। কান্না থামিয়ে বললো, আমার পুলারে আবার বিয়া করামু। আমার নাতি লাগবো, বংশ রক্ষা করার জন্য। যার পুলা জন্মাবার মুরোদ নাই, খালি আছে চোপা, তারে বসাইয়া বসাইয়া আর খাওয়ামু না।
তিন.
ইলিয়াস শেখের বাড়ি সেদিনের পর থেকে বেশ থমথমে। রেশমার সৎ মায়ের ঘরে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই বলে প্রতিবারের মতো এবারো মুখ বুজে পড়ে রয়েছে ইলিয়াস শেখের সংসারে। জমিলা বিবি চাল, ডাল, নুন, তেল ভাগাভাগি করে নিয়ে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করেছে আজ কয়েকদিন হলো। দুজন দুজনের মুখ দেখাও বন্ধ করেছে। প্রতিবারের মতো এবারও গ্রাম ঘুরে ঘুরে রেশমার গায়ে হাত তোলার কথা বলেছে, সবাই রেশমার নামে ছিঃ ছিঃ করলে শান্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। ঘটকও লাগিয়েছে, ছেলেকে আবার বিয়ে দিয়েই শান্ত হবে সে। তার স্বামীর বংশরক্ষা হবে না, তা সে কিছুতেই মানতে পারবে না।
কিন্তু আজ হঠাৎ করেই পরিবেশ অন্য দিকে ঘুরে গেলো। অনেকদিনের গুমোট শেষে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া। জমিলা বিবির ভাই এসেছে, অনেক বছর পর। বিবাগী মানুষ, সংসার কর্মে মন নেই তার। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। মাথার তেলতেলে চুলগুলো কাঁধ পার হয়ে পিঠে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। সাদা লুঙ্গি, ফতুয়া৷ গলায় সাদা ওড়না পেঁচানো। তার আসায় আজ এ বাড়ির হাওয়া বদলে গেলো এক নিমিষেই। তার আনা খুশির খবরটা আনন্দকে বাড়িয়ে দিলো শতগুণ। জমিলা বিবি যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেলো।
সোনাদিয়ার পাশের গ্রাম বসন্তপুর। অথচ এমন খবর তারা পায়নি বলে খুব দুঃখ করতে লাগলো। জমিলা বিবির সারাক্ষণ একই চিন্তা, বংশরক্ষা! তার একমাত্র ছেলে ইলিয়াসের ঘরে এক এক করে পাঁচ পাঁচটা মেয়ে জন্ম দিয়েছে ছেলের বউ। তার স্বামীর পরিচয় শেষ হয়ে যাবে এখানেই, মুছে যাবে অস্তিত্ব। এটা কিছুতেই হতে দিতে পারে না জমিলা বিবি।
-বুজি, আমারে তুমি চোখ বুইজা বিশ্বাস করবার পারো। সংসার করলাম না, পথে পথে ঘুইরা বেড়াই সত্যর সন্ধানে। আমি তোমারে মিছা কতা কইলে জিব জানি খইসা পড়ে।
-কী কস ভাই তুই? তোরে বিশ্বাস যামু না, তাইলে কারে বিশ্বাস যামু? তুই আমার মায়ের পেডের ভাই দেইহাই তো আমার কতা ভাবছোস!
-পাঁচ ছয়দিন আগে গোলাপকুঞ্জে এক দরবেশ বাবার আগমন ঘটেছে। কোলাহল, শব্দ তিনি পছন্দ করেন না। বেশি কথা বলেন না। সবচেয়ে বড় কথা যেটা, তিনি চোখ বন্ধ করেও দেখতে পান। তাই দিনের সারাটা সময় তাকে চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখা যায়। তার সামনে বসা মানুষটার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ-সব বলে দিতে পারেন। পারেন সমাধানের ব্যবস্থা করতেও। বিনিময়ে কিছুই চান না তিনি। খুশি হয়ে যে যা দিতে চায়, তা ভালোবেসে গ্রহণ করেন। কারণ ভালেবাসার উপহার ফিরিয়ে দিলে খোদ সৃষ্টিকর্তাও যে নারাজ হবে!
দরবেশ বাবার সবচেয়ে বড় সাফল্য, তার চিকিৎসায় ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছে বহু মা। এই খবরে আজ ইলিয়াস শেখের বাড়ি আনন্দের বন্যা।
-বউডারে ডাহো বুজি, আর ইলিয়াসের কাছে জিগাইয়া নিও।
-ইলিয়াস তো বাড়িতে নাই রে ভাই। কাপড়ের গাট্টি নিয়া চরে গেছে, দুই তিনদিন পরে আইবো। তুই বয় আমি বউরে নিয়া আসি।
বংশরক্ষা হতে চলেছ, এই আনন্দে সব ঝগড়া বিবাদ ভুলে শাশুড়ি বউকে আদর করে ডাকতে শুরু করে। ডাকের মধ্যে এমন কিছু ছিল, অবাক হয় রেশমা। এ কোন শাশুড়িকে দেখছে রেশমা। এ মানুষটা ভালো করে কথা বলতে জানে তাহলে!
