আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প লেখক সিলভিয়া প্লাথ ১৯৩২ সালের ২৭ অক্টোবর অ্যামেরিকার ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন। রহস্যময় ও বিষণ্ন কবি হিসেবে তিনি সবসময় পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন বলা যায়। জ্যামাইকার একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেওয়ায়ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি হয়। মাত্র সাড়ে আট বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। মা অরেইলিয়া স্কুবের (১৯০৬-১৯৯৪) অস্ট্রিয়া থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান ছিলেন। বাবা অট্টো প্লাথ (১৮৮৫–১৯৪০) এসেছিলেন জার্মানির জাব্রো থেকে। তিনি ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং একজন কীটবিজ্ঞানী। প্লাথের মা ছিলে তার বাবার চেয়ে ২১ বছরের ছোট।
১৯৪০ সালে সিলভিয়ার আট বছর বয়সে তার জার্মান বাবা অটো এমেলি প্লাথ ক্যান্সারে মারা যান। বাবার মৃত্যুতে সিলভিয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অথচ বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘৃণার এবং ভালোবাসায় মেশানো ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে লিখিত তার ‘ড্যাডি’ কবিতা থেকেই সেটাই মনে করা হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে অত্যাধিক ঘুমের ওষুধ খেয়ে সিলভিয়া একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালান। পরে অবশ্যই ১৯৬৩ সালে এক প্রচণ্ড শীতের রাতে ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করেন।
সিলভিয়া ১৯৫৬ সালে কবি টেড হিউজকে বিয়ে করেন। এই সময় তারা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করলেও পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান ফ্রায়েডা হাজেস এবং নিকোলাস। প্লাথ ছোটবেলা থেকেই অবসাদ আর বিষন্নতায় ভুগতেন বলে জানা যায়।তার প্রকাশিত দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েট্রি এবং এরিয়েল কাব্যসংকলনেস্বীকারোক্তিমুলক কাব্যধারা চর্চার কারণে তিনি বিশেষভাবে আলোচিত হন। তিনি ১৯৮২ সালে ‘দ্য কলেক্টেড পোয়েম’-এর জন্য কবিতায় মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার জিতে ছিলেন। এছাড়া মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ‘দ্য বেল জার’ নামক প্লাথের একটি আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল।
বাবা
তুমি বানিও না, তুমি বানিও না
আর কোনো কালো জুতো
যার ভেতর আমি ছিলাম পায়ের মতো
ত্রিশ বছর, রিক্ত আর বিবর্ণ
শ্বাস নেওয়ার মতো সাহস হয়নি এমনকি হাঁচি দেওয়ার মতোও
বাবা, তোমাকে তো আমার মারতেই হতো
আমার সময় হওয়ার আগেই তুমি চলে গেলে
মার্বেলের মতো ভারী, এক বস্তা ভরা ঈশ্বর
ফ্রেস্কোর সিলমাছের মতো বড় ধূসর এক পা-ওয়ালা ভূতুড়ে মূর্তি তুমি
উদ্ভট অ্যাটলান্টিকের ভেতর একটি মাথা
যেখানে নীলের ওপর শিমের মতো সবুজ পড়ে
সুন্দর নসেটের জলের মধ্যে
আমি তোমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতাম
ওহ, তুমি!
