[পর্ব-২৪]
আজকাল প্রায়ই অনেক রাত জেগে বই পড়ে রতন। যদিও ডাক্তারের কঠোর নির্দেশ দশটার পর কিছুতেই জেগে থাকা চলবে না তার। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে অবশ্যই। তুলিও পইপই করে ব’লে রেখেছে ময়নাকে, নয়টার মধ্যে রতনের খাবার দিতে। ময়নার তাতে ভুল হয় না খুব একটা। কিন্তু রতনকে ওষুধ দিতে তার ভুল হয়ে যায় মাঝে মাঝেই। যেদিন বেশি দেরী হয়ে যায়, ওষুধ খাওয়ার সময়টায় যেদিন বেশি তফাৎ হয়, সেদিনই সমস্যা হয় রতনের। ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই। দীপন বা তুলি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলে রতনের ওষুধ তারাই মনে করে খাওয়ায়। অন্যদিনে ময়না খাওয়ায়, নইলে রতন নিজে। নিজে যেদিন খেতে হয় তাকে ওষুধ, সেদিনই বিপত্তি বাধে। ওষুধ খেতে সে ভুলে যায়, কিংবা ভুলভালো খেয়ে ফেলে। কোনোটা হয়তো দুইবার খেয়ে ফেলে, কোনোটা আবার বাদই পড়ে থাকে। কোনোদিন আবার খাওয়াই হয় না একদম। দীপন বা তুলি কেউই বিষয়টা খেয়াল করে না। তারা জানে তাদের অনুপস্থিতিতে ময়না ঠিকঠাক ওষুধ খাওয়ায় রতনকে। কিন্তু ময়না রতনকে খাবারটা দিয়েই টিভি সিরিয়াল দেখতে বসে যায়। তখন আর কোনোদিকে হুঁশ থাকে না তার। তেমন হলে ওষুধটা রতনের আর খাওয়া হয় না ঠিকঠাক। পরদিন সকালে যদি ওষুধে কোনো অসামঞ্জস্য দেখে ময়না, সাবধানে অতিরিক্ত ওষুধ সরিয়ে ফেলে। যেটা বেশি খাওয়া হয় বুঝতে পারে, পরদিন সেটা বাদে অন্যটা দেয় দুটো খাইয়ে। তার ধারণা পাগলামি অতি কঠিন ব্যামো। যতই ওষুধ গেলাও, অযথা টাকা নষ্ট। তুলিকে সে আকার ইঙ্গিতে বলেও সে কথা। বলে, আফা, আপনেগোর উচিত ভাইজানরে পাগলা গারদে রাইখা আসা। খামোখা অশান্তি পালতাছুইন। সেইহানে থাকলে মেলা মাইনষের মইদ্যে ভাইজান যেমুন বালা থাইকপো, তেমুন আপনেরাও শান্তিত থাকপাইন আফা।
শুনে তুলি ধমকে থামিয়ে দেয় ময়নাকে। সংসার বড় কঠিন ঠাঁই। এখানে দূর্বল সব সময় চেষ্টা করে তারচে যে সবল তাকে টেনে তার পর্যায়ে নামাতে। ময়না তাই অবচেতনে চায় রতন তার পর্যায়ে নামুক। না-কি রতনকে সে তারচেও দূর্বল ভাবে, ভাবে করুণার পাত্র! তাই সে চায় তাকে আঘাত করার সুখ! ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুলি। জীবনকে চিনেছে সে আঘাতে, অপমানে, অবহেলায়। অন্যের পরিবারে সে ছিল আশ্রিত, অতিরিক্ত। তাকে আঘাত করে, অপমান করে, অনাদর আর অবহেলার কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত করে জীবন তাকে নিজেকে চিনেয়েছে প্রতিনিয়ত। তুলি জানে, এ সংসার, সমাজ, দূর্বলের উপর সদয় নয়, নির্দয়, নিঃষ্ঠুর। সবলের জন্য জীবন স্নেহভাণ্ড উজাড় করে দেয়। দূর্বলের সামনে মেলে ধরে করুণার ডালা, অপমানের অনাচার। রতনকে ভালোবাসে তুলিও। দীপনের ভাই হিসেবে, মানুষ হিসেবেও। মাঝে মাঝে রুমকীর ভবিষ্যৎ ভেবে সে উদ্বিগ্ন হয়, বিরক্ত হয় রতনের ওপর, দীপনকে সে তখন তাগাদাও দেয় বটে রতনকে পাগলা গারদে পাঠাতে, কিন্তু সে মন থেকে চায় রতন ভালো হয়ে উঠুক, সুস্থ হয়ে উঠুক। শান্তি ফিরে আসুক তাদের সংসারে। দীপনের মুখে মেঘ জমলে তার আকাশে বৃষ্টি হয়। সে চায় দীপনের মুখ নির্মেঘ থাকুক, আনন্দময় হোক দীপনের জীবন। তাহলে তার নিজের আকাশও থাকবে নির্মল, ঝকঝকে রোদে ভরবে তারও উঠোন। সে বা দীপন, তারাও আলাদা কেউ নয় আদতে। এক। শরীরে, মনেও।