শাশুড়ির আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে রেশমার। কাপড় বদলে বের হয়, হাঁটতে থাকে শাশুড়ির পিছু পিছু। দরবেশ বাবা কেমন হবে দেখতে, সত্যি কি তার চাওয়া পূরণ করতে পারবে? এসব ভাবতে ভাবতেই ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে পুরনো একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। এ বাড়ি নিয়ে বিভিন্ন রকম গল্প শুনেছে রেশমা। আজ সেই ভুতুড়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভয় নয় বরং ছেলের কথা ভাবতেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি ঘিরে ধরেছে রেশমাকে। ছেলে হলে স্বামী তাকে ভালোবাসবে, গায়ে হাত তুলবে না আর। ভাবতেই শিহরণ জাগে রেশমার। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছালো ওরা। আতর, গোলাপ জলের ঘ্রাণ বাড়িজুড়ে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো রেশমার এই তীব্র গন্ধে। আধো আলো ছায়াতে রেশমা দেখতে পেলো লাল লুঙ্গি পরা খালি গায়ে বসে আছে দরবেশ বাবা। গলার লাল রঙের গামছার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাথরের মালা থেকে আলো বের হচ্ছ। ঘাড় পর্যন্ত চুল আর চাপ চাপ দাঁড়ি দরবেশ বাবার। চোখ বন্ধ করে বসে আছেন বড় এক জল চৌকির ওপর। জমিলা খাতুনের ভাই ইশারা দিয়ে শব্দ না করার ইঙ্গিত দিলেন।
কথা বলতে বলতে ফকির বাবার হাত দুই একবার রেশমার স্তনগুলো ছুঁয়ে গেলো। শেষের দিকে ফকির বাবার হাত রেশমার পেট নয় বরং রেশমার স্তনকেই বেছে নিলো।
বাবার ধ্যান ভেঙে গেলে মুশকিল! ভাইয়ের দেখাদেখি জমিলা খাতুনও রেশমাকে নিয়ে নিঃশব্দে বসে পড়লো মেঝেতে। ঘরে অসহ্য নীরবতা, আতর আর ধুপের ঝাঁঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে রেশমার। নীরবতা রেশমার গায়ে চাবুক মারছে যেন, ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। কতক্ষণ যে এভাবে বসে আছে রেশমা খেয়াল নেই, এমন সময় হঠাৎ করে ভরাট গলায় বলে উঠলেন বাবা, পাঁচ মেয়ে, বংশ রক্ষার চিন্তা! উফ তোদের সংসারে এত অশান্তি কেন রে মা! চোখ বন্ধ করে দরবেশ বাবা কথাগুলো এমনভাবে বললেন, যেন সব দেখতে পাচ্ছেন তিনি। ভিডিও ক্যামেরা কেউ অন করে দিয়েছে সামনে। দোতলার পশ্চিম দিকের ছোট রুমটাকে দরবেশ বাবার থাকার উপযোগী করে সাজানো হয়েছে। প্রথম রুমটাকে করা হয়েছে হলরুম। সেখানে এত মানুষ যে পা ফেলার জায়গা নেই। রেশমার মামা শ্বশুর দরবেশ বাবার খুব কাছের মানুষ বলে সরাসরি বাবার ঘরে নিয়ে এসেছে।
দরবেশ বাবার আলো আঁধারের কক্ষেও জমিলা খাতুনের ভক্তিতে গদগদ চেহারা যে কারও চোখে পড়বে। জমিলা খাতুনের ভাই দয়াল, বোনকে হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে, বুঝিয়ে দেয়, দেখেছিস বুজি কইছিলাম না!
রেশমার অবাক চোখে হাজারো প্রশ্ন খেলা করছে। দরবেশ বাবা চোখ খুললেন। ভাইয়ের ইশারায় জমিলা খাতুন ধপ করে দরবেশ বাবার পায়ের ওপর সিজদা করলেন। শাশুড়ির দেখাদেখি রেশমাও। যদিও রেশমার সিজদা দিতে খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, না দিয়ে উপায় ছিল না আর।
-মেয়েরা হলো মায়ের জাত। আমি তাদের সম্মান করি। কিন্তু মেয়েরাতো বংশরক্ষা করতে পারে না, পারে কি মা জননী?
