এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই প্রকাশিত হচ্ছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
না, পূর্বপরিকল্পনা থাকলেও এবারের বইমেলায় বই প্রকাশিত হচ্ছে না। বইটি ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। প্রচ্ছদ করেছিলেন আদিত্য অন্তর। তবে, এ বছরের কোনো এক সময়ে বইটি প্রকাশিত হবে। প্রবাস থেকে একুশে বইমেলায় বই প্রকাশের দিক দিয়ে একটি সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। সশরীরে মেলায় উপস্থিত না থাকতে পারাটা বিশেষ বেদনার হয়ে কাজ করে। তার মূলে আছে বইমেলায় পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকতে না-পারা।
সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সাধারণভাবে আমি বিষয়টিকে একটি প্রাণবন্ত উৎসব হিসেবেই দেখি। আর বিশেষভাবে বললে, একুশে বইমেলা হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক সবচেয়ে গর্বিত ও স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবমুখর মিলনমেলা। ভাষা-আন্দোলনকেন্দ্রিক একুশে বইমেলা এর স্বকীয়তায় পৃথিবীর অন্য যেকোনো বইমেলার সঙ্গে একটি মৌলিক ব্যবধান গড়ে তুলেছে। আমার মনে হয়, এভাবেই এই বইমেলা আরও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবে। সে হিসেবে মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আমি নেতিবাচক অর্থে দেখিনা। প্রথমত, এই সময়টাতে বাড়তি প্রাপ্তি হিসেবে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সরাসরি সংযুক্তির একটি সুযোগ ঘটে। দ্বিতীয়ত, প্রকাশকের বইকেন্দ্রিক বাণিজ্যের একটি সুযোগ ঘটে। আর এই বাণিজ্যের বিষয়টিকে কোনোভাবেই স্থূল করে দেখার সুযোগ নেই। প্রকাশকের গতিশীল বাণিজ্য ভালো ও নতুন বই প্রকাশের সহায়ক। তবে বাণিজ্যের কারণে যেন নিম্নমানের বই প্রকাশিত না হয়।
একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
পূর্বের কথায় ফিরে গেলে আবারও বলতে হয়, একুশে বইমেলা ভাষা-আন্দোলনের গর্বিত স্মৃতিকে উজ্জীবিত করে। এটি বাঙালি ও বাংলাদেশিদের একটি বিশাল আবেগের জায়গা। এই ভাষা-আন্দোলন বাঙালি ও বাংলাদেশি স্বাধীকার আন্দোলনের প্রথম বীজটি বপন করে, আর সেই পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান। সে হিসেবে, ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কবিতা ও সাহিত্যে অনেক কাজ হয়েছে। যদিও মানের বিচারে সে সংখ্যাটি প্রশ্নবিদ্ধ। ভাষা-আন্দোলন থেকে উৎসারিত একুশে বইমেলা অন্তত জাতি হিসেবে আমাদের পুরো একটি মাস দিয়েছে। যখন এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক ভালো বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেই বইগুলো আবার সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। আমার কাছে একুশে বইমেলা বাংলা সাহিত্যে আশাজাগানিয়া একটি উৎসব।
একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
একুশে বইমেলা তরুণ লেখকদের যতটা বই প্রকাশে উদ্যোগী করছে, প্রকাশকদের তরুণ লেখকদের বই প্রকাশে ততটা উদ্যোগী করছে না। সে ক্ষেত্রে প্রকাশকদের প্রতিষ্ঠিত লেখককেন্দ্রিক অত্যধিক ব্যবসাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতাই মূলত দায়ী। এর বিপরীতে তরুণ লেখকরা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তবে আমি মনে করি, সাহিত্য ও প্রকাশনা শিল্পে তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করার মতো কোনো ব্যাপার নেই, থাকাটিও যথার্থ নয়। কারণ, মেধা ও মানের যথার্থ বিচারে একটি লেখা ভালো হলে সেটি প্রকাশ পাওয়া উচিত। লেখককে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে যেকোনো প্রকাশনাই সে ভাষার সাহিত্যকে দুর্বল করে।
প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষযটাকে আপনি কী ভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
আমি এই কথাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে চাই না। প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতায় অনেকাংশেই সাহিত্যের মান খর্ব হচ্ছে। এটি শুধু যে বাংলা সাহিত্যে ঘটছে তা নয়, অন্য ভাষার সাহিত্যেও ঘটছে। যদিও বোদ্ধা পাঠকেরা মানসম্মত ও তাঁদের প্রত্যাশিত লেখাটি ঠিকই খুঁজে বের করছেন। তবে মান বৃদ্ধি না-ঘটার প্রধান এক কারণ হিসেবে আমি মনে করি, অনভিজ্ঞ প্রকাশকদের বিশেষ এক ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, একজন প্রকাশক জানেন না প্রকাশনা শিল্পে তাদের কী কী ভূমিকা থাকা উচিত। বলতে গেলে বাংলাদেশে কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কোনো অ্যাডিটোরিয়াল বোর্ড নেই। যে কারণে সহজেই অনেক স্থূল লেখাসর্বস্ব বই বেরুচ্ছে। প্রকাশনায় নীতিমালার প্রসঙ্গ এলে আমি বলব, এই অ্যাডিটোরিয়াল বোর্ডের উপস্থিতিকে আবশ্যক করা। আর প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতা হলেও মুদ্রণপ্রমাদ যেন এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার কারণ হিসেবে অযুগোপযোগী বাংলা সফ্টওয়্যার যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী বাংলা ব্যাকরণ ও বানান নিয়ে লেখকদের উদাসীনতা। এ ক্ষেত্রে বাংলা অ্যাকাডেমিরও রয়েছে ব্যর্থতা। উদাহরণ হিসেবে, সম্প্রতিক বাঙলা অ্যাকাডেমি কর্তৃক সব বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান-এ পরিবর্তন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সবশেষে, একটি ব্যাপার আমাকে অনেক ভাবায় যখন দেখি, বাংলাদেশে এখনও প্রকাশনা একটি শিল্প হয়ে গড়ে ওঠেনি। আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে, তার গড়ে ওঠার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে, আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনের মতো বিশাল দুটি ঘটনা আছে। যা আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে অনুপ্রাণিত করে। তাই আমি মনে করি, আমাদের এখন দেশটিকে গোছানোর সময় এসেছে। এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে মানসম্মত বইয়ের বিকল্প নেই। যার অনেকটা নিশ্চয়তা দিতে পারে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো, পারে এগিয়ে নিতে। সে কারণেই একটি প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।