এই শহরে এখন রয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, প্রকাশক মনিরুল ইসলাম, প্রকাশক লুৎফুর রহমান চৌধুরী, লেখক হুমায়ুন কবীর ঢালী; এঁরা আমার প্রিয়জন। এঁরা যোগ দিয়েছেন বইমেলায়। এঁদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।
এই বইমেলার সূচনা তথা প্রথম বইমেলার কথাটা অবগত করতে চাই। কারণ, অনেকেই সেই ইতিহাস জানেন না বা ইতিহাস চাপা দেওয়া হয়েছে!
অটোয়া থেকে টরন্টো এলাম, ২০০৬-এর জুনে। যোগ দিলাম সাপ্তাহিক বাংলার রিপোর্টারে। অফিসের কাছাকাছিই একমাত্র বাংলা বই-এর দোকান অন্যমেলা। ঢাকার মাজহার-মাসুমদের অন্যপ্রকাশ, অন্যদিন, অন্যমিডিয়া, অন্যমেলা কানাডায়! বাহ কী চমৎকার!
টরন্টোতে অন্যমেলা চালু করেন মাসুম রহমান, পার্টনার ছিলেন সাদী আহমেদ। এখন মাসুম নেই। সাদী আহমেদ একাই চালান। তাকে বললাম, একটা বইমেলা করলে কেমন হয়? বইমেলার কথা শুনে চমকে উঠলেন। চমৎকার প্রস্তাব। অনেক দিন ধরে ভাবছেন তিনি। তার মনের কথা বলায় আরও বেশি উৎসাহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছেন না। সাহস, সহযোগিতা, সাহায্য সবই প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সাদী আহমেদ রাজি নন। এক পা এগুলে, তিন’ পা পেছান।
এদিকে, ঢাকা থেকে বেশ ক’জন বন্ধু প্রকাশক নিউইয়র্কে মুক্তধারার বইমেলায় আসবেন, ২০০৭ জুনে। তারাও কানাডায় আসতে আগ্রহী। ভিসার জন্য নিমন্ত্রণপত্র দরকার। প্রকাশকদের জন্য (লেখক হিসেবে বা পত্রিকার চেয়ে) বই-সংক্রান্ত নিমন্ত্রণ প্রাসঙ্গিক বেশি। তাই তাঁর শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু সাদী সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বললাম, ‘হল ভাড়া করার দরকার নেই। অন্যমেলার পাশে শক্তি দেবের অফিসের মাঝের খালি জায়গাটা ব্যবহার করতে পারেন। শক্তি দেবও সানন্দে রাজি আছেন। স্থানীয় লেখক-শিল্পীদের দাওয়াত করুন। না হয়, অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই হলো, ক্ষতি কী? আর আমাদের সাপ্তাহিক রিপোর্টার প্রয়োজনে বইমেলার পার্টনার হবে। সব ধরনের সহযোগিতা পাবেন। এমনকি ঢাকার লেখক-প্রকাশকও সহযোগিতা করবেন।’
এদিনে আমাদের পত্রিকার প্রকাশক আশরাফ হাসান নেপথ্যে থেকে যারপরনাই, প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। নিউইর্য়কের বইমেলায় যারা আসবেন, তাঁদের হাতে সময় নেই। ভিসা পেতে কমপক্ষে সপ্তাহ খানেক লেগে যায়। অনন্যার মনিরুল হক যোগাযোগ করলেন। কিন্তু সাদীর ‘দোনামোনা’ শেষ হচ্ছে না। তিনি টরন্টোর বাইরে উইন্ডসর গেছেন। ফোন দিলাম। বললাম, কাল শুক্রবার আমাদের কাগজ বের হবে। একটা নিউজ করে দিচ্ছি। প্রকাশকেরা আসতে চাচ্ছেন। আপনি রাজি হন। তিনি হ্যাঁ/না কিছুই বললেন না। কিন্তু নিউজ করে দিলাম। পরদিন বাংলা রিপোর্টার-এর শেষ পাতায় ছাপা হলো, ‘টরন্টোতে হতে যাচ্ছে বাংলা বইমেলা।’ এরপর থেকে বাংলারিপোর্টার প্রতিসংখ্যায় সচিত্র সংবাদ, প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন এমনকি বিশেষ সংখ্যাও বের করলো।
