সেলিনা শেলীর ব্যক্তিত্ব সেই হীরের মতো, যার বিভিন্ন তল থেকে নানা কালে নানান আলোক বিচ্ছুরিত হয়। গেলো শতকের আশির দশকের গোড়া থেকে, তারুণ্যের প্রায় সূচনালগ্ন হতেই, তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন থিয়েটারে। এরপর ছাত্ররাজনীতির সমান্তরালে কবিতায়ও। ছাত্রাবস্থায়, ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে*, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্রগোষ্ঠীর ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হন তিনি। এতে হয়ে ওঠেন প্রগতিশীল জাতীয় দৈনিকের প্রধান সংবাদ শিরোনাম। কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু তার। তারপর দার পরিগ্রহ। এরও পরে দুই পুত্রসন্তানের জননী। এভাবে নানান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আজ তিনি অনেকটা স্থিতধী। কিন্তু থিতু হননি নাট্যচর্চায়। এখনো কি বয়ে চলেন প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির দায়? না, সাংগঠনিকভাবে নয়। তাহলে কোথায় মুক্তি খোঁজেন শেলী? অভিজ্ঞতার দাহ তিনি প্রশমণের প্রয়াস পান কবিতায়।
কী সেই দাহ? তার নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’ বিষয়ে কিছু বলতে চাওয়ার শুরুতেই মনে পড়ে মাইকেল মধুসূদনের কাব্যচরণ: ‘রাবণের চিতাসম জ্বলিছে হৃদয়।’ এদিকে, এটি এমন এক শ্মশান, সংসারচিতা, যাতে মানুষ, নারী কিংবা পুরুষ যে-ই হোন, কেবলই পুড়তে থাকেন, নিঃশেষিত হন না। তবু লৈঙ্গিক প্রশ্ন এসে যায়। কে বেশি দগ্ধ হন সংসারে? নারী না কি নর? হাজার হাজার বছরের পুরুষতন্ত্রের অবিরলতায় ঘরে-বাইরে নিগৃহীত-নিষ্পিষ্ট হয়ে চলেন নারীই। স্মরণ বাহুল্য, পুরুষেরা প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে দেয়। সেইসঙ্গে ব্যক্তিমালিকানার উৎপত্তি ও ব্যক্তিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার সৃষ্টির প্রয়োজনে বিবাহ ও পরিবার-প্রথার প্রচলন ঘটানো হয়। ধর্মও নারীকে এতে এমন নিগড়ে বাঁধে যে, সমাজের চাপে মৃত স্বামীর চিতায় তাকে আত্মাহুতি দিতে হয়। উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারেরও একপ্রকার সহায়তায়, যথাক্রমে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ ও বিধবা বিবাহের প্রচলণ করেন। কিন্তু নারী কি এখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন? এ-প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে আমরা শেলীর আলোচ্য কাব্যের পাঠ গ্রহণের প্রয়াস পেতে পারি।
আলোচ্য বইয়ের তৃতীয় কবিতা ‘পেণ্ডুলাম’ থেকেই প্রেমিক কি পুরুষের বিরহ, মিলনকাতরতা এবং এমনকি নরের আধিপত্য মেনে নেওয়ার অথবা তার ওপর নির্ভরশীলতার একপ্রকার দ্বান্দ্বিক প্রকাশ মুদ্রিত হতে শুরু করে—‘নিঃসঙ্গ বলি কেন/তুমি চললেই তো আমার গতি…/তবু একথা তো সত্যি যোজন যোজন ঘুরেও/আমরা একই ভূতলে দাঁড়াতে পারিনি!’ (পেণ্ডুলাম; তাচ্ছিল্যকুসুম)।
কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতাটিই নাম কবিতা। এতে নারীর মর্মবেদনা, এক ধরনের প্রতিবাদ এবং তবুও নরপ্রেম-প্রত্যাশা বাঙময়তা লাভ করে:
(১) দূর কোনো গাঁয়ে গিয়ে নদী হই যদি/কী অবাক দেখো, পারেই পড়ে রই বেওয়ারিশ লাশ! (তাচ্ছিল্যকুসুম; প্রাগুক্ত)
(২) তুমি তো নগেন ডোম! (প্রাগুক্ত)
(৩) তুমি তো গোরখোদক, মৃত্যুগন্ধ মাখা!/কাফনে ঢেকে রেখে অনিঃশেষ কাঁদো! (প্রাগুক্ত)
উপর্যুক্ত প্রথম কবিতাংশে কবির কাব্যিক মুক্তিকামনা ও অপ্রত্যাশিত করুণতম পরিণতির মধ্যে বিধৃত নির্যাতিত নারীর অসহায়ত্ব সচেতন পাঠকের মর্ম স্পর্শ করে। পরের দুই উদ্ধৃতিতে কবি তার পুরুষকে বিরল অপবাদে বিদ্ধ করেন যা, বলা যায়, অভিযোগ-অতিক্রমী প্রতিবাদে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু সেই ‘মৃত্যুগন্ধ মাখা’ পুরুষ কাঁদে কেন অনিঃশেষ? এ কি শেক্সপিয়ারীয় চরিত্রের অনুতাপ? নিজের হাতে নিহতের রক্ত দেখে হন্তারকের আত্মদংশনে জর্জরিত হওয়ার অনুরূপ? তবু কেন? কবি কেন অমন পুরুষে মহত্ত্ব আরোপের প্রয়াস পান? প্রেমিক অপরিত্যাজ্য কিংবা প্রচলিত চিরায়ত নারীধারণানুযায়ী, প্রেয়সীর প্রেম চিরজাগ্রত বলেই? হয়তো তাই। তারপরও কবির অভিযোগরূপী অস্বীকৃতি অব্যাহত থাকে, সেইসঙ্গে নিপীড়িতের অকল্পনীয় দশাও:
(১) তুমি তো মানুষ নও!-মানুষের মতো। (গোপন গল্পগুলো; প্রাগুক্ত)
(২) মানুষেরা কাঁটাগাছ, বিষাক্ত সজারু। (প্রাগুক্ত)
(৩) তবু দুই হাত তুমিমুখী/তুমিমুখী দুই হাত-বড় একা…একাকী! (প্রাগুক্ত)
ওপরের প্রথম কাব্যচরণটি নারীবাদী সাহিত্যাঙ্গন থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইলের মতো ঠেকে। কিন্তু এতে ব্যবহৃত প্রথম যতিচিহ্নটি লক্ষণীয়, যা উদ্ধৃত দ্বিতীয় কবিতাংশে নেই। তাহলে কবি কি প্রেমাস্পদ পুরুষকে ‘মানুষ নও’ বলে ফেলেন গভীর বেদনার ফলে, অথচ অনিচ্ছায়? এছাড়া ‘কাঁটাগাছ’ বা ‘বিষাক্ত সজারু’ কি আসলেই ‘মানুষেরা’? না কি সব পুরুষ? তবু কি ফের সেলিনা শেলীয় সমর্পণের ভাষার সম্মুখীন হন পাঠক ৩-সংখ্যক চরণযুগলে? তাহলে এই কবিতার পুরুষটি কেমন? নারীনিগ্রহে পারদর্শী অমানুষ? না। বইয়ের এই পঞ্চম কবিতায় কবি জানিয়ে দেন এই নর একজন সিজোফ্রিনিক পেশেন্ট এবং এতে স্পষ্ট হয় নারী এক রুগ্নের সহধর্মিণী, যিনি ‘দুই হাতে ধরে’ রাখেন ‘ফ্লুপেনজাইন, ডেকানোয়েট, রিজডন-৪, লিথোসান, অপসোনিল, পেরিডল, পারকিনিল’ নামের ওষুধগুলো। যতদূর জানা যায়, আমাদের কবিতায় এ-অভিজ্ঞতা নতুন। একজন নারী কবির, অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধে টগবগ সন্দেহজর্জর স্বামীর সঙ্গে, বসবাসের এই কাব্যাশ্রয়ী বয়ান আর কি মেলে বাংলা কবিতায়ও? নারীবাদী কবিতার অন্যতম স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত কবিতা সিংহের একটি কবিতার কিছু অংশ অবশ্যই সামনে এসে দাঁড়ায়:
অপমানের জন্য বার বার ডাকেন/ফিরে আসি/আমার অপমানের প্রয়োজন আছে! […] অপমানের জন্য বার বার ডাকেন/ফিরে আসি/উচ্চৈঃশ্রবা বিদূষক-সভায়/শাড়ি স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে/আমার যে/কার্পাসের সাপ্লাই মেলে না। […] যুদ্ধরীতি পাল্টানোর কোনও প্রয়োজন নেই/তাই করমর্দনের জন্য/হাত বাড়াবেন না।/আমার করতলে কোনও অলিভচিক্কন কোমলতা নেই। (অপমানের জন্য ফিরে আসি)।
কিন্তু অপমানিত হওয়ার জন্য বার বার ফিরে এলেও কবি এখানে দারুণ কাব্যিকতাযোগে সূক্ষ্ম প্রত্যাখ্যান লিপিবদ্ধ করেন। এদিকে আমাদের কবি শেলী অনেকটা অপবাদ-প্রতিবাদমুখর হলেও পরিত্যাগে অপারগ। তবু ভেঙে পড়েন না। দাঁড়িয়ে থাকেন বিস্ময়কররূপে—‘দুটি নুয়ে পড়া পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি—[…] দুটি নুয়ে পড়া ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি-একা’ (প্রাগুক্ত)।
যদিও, তিনি নিজেকেও অ-মানুষ আখ্যায়িত করেন অথবা নিজের মধ্যেও অদ্ভুতভাবে প্রত্যক্ষ করেন মনুষ্যত্বের স্বল্পতা:
(ক) মানুষেরা মুখোশপ্রবণ! আমিও। (ধুলোঝাড়া সকালগুলো; প্রাগুক্ত)
(খ) আমরা হয়তো মানুষই নই, মানুষের মতো! (ভিড় থেকে একা; প্রাগুক্ত)
ফলে স্পষ্ট হয়, শেলী একজন নারী হয়ে এ-কবিতাগুলো রচেননি, লেখেন মানুষ হিসেবে। তাই মানুষের সামান্য (ইংরেজি কমন অর্থে) নীচতা ও সীমাবদ্ধতায় মর্মাহত কবির পক্ষে এমন দ্ব্যর্থবোধক উচ্চারণ সম্ভব হয়ে ওঠে। তবে ‘তুমি তো মানুষ নও’-এর মতো ঘোষণার বিপরীতে অবস্থান স্ববিরোধিতার নামান্তরও। তবু ভালোবাসার পুরুষটির জন্যে তার বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন এভাবে:
(ক) পাখিরা জানে। পালক থেকে পোকামাকড় আর/ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে-ই তো আমাকে/শিখিয়েছে—রোজ সকালে বেদনাবিন্দুগুলো/ঝেড়ে ফেলতে হয় (ধুলোঝাড়া সকালগুলো; প্রাগুক্ত)
(খ) শুধু একখণ্ড স্মৃতিফুল/আমাদের আয়ুষ্কাল জুড়ে ফুটে থাকবে-/মোহমায়ায়…(স্মৃতি; প্রাগুক্ত)
শেলী মর্মবেদনাকে যেমন শিল্পিত করে তোলেন তেমনি প্রেমের শক্তিকে দান করেন অপার সৌন্দর্য:
(ক) আদিম বিভার মতো বেড়ে ওঠা হাহাকার/জলের গোপন তলে/মৃত ঝিনুকের মতো শুয়ে রয়! (আর্তি ও আরতিতে; প্রাগুক্ত)
(খ) ঘুমফোটা ভোরে/পাখিদের পালকের নিচে নিজেকে লুকিয়ে রাখি-/তুমি এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে খুঁজে/ক্লান্ত হলে-আমি রাঙা আকাশ মেখে/তোমাকে দেখি-/তোমার চোখের খুব গভীরে/লুকিয়ে থাকা জলবিন্দু হই/-তুমি জানো না/এভাবে পালানো ছাড়া/আমার আর কোনও গন্তব্য নেই (ভালোবাসা; প্রাগুক্ত)