দীপনটা গতরাতে দেশ ছেড়েছে। ইউরোপ। তার পৌঁছানোর খবরটা না পাওয়া অবদি দমবন্ধ লাগছিল তুলির, অস্থির। রুমকীটাও পাগল করে ফেলছিল তাকে। বাবার সাথে কথা হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই মেয়ের। আজ দুপুর নাগাদ তাদের কথা হয়েছে দীপনের সাথে। তারপর স্বস্তি। রুমকী ঘুমিয়ে গেছে। তুলির ঘুম আসে না কিছুতেই। দীপনকে ছাড়া তার ঘুমে সমস্যা হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। পাশে দীপন না থাকলে তার কেমন ফাঁকা লাগে, ভয়ও। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় তুলি। ঝকঝকে আকাশ। তারা ফুটেছে অজস্র। মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। হাসছে অমলিন। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা তবু কেমন খারাপ হয়ে যায়। দীপনটা কোথায় এখন? কতদূরে? সেখান থেকে সে কি দেখছে এই তারাভর্তি রাতের আকাশ? পরক্ষণেই মনে পড়ে, না তো। ইউরোপে এখন মাত্র বিকেল নেমেছে। দীপন হয়ত যাত্রার ক্লান্তি মুছতে ঘুমোচ্ছে এখন। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রতনের ঘরের দিকে চোখ যায় তুলির। বারান্দা থেকে দীপনের রুমটা দেখা না গেলেও জানালা গ’লে একফালি আলো যে নিচের খোলা জায়গাটাতে পড়েছে এসে, সেটা স্পষ্ট। কপাল কুঁচকে ওঠে তুলির। এখন রাত বাজে বারোটা প্রায়। ভাইয়ার ঘরে এত রাতেও আলো জ্বলছে কেন? তার তো দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার কথা! আলো জ্বেলে ঘুমোতে পারে না রতন, জানে তুলি। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে তুলি। তাদের বাড়িটা ডুপ্লেক্স। বাড়িয়ালা থাকেন দেশের বাইরে। তারা সস্তায় ভাড়া পেয়েছে। ভাড়ার টাকাটা প্রতিমাসে বাড়িয়ালার একাউন্টে জমা দিয়েই নিশ্চিন্ত তারা।
রতনের রুমের দরজা ভেজানো। চাপ দিতেই খুলে যায়। মূর্তিবৎ চেয়ারে বসে আছে রতন। টেবিলে খোলা একটা বই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় পড়ছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হলো তুলি, পড়ছে না। চোখ মেলে বসে আছে, নিঃস্পন্দ। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে তুলির। অমন করে বসে আছে কেন রতন? ভয়ার্ত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে দরজায় দাঁড়িয়েই প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে তুলি, ভাইয়া!
তুলির কণ্ঠে নড়ে ওঠে রতন। কেঁপে ওঠে শরীর। স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে তুলি। ঘুমোন নি কেন এখনো? –তুলির কণ্ঠে শাসন।
অদ্ভুত চোখে তুলির দিকে তাকিয়ে থাকে রতন। তুলি অস্বস্তিতে পড়ে, বিব্রত হয়। রতনের চোখের এই ভাষা তার চেনা। তাকে যখন চিনতে পারে না রতন তখন এভাবে তাকায় সে। এই দৃষ্টিতে থাকে অপরিচিতের সংকোচ, ভয় আর দ্বিধা।
ভাইয়া! আমি তুলি! দীপনের বউ!
দীপন! দীপন বিয়ে করেছে! ইশ! মা কিন্তু খুব বকবে!