মেলার প্রচারে টরন্টোর বইপ্রেমিকদের বিপুল সাড়ায় মেলার স্থান পরিবর্তন করে ওকনোর এবং সেন্ট ক্লেয়ার ইস্টের ইন্টারসেকশনের চার্চ অব সেন্ট কলাম্বাস অ্যান্ড অল হ্যালোজ হল ভাড়া করা হলো ৩০ জুন ২০০৭-এ।
ড. আনিসুজ্জামান আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের ফোবানায়। ঢাকায় ফোন দিলাম। বললাম, স্যার আমরা কানাডায় প্রথম বারের মতো বইমেলা করছি। আপনি কি কষ্ট করে আসবেন? তিনি একবাক্যে সম্মতি দিলেন। প্রধান অতিথি হয়ে এলেন ড. আনিসুজ্জামান। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে প্রথমবার সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদ ছাড়া আর কোনো প্রকাশকই ভিসা পেলেন না। অবশ্য পরের বার অনন্যার মনিরুল হক যোগ দেন। দ্বিতীয় বইমেলায় প্রথান অতিথি হয়ে টরন্টো আসেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান। ইতোমধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনিও সানন্দে রাজি হলেন। কলকাতা থেকে সুনীলও টরন্টো এলেন বঙ্গ সম্মেলনে। কিন্তু সুনীল দা দু’দিন আগে জরুরিভিত্তিতে কলকাতা ফিরে গেলেন, কারণ স্বাতী বউদি হাসপাতালে! ফলে তিনি টরন্টো এসেও বইমেলায় যোগ দিতে পারলেন না!
তবু জমজমাট হয়ে উঠলো কানাডার প্রথম বাংলা বইমেলা! বইমেলা নেপথ্যে যারা সহযোগিতা করেন, তারা হলেন তৎকালীন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শাহেদ, বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার ও বিশিষ্ট লেখক মাসুদ খন্দকার, শিল্পী ও কথাশিল্পী সৈয়দ ইকবাল, বাংলা রিপোর্টার প্রকাশক আশরাফ হাসানসহ অনেকেই। স্থানীয় শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে তৎকালীন ডেপুটি প্রিমিয়র ও মন্ত্রী জর্জ স্মিথারম্যান, এমপি মারিয়া মিন্না, প্রফেসর যশেফ ও কর্নেল প্রমুখ।
ইতোপূর্বে নিউইর্য়ক, লন্ডন, সিডনি, টোকিওতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা বইমেলা হচ্ছে। এবার যুক্ত হলো টরন্টো। বইমেলা টরন্টোতে হলেও এতে অটোয়া, মন্ট্রিয়ল থেকেও লেখক পাঠক স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। একদিনের জমজমাট মেলা যেন অতৃপ্তিই থেকে গেলো।
একদিকে বই বিক্রি, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অংশ নেয়। নৃত্য-শিল্পী অরুণা হায়দারের ‘সুকন্যা’রা নাচে গানেমালা পরিয়ে বরণ করে নিলো প্রধান অতিথিকে। মঞ্চে উঠতেই উদ্বোধনী গান করলো শিল্পী চমন আরা বেগমের সাতসুরের ছেলে-মেয়েরা। লেখক রচিত ছড়া গানটি হলো:
এসো এসো বই পড়ি
স্বপ্ন সুখের জীবন গড়ি।।
বন্ধু বইয়ের তুলনা নেই,
বন্ধ দুয়ার আজ খুলে দেই
নতুন মাত্রা যুক্ত করি।।
বই জীবনের চোখের মণি
বইয়ের ভেতর জাদুর খনি,
আজ শুধু হোক হাতে খড়ি।
যাইহোক, পরিতাপের বিষয় এই যে, বারো বছরেও এই মেলা সর্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছেনি, পায়নি বইমেলার প্রকৃত মাত্রাও। আশা করি, ধীরে ধীরে তা অর্জন করবে। পূরণ করবে কানাডা প্রবাসী পাঠকদের প্রত্যাশা।