ওপরে ‘ভালোবাসা’ কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয় এতে নিপীড়িতের আশ্চর্য প্রেমশক্তি ঐক্যচিন্তার বিরল অটলতায় ভাস্বর বলেই। এটি এ-বইয়ের দু-তিনটি অসামান্য কবিতার একটি। তবু প্রাগুল্লিখিত বঞ্চিতাবস্থা অনুবাদে আলোচ্য কবির ভাষা ক্রমশ সক্ষমতর হয়ে ওঠে:
(অ) আমাদের মৃত্যু অনেকদিন আগেই ঘটেছিল!/এই যে ছবিগুলো-সফেদ ঢেউ এর ভেতর/পানকৌড়ির মতো তাকিয়ে আছে—(ফসিল কাহিনি; প্রাগুক্ত)
(আ) দিনের ভেতর থেকে কেঁদে চলা নদী/জুঁই ফুলদাঁতে সকালটা কাটতে থাকলো।/আজ এই দিনটি শুধুই আমার হতে পারতো! […] যে পাখি সমুদ্রের নুন ঠোঁটে নোনা চোখে তাকায়/সেও জানে-/কান্না-নূপুরে আমি আজ বেজে চলেছি- (দাঁতেকাটা দিন; প্রাগুক্ত)
(ই) এ জীবন শরমিন্দা বড়/ভেঙে ভেংচি ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। (বাসনাপাখি; প্রাগুক্ত)
এইসঙ্গে লক্ষণীয় শেলীর চিত্রকল্পময় ভিন্ন ধরনের উত্তম কাব্যপ্রয়াসও:
(১) আকাশের ব্যালেন্স বিমের ঈশ্বরী/তাকে কাঁচুলি খুলে ডাকে/আর-সূর্যটা আকাশের প্লেটে/নাস্তার চামচে কেটে/মুখে তুলে নিতে নিতে, নিজেই সে/নিজের অলৌকিকত্বের মোহে/তালিয়া বাজায়…(অন্তর্জাল; প্রাগুক্ত)
(২) অতঃপর যবনিকাসমেত দাঁড়িয়ে থাকে/নগ্ন ঈশ্বর! […] উৎকেন্দ্রিকতা আর কেন্দ্রিকতার দোলাচলে/একটা বিন্দু হতে হতে মিলিয়ে যায় সে অন্ধকারে! (হেলুসিনেশন; প্রাগুক্ত)
(৩) বৃষ্টি যখন/মশারির মতো ঢেকে ফেলে—এতটা বেড়াল নিভৃত পায়ে!/আমি তাকে শুনতেই পাইনে। (যাপননামা; প্রাগুক্ত)
সেই সঙ্গে আরও লক্ষযোগ্য, ‘বিবৃতি’ কবিতায় প্রাপ্ত নিদারুণ অপ্রেমের সঙ্গে নিজের রক্তাক্ত অজরামর প্রেমের দ্বান্দ্বিকতা নতুনতর ভাষা লাভ করে:
আমিও সিজোফ্রেনিক হবো-/[…] তোমাকে ঘৃণা করি।/[…] মিনতির বাকল খুলে বলি—/অনুনয়ে উজাড় হয়ে বলি—/তোমার নিউরন খুলে একটি বীজাণু দেবে?—/আমিও সিজোফ্রেনিক হবো।
এ কি তবে ঋণাত্মক শক্তির অনুরূপতা অর্জনের অভিলাষ? না। এ এক প্রকার বক্রোক্তিমূলক প্রতিবাদ কিংবা নিগ্রহে-বিগ্রহে ঝাঁজরা একজন নারীর ভেঙে কিংবা হেলে না পড়ার অভিপ্রায়ের ভাষা। বাংলাদেশের কবিতায় এও অভিনতুন উচ্চারণ। কিন্তু প্রেম কি এতই দুর্মর? এমন পরিস্থিতিতে সচেতন কোনো নারীর পক্ষে কি ভালোবাসায় এতটা স্থিতধী থাকা সম্ভব? সর্বংসহার এই চারিত্র্য কি নারীশোষণ ও শ্রেণীশোষণের অনুকূল নয়? অথচ সেই কবে উনিশ শতকে তরু দত্ত, যিনি ইংল্যান্ডে শিক্ষার্জন করেন, সপরিবার খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ইংরেজি ও ফরাসিতে লেখালেখি করেন, তার My Vocation কবিতায় বলেন—All men have a task,/And to sing is my lot-/No meed from men I ask/But one kindly thought.