জার্মান ভাষায়, পোলিশ শহরের ভেতর
রোলার দিয়ে যেভাবে চিড়েচ্যাপটা করা হয়েছিল
কারণ যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ
কিন্তু শহরের নামটি সাধারণ
আমার পোলিশ বন্ধু
মনে করো সেখানে এক বা দুই ডজন
তাই আমি কখনোই বলতে পারিনি
কোথায় তুমি তোমার পা মাড়িয়েছ, কোথায় তোমার শেকড়
আমি কখনোই তোমাকে বলতে পারিনি
আমার জিভ চোয়ালে আটকে গেছে
এটি একটি তারের ফাঁদের হুকে আটকে আছে
আমি, আমি ,আমি, আমি
কথাই বলতে পারতাম না আমি
ভেবেছিলাম প্রত্যেকটি জার্মানি তোমার মতো
এবং ভাষাটি অশ্রাব্য
একটি ইঞ্জিন, একটি ইঞ্জিন
ইহুদিদের মতো আমাকে খোঁচাতো
ইহুদি থেকে ডাচ, অস্ট্রিকজ, বেলসন
আমি ইহুদির মতো কথা বলা শুরু করলাম
ভাবতাম ইহুদি হলেই ভালো হতো
টাইরলের তুষার, ভিয়েনার স্বচ্ছ বিয়ার
কিছুই খাঁটি নয়, নয় সত্য
আমার জিপসি পূর্বরমণীদের এবং অদ্ভুত ভাগ্যের সাথে
আমার ট্রাম্প কার্ডের বক্স, আমার ট্রাম কার্ডের বক্স
আমি হয়তো কিছুটা ইহুদি
আমি সবসময় তোমার ভয়ে আতঙ্কিত থাকতাম
তোমার লুফটওয়েফি, তোমার গোবেল্ডিগিরি
তোমার পরিপাটি গোঁফ
তোমার আর্যীও চোখ, উজ্জ্বল নীল
পাঞ্জার মানব, পাঞ্জার মানব, ও তুমি
কোনো ঈশ্বর নও তবে স্বস্তিকা চিহ্ন
নিকষ কালো কোনো আলোই তাতে প্রবেশ করতে পারে না
প্রত্যেক নারীই একজন ফ্যাফিবাদিকে পূজা করে
মুখে বুটের কাঠিন্য, নির্দয়
তোমার মতো নিষ্ঠুর হৃদয়ের নির্দয়কে
বাবা তুমি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে দাঁড়ানো
আমার কাছে থাকা ছবিতে যেমন দেখি
পায়ের বদলে তোমার থুতনিতে একটি খাঁজ আছে
তাতে কিন্তু কোনো শয়তানি কমেনি, এমনকি
ওই কালো লোকের চেয়ে কিছু কম নয়
যে আমার সুন্দর লোলিত হৃদয়কে দ্বিখণ্ডিত করেছিল
ওরা যখন তোমাকে কবর দেয় তখন আমি দশ বছরের
কুড়ি বছর বয়সেই মরে যেতে চেয়েছিলাম
এবং ফিরে,ফিরে, ফিরে তোমার কাছেই যেতে চাই
ভাবতাম হাড়গুলো দিয়েও চলবে
কিন্তু তারা আমাকে বস্তা থেকে টেনে বের করে দিলো
আর আঠা দিয়ে তাদের সঙ্গে আটকে রাখলো
এবং আমি তখন জানতাম কী করতে হবে
আমি তোমার একটি মডেল তৈরি করি
মেইনকাম্পফের মতো দেখতে একটি কালো মানুষ
এবং অত্যাচারের প্রতি ভালোবাসা এবং যৌনতার
আমি বলেছিলাম, আমি রাজি, আমি রাজি
তাই তো বাবা, আমি শেষপর্যন্ত উৎরে গেলাম
শেকড় থেকে কালো টেলিফোন উপড়ে ফেলা হলো
সেই স্বরগুলো কৃমির মতো কামড়াতে পারে না
যদি আমি একজনকে খুন করে থাকি, আমি দুজনকেই খুন করেছি
সেই রক্তচোষা যে বলেছিল, সে তুমিই ছিলে
এবং একবছর ধরে আমার রক্ত চুষেছে
সাত বছর ধরে, যদি তুমি জানতে চাও
বাবা, তুমি এখন শুয়ে পড়তে পারো