জমিলা খাতুন নিঃশব্দে দুদিকে মাথা নাড়ালেন
-বাবা-মা মারা গেলে একটা মেয়ে কি তাদের জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারে? পারে না। কবর খুড়তে পারে? পারে না। কবরে নামতে পারে লাশ নিয়া? পারে না। মেয়েরা হলো শো-পিস-এর মতো স্বামীর ঘরে শোভা বর্ধনকারী। বংশরক্ষা করার জন্য ছেলে সন্তান দরকার।
দরবেশ বাবার কথায় রেশমার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। তার ছেলে জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। মেয়েদের কেন আল্লাহ এত কম ক্ষমতা দিয়ে তৈরি করেছে! রেশমা ভেবে পায় না এর উত্তর। দরবেশ বাবার কথা গ্রামের মানুষের মতো নয়। কী সুন্দর উচ্চারণ তার! কণ্ঠে এমন কিছু আছে, যা ভয় বা শ্রদ্ধা করতে বাধ্য করে। ফারিয়ার কথাগুলোও এমন সুন্দর। হঠাৎ করে ফারিয়ার চেহারাটা সামনে ভেসে উঠলো। সম্পর্কে ভাসুরের মেয়ে হয় রেশমার। একটা স্কুলে পড়ায়। স্বামী গায়ে হাত তুলতো বলে তাকে ছেড়ে চলে এসেছে। একা থাকে, কত স্বাধীন। কখনো মেয়ে বলে নিজেকে ছোট ভাবে না সে। ফারিয়া একদিন কী সব বলেছিল, ছেলে না হওয়ার জন্য নাকি কোনো মেয়ে দায়ী নয়। যদি কেউ দায়ী হয়, তাহলে সেটা পুরুষরাই। কিন্তু মেয়েদের কেন তাহলে দোষ দেওয়া হয় বোঝে না রেশমা। হয়তো ফারিয়া সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল রেশমাকে তাই ওসব গল্প বলেছিল। এক অন্যরকম মনের জোর ফারিয়ার। ফারিয়া বলে, মেয়েদের দিয়ে যেমন সব কাজ হয় না, তেমনি ছেলেদের দিয়েও তো সব কাজ হয় না। ছেলরা কি কোনোদিন সন্তান জন্ম দিতে পারবে? পারবে না। আল্লাহ সব মানুষকে আলাদা আলাদা কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। কারও সঙ্গে কারও তুলনা করা উচিত নয়।
ফারিয়ার কথা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো, একটা ফুরফুরে হাওয়া ছুঁয়ে গেলো রেশমার শরীর।
-এই দয়াল, আমার মাকে এদিকে নিয়ে আয়। একটা ভারী গম্ভীর চেহারার শব্দে ফারিয়ার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো রেশমা। দয়াল মামার সঙ্গে বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো রেশমা। দরবেশ বাবার হাতের ইশারায় দয়াল মামা ফিরে গেলো নিজের জায়গায়।
চোখ বন্ধ করেই রেশমার আঁচল সরিয়ে ফর্সা পেটে হাত রাখলেন বাবা। একটা শীতল হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো রেশমার শরীর। শীতল হাতটা রেশমার পেটে মৃদু চাপ দিলো। এরপর তার পুরো পেটে ঝড়ের গতিতে ফকির বাবার হাত ঘুরে বেড়ালো৷ ছেলে হবে তো, আমার মায়ের পেটে ছেলে হওয়ার সব নমুনা দেখতে পাচ্ছি! ছেলে এবার হবেই, কোনো চিন্তা নাই। কথা বলতে বলতে ফকির বাবার হাত দুই একবার রেশমার স্তনগুলো ছুঁয়ে গেলো। শেষের দিকে ফকির বাবার হাত রেশমার পেট নয় বরং রেশমার স্তনকেই বেছে নিলো। একবার মনে হলো লাফ দিয়ে উঠে পড়বে রেশমা। কিন্তু পারলো না, রেশমার শরীর আরও অবশ হয়ে এলো। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। শাশুড়ির দিকে একবার তাকালো রেশমা, চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে বসে আছে। বংশরক্ষার চিন্তায় নিমগ্ন সে। দরবেশ বাবার হাত এবার রেশমার পিঠ, মুখ সব জায়গায় সমানে চললো। রেশমার কাছে ঝাঁঝালো গন্ধটা হঠাৎ করে তীব্র মনে হলো। জ্ঞান হারিয়ে দরবেশ বাবার পায়ের কাছে পড়ে গেলো রেশমা।
দয়াল মামা চিৎকার দিয়ে উঠলো, ট্রিটমেন্ট শুরু হই গ্যাছে, ট্রিটমেন্ট শুরু হই গ্যাছে…