তরু দত্তর উপর্যুক্ত কবিতাংশের তৃতীয় চরণে পুরুষদের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার বা সম্মান না চাওয়ার ঘোষণাটি লক্ষণীয়। তরুরও ঢের আগে সতেরো শতকে সর জুয়ানা (Sor Juana Inés de la Cruz), উপনিবেশিত লাতিন এমেরিকায়, ক্রিটিকাল বিশপকে দেওয়া যার ‘রিকোয়েস্টা আ সর ফিলোটিয়া’ শিরোনামের পৃথিবীর প্রথম নারীবাদী ইশতেহারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত, You Foolish Men কবিতায় লেখেন—You foolish men who lay/the guilt on women,/not seeing you’re the cause/of the very thing you blame; […]
কেবলই কি তাই? যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ নারীবাদী কবি অড্রি লোর্ডি গেলো শতকে কবিতায় লড়েন বৈশ্বিক বিস্তৃতিমুখি ‘শ্বেতাঙ্গ’ নারীবাদের বিরুদ্ধে। তাই A Woman Speaks কবিতায় তাকে বলতে হয়—I am/woman/and not white.
প্রসঙ্গত, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট্-এর A Vindication of the Rights of Woman, কেইট মিলেটের Sexual politics, লেখক-অনুবাদক আলম খোরশেদ অনূদিত ভার্জিনিয়া উলফ্-এর ‘নিজের একটি ঘর’, সিমোন দ্য বোভোয়ারের ‘ল্য দ্যজিয়েম সেক্স’ বা The Second Sex, জার্মেইন গ্রিয়ারের The Female Eunuch এবং বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর কথা নাইবা বলি। তবে গ্রিয়ার গবেষণা করেন উপশহরের ক্ষুদ্র পরিবারগুলোয় পুরুষ কর্তৃক যৌন নিগ্রহের ঘটনাবলির ওপর যা আমাদের উপমহাদেশীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ।
এদিকে নিজেও সিজোফ্রিনিক হয়ে উঠতে চাওয়ার অনুবর্তিতার সমান্তরালে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উৎকীর্ণ করেন সেলিনা শেলী:
(১) যে অসুখ রেখেছি পুষে/সুখের চেয়েও দাপুটে তার শ্বাসকণা! (আত্মনিপীড়ন; প্রাগুক্ত)
(২) আর মদের পিপের মতোন গড়িয়ে পড়তে পড়তে/যেখানে এসে থামলাম- আবারও তুমি!/বড় সংহারক কারিগর তুমি-/ব্যাধি কী তোমার ভেতর, না আমিই ব্যাধি? (ব্যাধি; প্রাগুক্ত)
(৩) আমি তো প্রত্ননারী, দেহ মন সময় প্রহেলিকায়/তুমি কী আমাকে চেনো? কে চেনে আমায়! (দাহ; প্রাগুক্ত)
দাহ কবিতার উপর্যুক্ত প্রশ্নটি সমগ্র পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো ওজস্বী। যদিও, আমাদের কবি তাঁর রুগ্ন পুরুষ বা প্রেমিককে পুরুষতন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখেন না।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ৪০টি কবিতার এই বইয়ের ৩৩-সংখ্যক কবিতা থেকে শেষ রচনা পর্যন্ত কাব্যিকতা, ছন্দ ও সুরময়তার বুঝি নব উদ্বোধন ঘটে। এই আটটি কবিতার সবকটিই নিরূপিত ছন্দে রচিত না হলেও, কাব্যগ্রন্থটির এই অংশেই শৈল্পিকতা ও সাঙ্গীতিকতা অপেক্ষাকৃত বেশি বিকশিত হয়েছে। যেমন:
(১) আস্তিন ছেঁড়া শার্ট ভাঙা আয়না আর ছিটকে পড়া চক্ষুর ভেতর থেকে/কোনো সূর্য ওঠে না,/তাই সকাল নামের কোনো প্রহরেই আমরা আলোর জলে মুখ ধুই না। (ভাঙা আয়না ও প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার; প্রাগুক্ত)
(২) তবু, রাইখং নদী ঘিরে কাচতোয়া জলে/সবুজ অন্ধকারে-পাহাড়ে পাহাড়ে/আদি অস্পৃশ্য বনে অকর্ষিত পৃথিবীর/আদিম প্রান্তরে-নিজেকে খুলে খুলে/শংকরাকীর্ণ মন মেজে ঘষে/ধুয়ে নিতে বড় সাধ হয়। (নীল স্নান; প্রাগুক্ত)
(৩) আমি কেনো ভুলে যাই পাখিজন্ম কথা!/পাখিই যদি, মানুষের মতো কেনো কাঁদি/নদী খুঁটে খাই আমি, পাহাড় নখে মাখি/মানুষের কটু কথা কেনো মনে রাখি! (আত্মগত; প্রাগুক্ত)
(৪) তোমার গা বেয়ে কর্পুর আর আতরের ঘ্রাণ-/আমাকে আক্রান্ত করার মুহূর্তেই টের পেলাম/তুমি এক মৃত মাছি,/আমার গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেগে আছো/আঠালো-আঁশটে! (মৃত কথামালা; প্রাগুক্ত)
(৫) অগ্নিউনুনে রাখি সিলভিয়া প্লাথ (প্রতিকৃতি; প্রাগুক্ত)
(৬) ভিড় নই আমি, একা ও একক- ভবপাড়ে নেই ঘর/তোমাকে কী চিনি! আমাকেও বলো! কে আপন কেবা পর! (ছুটি; প্রাগুক্ত)
(৭) আধেক জীবন পার করেছি কুয়াশার মতো মিছে/কিছু দেখা যায় কিছু ধোঁয়াশা অন্ধছানির নিচে! (ঐ)
ওপরে ‘আত্মগত’ কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত না করে পারা যায়নি আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের অন্য কবিতাগুলোর তুলনায় এর উৎকর্ষ ভিন্নতর নান্দনিকতায় ব্যতিক্রমী বলেই। এটি যেমন অনেকটা পয়ারে তেমনি বইয়ের দারুণ অন্তিম কবিতা, ‘ছুটি’, মাত্রার দুয়েকটি ঘাটতিসহ, মাত্রাবৃত্তে লেখা। তবে উল্লিখিত ঊনতায় কোনো ক্ষতি হয় না। পয়ারের কিছুটা গড়িয়ে আর মাত্রাবৃত্তের হেঁটে চলায় কোনো ছেদ পড়ে না। তরঙ্গ বয়ে যায়। শুধু প্রশ্ন জাগে, ছন্দহীনতা কিংবা মুক্ত ছন্দের পরিবর্তে বিধিবদ্ধ অথচ প্রাঞ্জল নিরূপিত ছন্দে সেলিনা শেলী কেন লেখেন না! ওপরের ৪-সংখ্যক কবিতাংশটি সাংঘাতিক অর্থদ্যোতনাময়। যদিও, পঞ্চম উদ্ধৃতির কবিতায় সিলভিয়া প্লাথের পরিচিত সংবাদটি জানিয়ে শেলী কোনো অভিনবত্ব সৃষ্টি করেন না। সিলভিয়ার ওই আত্মহনন যতটা পলায়ন কিংবা প্রতিবাদ, ততটাই পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তর্গত মানবমণ্ডলীর পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতারও ফল। কিন্তু শেষ কবিতার শেষে শেলী ছুটি নেন পৃথিবী থেকে, উড়ে যান মহাকাশে। কেন? এ কি তবে পলায়ন? অংশত তো বটেই। তবে তিনি চূড়ান্তরূপে পাঠককে জানিয়ে দেন—‘পুড়ে পুড়ে আজ হয়েছি ধোঁয়াশা উড়ে গেছি মহাকাশে/পাবে না তো আর ইচ্ছেপুতুল-বেদনায় আক্রোশে।’