দরজায় দাঁড়িয়ে পাথর হয়ে যায় তুলি। কী করবে ভেবে পায় না। সে কি নিজের রুমে ফিরে যাবে? দীপন বাড়িতে নেই, বাকী সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যদি কোনো বিপদ হয়? যদি হঠাৎ তাকে আক্রমন করে বসে রতন! দ্বিধা সরিয়ে দেয় তুলি। এসব ভাবার সময় নেই এখন। সে এগিয়ে যায় ঘরের মধ্যে। ওষুধের বক্সটা সাবধানে খোলে। চমকে ওঠে তুলি। ওষুধের পাতাগুলো তেমনই আছে। খায় নি রতন। গুনে দেখে তুলি। প্রতিমাসের এক তারিখে পুরো মাসের ওষুধ কেনে দীপন। আজ দশ। প্রতিটা ওষুধের থেকে অন্তত দু পাতা শেষ হওয়ার কথা। সকালে, রাতে। হয় নি। একটা পাতার অর্ধেক ফুরিয়েছে। সব ওষুধের। মাথা ঘুরে ওঠে তুলির। তার মানে ময়না ঠিক মতো ওষুধ খাওয়ায় না রতনকে। মাস শেষে বাকী ওষুধ সরিয়ে ফেলে ময়না। আর দীপন না বুঝে মাস শেষে নতুন করে আবার একগাদা টাকার ওষুধ কিনে আনে। মাঝখান থেকে রতনের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আরও। অবস্থার অবনতি ঘটছে ধীরে ধীরে। বক্স থেকে প্রেসক্রিপশন দেখে রাতের ওষুধগুলো নিল তুলি। সাবধানে জল ভরল গ্লাশে। এগিয়ে গেল রতনের দিকে। নির্দেশের সুরে বলল, ভাইয়া, হা করুন তো!
বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রতন তুলির মুখের দিকে। তারপর হা করল বাধ্য ছেলের মতো। রতনের মুখে ওষুধ গুলো দিয়ে জলের গ্লাশ এগিয়ে ধরল তুলি। বলল, গিলে ফেলুন এবার।
তুলির বাড়িয়ে ধরা গ্লাশে চুমুক দিল রতন। প্রথম চুমুকে ওষুধগুলো গিলল। চোখ-মুখ বিকৃত করল একটু। তারপর গ্লাশের বাকী জলটা একচুমুকে ঢকঢক করে গিলল রতন। বড় একটা শ্বাস ছাড়ল স্বস্তির। বুকের ভেতরটা কেমন ভিজে উঠল তুলির। রতনের জন্য কষ্ট হলো ভীষণ। কী অসহায় দেখাচ্ছে তাকে! এতটা তেষ্টা বুকের ভেতর নিয়ে এতরাতে না ঘুমিয়ে এমন মূর্তি হয়ে বসেছিল লোকটা! অথচ টেরও পায় নি তেষ্টা পেয়েছে! দীপনকে মনে পড়ল। তার মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। অপরাধী লাগল নিজেকেই। তার ওপর ভরসা করে দীপন। তুলি খেয়াল রাখবে তার সবকিছুর, প্রাণমনে সে কথা বিশ্বাস করে সে। অথচ সে রতনের ওষুধের ভারটা ময়নার ওপর ছেড়ে কী করে নিশ্চিন্ত ছিল এতদিন! আর ময়না! সে-ই বা কী করে এমন অন্যায় করে চলেছে দিনের পর দিন! সব রাগ ময়নার ওপর গিয়ে জমল তুলির। সকালে তাকে দেখবে তুলি। কে জানে আর কোন কোন ব্যাপারে এমন যথেচ্ছাচার করে চলেছে সে!
এবার শুয়ে পড়ুন ভাইয়া। অনেক রাত হয়েছে।
আচ্ছা! –ঘাড় নেড়ে বিছানার দিকে এগোয় রতন।
আমাকে কি চিনতে পারছেন এখন?
লাজুক চোখে তুলির দিকে তাকায় রতন। হাসে। মাথা একদিকে হেলিয়ে বলে, পেরেছি তো। তুমি দীপনের বউ। কিন্তু মা শুনলে কী বলবে বল তো! খুব বকবে কিন্তু তোমাদের! দীপনটা বরাবরই এমন ফাজিল। কোনো ভয়ডর নেই। মাকে আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা ক’র না। তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে। মাকে বলব… চিন্তা ক’র না…
বিড়বিড় করতে করতে বিছানায় শুয়ে পড়ে রতন। চোখ বন্ধ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুলি। লাইট অফ করে ঘর থেকে বের হয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দেয় সাবধানে। সন্তর্পণে সিঁড়ি ভাঙে। মাথার মধ্যে জমা হতে থাকে ময়নার ওপর রাগ, দীপনের জন্য ভালোবাসা, রতনের জন্য উদ্বেগ আর নিজের প্রতি অপরাধবোধের গ্লানি।
চলবে
পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২৩॥ শিল্পী নাজনীন