তোমার তৈলাক্ত কালো হৃদয়ে একটি মোড়ক আছে
এবং গ্রামের লোকেরা কখনো তোমাকে পছন্দ করতো না
তারা এখন তোমার উপর নাচছে ও লাথি দিচ্ছে
তারা সবসময়ই জানতো এটা তুমিই ছিলে
বাবা, বাবা, তুমি একজন জারজ, আমি এখন মুক্ত
অক্টোবরের পপি
এমনকি এই সকালেও, সূর্য-মেঘ—কেউ স্কার্টগুলো সামলাতে পারে না
অ্যাম্বুলেন্সের নারীগুলোও নয়
আশ্চর্যজনকভাবে যার জামার ভেতর দিয়ে লাল হৃদয় ফোটে
একটি উপহার, একটি ভালোবাসার উপহার
একটি আকাশ দ্বারা তীব্রভাবে
না চাওয়া রয়ে গেলো
ফ্যাকাসেভাবে এবং উজ্জ্বলভাবে
চোখ দিয়ে কার্বন মনোক্সাইড স্ফুলিঙ্গ ঝরছে
বোলারদের দ্বারা স্থগিত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে
হে আমার ঈশ্বর, আমি কী
যে এই শেষ মাসগুলোতেও কেঁদে ভাসাচ্ছি
তুষারের বনের ভেতরে, কর্নফ্লাওয়ার ফোটার সময়েও।
টিউলিপ
টিউলিপ ফুল খুবই উত্তেজনাক্ষম, এখানে এখন শীতকাল
দেখো সবকিছু কেমন শাদা এখানে, কত শান্ত, কত তুষারাচ্ছন্ন
আমি শান্ত হতে শিখছি, নীরবে নিজে নিজেই শুয়ে থাকি
যেভাবে শাদা দেয়ালগুলোর ওপর, এই বিছানার ওপর, এই হাতের ওপর আলো এসে পড়ে,
আমি কেউ নই, এইসব বিস্ফোরণের ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই
আমি আমার নাম ও সারাদিনের পোশাক নার্সদের দিয়ে দিয়েছি
এবং আমার অতীত ইতিহাস দিয়ে দিয়েছি এনেস্থেটিস্টকে আর সার্জনকে দেহটি
তারা বালিশ ও বিছানার চাদরের মাঝখানে আমার মাথাটা উঁচু করে রাখলো
যেন একটি চোখ যা দুচোখের শাদা পাপড়ির মাঝে কখনো বন্ধ হবে না
বোকা বাচ্চারা, সবকিছুই ভেতরে আনা যেতো
নার্সরা আসা-যাওয়া করছে, তারা কোনো সমস্যা নয়
তারা এমনভাবে আসা-যাওয়া করছে যেভাবে সিগাল শাদা টুপি পরে তাদের দ্বীপ ছেড়ে যায়
তাদের হাত দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, একে অন্যের মতো
ফলে তাদের সংখ্যা জানা অসম্ভব
আমার শরীরটি তাদের কাছে নুড়ির মতো, তারা জলের মতোই এটি নিয়ে খেলে
নুড়ির যেমন ঝোঁক থাকে গড়িয়ে যাওয়ার, ধীরে ধীরে নম্রভাবে
আমাকে অসাড় অবস্থায় তাদের উজ্জ্বল সুঁইয়ের মধ্যে নিয়ে আসে, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়
এখন আমি আমাকেই হারিয়ে ফেলেছি, আমি যেন অসুখের লটবহর
আমার স্বামী এবং বাচ্চা পারিবারিক ছবির ভেতর হাসছে
ছোট্ট বড়শির মতো তাদের হাসাহাসি আমার চামড়ায় বিঁধছে
একটি ত্রিশ বছরের কার্গো নৌকায় আমি সব কিছুকে ঘুমাতে দিয়েছি
আমার নাম ও ঠিকানা সেখানে একগুঁয়েভাবে ঝুলছে
আমার প্রিয় সংঘ থেকে তারা আমাকে মুছে ফেলেছে
সবুজ প্লাসিক ট্রলি বালিশের মতো আতঙ্কিত এবং ফাঁকা বোধ করছি