তবে এটা ঠিক, কবি প্রেয়সী হিসেবে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্কের পুরুষকে সারা গ্রন্থে যেভাবে মূল্যায়ন করেন অন্তিমেও তার ব্যত্যয় ঘটান না। শুধু কোনো কোনো পাঠকের দিকে উড়ে আসে মধুসূদনীয় সেই চিতারও ধোঁয়া। যদিও, ‘বেদনাবালিশের নিচে (ধুলোঝাড়া সকালগুলো; প্রাগুক্ত)’, ‘লাল ঝুঁটি মোরগের মতো যে সূর্য (সমূহ সত্য নয়; প্রাগুক্ত)’, ‘সবকিছু ভেঙে পড়ছে (ক্ষয়া আলোয়)’, ‘পাশবালিশের মতো ওম (ফসিল কাহিনি; ঐ)’, ‘তোমাকে কী ভালোবাসি আমি? ঘৃণা করি? (বিবৃতি; ঐ)’ ইত্যাদি অকাব্যিক মেটাফর, বহুব্যবহৃত উপমা, সাধারণ বিশেষ্য এবং বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থনাম (চিনুয়া আচেবের সবকিছু ভেঙে পড়ে বা Things Fall Apart) এড়ানো গেলে এ-ক’টি কবিতা আরো ঘনবদ্ধ হতো।
তবু বইয়ের উৎসর্গপত্রের কথা বলতেই হয় যা একটি অনবদ্য কবিতা। এতে মুদ্রণপ্রমাদ থাকলেও তা স্বয়ং একটি কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। চমকে উঠতে হয় যখন এর শুরুতেই কবি বলেন—‘একদিন একাকিত্বগুলো জড়ো করে দেখি/তার ভেতর একটি নিউরনের মতোন ঘুমিয়ে/পড়েছি আমি!’
তারপর শেলী নিজের সৃষ্ট সৌন্দর্যরাশির মধ্যে ‘সঙ্গমসময়’, ‘একটি অনন্ত চুমুর মুহূর্ত’ ইত্যাদি ফিরে পাবেন বলে আশাবাদ উৎকীর্ণ করেন। কিন্তু অমন মিলন কি আর ঘটে? না। অসুস্থ প্রেমীর নানান পীড়ন তিনি মেনে নেন ওপরে আলোচিত নিজের দ্বান্দ্বিক অনুভূতির দুঃসহ ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
তবে ‘ক্ষয়া আলোয়’ কবিতার কথা না বললেই নয়। কেননা এই কবিতায় আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক বাস্তবতা ইঙ্গিতে বাঙময় হয়ে আছে, বিশেষত, এর শেষাংশে—‘আমি এমন এক নার্স অথবা চিকিৎসক/যে কেবল একজন সিজোফ্রেনিকের দ্বন্দ্ব, বিভ্রাট/সন্দেহ-ঘৃণায় টুকরো টুকরো হই-/আবার/টুকরোগুলো গুছিয়ে রাখি,/ফের যদি সে/ভাঙতে চায়-/প্রতিমা তৈরি রাখি।/একটাই সমস্যা কেবল-/প্রতিমার চোখে জল থাকে না/আমার আছে!’
প্রথমত, সামনে চলে আসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি-আক্রান্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভগ্ন প্রতিমার চিত্রকল্প। তারপর অসুস্থ নরের আঘাতে বহুধাখণ্ডিত নারী কবির মারাত্মক মানসপট। ‘ফের যদি সে/ভাঙতে চায়’ বলে নিপীড়িত অস্তিত্বের অখণ্ডতা রক্ষার এই ঘোষণার মধ্যে সেলিনা শেলীর অসাধারণ কবিত্ব, অকল্পনীয় ধৈর্য ও অসম্ভব বেদনার্ত প্রাণশক্তির পরিচয় মুদ্রিত হয়ে আছে। কিন্তু এই গ্রন্থের সোনার চাবি কবির এই মর্মভেদী সৃষ্টিশীল আবিষ্কার বা বার্তায় নিহিত: ‘প্রতিমার চোখে জল থাকে না, আমার আছে।’ কবিতাস্বর্ণের এই মোচড়ে পাঠকের চোখ ভিজে আসে। সচেতন পাঠক ওই ‘তাচ্ছিল্য’ মেনে নিতে অপারগ হলেও অশ্রুসিক্ত আরেক ‘কুসুম’ তাই উঠে আসে তাঁর হাতে, কবিকে সম্মান জানাতে।
তথ্যসূত্র:
১। ২২ ডিসেম্বরের সেই হামলায় তার ব্যাকবোনে ফ্রেকচার হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ৬ মাসব্যাপী তার ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থার করেন। এর আগেও তিনবার আক্রান্ত হন সেলিনা শেলী।