আমি দেখতে পাচ্ছি আমার টি-সেট, লিনেনের লেখার টেবিল, আমার বইগুলো
দৃষ্টির বাইরে ডুবে যাচ্ছে, এবং আমার মাথার ওপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে
আমি এখন একজন নান হয়ে গেছি, কখনো এত হতদরিদ্র ছিলাম না
আমি কোন ফুল চাইনি,
চেয়েছিলাম শুধু হাতদু’টো উল্টো করে নিয়ে শুতে
এবং সম্পূর্ণ খালি হতে
কতটা নির্ভার তুমি ভাবতেও পারবে না, কতটা
এই শান্তভাব এতোই গভীর যে তোমাকে উদ্ভ্রান্ত করে দেয়
এটা কিছু জানতে চায় না, একটি নামের ট্যাগ, কিছু তুচ্ছ উপহার,
এটা তাই যা মৃত্যুর কাছে এনে দেয়, আমি কল্পনা করছি তাদের
এটা তাদের মুখ বন্ধ করছে যেন একটি ধ্যানগ্রস্ত পাথর
টিউলিপগুলি প্রথমে খুব বেশি লাল থাকে, তারা আমাকে কষ্ট দেয়।
এমনকি গিফট পেপারের ভেতর দিয়েও আমি তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেতাম
হালকাভাবে পেঁচানো তাদের শাদা ফিতার ভেতর থেকেও,
যেন একটি অবোধ শিশু,
তাদের লালিমা আমার ব্যথার সাথে কথা বলে, চিঠিপত্র লিখে
তারা অস্পষ্ট যেন ভাসছে, যদিও তারা আমাকে ভারগ্রস্ত করে রাখে
বিমর্ষ করছে তাদের আকস্মিক জিভ দিয়ে আর তাদের রঙ দিয়ে
গলার চারপাশ ডুবিয়ে রাখছে এক ডজন লালের নেতৃত্বে।
এর আগে আমাকে কেউ লক্ষ করেনি এখন করছে
টিউলিপগুলো আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে এবং আমার পেছনের জানালা
যেখানে দিনে একবার ধীরে ধীরে আলো উদ্ভাসিত হয় এবং ক্ষয়ে যায়
এবং আমি আমাকে কপট, হাস্যকর, একটি ছেঁড়া পাতার ছায়া হতে দেখি
সূর্যের চোখের মধ্যে ও টিউলিপের চোখের ভেতর,
এবং আমার কোনো মুখচ্ছবি নেই, আমি নিজেই নিজেকে মুছে ফেলতে চাই
প্রাণবন্ত টিউলিপগুলো আমার অক্সিজেন শুষে নেয়।
তারা আসার আগে বাতাস খুব শান্ত ছিল
আসে আর যায়, শ্বাসের পর শ্বাস নিরবচ্ছিন্নভাবে
তখন টিউলিপগুলো উচ্চস্বরে তা ভরে দেয়
এখন বাতাস অপ্রতিহতভাবে ঘুরছে তাদের চারপাশে যেভাবে একটি নদীর প্রবাহ বয়ে যায়
একটি লাল ডুবন্ত ইঞ্জিনের চারপাশ দিয়ে।
তারা আমার মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছে, সেটাই সুখের ব্যাপার
কোন শর্ত ছাড়াই তারা দুলছিল, খেলছিল
দেয়ালগুলো মনে হচ্ছিল উষ্ণতর হয়ে উঠছে
টিউলিপগুলোর ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলোর মতোই পিছনের বাধা হয়ে ওঠা উচিত
তারা আফ্রিকার কিছু বড় বেড়ালের মতোই মুখ খুলছে
এবং আমি আমার হৃদয় সম্পর্কে জানি, এটি খোলে আবার বন্ধ হয়
আমার ভালোবাসায় লাল রঙের পাত্রটি উচ্ছ্বসিত হয়ে ফোটে
আমি যেই জল পান করলাম, তা সাগরের জলের মতো উষ্ণ এবং লবণাক্ত
এবং তা দূর কোনো দেশ থেকে সুস্থতা বয়ে আনে।